জ্বলদর্চি

ধারাবাহিক-প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান-৯/অনিন্দ্যসুন্দর পাল

প্রাচীন ভারত, ইতিহাস ও বিজ্ঞান
(Ancient India, History & Science)
নবম পর্ব

অনিন্দ্যসুন্দর পাল
অলংকরণ- শ্রেয়সী ভট্টাচার্য্য

"ঐতিহাসিক উৎস, প্রকারভেদ ও ধারণা-৬"

(গত পর্বের পর)
বৈদিক সাহিত্য যেখানে শেষ হয় সেখান থেকেই বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যের শুরু হয় এটা ধরে নেওয়া হয়ে থাকে। তাই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য অপেক্ষাকৃত অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে বৌদ্ধ ও জৈন উভয় সাহিত্যেই ষোড়শমহাজনপদের উল্লেখ থাকলেও বৌদ্ধ সাহিত্যকেই সর্বাধিক সমাজ-সচেতন বলে ধারণা করা হয়েছে। বলে রাখা ভালো বৌদ্ধ চিন্তাধারা বৌদ্ধ উপাদান এবং বৌদ্ধ প্রচার ও প্রসার শুধু সংস্কৃত সাহিত্যে আবদ্ধ না, সমগ্র সংস্কৃত মহাকাব্য নাটিসহিত্য ও কথা সাহিত্যেও যথেষ্ট উন্মাদনার বিষয়। তবে এই মুহূর্তে আমি এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় আসব, পরবর্তীতে সুযোগ পেলে অবশ্যই আসব। এমন কয়েকটি বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সম্বন্ধে কিছু বলে নেওয়া যাক।

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। তবে, প্রাশ্চাত্য গবেষকদের নিকট "শাস্ত্র"(Scripture) ও "অনুশাসনিক"(Colonial) এই শব্দদুটির ব্যবহার অধিক থাকলেও কেউ কেউ এই বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্ত্রগুলোকে পুনরায় তিনটি শ্রেণীতে (আনুশাসনিক, বাণিজ্যিক ই ছদ্ম-আনুশাসনিক) বিভক্ত করেছেন। এছাড়াও, আবার কেউ কেউ এইটিকে দুই শ্রেণীতেও বিভক্ত করেছেন, যথা- এক, বুদ্ধবচন ও দুই-অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ। প্রঙ্গত, এইমুহূর্তে বুদ্ধবচন একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয়, তাই বোধ করি এই বুদ্ধবচনের ব্যাপারে কিছু কিছু বিষয়ে অবগত হওয়া একটু প্রয়োজন। যেমন- "মহাসাংঘিক" ও "মুলসর্বাস্তিবাদ"এই দুইটিকেই বুদ্ধবচন হিসেবেই ধরা হয়। এছাড়াও থেরবাদী বৌদ্ধধর্মে "ত্রিপিটক" একপ্রকার প্রামাণ্য বুদ্ধবচনের নিরিখেই পড়ে, এরসহিত "তাইশো ত্রিপিটক", শিঙ্গন বৌদ্ধধর্মের "একযান" সূত্র ও "বজ্রযান" সূত্র যা যথাক্রমে সম্ভোঘকায়া ও ধর্মকায়া নামে অভিহিত এবং তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের "কাংয়ুরে" সবকটিই বুদ্ধবচনের এক একটি ধারা।
বস্তুত, বিনয় সাহিত্য যেমন সন্ন্যাস প্রথার প্রাথমিক ধারণা দেয়, তেমনই এর সাথে "প্রতিমোক্ষ" যাকে বিনয় সাহিত্যের একপ্রকার আঙ্গিক হিসাবে ধরা হয়। এছাড়াও পালি ভাষায় রচিত "থেরবাদ", সংস্কৃতে রচিত মূল-সর্বাস্তিবাদ এবং ভারতীয় ভাষায় রচিত মহীশাসিকা ও ধর্মগুপ্ত যা থেকে মতবাদের ব্যাখ্যা, জীবনী, আচার-অনুষ্ঠানের পদ্ধতি ও কিছু কিছু জাতক কাহিনীর বর্ননা পাওয়া যায়।

তবে, সূত্র (পালি: “সুত্ত”) প্রধানত বুদ্ধ বা তাঁর কোনো ঘনিষ্ঠ শিষ্যের কথোপকথন হিসাবে মনে করা হলেও এগুলির সবকটিকেই বুদ্ধবচন হিসেবে ধরা যেতেই পারে কারণ বুদ্ধবচনের সংজ্ঞা অনুযায়ী এগুলোকে বুদ্ধ কথোপকথনের ধারা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও এগুলি ঠিক তাঁর দ্বারা কহিত নয় কিন্ত। তবে এখানে বুদ্ধের কথোপকথনগুলিকে পর্যায়ভিত্তিতে ক্রমিক আকারে বিন্যাস করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে নয়টি প্রকৃত বুদ্ধবচন। পরবর্তীকালে বারোটিকে প্রকৃত বুদ্ধবচন বলে ধরা হয়েছে। সংস্কৃত রূপগুলি হল:

যথা:-
সূত্র: (গদ্য কথোপকথন, বিশেষত ক্ষুদ্রাকার ঘোষণামূলক কথোপকথন)
গেয়: (মিশ্র গদ্য ও কাব্যিক কথোপকথন। সংযুক্ত নিকায়ের সগাথাবগ্‌গ সঙ্গে তুল্য)
ব্যাকরণ: (ব্যাখ্যা। প্রশ্নোত্তরের আকারে কথোপকথন)
গাথা: (কাব্য)
উদান: (অনুপ্রাণিত বক্তৃতা)
ইত্যুক্ত: (‘ভগবান এই বলেছেন’ বলে শুরু গ্রন্থ।
জাতক: পূর্বজন্মের কাহিনি)
অভুতধর্ম: (অতিলৌকিক ঘটনাবলির প্রসঙ্গ)
বৈপুল্য: (‘বিস্তারিত কথোপকথন’, ‘যা আনন্দপ্রদ’।
নিদান: (অবস্থা অনুসারে প্রদত্ত শিক্ষা)
অবদান: (ধর্মবিকাশের কাহিনি)
উপদেশ: (নির্দেশাবলি)
সবকটি প্রাপ্ত আগমে প্রথম নয়টি পাওয়া যায়। অন্য তিনটি যুক্ত হয়েছে অন্যান্য সূত্র থেকে। থেরবাদে এগুলি শুধু সুত্ত নয়, বরং সামগ্রিক শাস্ত্র হিসেবেই গৃহীত হয়।

এছাড়াও, মহাযান ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে প্রজ্ঞাপারমিতার গ্রন্থাবলী, সদ্ধর্ম-পুন্ডুরীক, পুণ্যভূমি সূত্র, বিমলকীর্তি নির্দেশসূত্র, সামধ্যসূত্র,অবতংসক সূত্র, তৃতীয় আবর্তন সূত্রাবলি, দেহান্তর সূত্রাবলী, এবং সংকলিত সূত্রাবলী, ইত্যাদি যা বুদ্ধবচনের অন্যতম প্রধান প্রধান ধারা। শুধু তাই নয়, এই বুদ্ধবচন ব্যতীত কিছু ধর্মগ্রন্থও বেশ উল্লেখযোগ্য যেমন-

নাগার্জুন রচিত মূলমধ্যমিককারিকা হল মধ্যমিক দর্শনের একটি প্রভাবশালী গ্রন্থ। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র গ্রন্থের বিষয়বস্তুর মিল আছে। নবম শতাব্দীর ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত শান্তিদেব দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন: বোধিচর্যাবতার গ্রন্থটি মহাযান মতের বিভিন্ন উপসম্প্রদায়ের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। শান্তিদেবের অপর গ্রন্থশিক্ষাসমুচ্চয়  মহাযান সূত্রের বিশাল গ্রন্থাবলি থেকে নির্বাচিত মতবাদের সংক্ষিপ্তসার। কথিত আছে, মহাযান যোগাচার উপসম্প্রদায়ের অসঙ্গ তুষিত স্বর্গে সরাসরি বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়ের কাছ থেকে অনেকগুলি গ্রন্থ পেয়েছিলেন যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মধান্তবিভাগ, মহাযানসূত্রালঙ্কার, অভিসময়ালঙ্কার ইত্যাদি, এছাড়াও তিনি স্বয়ং রচনা করেন মহাযানসংগ্রহ, অভিধর্মসমুচ্চয় (অভিধর্ম ধারণার সারসংক্ষেপ) এবং যোগাচারভূমি (যদিও এটির রচয়িতা একাধিক ব্যক্তি , এটাই ধরে নেওয়া হয়)। অসঙ্গের ভ্রাতা বসুবন্ধু যোগাচার মতের সঙ্গে যুক্ত অনেকগুলি বই রচনা করেছিলেন।যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ত্রিবভাবনির্দেশ, বিংশটিকা, ত্রিংশটিকা ও অভিধর্মকোষভাষ্য। বৌদ্ধ ন্যায় ধারার এক উপসম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত দিগনাগপরিণামসমুচ্চয় নামে একটি বই লেখেন, এটিকে পরবর্তীতে ধর্মকীর্তি একটি টিকায় রূপান্তরিত করেন, তাই নাকি "পরিণামবার্তিকা" নামে পরিচিত হয়। সর্বশেষে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে- অশ্বঘোষের মহাযান শ্রদ্ধোৎপাদ শাস্ত্র পূর্ব এশীয় বৌদ্ধধর্মে (বিশেষত চীনা হুয়া আন সম্প্রদায় এবং এর জাপানি রূপ কেগনে) বিশেষ প্রভাবশালী যার উপর নির্ভর করে তিনি একাধিক বিখ্যাত নাটকও রচনা করেছিলেন বলে সূত্রের খবর।
( ক্রমশ)

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 
উপনিষদ হলো বেদের শেষ ভাগ, তাই এর অপর নাম 'বেদান্ত', তবে অন্য মতে এটিকে বেদের সারাংশ বলে মনে করার কারণে অনেকে এর অপর নাম 'বেদান্ত' বলে অভিহিত করে থাকেন।

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সমৃদ্ধ পত্রিকা জ্বলদর্চি। ঋদ্ধ হই পড়ে

    ReplyDelete