পর্ব-১৭
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
সু দ র্শ ন ন ন্দী
পরের গানের উল্লেখ ১৮৮৪, ১৪ই সেপ্টেম্বরে। ঠাকুরের ঘরে অনেক ভক্ত সমাগত হয়েছেন। কোন্নগরের ভক্তদের মধ্যে একজন সাধক নূতন এসেছেন -- বয়ঃক্রম পঞ্চাশের উপর। দেখলে বোধ হয়, ভিতরে খুব পাণ্ডিত্যাভিমান আছে। তিনি বলছেন, “সমুদ্র মন্থনের আগে কি চন্দ্র ছিল না? এ-সব মীমাংসা কে করবে?”
নরেন্দ্র গান গাইছেন: যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে,
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে।
সাধক গান শুনতে শুনতে ধ্যানস্থ হলেন। বেলা ৩টা-৪টা হইবে। পশ্চিমের রোদ তাঁর গায়ে পড়ছে দেখে ঠাকুর তাড়াতাড়ি একটি ছাতা নিয়ে তার পশ্চিম দিকে রাখলেন।
সেসময় নরেন্দ্র গান গাইছেন:
মলিন পঙ্কিল মনে কেমনে ডাকিব তোমায়।
পারে কি তৃণ পশিতে জ্বলন্ত অনল যথায় ৷৷
তুমি পুণ্যের আধার, জ্বলন্ত অনলসম......
গানটির রচয়িতা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী। গানটির একবারই উল্লেখ রয়েছে কথামৃতে।
এদিন নরেন্দ্র আর গান গেয়েছিলেন আরেকটি গান (রবীন্দ্রসঙ্গীত)হল--
দিবানিশি করিয়া যতন হৃদয়েতে র’চেছি আসন,
জগৎপতি হে কৃপা করি, সেথা কি করিবে আগমন।
ঠাকুর ভাবাবেশে নিচে নেমে মেঝেতে নরেন্দ্রের কাছে বসলেন। এদিন নরেন আর গান গেয়েছিলেন যা পূর্বে উল্লেখ করেছি।
ঠাকুরও এদিন কীর্তন গাইলেন--
রাই বলিলে বলিতে পারে! (কৃষ্ণের জন্য জেগে আছে।)
(সারা রাত জেগে আছে!) (মান করিলে করিতে পারে।)
ঐদিন বিকাবেলা। ঠাকুর পশ্চিমের গোল বারান্দায়। শরৎকাল। গেরুয়া রঙে ছোপানো একটি ফ্লানেলের জামা পরেছেন ও নরেন্দ্রকে বলছেন, “তুই আগমনী গেয়েছিস?” গোল বারান্দা থেকে নেমে নরেন্দ্রের সঙ্গে ঠাকুর গঙ্গার পোস্তার উপর এলেন। সঙ্গে মাস্টার।
নরেন্দ্র গান গাইছেন:
কেমন করে পরের ঘরে, ছিলি উমা বল মা তাই।
কত লোকে কত বলে, শুনে প্রাণে মরে যাই ...
এটি গিরিশ্চন্দ্রের আগমনী নাটকের গান। গানটির উল্লেখ কথামৃতে একবারই পাই। ঠাকুর শুনছেন। শুনতে শুনতে ভাবাবিষ্ট হয়ে গেলেন।
এদিন সন্ধ্যাবেলায় যদু মল্লিক এসেছেন তাঁর বাগান বাড়িতে। ঠাকুর উপস্থিত। যদু মল্লিকের অনুরোধে ঠাকুর চারটি গান করেন --
১) আমার গৌর নাচে।
নাচে সংকীর্তনে, শ্রীবাস-অঙ্গনে, ভক্তগণসঙ্গে ৷৷
২)মার গৌর রতন।
৩)গৌর চাহে বৃন্দাবনপানে, আর ধারা বহে দুনয়নে।
৪)আমার অঙ্গ কেন গৌর, (ও গৌর হল রে!)
