জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা - প্রথম সংখ্যা

ছোটোবেলা - ১ম সংখ্যা


আজ থেকে শুরু হল 'ছোটোবেলা' বিভাগ। মূলত শিশু কিশোরকিশোরীদের জন্য হলেও সবারই আশা করি ভালো লাগবে। কারণ আমাদের যার যত বয়স বাড়ুক না কেন মনের মধ্যে সেই ছোটোবেলার স্মৃতি থেকে যায় সারাজীবন। মনের বয়স তাই কিছুতেই বাড়ে না। 
এই সংখ্যায় আমন্ত্রিত কবি লেখকদের পাশাপাশি থাকলো স্বনামধন্য সন্তোষ জানার বিখ্যাত এক ফোটোগ্রাফি। যেখানে স্পষ্ট হয়েছে  জীবনের জয়গান।  একদিন আমরা সবাই বর্তমানের বন্দিজীবন কাটিয়ে ফের সুস্থ জীবনের পথে বাড়ির বাইরে পা রাখবো, তারই ব্যঞ্জনা তুলে ধরছে এই ফোটোগ্রাফি।        
           
ফটোগ্রাফি - সন্তোষ জানা  


কে আছো জেগে?

নির্মাণ মহান্তী (দশম শ্রেণি)


'কে আছো জেগে?'
দীর্ঘ ঘাসের বন, দীর্ঘ যবনিকার অন্ধকারে,
ধূসর বাতির মতো,  কুয়াশার শব্দে শুনি
পথিকের কন্ঠস্বরে
'কে আছো জেগে?'

সেখানে ক্লান্ত অরণ্যপথে
সে পান করে সমীরণ;
সহস্র বছরের নিঃসঙ্গ পথে পথে, জেগে ওঠে ব্যাকুল অধর, 'কে আছো জেগে?'

তারপর রাত্রি আসে,নিভে যায় আলো, পৃথিবীর
বুকে জাগে শুধু অগোচরে, সেই কবেকার
কত ভুলে যাওয়া ব্যথা...

আঁধার শিশির বন, অজ্ঞাত প্রলাপে ধরে
হিমের বসনটুকু...

সব ছবি মুছে দেয় গহন কালির লিপি;
সব কবির ফুরায় কলমের স্পন্দন
পরম নিদ্রায় ডুবে যায় সকল প্রাণ...

 তখন পায়ের শব্দের মতো
নিবিড় কুয়াশার বুকে নেমে আসে আগন্তুকের ডাক,
'কে আছো জেগে?'
দীর্ঘ নদী, অরণ্যপথে,
ঘন অন্ধকারে
কত নিশাচর প্রাণ ওঠে জেগে
করে রাত্রি জাগার আয়োজন;
নিভৃত ঘাসের ভেতর
নীরব পাতার সমাধিতে সহসা থেমে যায় এসে
রাত্রির চোখ।
পথ চলে শুধু সেই ক্লান্ত চরণ
গৈরিক ধুলোর মতো;
বিজন পথে ঘুম -ভেঙ্গে-বসা আঁধারের বুকে
বেজে ওঠে 'কে আছো জেগে?'



-------------------------------------------------------

বাঘমামার কোয়ারেন্টাইন

 সু দ র্শ ন  ন ন্দী ( আমন্ত্রিত লেখক) 


বাঘমামার বেজায় মন খারাপ। কদিন শরীরটা ভালো নেই। সেদিন মামীমা ভাগনে শেয়ালকে ডেকে পাঠাল মামাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য। ভাগনে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এল মামীমার ডাকে। শেয়াল সব শুনে আর মামার অবস্থা দেখে একটু দুরত্ব রেখেই বসে আছে। মাথা চুলকে কি ভাবল খানিক। নাকে মাস্ক, টাকে টুপি তাঁর,  সাবধানের মার নেই যেভাবে করোনা চারদিকে ছড়াচ্ছে। বগলেও স্যানিটাইজারের বড় বোতল রেখেছে।খানিক ভেবে বললে, মামা, তোমার করোনা টরোনা হল নি তো? 
করোনার কথা শুনে বাঘের মাথায় বাজ পড়ল। বললে, ভাগনে আনসান মুখে যা আসে তাই বলে ফেলিস। শুধু আমার অমঙ্গল চাস।
শেয়াল জিভটা বের করে কান ধরে বলল- এ কথা বললে মামা পাপে মরে যাব যে! আসলে চারদিকে করোনা হচ্ছে আর তুমি যেভাবে থাকো ! জানি করোনা তোমার  টিকিটিও ছুঁতে পারবে নি তবুও   মাস্ক পরা উচিত।  কিন্তু তুমি মাস্ক পরো না, খাবার আগে হাত ধোও না, গায়ে ঠেস দিয়ে বন্ধুদের সাথে গপ্পো গুজবও কর। আবার দুর্বল লাগছে বলছ, তাই মনে হল আর কি। দাঁড়াও দুটো ঘরোয়া টেস্টেই বোঝা যাবে করোনা হয়েছে কিনা। এসব ব্যবস্থা ব্যাগে আমি সব সময় রাখি করোনার ভয়ে  নিজের পরীক্ষার জন্য। এই বলে শেয়াল ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ভেজা তুলো বের করে বলল- মামা দেখ তো এটাতে সুগন্ধী আতরের গন্ধ পাচ্ছ কিনা?
বাঘমামা সেই তুলো নাকে নিয়ে বলল- কই না কোন গন্ধই নেই।
এরপর শেয়াল মামাকে একটা বোতল দিয়ে বলল এটাতে সরবত আছে। দেখো তো মিষ্টি লাগছে কিনা?
বাঘ সরবত খেয়ে বলল , না চপশা, কোন স্বাদই নেই।
শেয়াল আফসোস করে বলল, আমি যা ভেবেছিলুম ঠিক তাই। মামার নির্ঘাত করোনা হয়েছে।
মামীমা  ভয় পেয়ে বললে, কি সব্বোনাশ হল রে ভাগনে, বড় চিন্তায় পড়ে গেলাম। তুই এখনই হাসপাতালে খবর দে। ওরা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখুক। ওদিকে বাঘ মামা ভয়ে একেবারে শুঁয়োপোকার মতো গুঁটিয়ে গেছে।  
 মামার অবস্থা শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের একমাত্র কোভিড হাসপাতালে খবর দিল শেয়াল।জানাল, স্বাদ নেই, গন্ধ না পাওয়ার  কথা। তাঁর সাথে জ্বরটাও জুড়ে দিল সে। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে ডাক্তারবাবুরা মানে ডাঃ নেকড়ে, ডাঃ হায়নারা এ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিল। জানাল চোদ্দ দিন কোয়ারেন্টিনে মানে আলাদা বন্দী থাকতে হবে।
 বাঘ মামা তা শুনে হতাশ হয়ে মুষড়ে পড়ল। শেয়াল বলল, মামা, তুমি চিন্তা করো নি কো। তোমার ঘরের বাজার টাজার আমি সব করে দেব।  চোদ্দ দিনের তো ব্যাপার । দেখতে দেখতে কেটে যাবে।  শুনেছি মানুষদের কোন রাজা একবার ভাই বৌকে নিয়ে চোদ্দবছর জঙ্গলে কাটিয়েছে।  আর  জঙ্গল তো তোমার মাতৃভূমি।  তারা পারলে তুমি পারবে না? সেখানে আলাদা করে চোদ্দদিন থাকবে।  কি আর এমন কষ্ট বল দিখি !
বাঘ ভয়ে জড়সড় হয়ে বলল,- হ্যারে ভাগনে ভাল হয়ে ফিরব তো?
বাঘের বৌ বাঘিনী সেকথা শুনে বলল, যত্তোসব অলুক্ষণে কথা? হাসপাতালে শুনলুম দুজন স্পেশালিস্টও এসেছে চীন থেকে।  ডাঃপাণ্ডা না কি নাম। ওরা পূজারী পান্ডা নয়, একেবারে জন্তুদের ডাক্তার- চীনা স্পেশালিস্ট, ঠিক সামলে নেবে।  তুমি মিছে টেনশেন নিওনি তো?
শেয়াল বলল-ঐ কথাটাই তো আমি মামাকে বোঝাতে চেয়েছিলুম মামী। মামা, তোমার জায়গায় আমি হলে কিন্তু অত ভয় পেতুম নি। 
বাঘ কথাটা লুফে নিল।  বলল, ভাগনে তাহলে তুই ছদ্মবেশ ধরে আমার হয়ে হাসপাতাল যা, আমি ঘরেই থাকি।
শেয়াল এক গাল হেসে বলল, মামা তোমার জন্য আমি তাতেও রাজি।  কিন্তু ঘরে তোমার বাড়াবাড়ি হলে মামী শুদ্দু যে মরবে সে দিকটা ভেবে দেখেছ?
বাঘ ঢোক গিলে বলল তবে থাক।  কিন্তু ভাগনে, রিপোর্ট যদি ভুল হয় সেখানে আমি কেন শুধু শুধু চোদ্দ দিন থাকতে যাব বল। 
শেয়াল বলল আমাদের এই জঙ্গলের হাসপাতালে একচুল ভুল হবার জো নেই।   তাছাড়া তুমিই তো বলছ নাকে গন্ধ নেই, জিভে স্বাদ নেই তাহলে এমনি বোঝা যাচ্ছে করোনা তোমার বডিতে ল্যাপটে রয়েছে।  বুঝলে কি না মামা?
বাঘ আর কথা বাড়াল না। খানিক বাদেই এ্যাম্বুলেন্স এল পোঁ পোঁ আওয়াজ করে।দুজন জন্তু এপ্রন পরে  এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামল। বোঝা গেল না তারা কারা। চোখমুখ গা পা সব ঢাকা।বাপরে কি শক্তি ওদের। বাঘকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে এম্বুলেন্সে ঢুকিয়ে পোঁ পোঁ করতে করতে চলে গেল ওরা। মামীমা শেয়ালকে বলল, যা তুই ও যা।
এই যাচ্ছি বলে শেয়ালও রওনা হল। সে আনন্দে  হাসপাতালে না গিয়ে  নিজের ঘর চলে গেল। গিয়ে বৌ শেয়ালনিকে বলল- আজ বাঘমামাকে জোর ঘোল খাইয়েছি। জলে তুলো ভিজিয়ে আতরের গন্ধ শুকিয়েছি আর খালি জলকে  সরবত বলে খাইয়েছি। গন্ধ স্বাদ কোত্থেকে পাবে মামা?
আর হাসপাতালে সেকথা বলতেই এ্যাম্বুলেন্স এসে সোজা মামাকে তুলে নিয়ে গেছে। মামাকে কতদিন ঠকাইনি। কেমন ভয় পাইয়ে দিয়েছি বল?
শেয়ালনি বলল- মামা যখন বুঝবে সব তোমার কারসাজি তখন মামা তোমাকে জ্যান্ত রাখবে?
শেয়াল আনন্দে আর কথা বাড়াল না।
এদিকে শেয়াল বিকালে খবর পেল হাসপাতালে স্বাদ, গন্ধ সব ঠিক পেয়েছে মামার, আবার করোনা টেস্টেও কিছু ধরা পড়ে নি তাই ছেড়ে দিয়েছে মামাকে। শেয়ালও ভাবতে পারেনি এতো তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবে মামা। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শেয়াল হঠাৎ দেখে মামা হাজির তার ঘরে। রাগে গোঁ গোঁ  করছে। শেয়াল বৌকে সামলে নিতে বলে নিজে ভেতরের ঘরে লুকিয়ে গেল। বাঘ চেঁচাল সেই বদমাশটা কোথায়?
 শেয়ালনি বলল সে বোধ হয় মামিমার বাজার করে দিতে গেছে। তারপর মামাকে বসতে দিল, আদর যত্ন করল। বাঘ রাগে বলল ভাগনে আমাকে চিটিং করেছে। আমার কিছু হয়নি, জোর করে আমাকে ভয় খাইয়ে হাসপাতাল পাঠিয়েছে। আজ আমি ওকে দেখেই ছাড়ব।
শেয়াল চুপটি করে বসে ভেতর থেকে সব শুনছে । শেয়ালনি বলল, মামা কোথাও তোমার ভুল হচ্ছে। ভাগনে তোমাকে ঠকাতে যাবে কেন? তুমি স্বাদ গন্ধ পাওনি তাই সন্দেহ  হওয়াতে তোমার ভালর জন্যই হাসপাতালে খবর দিয়েছে।
তাহলে হাসপাতালে কি করে ওসব পেলুম। দিব্যি গন্ধ,স্বাদ সব ঠিকঠাক?
তখন তোমার করোনা ভাইরাস পালিয়ে গেছে শরীর থেকে, তাই। আচ্ছা মামা তুমিই বল,তোমার মতো শক্তিশালী আর ক্ষমতাবানের শরীরে কোন ভাইরাসের দম আছে  বেশিক্ষণ থাকবে? ভাইরাস ভুল করে ঢুকেছিল, হাসপাতালের পথে দৌড়ে পালিয়ে গেছে। তুমি ভাগনের উপর শুধু শুধু রাগ করছ।
বোকা বাঘ খানিক ভাবল, তারপর বলল, তা অবশ্য মন্দ বোলো নি। ভাগনে এতটা অপকার আমার করবে বলে মনে হয় না। বাঘ মাথা চুলকাতে খাকে। এরমধ্যে শেয়ালনি খরগোশের রোস্ট দিয়ে গেল মামাকে খেতে।
মামার জিভ দিয়ে জল পড়ছে। তারপর আতঙ্কে কি ভেবে বলল থাক থাক অন্যদিন খেয়ে যাব। আবার যদি স্বাদ না পাই তাহলে... বলে বাঘমামা ঘরের দিকে পা বাড়াল।
শেয়াল ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, খুব সামলে নিয়েছিস বৌ, নইলে আমাকে হাতের কাছে পেলে ঠ্যাং ভেঙ্গে দিত আজ।
শেয়ালনি বলল, যাই বল, মামাটা সত্যিই বোকা! বলে দুজনে বাঘের জন্য তৈরি খরগোশের রোস্ট খেতে লাগল আয়েশ করে।
----------------------------------

চিরসখা

দি লী প  ম হা ন্তী (আমন্ত্রিত লেখক)

মাঠের মাঝে ছোট্ট পুকুর
পাড়েতে দীর্ঘ বট
ছায়া দিয়ে ঢাকা অর্ধেক আকাশ
ঝুরিতে ধরেছে জট।

তার সঙ্গেই পথ আগলে
পাকুড় রয়েছে জড়িয়ে
চিরকাল ধরে এই দুটি গাছে
সুখদুখ যায় গড়িয়ে।

কত যে দীর্ঘ গ্রীষ্মের তাপ
একা শুষে নেয় পাতা
তার নিচে শোয়া ক্লান্ত মানুষ
মাথায় ধরেছে ছাতা।

কত বর্ষার আনন্দ জল
গাছে লাগে কাদা হাওয়া
ছেলেবেলা খেলে ডালে ডালে
শৈশব টাকেই পাওয়া।

এখনো দাঁড়িয়ে বট-পাকুড়
পুকুর হয়েছে মজা
জলতল তার কত উঠে গেছে
তবুও উড়ছে ধ্বজা।
-----------------------------------------------------
দেবতনু ঘোষ (সপ্তম শ্রেণি)

------------------------------------------------------
এই বিভাগের জন্য (কেবলমাত্র মেল মাধ্যমে)
লেখা পাঠাতে পারেন। 
jaladarchi@yahoo.in 
 

Post a Comment

1 Comments

  1. সোনা, ( Nirman Mahanty) ,কি অসম্ভব সুন্দর একটা লেখা !আশীর্বাদ করি অনেক অনেক বড়ো হও। তোমার লেখনী আরো, আরো শাণিত হয়ে উঠুক । খুব ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete