জ্বলদর্চি

বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্কপর্ব ৬/অসীম ভুঁইয়া


Bengali grammar and debate
বাংলা ব্যাকরণ ও বিতর্ক
পর্ব ৬

অসীম ভুঁইয়া

বাচ্যের বীতাধুনিক ক্যারিশ্মা

বাক্য নির্মাণের নানা বৈচিত্র্যে খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্রিয়াপদের কিছুটা পরিবর্তন ঘটে যায়।  ক্রিয়াপদের এই রূপ পরিবর্তনের মূল কারণ-  এক, বাক্যে কখনো কর্তার প্রধান হয়ে ওঠা।
দুই, কখনো কর্মপদের প্রাধান্য। তিন, ক্রিয়ার ভাব বা ঘটনার প্রধান হওয়া এবং 
চার, কর্ম, কর্তার মুখোশ পরে প্রধান হয়ে ওঠা।  
এই যে ক্রিয়াপদের রূপ বৈচিত্র্যে বাক্যের গঠন ভঙ্গিমার হেরফের; একেই প্রথাগত ব্যাকরণে বাচ্য বলা হয়।

   আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সহজ করা যাক। প্রথাগত ব্যাকরণে বাচ্যকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। 
১. কর্তৃবাচ্য - সে বাইক চালায়। 
২. কর্মবাচ্য- তার বাইক চালানো হয়। 
৩.ভাববাচ্য- তার বাইকের চলা হয়।       
এবং 
৪.কর্মকর্তৃবাচ্য- তার বাইক চলে। 
 
  প্রথমটিতে কর্তা প্রাধান্য পেয়েছে। দ্বিতীয়টিতে কর্ম, তৃতীয় বাক্যে ক্রিয়ার ভাব বা ঘটনা, এবং চতুর্থ বাক্যে কর্তার ভূমিকায় কর্ম।

   কিন্তু প্রথাগত ব্যাকরণের এই শ্রেণিটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা প্রশ্নচিহ্ন দেখা দিয়েছে। চালু ব্যাকরণে বাচ্যের শ্রেণিটি  করা হয়েছে মূলত আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে অনুসরণ করেই। বাচ্যের চারটি বিভাগের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিয়ার  রূপভেদই যে বাচ্যের মূল ভিত্তি তাও তিনি বলেছেন। সংস্কৃত- অনুসারী এই শ্রেণির সমস্যা সম্পর্কে মনীন্দ্র কুমার ঘোষই  প্রথম প্রশ্ন তোলেন। পরবর্তী সময়ে শ্রদ্ধেয় সুভাষ ভট্টাচার্য ও পবিত্র সরকারের মতো ভাষাবিশেষজ্ঞরাও তাঁকে সমর্থন করেন। মনীন্দ্র কুমার ঘোষের চিন্তাশীল আলোচনায় নবতর মাত্রা জুড়ে দিলেন ড. পবিত্র সরকার।  সব মিলিয়ে বাচ্যের চালু ধারণা ভেঙে নতুন ধারণাকেই আমরা মান্যতা দিলাম।

   এই ধারাবাহিকের মূল উদ্দেশ্য যেহেতু সহজ সরল ভাবে বিতর্কের মাধ্যমে মূল বিষয়টি তুলে ধরা, তাই খুব সহজভাবেই বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। 
 
   ভাষা স্রোতের মতোই এগিয়ে চলেছে, তাই তার শব্দ প্রয়োগ ও বাক্য গঠনেও অনেক নতুনত্ব ও স্মার্টনেস এসে গেছে। তাই বাচ্যের পুরনো ধারণা বাতিল করে আধুনিক ধারণাকেই বেশি ব্যাকরণসম্মত বলে মনে করা হচ্ছে। 

   প্রথমেই বলি, আচার্য সুনীতিকুমারের মতে ক্রিয়ার রূপভেদই  বাচ্যের মূলভিত্তি। তাই যদি হয় তাহলে এই রূপ ভেদই কি বাচ্যে কর্তা, কর্ম বা ভাবের মুখ্য হওয়ার জন্য দায়ি? নাকি কর্তা, কর্ম বা ভাবের মুখ্য হয়ে ওঠাই ক্রিয়ার রূপভেদের কারণ?  

   যাইহোক আধুনিক ভাষাশিল্পীরা চালু ব্যাকরণের চারটি বাচ্যের মধ্যে কর্মবাচ্য ও কর্মকর্তৃবাচ্য নিয়ে যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন। এই প্রশ্ন- বিষয়ক সমস্যা ও তার সমাধান করতেই আমরা ধীরে ধীরে আলোচনা এগোচ্ছি।
 
   প্রথমে কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্য প্রসঙ্গে আসি। আধুনিক বাংলায় কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের গঠনগত বৈশিষ্ট্য, ক্রিয়াবৈচিত্র্য ও অর্থবোধ কার্যত একই ধরনের। তাই কর্মবাচ্যের আলাদা করে কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন: "আমি লিখি।" - "আমার লেখা হয়।"
" আমি কবিতা লিখি" - "আমার কবিতা লেখা হয়।"
প্রথম বাক্যে কর্তৃবাচ্যকে ভাববাচ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। "আমার লেখা হয়" বাচ্যে আমার কর্তৃপদটি গৌণ। এখানে "লেখা হয়" বা" আমার লেখা হয়" এই পুরো ঘটনাটি মুখ্য হয়ে উঠেছে।  ঘটনা বা  ভাব মুখ্য হওয়ায় এটি ভাববাচ্য। 

   পরের বাক্যে আসি, 
" আমার কবিতা লেখা হয়।"
 প্রথম বাক্যে যদি "আমার লেখা হয়" ঘটনাটি প্রধান হতে পারে, তাহলে পরের বাক্যেও তো একই ধরনের ঘটনা বা ক্রিয়ার বৈচিত্র্য রয়েছে অর্থাৎ এখানেও তো বর্ণিত বিষয়ের ভাবই মুখ্য। "কবিতা" কর্মপদ একথা ঠিক, কিন্তু তার প্রাধান্য কোথায়? সেকি প্রধান বিষয় বা ক্রিয়ানিয়ন্ত্রক হতে পেরেছে?  আদৌ তা হয়নি। বরং এখানে "কবিতা লেখা হয়" এই  পুরো বিষয়টি মূল উদ্দেশ্য।  যেহেতু শুধু "কবিতাটির" প্রাধান্য নেই তাহলে একে কেন কর্মবাচ্য বলতে যাব? বরং "কবিতা লেখা হয়" এই পুরো ঘটনাটিকেই ভাব ধরে আমরা ভাববাচ্যই বলব যা "হয়" ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। 
   এভাবে আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। "এই বইটি পড়া যায় না।" "আমাকে একটা কথা দিতে হবে।"  "রোজ এটা করতে হত" প্রভৃতি।
 
   এক ধরনের পুরনো বাক্যের প্রসঙ্গ না তুললেই নয়।" আমা কর্তৃক বইটি পঠিত হল।" 
"তোমার দ্বারা নির্দেশিত হল।" সংস্কৃত -অনুসারী কৃত্রিম, আড়ষ্ঠ এই বাক্যগুলি পুরনো বাংলায় চালু থাকলেও আধুনিক মান্যভাষায় পুরোপুরি মৃত । তাই এই কষ্টকল্পিত, কৃত্রিম প্রথাগত কর্মবাচ্যগুলিকে  আধুনিক ব্যাকরণের আলোচনা থেকে চির বিদায় সংবর্ধনা দিতেই হল।

   এবার আসি কর্মকর্তৃবাচ্য ও কর্তৃবাচ্য প্রসঙ্গে। প্রথাগত ব্যাকরণে যে বাচ্যগুলোকে কর্তৃবাচ্য বলা হয়েছে এখানেও সেগুলো কর্তৃবাচ্য। সমস্যা কর্মকর্তৃবাচ্য নিয়ে। আদৌ কর্মকর্তৃবাচ্য বলে কোনো বাচ্য কি বাংলায় আছে? দেখাই যাক। তার আগে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, কর্তৃবাচ্যের কর্তা বাস্তব প্রাণী (মানুষ গরু বাঘ সিংহ ভেড়া ঘোড়া প্রভৃতি) ও কল্পিত প্রাণী (রাক্ষস দেবতা ভূত প্রেত আত্মা গাছ) দুইই হতে পারে। অথবা অপ্রাণীবাচক শব্দে প্রাণসত্ত্বা আরোপ করেও কর্তা বানানো যায়। যেমন: সুদেষ্ণা কলেজে পড়ায়।  নীল পরী ডানা মেলে উড়ে যায়। রোদ উঠেছে, ফুল ফুটেছে প্রভৃতি।

   প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। এবার কর্মকর্তৃবাচ্যের বিষয়টি আলোচনা করা যাক। কয়েকটি উদাহরণ নিলাম। টিভি চলছে। গাড়ি চলে। ফুল ফুটেছে। রোদ উঠেছে। প্রথমবাক্যটি প্রথাগতভাবে কর্মকর্তৃবাচ্য, কারণ টিভিকে কেউ চালনা করছে। টিভি তো আর নিজে নিজে চলতে পারে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে টিভি যেন নিজেই চলছে কিন্তু তা নয়। এখানে টিভি  কর্মপদ হয়ে কর্তার মতো আচরণ করায় তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধারণা আধুনিক বাংলা পেছনে ফেলে এসেছে। প্রথমত: টিভিকে যেই চালাক, "চলা" কাজটি সে নিজেও করছে, তাই বাক্য - সংগঠনের দিক থেকে চলছে ক্রিয়ার সঙ্গে টিভির সরাসরি সম্পর্ক এবং এ সম্পর্ক তিনভাবে কার্যকরী ১. টিভি এখানে উদ্দেশ্য পদ (subject)।  প্রশ্ন: কার সম্পর্কে বলা হয়েছে? উত্তর: টিভি সম্পর্কে। আর উদ্দেশ্যপদ সবসময় প্রধান হয়ে থাকে।
 ২. "চলছে" ক্রিয়াকে টিভি সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করছে তাই টিভি এখানে ক্রিয়াসম্পাদক। 
৩. কারকের দিক থেকেও টিভি কর্তৃপদ। ক্রিয়াকে "কে" দিয়ে প্রশ্ন করলে সাধারণত কর্তা পাওয়া যায়। কে চলছে? উত্তর: টিভি।
 অর্থাৎ তিন ভাবেই টিভি কর্তা হয়ে  ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই একে কর্তৃবাচ্য বলতেই হয়। দ্বিতীয়ত: টিভি তো এখানে প্রকৃত অর্থে কর্মপদই নয়, এটি একটি প্রযোজ্য কর্তা। টিভিকে যে  চালাচ্ছে সে প্রযোজক কর্তা আর টিভি যেহেতু নিজেও চলছে তাই সেও কর্তা। কারকে নিয়মেই প্রযোজ্য কর্তা।

   অতি কমন দুটি উদাহরণ নেওয়া যাক। মা শিশুকে চাঁদ দেখায় বা শিক্ষক ছাত্র পড়ান। এখানে মা ও শিক্ষক প্রযোজক কর্তা এবং শিশু ও ছাত্র যদি প্রযোজ্য কর্তা হয় তাহলে টিভি চলছে বাক্যে টিভি কেন প্রযোজ্য কর্তা হবে না?    

   আমাদের আলোচ্য টিভি চলছে বাক্যটিতে প্রযোজক কর্তা সম্ভাব্য আমি, তুমি প্রভৃতি। অর্থাৎ এই বাচ্যে কর্মপদ নেই। কর্ম না থাকলে তাকে কর্মকর্তৃবাচ্য কীভাবে বলা যাবে? তাই বাচ্যটি কর্তৃবাচ্যই।  একইভাবে বাকি উদাহরণগুলোও কর্তৃবাচ্য। 

অর্থাৎ উপরের আলোচনা থেকে মূলত দুই ধরনের বাংলা বাচ্যের জন্মান্তর হল। এক, কর্তৃবাচ্য ও দুই, ভাববাচ্য। 

   প্রসঙ্গত বলে রাখি, এদের নানা বিভাগ ও আরো বিতর্ক রয়েছে।পরে কোনোদিন আলোচনা করা যাবে। আপাতত  সাধারণ পাঠকদের কথা ভেবে সেই গভীর বিতর্কে না গিয়ে এখানেই ইতি টানছি।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments