জ্বলদর্চি

'তরবারি পুজো’ মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য / মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি

তরবারি পুজো’ মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য


ম ঙ্গ ল প্র সা দ  মা ই তি 

মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির দুর্গাপুজো পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার অন্যতম একটি প্রাচীন দুর্গাপুজো। এই পুজোকে ঘিরে ছড়িয়ে আছে নানান কিংবদন্তী ও জনশ্রুতি। ছুঁয়ে আছে এক ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস। চারশো বছরেরও বেশি পুরোনো এই মঙ্গলাপোতার দুর্গাপুজোর অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল এখানকার পুজোকে ঘিরে চারটি তরবারির পুজো করা হয়। যা সুদীর্ঘকাল ধরে হয়ে আসছে। একটি তরবারির পুজো করা হয় জিতাষ্টমীর দিন, একটি তরবারির পুজো মহালয়ার দিন, একটি মহাষষ্ঠীর দিন আর চতুর্থটির পুজো হয় মহাসপ্তমীর দিন। এই চতুর্থ তরবারিটি যেটি মহাসপ্তমীর দিন পূজিত হয় সেটি একটি বিশাল আকারের তরবারি। কথিত এই তরবারি দিয়েই বহুকাল আগে এখানে সামসের জং বাহাদুর বিষ্ণুপুর মল্লরাজ খয়ের মল্লকে পরাজিত করে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি উদ্ধার করেন, উদ্ধার করেন এখানকার সর্বমঙ্গলার ঘট।  তৎকালীন উড়িষ্যা রাজ্যের বীরযোদ্ধা সামসের জং বাহাদুর মা কালীর সাধনা করে এই তরবারি লাভ করেন। আর এই তরবারি দিয়েই খয়ের মল্লকে পরাজিত করেন। আসলে এই তরবারি একটি মন্ত্রপূত তরবারি। এই তরবারি সহ আর তিনটি তরবারি মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির যে কুলদেবতা রাধাকৃষ্ণ জিউ-এর দেউল আছে সেখানে রাখা আছে। রাধাকৃষ্ণ, লক্ষ্মীনারায়ণ, সর্বমঙ্গলা, দুর্গা ছাড়াও এখানে এই তরবারিগুলিরও প্রতিদিন পূজা হয়ে থাকে। দুর্গাপুজোর সময় এখান থেকে এই গুলি নিয়ে যাওয়া হয় মূল মণ্ডপে। অনতিদূরে মূল মণ্ডপের বামপাশে বিরাট এক উইঢিপি আছে সেখানে রাখা হয়। এবং পুজো দেওয়া হয়। বর্তমানে এই মন্দিরের পুরোহিত চণ্ডীমঙ্গল চক্রবর্তীবাবু এবং মঙ্গলাপোতা রাজবংশের বর্তমান বংশধর ৩২ বছরের যুবক সমরজিত্‍ সিংহদেব জানালেন সামসের জং বাহাদুরের তরবারিটি এখানে আসলে কালী মা। কালীমা জ্ঞানেই পুজো করা হয়। দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিন এবং পরবর্তী অমাবস্যায় শ্রী শ্রী শ্যামাপুজোর দিন এই তরবারিটিতে দু’মিটার করে চারমিটার লাল শালু কাপড় জড়ানো হয়। একটা আশ্চর্যের ব্যাপার দীর্ঘদিন ধরে এটা হয়ে আসছে, পুরাতন শালুকাপড়টি ফেলা হয় না। তার উপরেই এই লাল শালু জড়ানো হয়। সেই হিসাবে তরবারির দেহ স্ফীত, মোটা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মোটা হয়নি। যা ছিল তেমনই থাকে। মঙ্গলাপোতার রাজবাড়ির এই তরবারি স্বভাবিকভাবেই এক ঐতিহ্যের শিকড়কেই বহন করে চলেছে। 
   মঙ্গলাপোতা। গড়বেতা শহর থেকে আট কিলোমিটার পূর্বে শিলাবতী নদীর তীরে সবুজ-শ্যামল গাছপালায় ভরা এই গ্রামে অবস্থান করছে মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি। ঐতিহ্যের দিক দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রামটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় এই মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ি আসলে ছিল রাজাদের আমোদ-প্রমোদের বাগানবাড়ি। যা বগড়ীর রাজা ছত্রসিংহ নির্মাণ করেছিলেন। প্রচলন করেছিলেন দুর্গাপুজোর। যা মঙ্গলাপোতার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো নামে পরিচিত।
   মঙ্গলাপোতার এই রাজবাড়ির দুর্গাপুজো আনুমানিক ২৩৩ বছরের পুরোনো। কথিত এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন রাজা ছত্রসিংহ বাহাদুর। তত্কারলীন বগড়ী পরগনার শেষ স্বাধীন রাজা ছিলেন তিনি। 
১.
