জ্বলদর্চি

কুয়াশা যখন/ পর্ব ৯/বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক  
কুয়াশা যখন  
পর্ব ৯
বাসুদেব গুপ্ত 

লড়াই লড়াই লড়াই চাই

আজ স্বপনের দরকার রহিমের সাহায্য । সকাল সকাল রহিমের বাড়ি গিয়ে ডাক দিতেই রহিম বেরিয়ে এল, এখুনি বেরোচ্ছে ডিউটিতে, গায়ে ইউনিফর্ম, পরিষ্কার ঝকঝকে না হলে চলবে না, ওই রোজ কাচে, ইস্ত্রী করে রেডি করে রাখে। রহিম স্বপনকে দেখেই খুব খুশি। বাইকে চড়ে নিয়ে গেল এজেন্সিতে। ওদের এজেন্সি শুধু লোক দেয় এপগুলোকে। এপ গুলো অর্ডার তোলে, খাবারের, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের আর এরা গিয়ে ডেলিভারি করে সেগুলো। 

স্বপন যেতে যেতে বোঝার চেষ্টা করল ডিলটা আসলে কি রকম। রহিম বোঝালো,

= ব্যাপারটা সোজা সাপটা কাজ করো পয়সা পাও টাইপের। প্রথম কয়েক মাস কোনো ফিক্স মাইনে নেই, পার ডেলিভারী পে। কাস্টমারদের রেটিং সারে চারের বেশি হলে ২০০০ টাকা বোনাস, পার ডেলিভারি ২০ টাকা। তিনমাস ভালো রেটিং পেলে ফিক্স স্যালারি হবে ৩০০০।
= গাড়ী আর পেট্রল?
= গাড়ি তোমার, পেট্রল তোমার। 
স্বপন দ্রুত হিসেব করে ফেলে। সাধারণত দিনে ২০টি ডেলিভারি হলে, সে পাবে  ৩০০০ + (৪০০ x ৩০) + ২০০০  টাকা, অর্থাৎ প্রায় ১৭০০০ টাকা। প্রতি অর্ডারে গড়ে ৫ কিমি ধরলে, মাসে ২০০০ কিমি। এতে প্রায় ৪০ লিটার পেট্রল লাগবে, অর্থাৎ ৪০০০ টাকা খরচ। সুতরাং,   মাসের রোজকার  ১০০০০   এই দিয়ে সে কীভাবে সংসার চালাবে?
= জানি, এটা খুব বেশি না, স্বপনদা, তবে বাজারে এটাই রেট। খুব ভালো কাজ, স্পটলেস হলে ছয় মাস পরে ফিক্সডটা ৫০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।  দেখো, শুরু করতে চাইলে বলে দাও। আর শহরে এইটাই একমাত্র জায়গা যেখানে  তুমি ভেকেন্সি পাবে। ”
= আর মেডিকাল এসব কিছু? এক্সিডেন্ট এসব হলে?
= তোমার খরচ। তুমি তো আর এদের কর্মচারী হচ্ছ না, একে বলে কন্ট্রাক্ট জব। যেন তোমার বিজনেস এটা। খরচ তোমার। 
🍂

অগত্যা স্বপন রাজি হলো। কাজটা পেলো এবং পাটা গেল  ভেঙ্গে।  ভাগ্য তার পক্ষে নেই। রহিমকেই হয়ত দোষ দেওয়া যেত। কিন্তু, রহিম কীভাবে জানবে?
কাজের কথা তো হল, কিন্তু ডেলিভারি দেবে কি করে? সাইকেল করেও অনেকে দিচ্ছে আজকাল, কিন্তু তার রেট দশ টাকা, আর সারা দিনে কটাই বা কভার করা যায়। স্বপন অফিসের বাইকে করে হিরোর মত এত দিন ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন অফিস নেই, ওর নিজেকে হ্যান্ডিক্যাপড মনে হয়। বাইক কেনার ক্ষমতা আর নেই ওর। তখনই  রহিম বলল, 
-আমার একটা পুরনো বাইক আছে। একটু ড্যামেজ, তুমি যদি সারিয়ে নিতে পারো তাহলে ওটা দিয়েই স্টারট করে দাও স্বপনদা
স্বপন কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞেস করল
=দাম? আমি তো বেশি দাম দিতে পারব না। 
=দাম কেন দেবে স্বপন দা, পড়ে আছে, তুমি নেবে, এই তো, দাম টাম কিচ্ছু দিতে হবে না, কি যে বলো
= নানা দাম না দিলে কি করে নেবো?
কিচ্ছুক্ষন তর্ক বিতর্ক শেষে ঠিক হল, স্বপন ৫ হাজার টাকা দেবে।  বাইকটা বেশ কিছু রিপেয়ারের কাজ। স্বপন নেতাজি বাইক শপে গেল, ওর খুবই চেনা। বিশ বছরে কত বার যে এসেছে তার ঠিক নেই। আর এখন যত ডেলিভারি বাইকারের ফেভারিট গ্যারাজ। 

অমরদা, মালিক আর মাস্টার ওকে দেখেই হাত থেকে কালি মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো,
=আরে স্বপন স্যার, অনেক দিন দেখা নেই। বলো কি কাজ? টায়ার না গীয়ার বক্স। ওটা তো ঝামেলা করছিল
= না অমরদা আমি এখন বেকার, আমাকে আর স্যার ট্যার বল না, লোকে হাসবে। অফিসের বাইক্টাও নিয়ে নিয়েছে। এই একটা পুরনো বাইক কিনেছি, দেখ না একটু চালু করে দাও। ডেলিভারি সার্ভিস করব ভাবছি
অমরদা বাইকটি দেখল, ওর অমায়িক হাসি বন্ধ করে মুখ বাঁকাল।
= কি একটা এনেছ, এটাকে সারানো মানে বেকার খাটা, কন্ডিশ্ন একেবারে যাতা। এটা ফেলে দাও আর একটা নতুন বাইক কিনে ফেল। 
“নতুন বাইক!”  স্বপন ম্লান হাসল। 
=কিনব কি করে দাদা, বেকার বসে আছি এক মাস। দেখ না কিছু করা যায় কিনা। তুমি তো মাস্টার, সবাই জানে ।ঠিক পারবে। 
=চাকরি গেল কি করে? ঘাপলা করেছিলে নাকি কিছু?
= তুমি তো চেনো আমাকে এতদিন। ক্মপানী বিক্রি হয়ে গেল, আর নতুন মালিক এসে আদ্ধেক লোক ছাঁটাই করে দিল। দেখ না অমরদা প্লীজ। এটা চালু হলে আমি ডোর ড্রপে কাজটা পাব। না হলে আমরা সবাই না খেয়ে মরব, আমার একটি ছোট নাতনি আছে,তার খুব অসুখ।”

 
“বাহ, যখন কাজ ছিল তখন টাকা বাঁচাওনি কেন? এখন কাঁদলে হবে?”
স্বপন অবাক হয়ে দেখে বাদলদার অমায়িক স্বর কেমন পালটে যায় ধিক্কার আর অপমানের দিকে। 
-আমি জানি তোমার মতো লোকেরা সব টাকা চুল্লু খেয়ে উড়িয়ে দেয়।  এখন ঠেলা সামলাও। বাদলদা বাইকটা নিয়ে দেখতে গেল কি কি করা যায়। স্বপন দাঁড়িয়ে রইল এক ঘণ্টা, আগে এলেই প্রচুর তদবির হত, বসো, চা খেয়ে যাও, এই ফ্যান্টা চালিয়ে দে তো, স্বপনবাবু বসবে। দেখো, স্বপনের চটকা ভাঙল বাদলদার কথায়।
“অবস্থা বেশ খারাপ। এটিকে আবার দাঁড় করাতে হলে কমপক্ষে দশ হাজার টাকা লাগবে। অনেক পারটস পাল্টাতে হবে, লেবার লাগবে।”
অনেক অনুরোধের পর, রফা হলো  ৮০০০ টাকায়।  এখন ৩০০০ টাকা এবং বাকি ৫০০০ টাকা ১০ কিস্তিতে। 
শুভ দিন দেখে, স্বপন পাড়ার কালী মন্দিরে গিয়ে চোখ বুজে প্রার্থনা করল, ঊষাকে বলল, যাও মাজারে একটা বাতি চড়িয়ে এস।   স্বপন মনে মনে কালীকে বলল, মা কাজটা যদি হয় ৫০০ টাকা মানত করলাম, তোমার সন্ধ্যে পূজোর  বাইকটিকে একটা গাঁদা ফুলের মালা পরানো হলো। রহিমও  এলো উৎসাহ দিতে।  কয়েকটা কিকেই বাইকটি ভররররর আওয়াজ করে দিব্যি চালু হয়ে গেল। রহিম তাকে তার পুরনো হেলমেটটিও দিয়েছিল, একটু কেমন তেলের গন্ধ, কিন্তু অনেক পয়সা গচ্চা গেছে, ওটাই জয় মা বলে স্বপন   মাথায় চাপিয়ে চলল ডেলিভারি দিতে।

এক মাস বাড়িতে বসে। পায়ে জং ধরে যাচ্ছিল। বাইকের স্পীড বাড়তে থাক,  বাতাস তার মুখের চারপাশে প্রবলতর হতে থাকে, স্বপনের মনটা এতদিন পরে একটু ভাল হল, একটু খুশির লহর ভেসে উঠল মাথায়। হ্যাঁ, আগের চাকরির মতো এটা ভাল হবে না, তবু বেকার থাকতে হচ্ছে না, মাসে মাসে সংসারে  কিছু না কিছু তো আমদানী হবে। হ্যাঁ, তাকে একেবারে মদ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। আর প্রতি শনিবার বিরিয়ানি খাওয়া চলবে না। পৃথা দি বলত, শুধুমাত্র রুটি আর সবজি খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।    রুটির সঙ্গে একটু দই আর পেঁয়াজ  হলেই তো অমৃত,  বেশি দরকার কি?

 যেন বাইকটাও ওর খুশির ভাগী। এতদিন পড়ে ছিল একটা জাংক হয়ে, আজ সে আবার হয়েছে পক্ষীরাজ। এতই খুশি যে সামনে রাস্তা দুভাগ হয়ে গেছে, একভাগ নীচে চলে যাবে, আর একদিক উঠে যাবে ফ্লাইওভারে, তখন বাইকের মাথাটা একটু ঘুরে গেল। বাঁক নিতেই ভুলে গেল। ঠিক সময় ঠিক বাঁক না নিল না তার কারণ অবশ্য জং ধরা হ্যান্ডল বার। সেটা হঠাৎ মড়াত করে ভেঙ্গে গেল, আর বাইকটা চলে গেল সোজা ডিভাইডারে।  বাইকটি ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়ে কয়েক ফুট উপরে উঠে রাস্তায় পড়ল, চারপাশে পাগলের মত ছুটে চলা অজস্র গাড়ী ও বাইকের মিছিল প্রচন্ড আওয়াজ করে ব্রেক কষল।  
হেলমেটটার গন্ধ যতই খারাপ হোক, ওর জন্যেই বেঁচে গেল স্বপন।  হাসপাতাল থেকে ফিরে ভাঙা পায়ে ক্রাচ লাগিয়ে স্বপন যখন ঘরে ফিরল, রহিম ধরে ধরে নিয়ে এসে খাটিয়াতে বসিয়ে দিল। ঊষা দেখেই কাঁদতে শুরু করল, তাই দেখে আয়েষাও চিল চিৎকার লাগিয়ে দিল। 

শুশ্রূষার আশ্রয়ে দিন দিন একটু একটু করে ভাল হতে হতে, স্বপন শুধুই ভাবল, দিন রাত দুপুর সন্ধে কাজ নেই শুধু ভাবা। শুধুই ভাবা, তার কোন সিদ্ধান্ত নেই, কোন নির্দেশ নেই। শুধু বুঝতে পারল সময় আরো  আরও খারাপ হবে আর ওর লড়ার ক্ষমতা দিন দিন কমেই যাচ্ছে। এখন কেবল একটিই উপায় বাকী। ভারতের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক যা করে। দেশের টাকা খাটে রাজনীতিতে, কাজও সেখানে অনেক। যে একবার পারে ক্ষমতাসীন দলে ঢুকে যেতে, তার খাওয়ার আর অভাব হয় না। স্বপন কি সেদিকেই গলা বাড়াবে? 
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব সহজভাবে এগোচ্ছে,ভালো লাগছে,বাঁচতে গেলে লড়াই চালাতেই হবে,সব জায়গায়🩷

    ReplyDelete
    Replies
    1. 💚ধন‍্যবাদ।

      Delete