জ্বলদর্চি

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-৮/ অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান 
(Ancient India, History & Science)

অষ্টম পর্ব

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

"ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা -৫"


সাহিত্য পর্বের মতোই আমরা সম্পূর্ণ লিখিত উৎসকেও ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত করতে পারি, তবে বলে রাখা ভালো গত পর্বে আলোচ্য সাহিত্য পর্বের খুঁটিনাটি কিন্তু এই 'লিখিত-উৎস' পর্বেরই অন্তর্গত। তাই মন স্থির করেছি এই পর্যায়ে লিখিত উৎসের ভিন্ন বিষয়ের অবশিষ্ট দিকগুলোর খুঁটিনাটি'র ব্যাপারে দৃষ্টি রাখব। প্রথমত, এই লিখিত উৎস গঠিত হয় দুটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে (যথা, দেশীয় লেখকদের রচনা ও বিদেশীয় লেখকদের রচনা।) অর্থাৎ দেশীয় রচনা (Indigeneous Literature of ancient times) ও বৈদেশিক বিবরণী (Accounts of foreign Travellers)। পুনরায় দেশীয় বিবরণী বা সাহিত্যকেও আমরা বহু ভাগে ভাগ করতে পারি। তবে আমি এই আলোচনায়  এক বা দুই প্রকার বিভাগ উপস্থিত করার চেষ্টা করছি। যথা, দেশীয় লেখকদের রচনাকে দুই ভাগে বিভক্ত করা যায়- এক, আধ্যাত্মিক গ্রন্থাদি, দুই, ধর্মবহির্ভূত বিষয়ের রচনা। এই আধ্যাত্মিক গ্রন্থাদির মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন- বৈদিক, বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি ঠিক তেমনই এই ধর্মবহিভূত বিষয়ক রচনার উল্লেখযোগ্য পুরাণ, মহাকাব্য, স্মৃতি ও আইন বিষয়ক, সাহিত্য (পূর্বে আলোচিত) ও ইতিহাস বিষয়ক রচনা। আবার অন্যভাবে দেখলে, এই দেশীয় উপদানকে পুনরায় চার ভাগেও বিভক্ত করা যায়- এক, ধর্মীয় সাহিত্য বা গ্রন্থ (Sacred literature ), ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থ (Secular Literature), জীবন চরিত (Biography) ও আঞ্চলিক ইতিহাস (Regional history)।

    প্রসঙ্গত, গত পর্বে আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম যে, আর্যদের ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রধান সূত্রই হলো চতুর্বেদ। ১৫০০ খ্রিঃপূঃ থেকে ৬০০ খ্রিঃপূঃ অবধি প্রাচীন ভারতের নিদর্শনের উৎস স্বয়ং বৈদিক সাহিত্য। ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব এই চার সংহিতাত মধ্যে ঋগ্বেদ'ই একমাত্র প্রাচীন। তবে বিষয়ভাবে জ্ঞাতব্য, খ্রিঃপূঃ ১৫০০-১০০০ সময়কাল পর্যন্ত বৈদিক যুগের আদিপর্বে রচিত 'ঋগ্বেদে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ক্ষেত্রটির মধ্যে বিশেষ করে পশুপালন ও কৃষিকর্মের দুটি দিক এতটাই সুন্দরভাবে বর্ণিত আছে যে এর মাধ্যমে আমরা যেমন তখনকার সমাজের প্রাণবন্ত প্রাণোচ্ছ্বল সমাজ-সংস্কৃতির অভূতপূর্ব পরিচয় পেয়ে থাকি ঠিক তেমনই পরবর্তী বৈদিক যুগীয় সাহিত্য চতুর্বেদ তথা ব্রাহ্মণ সাহিত্য , আরণ্যক, উপনিষদের অন্দরে রাজনৈতিক ঘটনাবলীর উল্লেখ খুবই স্বল্প থাকার কারণে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিকের পাশাপাশি বিশেষ করে ধর্মীয় ব্যাপার সম্বন্ধে অতিরিক্ত জ্ঞানার্জন করতে পারি। এথেকেই আমরা একটা স্পষ্ট ধারণা করতে পারি যে ঋগ্বেদের পরবর্তী যুগে কিভাবে তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় জটিলতা বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্মরণে রাখা প্রয়োজন, বৈদিক সাহিত্যের সীমাবদ্ধতার জায়গাটি। কারণ, তার রচনাকালের ইতিবৃত্ত নিয়ে মতানৈক্য এবং তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যে সাহিত্য আলোচনা ও ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্যগুলোর সমর্থনে প্রত্নতাত্ত্বিক অভাব অনেকটাই বৈদিক সাহিত্যকে বিশ্বাসযোগ্যতার পরিখায় বেশ কিছুটা কোণঠাসা করে দিয়েছে বলা যায়।     প্রসঙ্গত, এই বৈদিক সাহিত্য নিয়ে পরবর্তীতে সাহিত্য পর্বে দীর্ঘ আলোচনায় আসব হয়ত, তবে এই মুহূর্তে এর সম্বন্ধে কিছু কথা জানিয়ে রাখা ভালো বলে মনে করছি। যেমন, এই  বেদকে আমার "শ্রুতি" নামে চিনি অর্থাৎ যার আক্ষরিক অর্থ " যা শোনা হয়েছে"। শ্রুতি কিন্তু মানুষের লেখা বই নয়, তাই শ্রুতিকে বলা হয় "অপৌরুষেয়'। একারণেই সাধারণত আমরা এই শ্রুতিকেই 'বেদ' বলে থাকি। এই বিস্বাসযোগ্যতার প্রসঙ্গে স্বামী নির্মলানন্দ একটি বক্তব্যের উপর দৃষ্টি রাখা যাক, তাঁর মতে-
"হিন্দুদের কয়েকখানি বিশেষ ধর্মগ্রন্থকে কেন বেদ বলে তাহার একটি কারণ আছে। সংস্কৃতে "বিদ্" ধাতুর অর্থ 'জানা'। এই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন বলিয়া 'বেদ' শব্দের মূল অর্থ 'জ্ঞান'। বেদ বলিতে বিশেষতঃ ঈশ্বর, জীব ও জগৎ সম্বন্ধে পারমার্থিক জ্ঞানই বোঝায়। সৃষ্টিও যেমন অনাদি ও অনন্ত, ঈশ্বর সম্বন্ধে জ্ঞানও তেমনই অনাদি অনন্ত। ঈশ্বর সম্বন্ধে এই শাশ্বত ও অফুরন্ত জ্ঞানরাশিই বেদ শব্দের মুখ্য অর্থ। এই জ্ঞানরাশির কিছু অংশের সন্ধান হিন্দু তত্ত্বদ্রষ্টাগণ পাইয়াছিলেন। তাহাই বেদ নামে প্রচলিত হইয়াছে।"

