উদ্ভিদনামে পূর্ব মেদিনীপুরের গ্রামনাম
(পর্ব - ৪)
ভা স্ক র ব্র ত প তি
চাঁপা -- পাঁশকুড়ার কাশীজোড়া রাজবংশের কবি ছিলেন কোলাঘাটের কানাইচকের নিত্যানন্দ চক্রবর্তী। এই রাজবংশের রাজা রাজনারায়ণ রায়ের (১৭৫৬-১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) সভাকবি ছিলেন তিনি। লিখেছিলেন 'মনসামঙ্গল'। এতে আমরা পাই—“চম্পাইনগরে ঘর চাঁদবেনে সদাগর / মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর"। পাঁশকুড়ার মানুষের বিশ্বাস, এই চম্পকনগর-ই পাঁশকুড়ার চাঁপাডালি গ্রাম। যদিও এ বিষয়ে ঘাের সন্দেহ রয়েছে। চম্পকনগরী গ্রামনামটি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকটি রয়েছে। স্বভাবতই চাঁদ সওদাগরের রাজধানী ঠিক কোথায় ছিল তা নিয়ে সন্দেহ উদ্রেক করে। যদিও এই পাঁশকুড়ারই অনতিদূরে মেলে বেহুলা নদী এবং নেতা ধােপানির ঘাট। ফলে আলােচিত চাঁপাডালি-ই কী চাঁদের চম্পকনগরী ? কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের 'মনসামঙ্গল'-তে পাই 'চম্পকনগরে ঘর চাঁদ সদাগর / মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর'।
যাই হােক অ্যানােনেসী পরিবারভুক্ত চাঁপা বা MICHELIA CHAMPAKA অবশ্য দেখা যায় না চাঁপাডালি গ্রামে। যদিও এরকমই চাঁপা-র নামে সৃষ্টি হয়েছে আরও বেশ কয়েকটি গ্রামনাম। যেমন - চাঁপি, চাঁপাতলা, চম্পাইনগর, চাপবসান, চম্পাবনি ইত্যাদি।
চাঁপাগাছ বহু রকমের হয়। তবে অনেকেই এর পরিচয় কম জানি। ১) কাঁঠালিচাঁপা -- Artabotrys odoratissismus। হলুদ রঙের ফুলে পাকা কাঁঠালের গন্ধ মেলে। ২) জহুরিচাঁপা -- ছোট আকারের গাছ। ফুলের খুব মিষ্টি গন্ধ। ৩) ভুঁইচাঁপা -- Koemperia rotunda। সংস্কৃতে একে বলে ভূমিচম্পক এবং হিন্দিতে বলে মুখজালি। গরমকালে জলাভূমিতে ঘাসের মাঝে জন্মায়। ৪) বনচম্পক -- অরন্যজাত গাছ। ৫) গোবরিয়াচাঁপা। ৬) দুলালচাঁপা -- Hedychium coconarium। সাদা রঙের ফুল হয়। ৭) কনকচাঁপা -- Pterospernum acerifolium। বড় বড় পাতা। গাছ বড় আকারের হয়। ফুলগুলিও বড় বড় এবং গন্ধযুক্ত। সংস্কৃতে একে বলে দ্রুমোৎফল, পরিব্যাধ এবং কর্ণিকার। ৮) দুলিচাঁপা -- Magnolia pterocarpa। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মায়।
চাঁপাকে চেনা যাবে দীপপুষ্প, পীতপুষ্প, হেমপুষ্প, স্বর্ণপুষ্প, ভৃঙ্গমহী, শীতলচ্ছদ, ভ্রমরাতিথি, স্থিরগন্ধ, চাম্পেয়, সুভগ, হেমাহ্ব, বনদীপ, সুকুমার নামেও। চাঁপাকে কথ্য ভাষায় অনেকে চম্পা বা ‘চম্পক' বলে।
নিত্যানন্দের 'মনসামঙ্গল'-এ বহুবার এসেছে চাঁপা গাছের প্রসঙ্গ। মেদিনীপুরের এই মধ্যযুগের কবি যেসময়ে তা লিখেছিলেন সেসময়ে এতদঞ্চলে যে চাঁপা গাছের প্রাধান্য ছিল তা বলা যায়। মনসামঙ্গলে পাই “ভারে ভারে সাজাইয়ে / বেহুলার ছটি ভাইয়ে / কেঁদে চলে বেহুলা লাগিয়া / বিপ্র নিত্যানন্দ বলে / উত্তরিল চাঁপাতলা / কাঁদে সতী ভায়েরে দেখিয়া।”
চাঁপা + বসান > চাঁপাবসান > চাপবসান
চম্পক + নগরী > চম্পকনগরী > চম্পাইনগরী
বইতাল -- কুমড়া বর্ণের (কিউকারবিটেসী) গাছ বইতাল এবং লাউ। এই দুই ফলের নামে জেলায় দুটি গ্রামনাম মিলেছে।
বইতাল + চক > বইতালচক > বৈতালচক
লাউ + দহ > লাউদহ > লাউদা
বইতাল বা কুমড়াকে উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় BENINCASA CERIFERA। একে গুজরাটিতে ভুরুং, কোলুং, ওড়িয়াতে কখারু, পানিকখারু, মারাঠিতে ভোঁপলা,কোহঠঠা, সংস্কৃতে কুষ্মান্ড, হিন্দিতে কদু, কোঢ়ী, কুন্তরা এবং কোহড়া বলে।
তিন ধরনের কুমড়া পাই। ১) দেশিকুমড়া বা চালকুমড়া বা ছাঁচিকুমড়া। Cucarbita maxima। হলুদ রঙের ফুল, সাদা রঙের গোলাকার লম্বা ফল। সংস্কৃতে শ্বেতকুষ্মাণ্ড এবং পুষ্পফল বলা হয়। ২) ভুঁইকুমড়া। Ipomoea paniculata। সংস্কৃতে ভূমিকুষ্মাণ্ড, বিদারী, ক্ষীরবিদারী, হিন্দিতে ভুঁইকখারু, বিলাইখন্দ বলে। ৩) বিলাতি কুমড়া বা মিষ্টি কুমড়া বা গুড়কুমড়া। Cucurbita maxima। সংস্কৃতে বলে পীতকুষ্মাণ্ড। কোচবিহারের লোকেরা বলে ঘিত্বকুষ্মাণ্ড।
অপরদিকে লাউ তথা LAGENARIA VULGARI-কে তামিলে সােরাক্কই, তেলুগুতে সােরাকয়া, হিন্দিতে কটুতুম্বি, কদু, সংস্কৃতে তুম্বী, ইক্ষাকু, অলাবু, মারাঠীতে গোরবতুম্বী এবং ইংরেজি তে Bottle gourd বলে। মিস্টি লাউ ও কটুলাউ এই দু ধরনের লাউ মেলে। একে দীর্ঘবৃত্তফলা, গোরক্ষতুম্বী, ক্ষীরতুম্বী, মহাফলা, ক্ষীরিণী, গোরক্ষীও বলে।
নারকেল -- তালগাছের মতােই অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল এই নারকেল। প্রচুর পরিমাণে জন্মায় এই জেলায়। কেননা এই জেলার মৃত্তিকা নারকেল চাষের পক্ষে বেশ উপযুক্ত। এটি একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল। নন্দকুমার, তমলুক, মহিষাদল, ময়না, কাঁথি, চন্ডীপুর, নন্দীগ্রাম, পাঁশকুড়া, ভগবানপুর এলাকায় নারকেল প্রচুর জন্মায়। তেমনি নারকেলের ছোবড়া তৈরির কাজও চলছে জোরকদমে। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারকেল উৎপাদন হয় পশ্চিমবঙ্গে। এমনকি তা কেরলের চেয়েও বেশি। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গে 'ডাব' হিসেবে আগেই খেয়ে নেওয়া হয়। এই 'কেরা' বা 'নারকেল' শব্দ থেকে 'কেরালা' নামের সৃষ্টি। তেমনি নারকেলের নামে পূর্ব মেদিনীপুরে যেসব গ্রামনাম সৃষ্টি হয়েছে তা হোলো -- নারকেলদা।
নারকেল + দহ > নারকেলদহ > নারিকেলদা > নারকেলদা
নারিকেল বা নারকেল গাছের দীর্ঘতা এলাকার পরিচিতি জ্ঞাপক হয়ে ওঠে। এই জেলায় নারকেল প্রচুর পরিমাণে হওয়ায় মানুষের মধ্যে খাদ্যাভ্যাসেও তার প্রভাব পড়ে। অনেকেই নারকেলের তেল খাবার হিসেবে ব্যবহার করেন। যদিও সচরাচর সরিষার তেল রান্নায় ব্যবহৃত হয় সবচেয়ে বেশি। ‘পামি' গোত্রের নারকেল হল COCOS NUCIFERA। এই COCOS থেকেই এসেছে COCONUT শব্দটি। সংস্কৃতে নারিকেল, রসফল, তামিলে তেঙ্গায়ি, টেন্না, অসমিয়াতে নার্জিল, হিন্দিতে নারিয়ল, খােপরা, ফার্সিতে জোজ, তেলুগুতে টেঁকায়া, নারিকদম, কন্নড়ে তোঁগনকায়ী, ওড়িয়াতে নড়িয়া, গুজরাটিতে নালীয়ের বলা হয়।
এছাড়া শাস্ত্রকাররা নারকেলকে চেনে মুণ্ডফল, ত্র্যম্বকফল, মাক্ষিকফল, কৌশিকফল, মাধ্বীকফল, মধুফল, সদাফল, রসফল, স্কন্ধফল, দৃঢ়ফল, শিরঃফল, চটাফল, নীলতরু, দৃঢ়নীল, স্কন্দতরু, তৃণরাজ, দাক্ষিণাত্য দূরারূহ, করকাম্ভস, কুর্চশীর্ষক, কুর্চশেখর, মুধানালিকেরক, বিশ্বামিত্রপ্রিয়, মৎকুন, মঙ্গল্য, সুভঙ্গ, নারিকেল, নারিকেলী, নারীকেরী, নাড়িকেল, নারকেল, নারিকের, ফলমুণ্ড, তুঙ্গ, সুতুঙ্গ, মৎকুন, সদাপুষ্প, ফলকেপর নামেও।
বাঁশ -- ইদানিং পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় বাঁশ চাষে বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। হলদিয়ায় একটি সংস্থার উদ্যোগে বাঁশজাত শিল্পসামগ্রী তৈরি এবং বাঁশচাষের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পান চাষ হয় জেলায়। সেই পানচাষের বোরােজ বানানাের জন্য দরকার প্রচুর বাঁশ। তেমনি বন্যাপ্রবণ জেলায় নদী বাঁধ মেরামতিতে বাঁশের প্রয়ােজন পড়ে। স্বভাবতঃই প্রাচীন কাল থেকেই ব্যাপক গুরুত্ব পেয়ে আসছে বাঁশ। এজন্য বাঁশকে কেন্দ্র করে গ্রামনাম হওয়াটাও স্বাভাবিক।
বাঁশ + তলা > বাঁশতলা
বাঁশ + বেড়িয়া > বাঁশবেড়িয়া
বাঁশ + বনি > বাঁশবনি
বাঁশ + দহ > বাঁশদহ > বাঁশদা
বাঁশ + গোড়া > বাঁশগোড়া
বাঁশ + খানা > বাঁশখানা + জালপাই > বাঁশখানা জালপাই
বাঁশ + গেড়িয়া > বাঁশগেড়িয়া
গ্রামিনী গােত্রভুক্ত বাঁশের বিজ্ঞানসম্মত নাম BAMBUSA TULDA। তামিলে মনগিল এবং তেলুগুতে কটিকই, যদরু নামে ডাকা হয় বাঁশকে। পশ্চিমবঙ্গে মোটামুটি ৯ ধরনের বাঁশ জন্মাতে দেখা যায়। সেগুলি হোলো -- ১) ভালকু বা ভালকি বাঁশ Bambusa balcoaa ২) জাওয়া বাঁশ Bambusa salarkhauii ৩) কাঁটা বাঁশ Bambusa bambos ৪) বাসিনি বাঁশ Bambusa striata ৫) কঞ্চি বাঁশ Bambusa microvulgaris ৬) তরল বা তল্লা বাঁশ Bambusa tulda ৭) ব্ল্যাক ব্যাম্বো Gigantochloa albociliata ৮) বাইজ্যা বাঁশ Bambusa vulgaris এবং ৯) মুলি বাঁশ Melocanna bacifera। এছাড়াও বাওনি বা বাঁশনি বাঁশ, বোম্বাই বাঁশ, বেউর বাঁশ, গাঁট বা গিঁটে বাঁশ, নল বাঁশ দেখতে পাওয়া যায়।
তিল -- একমাত্র এই গাছটিই সম্ভবত সারা ভারতের সর্বত্র 'তিল' নামেই পরিচিত। এ ধরনের অবিকৃত নাম সারা ভারতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। SESAMUM INDICUM-এর উদ্ভিদবিদ্যাগত নাম। পঞ্চশস্য হিসেবে তিল মান্যতা পায়। তিলকে কেন্দ্র করে যে গ্রামনাম পাই, তাহ'ল — তিলখোজা।
আদা -- আদাবেড়িয়া গ্রামনামটির সৃষ্টির সম্ভাবনা আদা থেকেই। জিঞ্জিবারেসী গােত্রভুক্ত ZINGIBER OFFICINALE বা আদা ব্যবহৃত হয় রান্নার এক অন্যতম মশলা হিসেবে। গুজরাটিতে আদু, ইংরেজি তে Ginger, হিন্দিতে আদরক, সংস্কৃতে আদ্রক, কন্নড়ে অল্ল, তেলুগুতে অন্ন, ফারসিতে জিঞ্জি এবং অসমিয়াতে জিঞ্জিবিলতর বলা হয়। তবে বন আদা বা Zingiber casumunar এবং জঙ্গলী আদা বা Zingiber capitunatum পাওয়া যায়। শাস্ত্রকারদের কাছে এটি অপাকশাক, গুল্মমূল, শুন্ঠী, অদ্রক, শৃঙ্গীবের, মূলজ, বর, মহীজ, অনুপজ, একবেষ্ঠ, কন্দল নামেও খ্যাত।
বেল -- বেলফুল (JASMINUM SAMBACAIT) বা বার্ষিকা বা বল্লিকা নয়, বেলযুক্ত গ্রামনামের সৃষ্টির পিছনে বিল্ব বা বেলগাছের (AEGLE MARMELOS) প্রভাব রয়েছে। ধর্মীয় গাছ হিসেবে বেল পূজিত হয়। কন্নড়ে বেল্লবন, তামিলে ভিলভ পজম, তেলুগুতে মারডু, গুজরাটিতে বিলূ, ইংরেজি তে Bengal quince, হিন্দিতে শ্রীফল, বেল এবং সংস্কৃতে বিল্ব বলে। এছাড়াও বেল পরিচিত বিল্ব, শ্রীফল, শৈবপত্র, শিবেষ্ট, ত্রিশিখ, ত্রিশাখপত্র, গন্ধপত্র, শল্য, শাণ্ডিল্য, পত্রশ্রেষ্ঠ, সমীরসার, সৎফলদ, শিবদ্রুম, শলাটু, কর্কটাহ্ব, দুরারুহ, হৃদাগন্ধ, শৈলূষ, সুভৃতিক, শিবেষ্ট নামেও। বেলকেন্দ্রিক গ্রামনামগুলি হল
বেল + দহ > বেলদহ > বেলদা
বেলতলা > বেলতলা
আজও জেলার বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় বেল গাছের নীচে গােবর মাটি দিয়ে নিকানাে। সেখানে সন্ধেবেলায় গাঁয়ের বধূরা সন্ধ্যা দেখায়। ধূপ দেয়। কেউ কেউ বা ওই গাছের গােড়ায় মাটির শিবলিঙ্গ তৈরি করে রাখে। তাঁদের বিশ্বাস বেলগাছের সাথে দেবাদিদেব মহাদেবের সংস্পর্ষ রয়েছে। এরকমই কোনাে দেবজ্ঞানে পূজিত বেলগাছই এলাকার পরিচিতি জ্ঞাপক হিসেবে বেলতলা হয়েছে।
কেন্দু -- একসময় জেলেরা তাঁদের মাছ ধরার জাল রং করার কাজে কেন্দু গাছের কাঁচা ফলের আঁঠা ব্যবহার করত। হিন্দি এবং ওড়িয়াতেও কেন্দু নামে পরিচিত থাকলেও সংস্কৃতে বলা হয় কাকেন্দু। ল্যাটিন পরিভাষায় নাম DIOSPYROS MELANOXYLON। কেন্দু গাছের নামে যেসব গ্রামনামের দেখা মেলে সেগুলি হল --
কেন্দু + আড়া > কেন্দুআড়া > কেন্দুয়া
কেন্দু + আড়া > কেন্দুআড়া > কেন্দুয়াটা
কেন্দু + আ > কেন্দুয়া > কাদুয়া
হিঞ্চা -- এটি একটি জলজ ভেষজ উদ্ভিদ। হিঞ্চাগেড়িয়া, হিঞ্চি, হিঞ্চিবাড় গ্রামনামগুলি এই গাছের নামেই। পূর্ব মেদিনীপুরে বেসন দিয়ে হিঞ্চা শাকের ভাজা বেশ জনপ্রিয় খাবার। চপশিল্পের রমরমাতে এবং এই উদ্ভিদের যথেচ্ছ প্রাপ্তির অভাবে এটি এখন দুর্মূল্য। উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় হিঞ্চা হোলো ENHYDRA FLUCTANS।
সােনাগাছ -- বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ নাগাদ কাঁচা সােনার রঙের ফুল ফোটে এই গাছে। এই সােনাগাছ বা সোনালু থেকে সোনাপেত্যা গ্রামনামের সৃষ্টি।
সােনাপাতা > সােনাপেত্যা
এটিকে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়না। খুব একটা পরিচিত গাছও নয়। সােনাগাছকে তেলুগুতে রেল্লকায়া, হিন্দিতে ঘন বহেড়া, অসলতাম, মহারাষ্ট্রীয় সঙ্গাতিলগব, সংস্কৃতে সুবর্ণ, আমলতাস, আবগ্বধ, রাজকৃষ্ণ, সম্পাক, অসমিয়াতে খ্যারেচম্বর, কোঙ্কনীতে বাসরলাঠি, কানাইলড়ি, ওড়িয়াতে সন্দরী, সােনারী, আরবিতে কানাহলড়ি, ইংরাজিতে PURING CASSIA এবং কর্ণাটকীতে বড়িলুবাহবাহেগাক বলা হয়।
এই গাছকে সোঁদাল বা সোন্দালও বলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁর নাম দিয়েছিলেন অমলতাস। গ্রামের দিকে বাঁদরলাঠিও বলে। কাঞ্চনাদিবর্গের এই গাছটির বিজ্ঞান সম্মত নাম Casia fistula।
মান্দার -- আকন্দকে ওড়িয়াতে অরখ, সংস্কৃতে অর্ক, তুলফল, মন্দার এবং হিন্দিতে আক, মদার বা মন্দার বলা হয়। তবে আকন্দ এবং মান্দার দুটি আলাদা গাছ। তবে আকন্দ নয়, মান্দার বা মাদার বা ডহু বা লকুচা গাছ থেকেই সৃষ্ট গ্রামনাম -- মান্দারমণি এবং মান্দারগেছ্যা।
মান্দার + বন + ই> মান্দারবনি > মান্দারমণি
মান্দার + গাছিয়া > মান্দারগাছিয়া > মান্দারগেছ্যা
বর্ষায় জন্মে মান্দার গাছ। ফল পাকলে হলুদ রঙের হয়। কাঁঠাল গাছের মতো উদ্যানতরু বিশেষ। তেলুগুতে একে কম্মারেণ্ড বা লকুচ্চম, মহারাষ্ট্রতে লােই এবং ওড়িয়াতে জেউট বলে। ল্যাটিন ভাষায় ARTOCARPUS LACOOCHA নামে পরিচিত। এখন পূর্ব মেদিনীপুরের এক অতি পরিচিত পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠেছে মান্দারমণি। সমুদ্রতীরবর্তী এই এলাকাটিতে অবশ্য মান্দার গাছ বিশেষ দেখা যায় না।
হলুদ -- অতি পরিচিত কন্দ বিশেষ। সাধারণত হলুদ বা হরিদ্রা নামে লােকে চেনে। যদিও হরিতা, পীতা, হরিদ্রঞ্জনী, মঙ্গল্যা, বরবর্ণিনী, বর্ণদাত্রী, বিষঘ্নী, কৃমিঘ্না, শােকা, জনিষ্ঠা, শােভনা, দীর্ঘরাগা, বরাঙ্গী, সুভাগা, লক্ষ্মী, ভদ্রা, শিবা, কাঞ্চনী, জয়ন্তিকা, যোষিৎপ্রিয়া, বরা, হরিদ্রী, বিলাসিনী, হরবিলাসিনী, স্বর্ণবর্ণা নামে ডাকা হয় হলুদকে।
হলুদ কেন্দ্রীক গ্রামনামগুলো হোলো --
হরিদ্রা + চক > হরিদ্রা চক
হলুদ + চক > হলুদচক > হলদিচক
হলুদ + ইয়া > হলদিয়া
হলুদ + বাড়ি > হলুদবাড়ি
হলদিয়া নামটি হলদি নদীর নামে হয়েছে বলেই অভিমত। তবে আগে হলদিয়ার নাম ছিল দোরাে দুবনান পরগনা। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমে দরিয়া বা সাগরের বুকে স্রোত বাহিত পলি জমে জমে সৃষ্টি হয়েছিল এই দোরাে দুবনান পরগনা। 'দরিয়া' শব্দের অপভ্রংশ বিবর্তিত হয়ে 'দোরাে' হয়েছে। আর 'দ্বীপ' শব্দটি উচ্চারণের ভেদে 'দুব' এবং 'নারায়ণ' শব্দটির বিবর্তিত উচ্চারণ হয়েছে 'নান'। এক সময় এখনকার এক বহু চর্চিত ব্যক্তির নাম ছিল জয় নারায়ণ গিরি। পরবর্তীতে এখানে হলদিয়া নামকরণ হয়। পাের্তুগিজদের উচ্চারণ 'হলদ্যা' থেকে এই নামটি এসেছে বলে মত অনেকের। তবে দিল্লির মহাফেজখানায় 'হলদ্যা পয়েন্ট' নামটি মানচিত্রে রয়েছে। ছােটোনাগপুর থেকে হলুদ রঙের মাটি ধােয়া জল কংসাবতী হয়ে হলদি নদীতে এসে পড়ত। জলের রং হলুদ হওয়ায় নদীটির নাম হল 'হলদি'। সেই নদীর পাড়ে ৬৮টি মৌজা নিয়েই গড়ে ওঠে আজকের 'হলদিয়া'। অর্থাৎ হলদিয়া নামকরণের সাথে হলুদ গাছের সংস্পর্শ থাকার সম্ভাবনা নেইই। তবুও বিষয়টি উত্থাপন করা হল যেহেতু 'হলদিয়া' নামটির সাথে হলুদ শব্দের মিল রয়েছে।
0 Comments