Philippines Folklore / Chinmoy Das
দূর দেশের লােকগল্প- ফিলিপনস
চিন্ময় দাশ
দুটি প্রজাপতি
বেশ বড়সড় একটা সরােবর। যেমন গভীর, তেমনই টলটলে নীল তার জল। সরােবরের পাড়ে বাস করত এক বুড়ি। ভারি গরীব মানুষ। ছােটখাটো একটা কুঁড়েঘর তার। একলা মানুষ, দিন চলে যায় কোনও রকমে। অভাবী মানুষ হলে কী হবে, সব সময়েই হাসিমুখ বুড়ির। কোন অভাবেই মন ভার হয় না তার।
কুঁড়েঘরটা বাদ দিলে, আর একটাই জিনিষ ছিল বুড়ির। একটা ফুলের বাগান। ঘরের সামনে সুন্দর ছিমছাম একটা বাগান করেছিল বুড়ি। কত রঙের কত ফুল যে তাতে ফুটে থাকে সারা বছর, তার ইয়ত্বা নাই! বাহারি বাগানখানা যারাই দেখে, মন ভরে যায় সবার।
সরােবরে মাছ ধরতে আসে জেলের দল। বরাবরই তারা দেখে আসছে বুড়ির বাগানটাকে। মাছ ধরে ফেরার সময়, মাঝে মাঝে তারা আসে বুড়ির কুঁড়েঘরে। দু'টো- চারটা করে ফুল চেয়ে নিয়ে যায় বুড়ির কাছ থেকে। যাওয়ার সময় তারা মাছ দিয়ে যায় বুড়িকে। এভাবেই দিন কাটে বুড়িমানুষটির।
মাঝে মাঝে এক এক দিন চমকে যায় জেলেদের দলটা। কোন কোন দিন মাছ ধরে ফিরে আসতে, রাত নেমে যায় তাদের। সেদিন নৌকা রেখে পাড়ে নেমে দেখে, আলােয় ঝলমল করছে বুড়ির ঘরটা। বুড়ির ঘরে কোথা থেকে আসে এই আলাে! ভেবে কূল কিনারা পায় না তারা। কাদের আবার গলাও যেন শুনতে পাওয়া যায়। অথচ বুড়ি তাে একলা থাকে। উঁকি মেরে দেখেছে, বেঁটে আকারের কিছু মেয়ে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের ভিতর।
কিছু বুঝতে না পেরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে তারা। কৌতুহল চাপতে না পেরে, একবার তারা ঢুকেও ছিল বুড়ির ঘরে। কিন্তু ঐ ঢােকাই সার। কাউকেই চোখে পড়েনি। অবাক লােকগুলাে তখন বুড়িকে বলে-- "কারা কথা বলছিল, বুড়িমা ?"
বুড়ি ফোকলা মুখে হেসে বলে-- "কারা কথা বলবে, বাবাসকল ? আমার ঘরে আর আছেটা কে? তবে কিনা, কথা বলতে না পেরে মন কেমন করে তাে। তাই এই পােকা-মাকড়গুলাের সাথে একটু বকবক করি, এই আর কি।"
বাক হয়ে তারা দেখে, কতকগুলাে কাঁচপােকা ঘুরে বেড়াচ্ছে মেঝের উপর। কী সুন্দর রঙীন আর বুটিদার তাদের শরীর। আবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, চলে আসে লােকগুলাে।
তবে এসব দেখা যায় কেবল রাতের বেলায়। দিনের বেলায় কোনদিন নয়। তখন সব শুনশান।
একদিন দুটি ছেলেমেয়ে বেরিয়েছে বেড়াতে। সরােবরের জলে নৌকা চড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। ভাসতে ভাসতে বুড়ির বাগানটা চোখে পড়ে গেল তাদের। ভারি সুন্দর তাে! এমন সুন্দর আর ঝলমলে বাগান বড় একটা দেখা যায় না।
পাড়ে নেমে সােজা বাগানে এসে ঢুকে পড়ল তারা। কার বাগান, তার নাই জানা। বলে-কয়ে তবেই তাে ঢুকতে হয়। এসব কথা মনেই পড়ল না তাদের। আসলে দেখতে যত সুন্দর, ঠিক ততটাই দেমাকী ছেলেমেয়ে দুটি। কাউকেই তােয়াক্কা করে না। গ্রাহ্য করে না কাউকেই।
বাগানে ঢুকেই ফুল ছিঁড়তে যাবে, অমনি বুড়ি হাঁ হাঁ করে উঠল-- "আরে, আরে, করছটা কী? ফুলে হাত দিও না বাছারা।"
নিজেরা দেখতে সুন্দর বলে, যত তাদের অহংকার, অসুন্দরকে তাদের ঠিক ততটাই ঘেন্না। বুড়ি মানুষটার পােষাক মলিন। মাথার চুল শনের নুড়ির মত। গাল দুটো বসা। সারা মুখে বলিরেখার আঁকি বুকি। সত্যিই অসুন্দর চেহারা। তারা কানই দিতে রাজি নয় বুড়িরকথায়। বুড়ি তবু আবার বলল – “মানা করছি তােমাদের। না শুনলে কিন্তু ফল খারাপ হবে।"
বুড়ির কথা শুনতে বয়েই গেছে তাদের। ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল দুজনের ঠোঁটে।
কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেল তখনই। যেই না দুজনে তুলবে বলে ফুলে হাত দিয়েছে, ফুল তাে তুলতেই পারল না, দুজনেই উধাও। অত সুন্দর জলজ্যান্ত দুটো ছেলেমেয়ে, যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। কোথাও তাদের কোন চিহ্নটুকুও নাই। ঝকঝকে দিনের আলােয় একেবারে ভােজবাজির মত ব্যাপার।
তাই বলে হারিয়ে যায়নি কিন্তু ছেলমেয়ে দুটি। দেখা গেল, তাদের বদলে বাগানে উড়ে বেড়াচ্ছে দুটি প্রজাপতি। ভারী সুন্দর তাদের চেহারা। কী ফিনফিনে তাদের ডানা। আর কী সেই ডানার রঙের বাহার! চোখ জুড়িয়ে যায় দেখলে। কোনও ওস্তাদ শিল্পী যেন তুলি দিয়ে এঁকেছে ডানাগুলি। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি দুটি।
আসলে হয়েছে কী, কথা না শােনায় ভারি রাগ হল বুড়ির। ভাবল, অমন দুষ্টু ছেলেমেয়ের শাস্তি পাওয়া দরকার। কিন্তু বুড়ি নিজে তাে ভালমানুষ। তার মন ভারী নরম। যতই দেমাকী হােক, বা যতই দোষ করুক, বুড়ি ঠিক মনে রেখেছে, ছেলেমেয়ে দুটি দেখতে ভারি সুন্দর। সেজন্য তাদের কোনরকম ক্ষতি করল না বুড়ি। তাদের দুজনকে প্রজাপতিই বানিয়ে দিল।
প্রজাপতি বানালাে, তাই বলে মােটেই এলেবেলে করে নয় কিন্তু। কত রকমের রঙের ফুল ফুটে আছে বুড়ির বাগানে। সব রকম ফুল থেকে একটু একটু রঙ নিয়ে, দারুণ উজ্বল রঙীন দুটি প্রজাপতি করে দিল তাদের। এবার বাগানে বাগানে ঘুরে বেড়াবে তারা। ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াবে, বসবেও ফুলের উপর। কিন্তু একটা ফুলও ছিড়তে পারবেনা আর তারা কোনদিন। বরং এবার থেকে তাদেরই দেখে প্রশংসা করবে সবাই। সবাই ভালবাসবে দুজনকে। ছিল দুটি দেমাকী ছেলেমেয়ে, সেদিন থেকে হয়ে গেল-- মিষ্টি রঙের দুটি প্রজাপতি।
যখনই তােমরা কেউ দেখবে-- দুটি প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলের উপর, বাগানে-বাগানে, গাছে-পাতায়, তখনই যেন মনে পড়ে সেই দুটি দেমাকী ছেলেমেয়েকে। আর, অবশ্যই যেন একবার মনে পড়ে, দেখতে অসুন্দর অথচ ভারি দয়ালু সেই বুড়ি মানুষটির কথাও।
মনে রেখাে, ভালাে মানুষেরা কখনাে কারও ক্ষতি করে না। দুষ্টুলােকেরও নয়।
জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন
0 Comments