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় এই রাজা ছত্রসিংহ বাহাদুরের রাজত্বকাল আনুমানিক ১৭৭৯-১৮২৫ খৃষ্টাব্দ। অনুমান করা হচ্ছে এই সময়কালের মধ্যে রাজা ছত্রসিংহ বাহাদুর এই দুর্গাপুজোর প্রচলন করেছিলেন। ইতিহাস অবশ্য অন্য কথাও বলে। মঙ্গলাপোতার এই রাজবংশের প্রথম রাজা ছিলেন রাজা গজপতি সিংহ। যাঁর রাজত্বকাল ছিল ১৩৯১-১৪২০ খ্রিস্টাব্দ। এই বংশের নবম রাজা যিনি ছিলেন তাঁর নামও রাজা ছত্রসিংহ। এই ছত্রসিংহের রাজত্বকাল ছিল ইং-১৬২২-১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দ। ইনিও মঙ্গলাপোতাতে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করতে পারেন। তা যদি হয় তাহলে এই পুজো ৪০০ (চারশো) বছরেরও পুরোনো। যাই হোক-এই দুই ছত্রসিংহের মধ্যে যে কেউ একজন এই দুর্গাপুজোর করেছিলেন। চারশো বছর বা দুশো তিরিশ বছর যাই হোক না কেন মঙ্গলাপোতার এই দুর্গাপুজো সুপ্রাচীনকাল থেকেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল এখানে যে ঘটটি আছে তা আসলে গড়বেতার সর্বমঙ্গলার আসল ঘট। যেটি রাজা ছত্রসিংহ নিয়ে চলে এসেছিলেন জোরপূর্বক। সেই দেবীর ঘট আর ফেরত যায়নি। সেই ঘট এখানে পুঁতে রাজবাহাদুর ছত্রসিংহ এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন। দেবী সর্বমঙ্গলার ঘট এখানে পোঁতা হয়েছিল বলেই এখানকার নাম হয়েছে মঙ্গলাপোতা। কিছুকাল বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ খয়েরমল্ল দেবী সর্বমঙ্গলার এই ঘট নিয়ে চলে যান। সামসের জং বাহাদুর রাজা ছত্রসিংহের পাশে দাঁড়িয়ে খয়ের মলকে পরাজিত করে এই ঘট আবার উদ্ধার করে নিয়ে চলে আসেন। 
মঙ্গলাপোতা রাজবাড়ির সে বনেদিয়ানা আজ আর নেই, নেই সে আভিজাত্যও। কালের গর্ভে রাজবাড়ি প্রায় ধ্বংসের মুখে। ভবনগুলি ভেঙেচুরে একসা। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বড়ো বড়ো দেয়াল আর দালানকোঠাগুলি। ছোটো ছোটো কিছু কুঠরি সারিয়ে নিয়ে বর্তমান বংশধরেরা বিপদশঙ্কুল অবস্থায় কোনোরকমে বসবাস করছেন। পলেস্তারা খসে পড়েছে, চুন-সুরকি উঠে গেছে। একদা গমগম করে থাকা বড়ো বড়ো কক্ষগুলি আজ ঝোপ-জঙ্গলে ভর্তি। বড়ো করুণ দশা! কিন্তু ঐতিহ্য হিসাবে রয়ে গেছে এখানকার পুজো। মঙ্গলাপোতার রাজবাড়ির দুর্গাপুজো খুবই বিখ্যাত। বহুদূরদূরান্তের মানুষ একসময় এই পুজো দেখতে ভিড় করতেন। এই পুজোকে ঘিরে মানুষের উত্সাণহ ও উদ্দীপনা আর আনন্দের শেষ ছিল না। দুর্গাপুজোর ওই চারদিল হরেক রকম অনুষ্ঠানে গমগম করত সারা মন্দির চত্বর। হত যাত্রা, নাটক, থিয়েটার, বাউলগান এবং বসত কীর্তনের আসর। এখনো প্রতি বছর এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। ততখানি জাঁকজমকপূর্ন ভাবে না হলেও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য নিয়েই পুজো হয়। এই দুর্গাপুজোর মণ্ডপ স্থায়ী। বেদি তৈরি পঞ্চমুণ্ড দিয়ে। অতীতে পুজোমণ্ডপের দেওয়াল ছিল মাটির, ছাউনি টালি আর টিনের। দরজা কাঠের। বারান্দায় রয়েছে ছ’টি বিরাট আকারের থাম। অনুরূপ চারটি থাম রয়েছে বাড়ির ভিতরেও। একই কাঠামোর মধ্যেই দেবী দুর্গা, মহিষাসুর, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ বিরাজ করেন। বর্তমানে মাটির দেয়াল ভেঙে পাকার করা হয়েছে। মণ্ডপের সামনে নির্মিত হয়েছে এক বিরাট আটচালাও। মন্দিরের ভিতরে যে উইঢিপি আছে তা বহুপূর্ব থেকেই। ইটের দেয়াল তোলার সময়ও এই উইঢিপি ভেঙে ফেলা হয়নি। সেটিকে অক্ষুণ্ণ রেখেই দেয়াল নির্মিত হয়েছে। 
   পুজোর পনেরো দিন আগে থেকেই এখানে দেবীর ঘট ওঠে। জীতাষ্টমী, মহালয়া এবং ষষ্ঠী এই তিনদিন ঘট ওঠে। জীতাষ্টমী থেকে হোম, যাগযজ্ঞ এবং চণ্ডীপাঠ শুরু হয়ে যায়। মূর্তি প্রতি বছরই নতুন করে তৈরি করা হয়। ঐতিহ্য অনুসারে এখানে সপ্তমী, সন্ধিপুজো, নিশি আর ছাগ বলি হয়। পূর্বে এখানে মোষ বলিও হত। কয়েকবছর হল তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখানকার বলির বৈশিষ্ট্য হল এখানে বলির কাজ সমাধা হলে-সে খবর পৌঁছালে তবে দশ কিলোমিটার দূরে গড়বেতার সর্বমঙ্গলা এবং প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে গোয়ালতোড়ের সনকাদেবীর মন্দিরে ছাগ ও অন্যান্য বলি হয়। 
   এখন রাজবাড়ির বংশধর হিসাবে রয়েছেন অরবিন্দ সিংহদেব এবং তাঁর ভাইয়েরা। তাঁরাই এই পুজো করেন। কিন্তু আর্থিক সঙ্কটের দরুণ পুজোর সে ঐতিহ্য, অতীত গরিমা অনেকটাই ম্লান-নিষ্প্রভ। তা বলে পুজো তো বন্ধ হতে পারে না। আশেপাশের গ্রামের মানুষ সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এভাবেই টিকে আছে আজও মঙ্গলাপোতার এই অতি সুপ্রাচীন-গৌরবময় দুর্গাপুজো।         
  
৩.
  তা যাই হোক শীলাবতী অববাহিকায় অবস্থিত এই মঙ্গলাপোতাতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই রাজবাড়িতে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখানে ঘটস্থাপন করার ফলে দুর্গাপুজোর সময় যা কিছু হয় তা প্রথমে মঙ্গলাপোতার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোতে হয়-তারপর এখানকার তোপধ্বনি শুনে গড়বেতাতে দেবী সর্বমঙ্গলার পুজো হয়, গড়বেতার সর্বমঙ্গলার পুজোর তোপধ্বনি শুনে গোয়ালতোড়ে দেবী সনকা মায়ের পূজা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় চারশো তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দুর্গাপুজোর এই নিয়মবিধি চলে আসছে এখানে। যা ঐতিহ্যের পরম্পরাকে রক্ষা করছে। মঙ্গলাপোতা রাজবাড়িতে দেবী সর্বমঙ্গলার আসল ঘট থাকা ছাড়াও এখানে আছে রাজবাড়ির নানান ইতিহাস। যা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ। আছে রাজবাড়ির ভগ্ন দেউল, লায়কালি আমলের তৈরি সুড়ঙ্গ অর্থাত্‍ লায়কালি গড়। আছে সেই তরবারি যে তরবারি দিয়ে রাজা সামসের জং বাহাদুর খয়ের মল্লকে পরাজিত করে রাজবাড়ি পুনরুদ্ধার করেন। আছে দেবী সর্বমঙ্গলার ঐতিহাসিক ঘট, কালীবুড়ি এবং রাধাকান্ত জিউ। ১৯৮০ সালে এই রাজবাড়ির অদূরেই জঙ্গল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল যশোবন্ত সিংহের নাম খোদাই করা তিনটি কামান। দু’টি ব্রোঞ্জের, এবং একটি লোহার। পরে তা কলকাতার প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালায় সংরক্ষণের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
   এইভাবেই নানান ইতিহাস আর ঐতিহ্য নিয়েই মঙ্গলাপোতার রাজবাড়ির দুর্গাপূজা এখনো সমানভাবে সগৌরবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। হয়তো আগামীদিনেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।  
স্কেচ- সুদেষ্ণা রায়চৌধুরী    
____________________________
অভিমত জানাতে পারেন। 
jaladarchi@yahoo.in 




Post a Comment

0 Comments