এরসাথে আরও একটি আকর্ষণীয় বিষয়, বেদের কিন্তু আরও দুটি নাম আছে- যেমন 'আগম' (যার অর্থ যা ঐতিহ্য রূপে আমাদের কাছে এসেছে) ও 'নিগম' (যা জীবনের মূল সমস্যাগুলির স্পষ্ট ও নিশ্চিত সমাধান নির্দেশ করে)। শুধু তাই নয়, এই চারটি বেদের প্রতিটি আবার চারটি করে বিভক্ত যথা- ১. সংহিতা বা মন্ত্রভাগ ২. ব্রাহ্মণ ৩. আরণ্যক এবং ৪. উপনিষদ। এই উপনিষদ, গীতা ও ব্রহ্মসূত্র নিয়ে গঠিত হয় প্রস্থানত্রয়। বিশেষভাবে জ্ঞাতব্য, হিন্দুদের প্রধান সম্প্রদায়ের বিভক্তি এই প্রস্থানত্রয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল অতীতে।

    প্রসঙ্গত, উপনিষদ হলো বেদের শেষ ভাগ, তাই এর অপর নাম 'বেদান্ত', তবে অন্য মতে এটিকে বেদের সারাংশ বলে মনে করার কারণে অনেক এর অপর নাম 'বেদান্ত' বলে অভিহিত করে থাকেন। আদি পর্বে "আদিশঙ্কর" দশটি উপনিষদের নাম উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে "রামানুজ" আরও দুটি নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। পরে যদিও আরোও চারটি বৈদিক উপনিষদের উল্লেখ পাওয়া যা "আদিশঙ্করের" রচনায়। যথা- জাবাল, কৈবল্য, মহানারায়ণ ও বজ্রসূচিকা।

    বস্তুত, এরপরে যে নামটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ তা হলো শ্রীমদ্ভাগবদগীতা বা গীতা, যা হিন্দুমহাকাব্য মহাভারতের একটি অংশ, যাকে শুধু উপনিষদের সার বলে মনে করা হয়, তাই নয় এটিকে উপনিষদ শ্রুতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেও মনে করা হয়ে থাকে। এর প্রামাণিকতা বেদের সমতুল্য হওয়ায়, এই গীতাকে প্রস্থানত্রয় বা তিনটি প্রামাণিক শাস্ত্রগ্রন্থের একটি অংশ বলে মনে করা হয়েছে। তবে গীতার মূল বক্তব্যটি "স্বামী হর্ষানন্দের" ভাষায় সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে তিনি বলেছেন-

"সকলকে নির্ভীক হয়ে নিঃস্বার্থ ত্যাগের ভাবে আপন আপন কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে- তা সে কর্তব্য যতই কেন কঠিন বা অপ্রীতিকর হোক- এই হলো গীতার মর্মবাণী।"

যা থেকে স্পষ্ট বৈদিক সাহিত্য শুধু সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট নয়, যেখানে গভীরভাবে বর্ণিত হয়েছে ধার্মিক নীতি ও সামাজিক এবং ধার্মিক মনস্তাত্ত্বিকতা।

   সর্বশেষে, এত দীর্ঘ আলোচনার পরে "ব্রহ্মসূত্র" নামটি না উল্লেখ করলে বোধ হয় কোথাও কিছু একটা অপূর্ণ থেকে যায় বলে আমার ধারণা। কেননা, উপনিষদ গীতা এর প্রসঙ্গ এলে ব্রহ্মসূত্রের নাম আসতে বাধ্য। যদিও এটিকে উপনিষদ তথা বেদের অংশ হিসাবে ধরা না হলেও নিঃসন্দেহে বলা যায়- এইটি উপনিষদের সামগ্রিক ব্যাখ্যা মাত্র। তবে "ঋষি বাদরায়ণের" এই আলোচ্য বইয়ের প্রধান বিষয়ই হলো পরমব্রহ্মের সাথে মানুষ ও জগতের সম্পর্ক। তাই, যার থেকে সম্পূর্ণ স্পষ্ট-  মানুষ, বস্তু ও ব্রহ্মা অভিন্ন, এরা সবাই পঞ্চভূতেরই অংশ। যা থেকে যেমন নির্মিত হয়েছে কর্তব্য প্রসঙ্গ, সামাজিক ঐক্য, তেমনই স্বচ্ছ হয়েছে জগৎ ও মানুষ মধ্যবর্তী চিরন্তন এক অবিচ্ছেদ্য সূত্র। (ক্রমশ....)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments