ঘরে বসে বিশ্বদর্শন
অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
ও বৌদি, হ্যাঁ গো, রেডিয়োর থেকে বড় চৌকো কিন্তু বাক্সের সামনে কাঁচের পর্দা। সেখানে মানুষগুলো নড়েচড়ে আবার কথাও বলে। মফস্বলের বাড়ির পরিচারিকা টিভি দেখে এসে বিস্ময় প্রকাশের সাথে মায়ের কাছে গল্প জুড়ে দিয়েছে। পাড়ায় কারোর বাড়িতে টিভি থাকলে সেসময় অনেকেই ভিড় করে দেখত। তাও দুবছর হয়ে গেছে চালু হয়েছে কলকাতায় দূরদর্শনের অনুষ্ঠান।
পঞ্চাশ বছর আগে ৯ অগস্ট আমিও উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখেছি এরকমই অন্য কোনও বাড়িতে, সঠিক আর মনে নেই। তবে শুরুটা মনে গেঁথে গেছে। প্রথমে রবিশঙ্করের করা সিগনেচার টিউন আর পর্দায় দূরদর্শনের চিহ্নিত ছবি ভাসতে ভাসতে মাঝখানে এসে স্থির। সেই বাজনা যে কী মেদুরতা ছড়াত মনে যেমনটি রেডিয়োর সিগনেচার টিউন ছিল ছোটবেলার এক আশ্চর্য বাজনা। তারপর চৈতালি দাশগুপ্তের ঘোষণা দিয়ে শুরু হল। মঞ্চ আলো করে বসে আছেন অনেকে তার মধ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল ও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ছিলেন। কি অনুষ্ঠান হয়েছিল তা আর দেখিনি বা মনে নেই। এই দূরদর্শনের স্বর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে একাধিক পত্রপত্রিকায় তখনকার কর্মিদের স্মৃতিচারণ বর্ণিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এগুলোর সঙ্কলন আবশ্যক বলে মনে করি কারণ একটা যুগের পরিবর্তনের ইতিহাস রক্ষা ঐতিহ্য রক্ষার মতোই গুরুত্বপূর্ণ। টেলিভিশন ভারতের খবর ও সংস্কৃতি প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে একধাপে অনেকটা এগিয়ে গেছে। তার শুরুর ইতিকথা সংরক্ষণ জরুরি। এর সাথে দর্শকদের অভিজ্ঞতার কথা লেখা থাকাটাও জরুরি বলে মনে করি।
টেলিভিশনের আগে ছিল রেডিয়ো যেখানে খবর নাটক গান কবিতা যাত্রা কৃষিকথা সব শোনা যেত। মানুষ শুনে শুনে মনে ছবি আঁকত। সেও এক মজার ছিল। একসময় হলে সিনেমা শুরুর আগে দশ-পনেরো মিনিটের নিউজ রীল দেখাত। সারা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ খবর দেখা যেত সেই সময়টুকুর মধ্যে। এবার টেলিভিশন যখন ঘরের বসার ঘরে এসে জায়গা দখল করল তখন মানুষের ছবি দেখা আর কথা শোনার আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে গেল। তবে ঘরে ঘরে টিভি আসতে প্রায় দশক পার হয়ে গেছিল। ঘরে ঘরে টিভি আনার মূল কারণ উত্তরোত্তর আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের ডালি পরিবেশন।
প্রথমে সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়ে রাত নটা পর্যন্ত চলত। সাদাকালো ছবি দিয়েই শুরু। সেই সময়টুকু যাদের বাড়ি টিভি ছিল তারা তো বটেই পাড়ার অনেকে এসে বসে যেত। খবর পড়াটা প্রথমে অনেকটা রেডিয়োয় খবর পড়ার মত। খবরের একটা অংশ পড়া শেষ হলে তার ছবি দেখানো হত। পড়ার সময় ছবি জুড়ে দেওয়া অনেক পরে চালু হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রথমদিকে বিত্তবানদের ঘরে থেকে শোনা যেত টিভির আওয়াজ। জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে রাস্তা থেকে লোকে ছবি দেখত। সময়ের সাথে মধ্যবিত্তরাও টিভি কেনার সামর্থ অর্জন করল, কেউ ‘হায়ার পারচেজ’ বা মাসিক কিস্তিতে ধার শোধ কিংবা কেউ বোনাসের টাকা দিয়ে অথবা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা তুলেও টিভি কিনত। বিয়েতে যৌতুকে টিভির দাবিও সেসময় চালু ছিল। বাড়িতে টিভি আর ছাদে অ্যান্টেনা প্রেস্টিজ বাড়িয়ে দিত পাড়ায়। তবে ছাদে গিয়ে প্রায়ই অ্যান্টেনা এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ছবি স্পষ্ট আনার নিত্যকার প্রচেষ্টা অনেকেরই মনে আছে। পর্দায় আলো ঝিরঝির করছে নয়তো একটা লাইন কেবল উপর-নিচে দৌড়চ্ছে এসব দেখার অভিজ্ঞতা মনে রাখার মত। সেই সাথে ছাদ আর নিচের ঘরে কথোপকথনে নির্দেশ ও আদেশ পালন। এর সাথে রেডিয়োয় নব/চাকা ঘুরিয়ে বিদেশি সেন্টার ধরার সময় যে আওয়াজ শোনা যেত তার তুলনা মনে পড়ে। ঘরে বসে সিনেমা দেখার মজা যখন লোকে পেতে শুরু করেছে তখনই গৃহিনীদের টিভি কেনার দাবি শুরু হয়েছে। শনিবার আর রবিবার পর্যায়ক্রমে বাংলা ও হিন্দি ছবি দেখানো হত। সেই সাথে সাপ্তাহিক বাংলা ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ‘চিত্রমালা’ আর হিন্দি ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান ‘চিত্রহার’ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে যায়। তবে কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য টিভি প্রচারের সময় বাড়ানো হত বা নির্ধারিত সময় ছাড়াও প্রচারিত হত, যেমন মাদার টেরেসার নোবেল প্রাপ্তি অনুষ্ঠান, কলকাতায় টেস্টটিউব বেবি জন্মের অনুষ্ঠান অথবা কলকাতার মাঠে মোহনবাগানের সাথে পেলের দলের ফুটবল খেলার অনুষ্ঠান। এসব সময় দর্শকের ভিড় উপচে পড়ত ঘরে ঘরে। ভোটের সময় সারারাত নির্বাচনী ফল ঘোষণা, আলোচনা ও মাঝে নিরন্তর সিনেমা চোখ জাগিয়ে রাখার উপযুক্ত টোটকা ছিল। দর্শকদের চিঠিপত্রের উত্তর দেওয়া নিয়ে ‘দর্শকের দরবারে’ এবং সারা সপ্তাহের অনুষ্ঠান ঘোষণা নিয়ে ‘সাপ্তাহিকী’ দর্শকদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল পরিবেশনা-শৈলীর জন্য। খবর পড়ার জন্য নির্বাচিত পাঠক-পাঠিকা খুবই সাফল্যের সাথে কাজ করেছেন। তবে দেবরাজ রায় আসার পর অল্প বয়সী মহিলাদের হার্ট থ্রব হত বলেই শুনেছি।
🍂
বিভিন্ন শিল্পীদের নিয়ে লাইভ গানের অনুষ্ঠান খুব জনপ্রিয় হয় আর ছোটদের জন্যও টিভিতে প্রচার হত আকর্ষনীয় অনুষ্ঠান। খেলাধুলার অনুষ্ঠান সবসময়ই দর্শকের বাড়তি উৎসাহ থাকত। বিশ্ব টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা সরাসরি দেখানো হয়েছিল। টেলিভিশনে সাদাকালো ছবি রঙিন হল ১৯৮২ সালে এশিয়ান গেমসের সময়। রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার শুরু হয় রাত আটটায়, কলকাতার অনুষ্ঠান বন্ধ হয়। তখন অবশ্য সম্প্রচারের সময়ও বেশি হয়ে গেছিল। মনে পড়ে ‘ডিডি মেট্রো’ নামে কলকাতার দ্বিতীয় চ্যানেল শুরুর কথা। তারপর শুধু বাংলা অনুষ্ঠান। এল ‘ডিডি বাংলা’ – দূরদর্শনের নিজস্ব বাংলা চ্যানেল। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে খবরের সাথেই দেখানো হতে লাগল তার সম্পর্কিত ছবি, কখনও সরাসরি ঘটনাস্থল থেকে আবার কখনও রেকর্ডেড। যুক্ত হল শান্তিনিকেতন আর জলপাইগুড়ির অনুষ্ঠানের রেকর্ডেড প্রচার। লন টেনিস খেলাও সরাসরি দেখানো হত। ১৯৮৫, ১৯৮৬ সালে উইম্বলডনে বরিস বেকারের জয় ঘরে বসে দেখার আনন্দ ভোলার নয়। ১৯৮৬ তে বিশ্বকাপ ফুটবল রাত জেগে লোকে দেখেছে। মারাদোনার জাদু আর ‘ঈশ্বরের হাত’ দিয়ে গোলের সাক্ষীও থেকেছে বাংলা তথা ভারতের জনগণ।
অনুষ্ঠানের বৈচিত্র আনতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে কলকাতা দূরদর্শন তার সাথে সামাজিক দায়িত্ব পালনের কথাও ভোলেনি। সামঞ্জস্য রেখে অনুষ্ঠানের ছক কষা হত। পুজোর সময় মহালয়ার অনুষ্ঠান চালু হলেও রেডিয়োর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র চাহিদা আজও আছে। আসলে কিছু জিনিস কল্পনায় থাকাই ভাল। বেলুড়ের দুর্গাপুজো, দক্ষিনেশ্বরের কালীপুজো সরাসরি দেখানো শুরু হয়। বিজ্ঞানের অনুষ্ঠান ‘কোয়েস্ট’, সাধারণের জন্য ‘যুক্তি তক্কো’ দর্শকের ভাল চাহিদা ছিল। ছোটদের ‘ছুটি ছুটি’, ‘জন্মদিন’ অনুষ্ঠান আকর্ষণীয়। ‘জন্মদিন’ আজও সকালে অনুষ্ঠিত হয়। মহিলাদের ‘ঘরে বাইরে’ রুচিসম্মত পরিবেশন। এইসব অনুষ্ঠানের স্মৃতি কোনও কারণে থেকে গেছে। যেমন থেকে গেছে কিছু অবিস্মরণীয় সাক্ষাৎকার।
রঙিন হওয়ার পর দর্শকের সংখ্যা বেড়ে গেলে অনুষ্ঠানে চমক দিতে শুরু হল ‘সোপ অপরা’। ১৯৮৪ সালে শুরু হয় মধ্যবিত্ত সংসারে পারিবারিক গল্প নিয়ে সিরিয়াল ‘হামলোগ’। জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেল। বাংলার লোক হিন্দিভাষী পরিবারের সাথে নিজেকে মিলিয়ে চিনতে শিখল। এরপর দেশভাগ ও একটা পরিবারের উপর তার মানসিক, মানবিক প্রভাব নিয়ে এল ‘বুনিয়াদ’। এখানেও দেশভাগ ও নানাসময়ে বাস্তুচ্যুত বাঙালি নিজেদের আবিষ্কার করে। তবে যে দুটো অনুষ্ঠান সারা ভারতে অলিখিত কার্ফু জারি করে রাখত রবিবারে একঘন্টা দীর্ঘ সময় ধরে তা দুটো মহাকাব্য নিয়ে সিরিয়াল ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’। হিন্দি ঢুকে পড়েছিল আগেই এবারে সবশুদ্ধ নিয়ে ঘরে জাঁকিয়ে বসল আসমুদ্রহিমাচল। ‘নুক্কড়’ হিন্দি সিরিয়াল জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই তালিকায় রয়েছে ‘ভারত এক খোঁজ’, ‘তামস’, ‘চন্দ্রাকান্তা’, ‘বিক্রম বেতাল’, ‘ইয়ে যো হ্যায় জিন্দেগি’ ইত্যাদি। সত্যজিৎ রায়ের ‘সদ্গতি’ টেলিভিশনের জন্যে তৈরি ছবি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হিরের আংটি’ ও।
বাণিজ্যিকীকরণের হাত ধরে ১৯৯২ সালে দূরদর্শনের বেসরকারি চ্যানেল প্রচার শুরু হল। দুনিয়ার খবর নিয়ে এনডিটিভি প্রচার শুরু করে ‘ওয়ার্ল্ড থিস উইক’। প্রচণ্ড জনপ্রিয় হয় সঞ্চালকের উপস্থাপনার জন্য।
‘বোকা বাক্স’র সাথে আমার সরাসরি পরিচয় ১৯৬০ সালে। না, তখনও টিভি ভবিষ্যতের গর্ভে। তখন টালা পার্কে একটা বড় মেলা হত। সেবছর জ্যাঠামশায়ের সাথে গিয়েছিলাম আমরা কয় ভাইবোন। ওখানে একটা তাঁবুতে ঢুকে দেখি উঁচুতে বসানো আছে একটা সামনে কাচ লাগানো বাক্স আর সেখানে লোকের নড়াচড়া ছবি আর আওয়াজ হচ্ছে। একজন এসে আমায় বলল আমি কবিতা বলতে পারি কি না। মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানিয়ে দিলাম। আমাকে পাশের একটা ছোট তাঁবুতে নিয়ে গেল। বলল কবিতা বলতে। আমিও সুকুমার রায়ের ‘সৎপাত্র’ বলে দিলাম। একটা ক্যাডবেরি হাতে দিয়ে জ্যাঠামশায়ের কাছে দিয়ে গেল। জ্যাঠামশায় বললেন আমাকে কবিতা বলতে দেখেছেন ওই বাক্সে। পরে জেনেছি, ওটা ছিল ক্লোজড সার্কিট টেলিভিশন বা সিসিটিভি আজকাল যা ঘরেবাইরে সর্বত্র বিরাজমান। সেই প্রথম আমায় দেখা গেছিল টিভিতে। এরপর দূরদর্শনে আমার কর্মস্থল জিএসআইয়ের দেড়শো বছরে কয়েকটা ভূবিজ্ঞান ভিত্তিক অনুষ্ঠান করাই প্রচার অধিকর্তা হিসেবে। আমি নিজে সেখানে দৃশ্যমান ছিলাম না। সেসময় দূরদর্শনের ডিরেক্টর আমাকে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলে জানতে পারেন ভূবিজ্ঞান গবেষক ছাড়াও প্রতিবন্ধী আন্দোলনের সাথে আমার যোগ আছে। উনি তখন কিছু প্রোগ্রামের কথা বলেন। সেই সূত্রে ‘ডাক্তারবাবুদের জন্য’ অনুষ্ঠানে তিনটে প্রোগ্রামে ছিলাম তার মধ্যে একটায় পরিচালক হিসেবে। এছাড়া বিজ্ঞান নিয়ে দুটো অনুষ্ঠান করেছি। এ সবই এই শতকে প্রথম তিন বছরে। এরপর আমার প্রকাশিত একটা ইংরেজি নভেল নিয়ে অনুষ্ঠান করে দূরদর্শন ২০০৯ সালে ‘অপরাজিত’ প্রোগ্রামে।
দূরদর্শন সর্বদাই সামাজিক দায়িত্ব পালন করে এসেছে। বাণিজ্যিক চ্যানেলগুলোর বাইরের চাকচিক্যের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে এঁটে উঠতে পারেনি। তাদের সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় না। টিআরপি আর বিজ্ঞাপনের পেছেনে প্রতিযোগিতায় অনুষ্ঠানের মান পড়তেই থেকেছে। সস্তার বিনোদন, পারিবারিক কূটকাচালি আর খবরের নামে নানাবিধ কেলেঙ্কারির বার্তা তুলে পরস্পরের তুমুল বাকবিতণ্ডা করিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন হল তাদের উপজীব্য। কিন্তু এর বাইরেও সমাজ আছে, সংস্কার আছে, জীবন আছে সেটা বোঝার দায়িত্ব দর্শকের। দূরদর্শন সেই পথ পরিহার করে জনগণমাধ্যম হিসেবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, এটাই কাম্য।
1 Comments
খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete