জ্বলদর্চি

পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও অনিশ্চয়তা / পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ― ২
Physicist Werner Heisenberg

পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও অনিশ্চয়তা 

রাত্রির ঘন অন্ধকারে হামেশাই নিঁখোজ হচ্ছে শত্রুপক্ষের মধ্যবয়সী যুবক-যুবতী, এমনকি শিশুরাও। একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ বিতাড়িত হচ্ছেন স্বভূমি থেকে। বাদ পড়ছেন না বিজ্ঞানীরাও। একবার নিঁখোজ হয়ে গেলে তার ন্যূনতম তথ্য বা চিহ্ন চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে। কে নিরুদ্দেশ করল, কেন করল, নিরুদ্দেশ করার কারণ কী―সবটাই ধোঁয়াশা। হয়তো জানে সকলে। শুধু মুখ ফুটে কেউ বলছে না। আসলে বলবার সাহস পাচ্ছে না। তাই হাত-পা গুটিয়ে বাড়ির মধ্যে বসে থাকা ব্যতীত অন্য গত্যন্তর নেই। কারণ মহাযুদ্ধ চলছে।

১৯৪৩ সালের শরৎকাল। সে-বার কাশফুলের গায়েও রক্তের দাগ। এক জায়গায় স্থির বসে থাকবে না-কি স্রোতস্বিনী নদীর স্রোতের মতো স্বাভাবিক গতিতে বয়ে যাবে এই ভয়ে আকাশের ছেঁড়া পেঁজা মেঘ বুঝি কুণ্ঠিত। পাছে কেউ বন্দুকের নল উঁচিয়ে, যুদ্ধের ট্যাংক তাক করে নড়াচড়ার কারণ জিজ্ঞেস করে। সবসময় একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করে সবার মধ্যে। 

সেই দোদুল্যমান শরতে মহাযুদ্ধের উভয় পক্ষ একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে শঙ্কিত। শঙ্কার কারণ সরেজমিনে তদন্ত করে দেখতে আমেরিকার পরমাণু বোমা প্রকল্প (ম্যানহাটন প্রোজেক্ট)-এর সর্বময় সামরিক কর্তা জেনারেল লেসলি গ্রোভস 'Alsos Mission' নাম দিয়ে একটি ইন্টেলিজেন্স ইউনিট তৈরি করেন। অ্যালায়েড ফোর্সের এই ইন্টেলিজেন্স গ্রুপটি আংশিক সামরিক এবং আংশিক অসামরিক। সামরিক ও প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় কর্ণেল বরিস প্যাশকে। অসামরিক প্রধান একজন সিনিয়র সায়েন্টিস্ট― ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী স্যামুয়েল গাউডস্মিট। নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করলেও অনেক ইউরোপীয় ভাষায় তিনি বেশ দক্ষ। তাছাড়া জার্মানির পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত অনেক বিজ্ঞানী ব্যক্তিগতভাবে তাঁর পূর্বপরিচিত।

পরিকল্পনা মতো ইউরোপে যুদ্ধভূমিতে অ্যালায়েড ফোর্স যখন এগোবে, বাহিনীর পেছনে Alsos Mission থাকবে। জার্মান পরমাণু বোমা প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা কী তার খুঁটিনাটি তথ্য জানার চেষ্টা করবে ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের বিজ্ঞানীদল। কারণ ততদিনে IFB (আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা) গোপন সূত্র মারফত খবর পেয়েছে ভারী জল সংগ্রহ করছে জার্মানি। সাধারণ জলের থেকে ভারী জলে একটি অতিরিক্ত নিউট্রন থাকে। আর ১৯৩৮ সালে দুই জার্মান রসায়ন বিজ্ঞানী অটো হান এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসম্যান হালকা নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের ভাঙন ঘটিয়ে দিয়েছেন। ততদিনে ম্যানহাটন প্রোজেক্টের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও উচ্চ পদস্থ সামরিক কর্তারা ভালো মতন জেনে গেছেন নিউট্রনের সাহায্যে নিউক্লিয় বিয়োজন প্রক্রিয়ায় অ্যাটম বোমা তৈরি করা যায়। তাই জার্মানির ভারী জল সংগ্রহ করার খবর শুনে আমেরিকার চোখের ঘুম উড়ে গেছে। আসলে মহাযুদ্ধের সমান্তরালে আরেকটি প্রতিযোগিতায় নেমেছে যুযুধান দুই প্রতিপক্ষ। জার্মানি না আমেরিকা― কে আগে বানাবে অ্যাটম বোমা? 
               
দীর্ঘ দেড় বছরেরও বেশি সময় পর অবশেষে সাফল্য পেল 'Allied Alsos Mission', দক্ষিণ-পশ্চিম জার্মানি থেকে। ১৯৪৫-এর পয়লা মে থেকে জুন মাসের ৩০ তারিখের মধ্যে জার্মান পরমাণু বোমা প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত দশ শীর্ষ স্থানীয় বিজ্ঞানীকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করার পর তাদের ইংল্যান্ডে কেমব্রিজের কাছে গডম্যাঞ্চেস্টারে একটি পরিত্যক্ত ঘর 'Farm Hall'-এ অন্তরীণ করে রাখা হয়। এ হেন বিজ্ঞানীদের আটক রাখার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাৎসি জার্মানি বোমা তৈরির কত কাছাকাছি পৌঁছল বিজ্ঞানীগণের কথোপকথন থেকে সে বিষয় অবগত হওয়া। সেজন্য Farm Hall-এর বিশেষ কক্ষে (যেখানে সমস্ত বিজ্ঞানীকে একসঙ্গে আটক রাখা হয়) দেওয়ালের ভেতর মাইক্রোফোন চিপস বসানো হয়। দুই শত্রু বিজ্ঞানীর তেমন-ই একটি কথোপকথন মাইক্রোফোনের চিপসে ধরা পড়ে ৬-ই জুলাই ১৯৪৫-এ।

'আমি খুব অবাক হচ্ছি! দেওয়ালে মাইক্রোফোন ইন্সটল করা নেই তো?' সংশয় প্রকাশ করে একজন।

তৎক্ষণাৎ আরেকজন সপাটে উত্তর দেয়― 'মাইক্রোফোন ইন্সটলড? (প্রথমে বিস্মিত, তারপর হেসে হেসে) আরে না, না, আমেরিকা এখনও এত স্মার্ট হয়নি। আমার তো যথেষ্ট সন্দেহ আছে, তারা কতটুকু প্রকৃত গেস্টাপো পদ্ধতি জানে তা নিয়ে! এ ব্যাপারে সেই মান্ধাতার আমলে তারা।'

এ হেন কথোপকথনের প্রথমজন কুর্ট ডিয়েবনার এবং দ্বিতীয় জন ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ। সমকালীন বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের সমকক্ষ বিজ্ঞানী হিসাবে একসময় খ্যাতি ছিল হাইজেনবার্গের। খুব ছেলেবেলা থেকেই লেখাপড়ায় তিনি জিনিয়াস। জন্ম ১৯০১ সালের ৫-ই ডিসেম্বর। বিজ্ঞানের তীর্থভূমি ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত জার্মানির ভ্যুর্ৎসবুর্গ-এ। জন্মদাত্রী মা অ্যানি ওয়েকলেইন। পিতা বিখ্যাত হাইস্কুল শিক্ষক অগাস্ট হাইজেনবার্গ আধুনিক গ্রিক সাহিত্যের তৎকালীন একজন নামকরা প্রফেসর ছিলেন। 

ছেলেবেলায় একজন লুথাসিয়ান খ্রিস্টান হিসাবে বড় হতে থাকে ছোট্ট হাইজেনবার্গ। কিশোর বয়সে একবার আল্পস পর্বতমালা ভ্রমণে গিয়ে তিনি প্লেটোর 'Timaeus' বইখানা পড়ে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। বইটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি তত্ত্বের রহস্য নিয়ে লেখা। পরে তিনি স্বীকার করেছেন, 'ফিলোসফি, প্লেটো ও অনুরূপ বিষয় অধ্যয়ন করে আমার মন তৈরি হয়েছিল।'
১৯১৯ সালে 'Freikorps'-এর প্যারামিলিটারী বাহিনীর সদস্য হয়ে মিউনিখ পৌঁছন। সোভিয়েত রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ করতে। অবশ্যই কৌতুক বশত। এরপর ১৯২০-তে মিউনিখের লুডিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। প্রিয় বিষয় ফিজিক্স ও গণিত। সেখানে অধ্যাপক সমারফিল্ড এবং উইলহেল্ম ভিন-এর সান্নিধ্যে আসেন। প্রফেসর সমারফিল্ডের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। এমনকি, এই মহান শিক্ষকের অধীনে ডক্টরেট করছিলেন তিনি। সমারফিল্ড লক্ষ্য করেন নীলস বোর-এর অ্যাটমিক তত্ত্বের উপর ছাত্রের তীব্র উৎসাহ। এদিকে 'Bohr Festival' বসবে গোটিনজেনে। সেখানে ভাষণ দিতে আসছেন অধ্যাপক নীলস বোর। ১৯২২-এর জুন মাসে। ছাত্রের উৎসাহের কথা মাথায় রেখে প্রফেসর সমারফিল্ড ছাত্র হাইজেনবার্গকে গোটিনজেনে বোর ফেস্টিভ্যালে নিয়ে যান। ফেস্টিভ্যালে অতিথি অধ্যাপক নীলস বোর তার কোয়ান্টাম অ্যাটমিক ফিজিক্সের ওপর দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন। সেখানে অধ্যাপক বোর-এর সঙ্গে প্রথম বার সাক্ষাৎ হয় হাইজেনবার্গের। যা পরবর্তী কালে তার জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থেকে যায়।

এরপর তিনি গোটিনজেনের জর্জ অগাস্ট ইউনিভার্সিটিতে  ভিজিটিং স্টুডেন্ট হিসাবে অধ্যয়ন শুরু করেন। একই বিষয় ফিজিক্স ও গণিতে। সেখানে তার ফিজিক্স টিচার ছিলেন অধ্যাপক ম্যাক্স বর্ন ও জেমস ফ্রাংক, এবং গণিত শিক্ষক বিখ্যাত ডেভিড হিলবার্ট। 

১৯২৩-এর মে মাসে তিনি গোটিনজেন থেকে মিউনিখে ফিরে আসেন। ডক্টরাল পরীক্ষার শেষ সেমিস্টারে বসতে। সমারফিল্ড ছাত্রের প্রিয় বিষয় কোয়ান্টাম থিওরি জানা সত্ত্বেও আপাতত কঠিন বিষয় উদস্থিতিবিদ্যার উপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে নির্দেশ দেন প্রিয় ছাত্রকে। আর প্রফেসর উইলি ভিন টাস্ক দেন চার ঘণ্টার ল্যাবরেটরি ওয়ার্ক। তারপর মৌখিক পরীক্ষা। লিখিত ও ল্যাবরেটরি এক্সপেরিমেন্টের পর সমারফিল্ড ও ভিন মৌখিক টেস্ট নিতে বসলেন। কিন্তু ফল আশাব্যঞ্জক নয়। দুজনেই সিঙ্গেল গ্রেড দিলেন। ইতিমধ্যে ল্যাবরেটরি ওয়ার্ক চলাকালীন হাইজেনবার্গ "On the Stability and Turbulence of Liquid Currents" বিষয়ে একটি ৫৯ পৃষ্ঠার প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। এ হেন প্রবন্ধটি তিনি ১৯২৩-এর ১০ জুলাই মিউনিখ কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়ে দেন। প্রবন্ধের ঐ বিষয়টি একটি কোম্পানি প্রফেসর সমারফিল্ডকে পাঠিয়েছিলেন সমাধানের জন্য। ঐ কোম্পানি তখন মিউনিখের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আইজার নদীতে সুড়ঙ্গ তৈরির কাজে ব্যস্ত। কিন্তু সমস্যা বাধল নদীতে জলের অশান্ত প্রবাহ (Turbulent Flow)। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোম্পানি স্মরণাপন্ন হয় সমারফিল্ডের। কোন কারণে সমারফিল্ড সমস্যাটির সমাধান করেননি। অথচ তার ছাত্র সেটির সমাধান করে ফেলেন। ফলে মিউনিখ কর্তৃপক্ষের কাছে তার প্রবন্ধ অনুমোদন পায় ও অধ্যাপক ভিন ফিজিক্স জার্নালে ছাপার জন্য গ্রহণ করেন। 

সে-যাত্রায় ঐ আর্টিকেল সাময়িকভাবে তার রক্ষাকর্তা হয়ে অবতীর্ণ হয়। তাকে ফাইনাল ওর‍্যাল পরীক্ষায় বসার আরও একটি সুযোগ দেয় কর্তৃপক্ষ। একুশ বছর বয়সী হাইজেনবার্গ উপস্থিত হয় চারজন পরীক্ষকের সম্মুখে। ২৩ জুলাই ১৯২৩ সাল। গণিত ও সমারফিল্ডের সব প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলেও অ্যাস্ট্রোনমি এবং এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে ফল আশানুরূপ হলো না। ভিন-এর প্রশ্নের সম্মুখে রীতিমতো ফ্লপ হাইজেনবার্গ। অন্য বিষয়ে যতই ব্রিলিয়ান্ট হোক, প্রফেসর ভিন ছাত্রকে পরীক্ষায় পাশ করাতে তীব্র অনিচ্ছুক। এতটাই ক্রুদ্ধ তিনি। 

লজ্জায় মর্মাহত হাইজেনবার্গও। ক্লাসে সর্বদা শীর্ষ স্থান পাওয়া ছাত্রের এ কী অবস্থা! ডক্টরাল পরীক্ষায় সর্বনিম্ন গ্রেড! অবিশ্বাস্য ব্যাপার! সেদিন রাত্রে প্রফেসর সমারফিল্ড সদ্য ডক্টরেট হওয়া ছাত্রের অভ্যর্থনায় তাঁর বাড়িতে একটি ছোট পার্টি আয়োজন করেন। পার্টিতে হাইজেনবার্গ বেশি ক্ষণ থাকেননি। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে সেদিন মাঝরাতের ট্রেনে গোটিনজেনে পৌঁছন। পরের দিন সকালে অফিসে ম্যাক্স বর্ন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ম্যাক্স বর্ন পরের বছরের জন্য তাকে টিচিং সহকারী হিসাবে নিযুক্ত করেন। সেখানে ১৯২৪ সালে ম্যাক্স বর্ন-এর সঙ্গে 'অ্যানামোলাস জিম্যান এফেক্ট'এর উপর Habilitation Thesis সম্পূর্ণ করেন তিনি। 
           
তারপর এল সেই কাঙ্ক্ষিত সময়। যা তাকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেয়। ১৯২৫ সাল। নীলস বোর-এর পরমাণু তত্ত্ব আবিষ্কারের পরেও পরমাণুর ভেতরে অদ্ভুত যে কাণ্ডকারখানা ঘটে চলেছে তার সঠিক ব্যাখ্যা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এত ক্ষুদ্র পরমাণুর অভ্যন্তরে এতগুলো ইলেকট্রন কীভাবে ঘুরপাক খায়! কোয়ান্টাম বলবিদ্যার স্থপতি বিজ্ঞানী শ্রোডিঞ্জার-এর তরঙ্গের ব্যাখ্যা আশাব্যঞ্জক হলেও পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনের সমস্যার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

জুন মাসের এক বিকেলে শরীরে সামান্য জ্বর নিয়ে হাইজেনবার্গ পৌঁছে গেলেন জার্মানির উত্তরে নির্জন দ্বীপ হেজল্যাণ্ডে। বয়স সবেমাত্র চব্বিশ। ইলেকট্রনের সমস্যাটি মাথার মধ্যে অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন রাতে গণনা করতে বসে পড়েন। ইলেকট্রনের গতি ও ভরবেগ নিয়ে। তা করতে গিয়ে পেলেন অদ্ভুত তথ্য। তিনি দেখলেন, কোন এক মূহুর্তে একটি ইলেকট্রনের 'অবস্থান' ও 'ভরবেগ' রাশি দুটিকে গুণ করলে যে ফল পাওয়া যায়, ইলেকট্রনের 'ভরবেগ' ও 'অবস্থান'-এর গুণফলের তথ্য হুবহু মিলছে না। ব্যাপারখানা কী? 'A × B'-এর ফলের সঙ্গে 'B × A'-এর ফল মিলছে না। আরও সহজ করে বললে, ২ × ৩ এবং ৩ × ২ সমান নয়! কী করে সম্ভব এই অদ্ভুত ঘটনা? এমন নিয়ম কেবল গণিতের ম্যাট্রিক্স-এর ক্ষেত্রে খাটে। এরই সূত্র ধরে ম্যাক্স বর্ন ও পাসকুয়াল জর্ডানের সঙ্গে মিলে তিনি জন্ম হল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নতুন শাখা― ম্যাট্রিক্স মেথড। এ হেন যুগান্তকারী আবিষ্কার এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ হিসাবে হাইড্রোজেনের বহুরূপতা আবিষ্কারে অবদান রাখার জন্যে ১৯৩২ সালে তিনি ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

যদিও কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় তিনি বেশি বিখ্যাত তাঁর 'অনিশ্চয়তা নীতি' আবিষ্কারের জন্য। কী এই 'অনিশ্চয়তা নীতি'?

কোন একটি মূহুর্তে একটি গতিশীল ইলেকট্রন কণার অবস্থান ও ভরবেগ দুটো একইসঙ্গে নিঁখুত মাত্রায় গণনা করা সম্ভব নয়। অবস্থান পরিমাপ করলে ভরবেগের মাপনে ত্রুটি অবশ্যম্ভাবী। আবার ভরবেগের পরিমাপনে অবস্থান পরিমাপে ত্রুটি পাওয়া যায়। একে হাইজেনবার্গের 'অনিশ্চয়তা নীতি' বলে। এটি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটি মৌলিক নিয়ম। অথচ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তা মানতে অপারগ। অসম্মতিমূলক মন্তব্য করে বসলেন তিনি, 'ঈশ্বর পাশা খেলেন না।' এদিকে ক্ষেপে লাল হাইজেনবার্গ ও নীলস বোর। প্রত্যুত্তরে কড়া কথা শোনালেন বিজ্ঞানী বোর। অবশিষ্ট জীবনে যে ঝগড়া আর মেটেনি। আইনস্টাইনের পরম ভক্ত থেকে হাইজেনবার্গ হয়ে উঠলেন কঠোর প্রতিপক্ষ।

জার্মান এই পদার্থবিজ্ঞানী বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। জার্মানি তখন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে। চারদিকে শুধু হিটলারের জয়ধ্বনি বেজে চলছে। নাৎসি জার্মানরা ইহুদি নিধনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এমন সময় বে-মক্কা মন্তব্য করে বসলেন হাইজেনবার্গ। তিনি বললেন, 'একজন বিজ্ঞানী ইহুদি হলেও তাকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে দেওয়া উচিত।' ব্যাস, নিন্দার ঝড় ওঠল আলোর বেগে। প্রাণ সংশয় দেখা দিল। 'শ্বেতাঙ্গ ইহুদি' তিরস্কার শুনতে হল তাকে। এমনকি ১৯৩৫ সালের শেষদিকে তাঁর জীবনে নেমে এল এক বড় সড় দুর্যোগ। হত্যার উদ্দেশ্যে গুপ্তচর নিয়োগ করা হল তাঁর পেছনে। চাকুরীর পদোন্নতি আটকে গেল। এমন বিভীষিকাময় সময়ে এগিয়ে এলেন তাঁর মা ওয়েকলেইন। দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতার কারণে হিটলারের মায়ের সঙ্গে দেখা করেন ওয়েকলেইন। দু'মায়ের সাক্ষাতের পর রাগ ঠাণ্ডা হয় সর্বাধিনায়ক হিটলারের। স্বস্তি পেলেন হাইজেনবার্গ।

গানের প্রতি আসক্তি ইতিমধ্যে তাকে তাঁর ভালোবাসার মানুষের সন্ধান দেয়। ক্লাসিক্যাল মিউজিক পছন্দ করতেন হাইজেনবার্গ। নিজে সম্পন্ন পিয়ানো বাদক ছিলেন। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে এলিজাবেথ স্কুমাচারের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে একটি ব্যক্তিগত কবিতা-গানের আড্ডায়। পরিচয় থেকে গাঢ় হয় সম্পর্ক। সম্পূর্ণ হল পরিণয়ে। ২৯-শে এপ্রিল সাত পাকে বাঁধা পড়েন তারা। সাত সন্তানের জনক-জননীর সে-বন্ধন আমৃত্যু অটুট ছিল।

১৯৩৯ সালে শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রবার্ট ওপেনহেইমারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে পরমাণু বোমা তৈরির কাজ। যুদ্ধে টিকে থাকতে গেলে হিটলারকেও বানাতে হবে পেল্লাই ক্ষমতার তেমন বোমা। কিন্তু কে বানাবে সেই মারণাস্ত্র? 

হিটলারের অফিসে ডাক পড়ল হাইজেনবার্গের। কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করে শুরু হল জার্মান নিউক্লিয়ার রিসার্চ টিম― 'ইউরেনিয়াম ক্লাব'। হাইজেনবার্গ হলেন তার প্রধান। হিটলারের শত্রু থেকে মিত্রে পরিণত হলেন তিনি।সেই সঙ্গে আমেরিকার মাথা ব্যথার কারণও হয়ে উঠলেন। কারণ ততদিনে IFB মারফত আমেরিকা জেনে ফেলেছে জার্মানির ভারী জল সংগ্রহের অভিসন্ধি। যদিও হাইজেনবার্গ বোমা তৈরির খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছিলেন, কিন্তু শেষোদ্ধার করতে পারেননি। তার আগেই অ্যালায়েড ফোর্সের বিছানো ফাঁদে ধরা পড়ে যায় জার্মানির সব নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী। এ ঘটনা এই পর্বের প্রথমে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। 

অবশ্য ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হবার পর পৃথিবীর ক্ষমতার ভারকেন্দ্র পাল্টে গেল। আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতে তখন ক্ষমতার ব্যাটন। শেষমেশ ১৯৪৬-এর ৩-রা জানুয়ারি ইংল্যান্ডের Farm Hall থেকে সব বিজ্ঞানীকে জার্মানিতে ফেরত পাঠানো হয়। মুক্তি পেলেন হাইজেনবার্গ।

যুদ্ধ শেষে অনেক গুলো গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সংস্থার প্রধানের পদ অলংকৃত করেন তিনি। বেশ কিছুদিন কেমব্রিজ, ব্রিস্টল, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেন। সার্ন-এ জার্মান প্রতিনিধি দলের প্রধানও ছিলেন তিনি। 

আপাদমস্তক বামপন্থী হাইজেনবার্গ নাস্তিক বলে প্রচলিত থাকলেও নিকটজনের কাছে তিনি ছিলেন ঈশ্বরের একনিষ্ঠ বিশ্বাসী। একসময় পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি হতাশ হয়ে তিনি বলেছিলেন― 'When I met God, I am going to ask him two questions― why relativity? and why Turbulance? I really believe he will have an answer for the first one.'

পয়লা ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ সালে কিডনির ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরদিন সকালে তাঁর বন্ধুরা অফিস থেকে বাসা পর্যন্ত হেঁটে যান এবং সদর দরজার বাইরে মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে আসেন। জার্মানির মিউনিখে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি।

তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুস্তক হল―
(১) The Physical Principles of the Quantum Theory (1930),
(২) Physics and Philosophy: The Revolution in Modern Science (1958),
(৩) Physics and Beyond (1969).

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇


আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments