জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল-২৮/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল
পর্ব---২৮

সন্দীপ কাঞ্জিলাল

বুদ্ধিজীবী ও জিনিয়াস 

মধ্যযুগে সামন্ততন্ত্রের গর্ভ থেকে ধনতন্ত্র যখন প্রথম ভূমিষ্ঠ হয়, যন্ত্রযুগ ও বৈজ্ঞানিক যুগের তখনই আবির্ভাব হয়। সে সময় বুদ্ধি ও যুক্তির মিশ্রণে জ্ঞানের রুদ্ধদ্বার খুলে গেল। তখন ঘড়ি ছাপাখানা, কামান বারুদ প্রভৃতি এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করলো, আর এ সময় নতুন খেতমজুর শ্রেণি, জমিদার শ্রেণি, শ্রমিকশ্রেণি ও উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে নতুন এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির উদ্ভব ঘটলো। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বিদ্যাবুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে গ্রেটেন সাহেব বলেছেন, "সমাজের এই শ্রেণিকে আমরা মধ্যশ্রেণী বলতে পারি। মুদ্রাই যাদের জীবনের প্রধান নিয়ামক এবং মুদ্রাই যাদের জীবনের প্রাথমিক উপাদান। শিক্ষিত চাকুরীজীবি এবং অন্যান্য যারা বুদ্ধি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের জীবনের সঙ্গে মুদ্রার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, অর্থই তাদের মূলমন্ত্র। যাদের কাছে তখন ন্যায় অন্যায়, প্রভাব প্রতিপত্তি বিচারের একমাত্র মানদণ্ড মুদ্রা। যাদের ধ্যান জ্ঞান হল অর্থ। এরা হচ্ছে তাই মধ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।" আজকাল যাদের আমরা বুদ্ধিজীবী বলতে অভ্যস্ত, রাশিয়ার উনিশ শতকের ষাটের দশকে প্রথম intelligentsia শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তখন রাশিয়ার একটি গোষ্ঠী, তাদের নিজেদের বিদ্বৎ সমাজকে বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহার করেন। বিপ্লব, নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদে বিশ্বাস করে তাঁরা নিজেদের একটি পৃথক ও প্রভাবশালী বৌদ্ধিক জনগোষ্ঠী মনে করতেন। তাদের এই স্বাতন্ত্র্যসূচক আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি Nikolay Chemyshevsky-র কাল্পনিক উপন্যাস Chtodelat (১৮৬৩) দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়। উপন্যাসটির শিরোনামের অর্থ 'কি করণীয়?'। এটি পড়ে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ঘোষণা করেন যে, সমাজতন্ত্রের প্রচারে সাহিত্য একটি কৌশল হওয়া উচিত। 

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার ক্ষমতার দখলকারী লেনিন ও স্টালিনসহ বিখ্যাত বলশেভিক নেতাদের অনেকেই এই সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। অন্যদিকে টলস্টয়, দস্তয়েভস্কি এবং চেখভের মতো রাশিয়ার সবচেয়ে খ্যাতিমান লেখকদের অধিকাংশই 'বৌদ্ধিক অসহিষ্ণুতা, অতিশয় তত্ত্বপ্রিয়তা এবং বিপ্লবের পক্ষে উপযোগিতা বিচারে নৈতিকতাকে মূল্যায়ন' করার কারণে এই বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের নিন্দা করতেন। 
এরপর থেকে intelligentsia শব্দটি অত্যুগ্র ধর্মনিরপেক্ষ, প্রকৃতপক্ষে ধর্মবিরোধী এবং সমাজদর্শনের জন্ম দেয়। তবে উনিশ শতকের রাশিয়া থেকে শব্দটি যখন ইংরেজি ভাষায় প্রচলিত হয় তখন তার অর্থের বিস্তার ঘটে। Oxford English Dictionary শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবেঃ "The class consisting of the education portion of the population and regarded as capable of forming public opinion." (এমন একটি সম্প্রদায় যা জনসংখ্যার শিক্ষিত অংশ দ্বারা গঠিত এবং যারা জনমত সৃষ্টিতে সক্ষম।) শব্দটির এই আধুনিক ব্যাখ্যায়  টলস্টয় এবং Chemyshekvsky উভয়কেই একটি বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কার্ল মার্কসের তত্ত্ব এবং গোষ্ঠীভিত্তিক যে শ্রেণি বিশ্লেষণ তা সম্ভবত বুর্জোয়ার সঙ্গে এই intelligentsia কে এক করে দিয়েছে। 
বর্তমানে intelligentsia শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হয় সাধারণত সমাজের সর্বোচ্চ বিদ্বান ও সর্বাপেক্ষা স্পষ্টবাদী গোষ্ঠীকে বোঝাতে, যাদেরকে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায়ই 'বাচাল শ্রেণি' (chattering class) বলে আখ্যায়িত করা হয়। এরা ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মীয় উভয় ঐতিহ্যকেই গ্রহণ করেছেন। মনে করা হয় যে, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় স্বসমাজের জনমত, রাজনীতি ও মূল্যবোধকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। এদের এই প্রভাবশক্তির জন্য আন্তোনিও গ্রামসি সমাজ বিপ্লবের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের অস্তিত্বকে অপরিহার্য বলে মনে করেন। তবে এ সম্প্রদায়ের সকলেই যে ব্যক্তিগতভাবে এরূপ প্রভাব খাটাতে সক্ষম তা নয়। 
তাহলে এদের আমরা কি "বুদ্ধিজীবী" বলবো? না "জিনিয়াস" বলবো? আমার মনে হয় বুদ্ধিজীবী ও জিনিয়াস এক কথা নয়। বুদ্ধিজীবীর থাকে মেধা (Talent) আবার জিনিসয়াসেরও থাকে (Talent)। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে Talent এর অর্থ Genius নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। Talented ব্যক্তি বুদ্ধিমত্তায় চৌকস, সর্বত্রই সে তার পরিচয় রাখেন। স্কুল কলেজ University-তে সর্বত্র পুরোভাগে স্থান অধিকার করেন। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় রেকর্ড মার্ক্স কব্জা করেন। যে কোন প্রশ্ন ধাঁধার উত্তর চটজলদি বলে দেন। চটপটে তুখোড়, যাদের আলগা বা এলেবেলে ভাব নেই- আচরণ কথাবার্তায়। এই মেধাবী বা Talented ব্যক্তি প্রচলিত সকল বিধি ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে তার উপর নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ সহজেই সর্বত্র করতে পারেন। তিনি সচেতনভাবে জানেন, সকলের কাছে তাঁর বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ও পরিচয় রেখে কিভাবে তিনি সফল হবেন। সাফল্যের প্রয়োজনে, তিনি সামঞ্জস্য ও সমঝোতা করে নেন; সকল অবস্থা পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। Talented মানুষ তাঁর শক্তির একটা মোটা অংশ নিয়ে কাজ করে থাকেন। তিনি এই অভ্যাসগত কারণে, সেই মেধা শক্তির দাস হয়ে পড়েন এবং এই সচেতনতা সারা জীবন মুন্সিয়ানার সঙ্গে রক্ষা করে, জীবনে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন। সাফল্য অর্জনই তার পরম লক্ষ্য, সেজন্য যে কোনও কৌশল অবলম্বন করতে তার না থাকে দ্বিধা, না থাকে দ্বন্দ্ব। কারণ, তার বুদ্ধিশক্তির প্রয়োগ কৌশল থেকে কখনোই বিরত হতে চান না, সাফল্যই তার ঈস্পিত, ইষ্ট তথা ঈশ্বর স্বরূপ। বুদ্ধিসম্পন্ন ক্ষুরধার কোন মানুষকে জীবনে অসফল, অনুন্নত থাকার দৃষ্টান্ত বাস্তবে বিরল বললে অত্যুক্তি হয় না। 
অপরপক্ষে, প্রতিভাবান ব্যক্তি বা Genius এর জীবন চলে জয় পরাজয়ের মিলিত স্রোতে, তবু পরাজয়ে সে প্রতিহত হতে জানেন না। প্রতিকূল পরিস্থিতি জেনেও তার সঙ্গে আপস করতে পারেন না। আপন চিন্তা-চেতনা, তার আদর্শ তথা ধ্যান-ধারণা কাটছাট করে প্রচলিত বিধিব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেও অপারগ। প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি কোন বিষয়ে সত্যের সন্ধান পেলে তাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য, কিংবা নতুন কিছু সৃষ্টি করার প্রেরণা পেলে, সেই সৃজনশীল কর্মে তার সামগ্রিক চেতনা নিয়ে তিনি ছুটে চলেন তার পথে। সমস্ত রকম বাধাবিপত্তি তুচ্ছ করে, আপসহীন গতিতে। জিনিয়াসের সমগ্র শক্তি সংহত (convergent) করে, সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। নতুন সৃষ্টিই তাঁর আদর্শ এবং একমাত্র ধ্যান। এক্ষেত্রে কে তাকে তিরস্কার করল বা কে প্রশংসা করে পুরষ্কার দিল; সেদিকে তার তাকানোর অবকাশ থাকে না। কোন বাধানিষেধ বা চোখ রাঙানি তাকে আপসের হাত ধরতে বাধ্য করতে পারে না। কোন ব্যর্থতাই তাকে দমাতে পারে না। 
আপসহীন অজানা সন্ধানের তীব্র আকর্ষণ থেকে, creative pulse তাকে সর্বক্ষণ উজ্জীবিত করে রাখে; বাধাবিপত্তি এলে বরং আরও শক্তি সংহত করে সুতীব্র বেগে এগিয়ে চলার প্রেরণা পায় সে। কারণ, জিনিয়াস শক্তির দাস নয়, সে তাঁর শক্তির পরিচালক। 

প্রকৃতপক্ষে জিনিয়াস অসাধারণ শক্তি নিয়ে জন্মায়, সে মানুষকে নতুন সত্যের দিশা দিতে অগ্রগামী। 
নতুন সত্যের আলোকে তার ধ্যান ধারণায় আলোকিত করতে চায়। সে নিজে যা অনুধাবন করে, যে সত্যের আলো দেখে, তাই প্রচলিত সত্য বোধ ও বিশ্বাসের বাইরে বেরিয়ে এসে নির্মম আগ্রহে তা প্রকাশ ও প্রমাণ করতে এতটুকু দ্বিধা করে না। সে ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার সকল বিদ্যা ও জ্ঞান নিজস্ব মননে জারিত করে; নিষিক্ত করে নতুন সত্যের প্রতিমা। নতুন সত্যের তত্ত্বকে নতুন আলোকে উদ্ভাসিত করে দিতে চায়। সকল মানুষকে, তার সমাজ সভ্যতা তথা আগামীকালের ভবিষ্যতকেও আত্মবিশ্বাসের বলে প্রচলিত রীতিনীতির বাঁধ ভেঙে এগিয়ে চলে বেপরোয়া ভাবে। সম্ভবত, এই কারণেই বিদগ্ধ পণ্ডিতগণ বলে থাকেন- Genius is restlessly logical. এই বেপরোয়া হওয়ার কারণ কী, তা খতিয়ে দেখা যাক। 
Genius এর Strength থাকে তার Positive thinking তথা positive attitude এর মধ্যে। তার potential faculty সম্বন্ধে সচেতনতা, তাকে গড়ে তোলে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী। সে স্বভাবতই জানে তার মধ্যে কতটা faculty রয়েছে; নতুন কোন ভাব আদর্শ নির্মাণের জন্য বা মৌলিক নতুন কোন কিছু সৃষ্টির জন্য। Genius আত্মভোলা নয়, সে তার Superiority সম্পর্কে প্রখরভাবে সচেতন। সে জানে সৃষ্টির ক্ষমতা বা আবিষ্কারের প্রভাব কতখানি কার্যকরী হতে পারে; বৃহত্তর মানুষের কাছে। তার এই ক্ষমতাকে সমকালের প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত, বিদ্বান কী বুদ্ধিজীবী বা বৈজ্ঞানিক যদি স্বীকার নাও করেন তবু তার কিছুই আসে যায় না। কারণ, সে নতুনের পিয়াসি, এবং সে জানে তার প্রভাব কত সুদূর প্রসারী হওয়ার সম্ভাবনা বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎকাল পর্যন্ত।  প্রচলিত ধারণা ও বিধিব্যবস্থায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সফল না হলেও, ভবিষ্যতের মানুষ যে তার আবিষ্কৃত সত্যকে গ্রহণ করবে নিশ্চিতভাবে, এই ধারণা তার মধ্যে দুরন্তভাবে স্পষ্ট। অথচ অনেক অগ্রগামী সত্যের আলোকে সব যুগেই মানুষ তার সাধারণ জ্ঞানের অভিজ্ঞতায়, পারস্পরিকতার প্রচলিত সত্যের সঙ্গে মেলাতে পারে না এবং সমর্থনও করতে পারে না। সমাজের বৃহৎ জনগণের অজ্ঞতার জন্যই genius উদ্ধত হয়ে ওঠে তার নিজ শক্তির স্বচ্ছ ধারণায়। তখন মানুষের জমাট অজ্ঞতার বিরুদ্ধে সে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উত্তোলনেও দ্বিধা বোধ করে না। সেজন্য যে কোন পরিণামকে সে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে, এমনকী ব্যর্থ জীবনকেও আলিঙ্গন করে নেয়। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের একটি উক্তি এই সত্যেরই প্রতিধ্বনি করে- "আমি সত্যের জন্য সব কিছু ছাড়তে পারি, কিন্তু কোন কিছুর জন্যই সত্যকে ছাড়তে পারি না।" একই আত্মশক্তিতে গান্ধীজি বলেছিলেন,- "সত্য ছাড়া আমি অন্য কোন ঈশ্বরের সেবা করি না।" মানুষের জীবনে, সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় অহিংসার সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আজীবন প্রয়াস চালিয়েছেন গান্ধীজি। স্বামী বিবেকানন্দ, বেদ, উপনিষদ, গীতা প্রভৃতি শাস্ত্র গ্রন্থকে আন্তরিকভাবে মর্যাদা দিয়েও প্রকৃত ধর্মকে এবং প্রকৃত ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন সাক্ষাৎ মানুষের মধ্যেই। উচ্চ থেকে নীচ সকলের মধ্যেই একই ঈশ্বরের সত্তাকে ভ্রাতৃবোধে উন্মুক্ত করবার জন্য অকুতোভয় আহ্বান জানিয়েছিলেন, "বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। একই সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ঘোষণা করেছিলেন, "Man making is my mission."  
সমকালে যে সত্য অজানিত বা অনাবিষ্কৃত রয়েছে তাকে সহজে, বিনা দ্বন্দ্বে কী বিনা বাধায় জনস্বীকৃত করা কখনোই সহজলভ্য নয়। কিন্তু ঐ দ্বন্দ্ব বাধা বিপত্তিতে 'ট্যালেন্ট' হয়ে ওঠে বীতশ্রদ্ধ ও হতাশ। বিপরীতে, 'জিনিয়াস' যত দ্বন্দ্ব ও বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হয়, তাকে অতিক্রম করবার জন্য আরও শক্তি সম্পন্ন ও সংহত করে বিরুদ্ধ শক্তিকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে দুর্নিবার, অসীম ধৈর্য সহকারে। মৌলিক সত্যের শেষ বিন্দুতে তথা ভরকেন্দ্রে পৌঁছান অবধি। পরিণামে, সাফল্য এল, কী ব্যর্থতা কিংবা পরাজয় তার জন্য বিচলিত হন না,  সেই উদ্দেশ্যে প্রাণিত genius গণ। ইতিহাসে তার উদাহরণ কম নেই। ফ্রয়েড তার সকল ব্যর্থতাকে উপেক্ষা করে অসীম ধৈর্যে আসীন থেকে দীর্ঘ কুড়ি বছর যাবৎ নিজ গবেষণার লক্ষ্যে অটল ছিলেন; 'তার ক্রিয়েটিভ পালস্' নিরন্তর জাগ্রত রেখে যুগান্তকারী সৃষ্টির পথে পৌঁছে গিয়ে মনোবিজ্ঞান আবিষ্কারের জনক হয়েছিলেন। জিয়োর্দানো ব্রুনো ষোড়শ শতাব্দীর দার্শনিক, মনোবিজ্ঞান আবিষ্কারের জনক হয়েছিলেন। জিয়োর্দানো ব্রুনো ষোড়শ শতাব্দীর দার্শনিক, তার দর্শনমতে- ঈশ্বর তার সৃষ্টির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং তাঁর প্রত্যেক অংশ ঈশ্বর কর্তৃক  সঞ্জীবিত। তিনি মত পোষণ করতেন- তাঁর বিশ্বে অনেক নিত্য খণ্ডে তাঁরই সত্তা আছে, মানুষের আত্মা তাদের অন্যতম। তাদের প্রত্যেকেই মনাড (monad) রুপে পরিকল্পিত। ঈশ্বর বৃহত্তম 'মনাড'। তাঁর চিন্তা খ্রিস্ট ধর্মবিরোধী হওয়ায় তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এই পরিণামকে মেনে নিতে দ্বিধা করেননি। কারণ, genius কখনো প্রচলিত বিধিব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে পরোয়া করে না, বরং বিদ্রোহ করে মৃত্যুবরণ শ্রেয় মনে করেন। স্পিনোজার দর্শন ও ছিল সর্বেশ্বরবাদের ঘনিষ্ঠ। তিনি বিশ্বের মৌলিক সত্য substance হিসাবে ঈশ্বরকে কল্পনা করেছেন। 

ঈশ্বরের নানা সম্ভাব্য গুণের মধ্যে দুটি গুণ atribute আছে এবং এই দুই গুণের অসংখ্য বিকার modes আছে। ঈশ্বরের একটি গুণ ব্যাপ্তি ও অন্যটি চেতনা। তিনি মাত্র ২৩ বছর বয়স থেকেই ইহুদি ধর্মের মূল তত্ত্ব ও আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেন। প্রচলিত ধর্মবিরোধী মত প্রকাশের জন্য তার জীবনে নিদারুণ বিপর্যয় নেমে আসে। এতৎসত্ত্বেও তিনি তাঁর স্বাধীন চিন্তা থেকে বিরত হননি। তার পরিণামস্বরূপ একাকী নির্বাসনে গিয়ে নিদারুণ দুর্ভোগে যক্ষাক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৫ বছর বয়সে মৃতু্বরণ করেন। প্রাচীন গ্রীসের সক্রেটিস (খ্রিঃ পূঃ ৫০০) দার্শনিক বিচারে প্রচলিত আইন কানুনকে সামাজিক জীবনধারাকে যুক্তিসিদ্ধ ন্যায় বোধের মান সঙ্গত করে তুলতে চেয়েছিলেন এবং পৌরাণিক ধারণার দেবদেবীর সম্পর্কে পুরাতন ধারণার নিরসন করে তাদের মানবিক দোষগুণের ঊর্ধ্বে তুলে বিশুদ্ধ ঐশ্বরিক মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর মতাদর্শ ছিল মানব জাতির সুখ বিধানই সামাজিক এবং রাজনৈতিক কার্যের মূল মন্ত্র। তিনিই প্রথম বৈজ্ঞানিক নীতিধর্মের ভিত্তির স্থাপনক। সক্রেটিস এর মতাদর্শে- মানুষ বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন জীব।কী সত্য, কী অসত্য তা মানুষের সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার দ্বারা নির্ণীত হবে।যা সত্য তা সমাজের সকলের উপর সমানভাবে প্রযোজ্য। আত্মানুশীলনের দ্বারা যে ব্যক্তি সত্য উপলব্ধি করেছে,সে চিন্তায় ও কর্মে সর্বদা সত্যের দ্বারা পরিচালিত হবে।।নিগ্রহ নিপীড়ন, এমনকি মৃত্যু ভয়ও তাঁকে বিচলিত করতে পারবে না। সক্রেটিসের সময় প্রাচীন গ্রীসের সমাজে এক কালো অন্ধকার নেমে আসে।সেই অন্যায়ের সঙ্গে সক্রেটিস দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে লড়াই করেছেন। সত্য ও বুদ্ধির প্রতিষ্ঠার লড়াইকে, তখনকার রক্ষণশীল সমাজ মেনে নিতে পারেনি।তাঁকে বিচারের নামে প্রহসনের আসর বসিয়ে,হেমলক বিষ খাইয়ে হত্যা করেছিল।কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়েছে তাঁর চিন্তাধারা সঠিক ছিল, তা সবার জানা। 

মৌলিক সত্য আবিস্কারের দৃঢ়তা জিনিয়াসের এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। আর talent বা বুদ্ধি প্রচলিত নিয়মনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিশেষ সুযোগ সুবিধা ও তার মূল্য আদায় করে সুখী। সে সংগ্রামী নয়, সে সাধারণের থেকে দক্ষ ও কৌশলী মাত্র। সাধারণের চেয়ে উন্নত ও সফল ব্যক্তি মাত্র। সে প্রথাগত সত্যের প্রয়োগ ও প্রকাশ করে  সাফল্যের মুকুট পরে বিশিষ্ট হয়ে উঠে। সাধারণের চেয়ে বিশিষ্ট হয়ে ওঠার বৈশিষ্ট্যে সে উজ্জ্বল। আর জিনিয়াস হল অসাধারণ। তার সত্য অজানা ও অসীম। তার কর্ম বিপ্লবাত্মক। যেখানে talent এর কর্ম রক্ষণাত্মক, সেখানে জিনিয়াসের কাজ হলো মৌলিক সত্যের আবিষ্কার। (ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments