জ্বলদর্চি

বিশ্ব কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ দিবস/ দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে


বিশ্ব কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ দিবস 

দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে 

আজ ৩রা ডিসেম্বর বিশ্ব কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ দিবস। কীটনাশক কি, কেন এটি ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে ফসলে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আমাদের জীবনে কি প্রভাব পড়তে পারে, আসুন এই সব কিছুই বিস্তারিত ভাবে জেনে নিই।

কীটনাশক হল, এমন একটি পদার্থ, যা পোকামাকড় এবং অন্যান্য কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ বা ধ্বংস করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি প্রাকৃতিক বা রাসায়নিক উভয়ই হতে পারে এবং কৃষি, শিল্প, বা গৃহস্থালি কাজে কীটপতঙ্গ, আগাছা, এবং ছত্রাক দমনে ব্যবহৃত হয়। 
কাজ: কীটনাশক পোকামাকড়ের ডিম, লার্ভা এবং প্রাপ্তবয়স্ক পোকাকে মেরে ফেলে। এটি ফসলের ক্ষতি করা পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে।
প্রয়োগ: এটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যেমন কৃষিক্ষেত্রে ফসল রক্ষা, চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ, এবং ঘরবাড়িতে মশা-মাছি বা অন্যান্য কীটপতঙ্গ তাড়াতে।
প্রকার: রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াও, জৈবিক (যেমন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া) এবং প্রাকৃতিক উপাদান থেকেও কীটনাশক তৈরি করা হয়।
সাবধানতা: কীটনাশক মানুষ এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, তাই এটি ব্যবহারের সময় সঠিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। 

 "বিশ্ব কিট নাশক বন্ধ দিবসে" কীটিনাশক ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ হয় না, তবে কিছু নির্দিষ্ট কীটনাশক, যেমন ক্লোরপাইরিফোস এবং কার্বোফুরান, নিষিদ্ধ করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রচেষ্টা চলছে। এই ধরনের বিপজ্জনক রাসায়নিকের ব্যবহার সীমিত বা নিষিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন দেশ চুক্তি করছে, যদিও কিছু দেশ, যেমন ভারত, এর ব্যতিক্রম। একইসাথে, বিভিন্ন সংস্থা এবং দেশ নিজেদের উদ্যোগে ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করার জন্য প্রচার ও প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। 
বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টা
ক্লোরপাইরিফোস: কিছু দেশ ক্লোরপাইরিফোস নিষিদ্ধ করার জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।
কার্বোফুরান: জাতিসংঘ ২০১৫ সালে কার্বোফুরানকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করে এটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য দেশগুলোকে আহ্বান জানায়, যার ফলে ৮৭টি দেশ এটি নিষিদ্ধ করেছে। 
স্থানীয় ও আঞ্চলিক উদ্যোগ
ভারত: চা-চাষের মতো কিছু ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ কীটনাশকের ব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
উত্তরবঙ্গ: চা-চাষে ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য প্রচার ও প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রম চলছে। 

১লা নভেম্বর ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এক বড় পরিবর্তনের দোরগোড়ায় দেশ। কেন্দ্র সরকার ২০২৫ সাল থেকে প্রায় ২৫টি কীটনাশক সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। যেগুলিকে পরিবেশ ও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য “অত্যন্ত ক্ষতিকর” বলে মনে করা হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্তে কৃষক সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে — কেউ একে পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলছেন, আবার কেউ আশঙ্কা করছেন ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে।

কীটনাশক নিষিদ্ধের পেছনের কারণগুলো হল,
কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশে কীটনাশকের অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার মাটির উর্বরতা হ্রাস, জলদূষণ, মৌমাছি ও অন্যান্য পরাগবাহী প্রাণীর ক্ষতি এবং মানবদেহে বিষক্রিয়া বৃদ্ধির কারণ হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটেই ২০২৫ সালে  ২৫টি কীটনাশক (যেমন মোনোক্রোটোফস, কার্বোফুরান, ক্লোরপাইরিফস, ডাইক্লোরভস ইত্যাদি) ধীরে ধীরে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।

পরিবেশ গবেষক ড. তপন ঘোষ বলেন,
“কীটনাশক নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপটি সাহসী ও প্রয়োজনীয়। এতে মাটির জৈবিক ভারসাম্য ফিরবে, কৃষিজ জলাশয়ে বিষাক্ত অবশেষ কমবে, আর কৃষকের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে।”

 ফসল উৎপাদনে সম্ভাব্য প্রভাব বলতে বলা যায় যে, কৃষক সংগঠনগুলির একাংশ এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে তুলা, ধান, ডাল ও সবজি চাষিরা বলছেন, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে এসব রাসায়নিকই সবচেয়ে কার্যকর ছিল। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকলে ফসলের উৎপাদন ১৫–২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
🍂

মহারাষ্ট্রের এক তুলা চাষি রমেশ যাদবের কথায়,
“আমরা প্রতিদিন কীটপতঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করি। যদি সরকার বিকল্প জৈব পদ্ধতি বা নতুন প্রযুক্তি না দেয়, তাহলে ফলন টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।”

কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে, কীটনাশক নিষিদ্ধ হলে, স্বল্পমেয়াদে উৎপাদনে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থার ভিত্তি গড়বে।

বিকল্প ব্যবস্থা ও নতুন প্রযুক্তি
সরকার ইতিমধ্যে ‘Integrated Pest Management (IPM)’ পদ্ধতি চালুর উপর জোর দিচ্ছে, যেখানে জৈব কীটনাশক, ন্যাচারাল প্রেডেটর (যেমন লেডিবার্ড, ট্রাইকোগ্রামা) এবং ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করা হবে। পাশাপাশি, কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে কীভাবে জৈব কীটনাশক তৈরি ও ব্যবহার করতে হয়।

কৃষি বিজ্ঞানী ড. আরতি দত্ত বলেন,
“এখন ফোকাস হচ্ছে ইকো-ফ্রেন্ডলি পদ্ধতিতে। বায়ো-কীটনাশক যেমন নিং তেল, ব্যাসিলাস থুরিঞ্জেনসিস বা ট্রাইকোডার্মা ফাঙ্গাস ব্যবহার করলে কীট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।”

কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, নিষিদ্ধকরণের ফলে, প্রাথমিকভাবে কীটনাশক শিল্পে ২,০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে। তবে জৈব ও বায়ো-কীটনাশক প্রস্তুতকারীদের জন্য এটি একটি নতুন সুযোগ তৈরি করবে। ভারত ইতিমধ্যেই ‘Make in India for Bio-Agro’ উদ্যোগে বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করছে।

 কৃষকদের জন্য সরকারি পরিকল্পনা সরকার ঘোষণা করেছে, আগামী আর্থিক বছরে ৫০০ কোটি টাকার একটি বিশেষ তহবিল গঠন করা হবে জৈব ও প্রাকৃতিক কীটনাশক উন্নয়নের জন্য। রাজ্য সরকারগুলিকেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে কৃষকরা সহজে নতুন বিকল্প পদ্ধতিতে পরিবর্তিত হতে পারেন।এছাড়া, ২০২৫ সাল থেকে প্রতিটি কৃষককে ডিজিটাল অ্যাপে কীটনাশক ব্যবহারের রিপোর্ট আপলোড করতে হবে, যাতে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়।

পরিবেশবান্ধব কৃষির পথে এই পদক্ষেপ ভারতের জন্য বড় মাইলফলক হতে পারে, তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। আগামী দুই বছর হবে এই নীতির পরীক্ষার সময়— সরকারের প্রশিক্ষণ, বিকল্প প্রযুক্তির প্রসার এবং কৃষকদের সচেতনতা নির্ধারণ করবে এই পরিবর্তন কতটা সফল হবে।

Post a Comment

0 Comments