১৮৮৪, ২১শে সেপ্টেম্বর। ঠাকুর বিডন স্ট্রিটে স্টার থিয়েটারে “চৈতন্যলীলা” নাটক দেখতে এসেছেন। সঙ্গে মাস্টার,বাবুরাম,মহেন্দ্র এবং আরো দুএকজন ভক্ত। গিরিশ ঘোষ ও তাঁর কর্মচারীরা ঠাকুরকে অভ্যর্থনা জানিয়ে উপরে নিয়ে গেলেন। ঠাকুরের খুব আনন্দ। অভিনয় শুর হল। নাটকে অভিনেতা অভিনেত্রীরা যে গান গেয়েছেন তার আলোচনা দেওয়া হল।
নাটক অভিনীত হচ্ছে। জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে অতিথি এসেছেন। বালক নিমাই সদানন্দে সাথীদের সাথে গান গাইছেন:
কাঁহা মেরা বৃন্দাবন, কাঁহা যশোদা মাই।
কাঁহা মেরা নন্দ পিতা, কাঁহা বলাই ভাই ......
অতিথি এসেছেন জগন্নাথ মিশ্রের বাড়িতে। অতিথি চোখ বুজে ভগবানকে অন্ন নিবেদন করছেন। নিমাই দৌড়ে গিয়ে সেই অন্ন ভক্ষণ করছেন। অতিথি ভগবান বলে তাঁকে জানতে পারল ও দশাবতারের স্তব করে প্রসন্ন করছেন। মিশ্র ও শচীর কাছে বিদায় নেবার সময় তিনি আবার গান করিয়া স্তব করছেন -
জয় নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র জয় ভবতারণ।
অনাথত্রাণ জীবপ্রাণ ভীতভয়বারণ ৷৷
যুগে যুগে রঙ্গ, নব লীলা নব রঙ্গ......
স্তব শুনতে শুনতে ঠাকুর ভাবে বিভোর হইয়ে গেলেন।
নিমাই-এর উপনয়ন। নিমাই সন্ন্যাসী সেজেছেন। শচী ও প্রতিবেশী চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে। নিমাই গান গেয়ে ভিক্ষা করছেন:
দে গো ভিক্ষা দে।
আমি নূতন যোগী ফিরি কেঁদে কেঁদে।
ওগো ব্রজবাসী তোদের ভালবাসি,
ওগো তাইতো আসি, দেখ মা উপবাসী......
সকলে চলে গেলেন। নিমাই একাকী। দেবগণ ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী বেশে তাঁকে স্তব করছেন।
পুরুষগণ -- চন্দ্রকিরণ অঙ্গে, নমো বামনরূপধারী।
স্ত্রীগণ -- গোপীগণ মনোমোহন, মঞ্জুকুঞ্জচারী।
নিমাই -- জয় রাধে শ্রীরাধে...
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই গান শুনতে শুনতে সমাধিস্থ হলেন।
এবার নাটকের অন্য গান। অদ্বৈতের বাড়ির সামনে শ্রীবাসাদি কথা বলছেন। মুকুন্দ মধুর কণ্ঠে গান গাইছেন:
আর ঘুমাইও না মন।
মায়াঘোরে কতদিন রবে অচেতন।
কে তুমি কি হেতু এলে, আপনারে ভুলে গেলে
চাহরে নয়ন মেলে ত্যজ কুস্বপন ৷৷
মুকুন্দ বড় সুকণ্ঠ। শ্রীরামকৃষ্ণ মণির কাছে প্রশংসা করছেন।
পরের গান। শ্রীবাস ষড়্ভুজ দর্শন করছেন, আর স্তব করছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হয়ে ষড়্ভুজ দর্শন করছেন। গৌরাঙ্গের ঈশ্বর আবেশ হয়েছে। তিনি অদ্বৈত, শ্রীবাস, হরিদাস ইত্যাদির সহিত ভাবে কথা কইছেন।
গৌরাঙ্গের ভাব বুঝতে পেরে নিতাই গান গাইছেন:
কই কৃষ্ণ এল কুঞ্জে প্রাণ সই!
দে রে কৃষ্ণ দে, কৃষ্ণ এনে দে, রাধা জানে কি গো কৃষ্ণ বই।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব গান শুনতে শুনতে সমাধিস্থ হলেন।খানিকপর ঠাকুরের সমাধি ভঙ্গ হল। ইতিমধ্যে খড়দার নিত্যানন্দ গোস্বামীর বংশের একজন এসেছেন ও ঠাকুরের চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়স ৩৪/৩৫ হবে। ঠাকুর তাঁকে দেখে আনন্দে ভাসতে লাগলেন।হাত ধরে তাঁকে বলছেন, “এখানে বসো না; তুমি এখানে থাকলে খুব উদ্দীপন হয়।”
মঞ্চের যবনিকা উঠল। মাধাই কলসির কানা ছুঁড়ে মেরেছে তাই রাজপথে নিতাই মাথায় হাত দিয়ে রক্ত বন্ধ করছেন। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। দেখছেন, নিতাই জগাই মাধাইকে কোল দেবেন। নিতাই বলছেন:
প্রাণ ভরে আয় হরি বলি, নেচে আয় জগাই মাধাই।
মেরেছ বেশ করেছ, হরি বলে নাচ ভাই ......
গান শুনে ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হলেন। উপরের গানগুলি সবই নাটকের অংশ।
আজ রবিবার, মহাষ্টমী, ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলিকাতায় প্রতিমা দর্শন করতে এসেছেন। অধরের বাড়িতে শারদীয় দুর্গোৎসব হচ্ছে। ঠাকুরের তিনদিন নিমন্ত্রণ। অধরের বাড়ি প্রতিমাদর্শন করার আগে রামের বাড়ি হয়ে যাচ্ছেন। বিজয়, কেদার, রাম, সুরেন্দ্র, চুনিলাল, নরেন্দ্র, নিরঞ্জন, নারাণ, হরিশ, বাবুরাম, মাস্টার ইত্যাদি অনেক উপস্থিত ।
ঠাকুর কেদারকে গান করতে বললেন। কেদার গাইছেন:
(১) - মনের কথা কইব কি সই কইতে মানা।
(২) - গৌর প্রেমের ঢেউ লেগেছে গায়।
(৩) - যে-জন প্রেমের ঘাট চেনে না।
প্রথম দুটি গানের উল্লেখ আগে করা হয়েছে। তৃতীয় গানটির রচয়িতা অজ্ঞাত।
গানের পর আবার ঠাকুর ভক্তদের সাথে এবার কথা বলছেন। বেদ পুরাণ বিষয়ে কথা হচ্ছে। ঠাকুর বললেনঃ “কি অবস্থাই গেছে! মুখ করতুম আকাশ-পাতাল জোড়া, আর ‘মা’ বলতুম। যেন, মাকে পাকড়ে আনছি। যেন জাল ফেলে মাছ হড়হড় করে টেনে আনা। গানে আছে:
এবার কালী তোমায় খাব।
(খাব খাব গো দীন দয়াময়ী)।
ঠাকুর বললেন, উন্মাদের মতন অবস্থা হয়েছিল। এই ব্যাকুলতা!
ঠাকুর এখানে গানটি শুধু উল্লেখ করেছেন। এই রামপ্রসাদীটি তিনি আরেকবার ( ১৮ই অক্টোবর ১৮৮৪) দক্ষিণেশ্বরে গেয়েছেন তাঁর উল্লেখ পাই কথামৃতে।
নরেন্দ্র গান গাইতে লাগলেন: আমায় দে মা পাগল করে, আর কাজ নাই জ্ঞানবিচারে।( গানটি আগে উল্লেখ করেছি)
গানের পর ঠাকুর ভক্তদের বলছেন, “আজ মহাষ্টমী কিনা; মা এসেছেন! তাই এত উদ্দীপন হচ্ছে!”
কেদার বললেন-- প্রভু! আপনিই এসেছেন। মা কি আপনি ছাড়া?
ঠাকুর অন্যদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া আনমনে গান ধরলেন:
তারে কই পেলুম সই, হলাম যার জন্য পাগল।
ব্রহ্মা পাগল, বিষ্ণু পাগল, আর পাগল শিব।
তিন পাগলে যুক্তি করে ভাঙল নবদ্বীপ...
( গানটির রচয়িতা অজ্ঞাত। কথা মৃতে এই গানটি ঠাকুরকে আরেকবার ( ১৫ই জুলাই ১৮৮৫) বলরাম মন্দিরে গাইছেন তাঁর উল্লেখ পাই।)
আবার ভাবে মত্ত হইয়া ঠাকুর গাইলেন: কখন কি রঙ্গে থাক মা শ্যামা সুধাতরঙ্গিণী!
কমলাকান্তের গান এটি। ঠাকুর এই গানটি আরেকবার গেয়েছেন দক্ষিণেশ্বরে ২৯শে সেপ্টেম্বর ১৮৮৪, নরেন্দ্র গেয়েছেন একাবার ১৪ই জুলাই ১৮৮৫, এবং শ্যামপুকুরের বাড়িতে ভক্তেরা গেয়েছেন ৬ই নভেম্বর ১৮৮৫।
পরের গান ২৯শে সেপ্টেম্বর দক্ষিণেশ্বরে মহানবমীর দিন। দুপুরে ভবনাথ, বাবুরাম, মাস্টারমশায় সকলে প্রসাদ পেয়েছেন। ভক্তরা সব গল্প করছেন। ঠাকুরও এসে যোগ দিলেন। হঠাৎ ভবনাথ ব্রহ্মচারী বেশে হাজির দেখে ঠাকুর বললেন, ওর মনের ভাব ঐ কিনা, তাই সেজেছে। নরেন্দ্র বললেন, আমি তবে বামাচারী সাজি। ঠাকুর কিছু বললেন না। হঠাৎ নৃত্য করতে করতে গাইলেন- আর ভুলালে ভুলব না মা, দেখেছি তোমার রাঙ্গা চরণ।
এই রামপ্রসাদী গানটি ঠাকুরকে আরেকবার গাইতে দেখি ১০ই নভেম্বর ১৮৮৪ এই দক্ষিণেশ্বরেই।
ঐদিনই ঠাকুর তক্তপোশে বসে আছেন। ভক্তদের সাথে নানা প্রসঙ্গে আলচনা হচ্ছে। বলছেন সর্বভূতে ইশ্বর রয়েছেন তাই সকলকে ভালবাসতে হয়।কিন্তু যেখানে দুষ্ট লোক সেখানে দূর থেকে প্রণাম করতে হয়। এসব আলোচনার পর ঠাকুর দাশরথি রায়ের গান থেকে দু’লাইন উদাহরণ দিয়ে বললেনঃ
ঘরে আসবেন চণ্ডী, শুনবো কত চণ্ডী,
কত আসবেন দণ্ডী, যোগী জটাধারী...
এই গানটি আরেকবার (৫ই অক্টোবর ১৮৮৪) গাইতে দেখি ঠাকুরকে দক্ষিণেশ্বরে।
এদিন নরেন্দ্রকেও ত্রৈলোক্যনাথ স্যন্যালের লেখা “ এক পুরাতন পুরুষ নিরঞ্জনে, চিত্ত সমাধান কর রে্...” গানটি গাইতে শুনি।
পরের গানের উল্লেখ পাই ১৮৮৪, ১লা অক্টোবর অধর সেনের বাড়িতে। সেদিন ঠাকুর তাঁর বাড়িতে এসেছেন। বিজয়, কেদার, অধরদের ইশ্বরের সাকার নিরাকার রূপের বিষয়ে ঠাকুর বলছেন । বললেন, তিনি কখন কিরূপে দেখা দেন বলা যায় না। এই বলে তিনি “এসেছেন এক ভাবের ফকির, ( ও সে) হিঁদুর ঠাকুর, মুসলমানের পীর” গানটি গাইলেন।
পরের গানের উল্লেখ পাই ২রা অক্টোবর ১৮৮৪ । দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর নিজের ঘরে বসে আছেন। ভক্তদের মধ্যে মাড়োয়ারি ভক্ত এবং দক্ষিণেশ্বরের কয়েকজন যুবক আছেন। ঠাকুর বলছেন খুব উদার সরল না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। বলে তিনি গান ধরলেনঃ অমুল্য ধন পাবি রে মন হলে খাঁটি।
গান শেষ হলে বললেন, শেষ জন্ম বা তপস্যা না থাকলে উদার সরল হয় না।
--------------------------------------------------
প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক। অভিমত জানাতে পারেন।
jaladarchi@yahoo.in
0 Comments