জ্বলদর্চি

আবৃত্তির পাঠশালা-৫ / শুভদীপ বসু

আবৃত্তির পাঠশালা-৫

শুভদীপ বসু

ছোটদের আবৃত্তি চর্চা

আবৃত্তি সারা জীবনব্যাপী এক সাধনা।এক নিরন্তর প্রয়াস।আবৃত্তি এখন আর অনুষ্ঠানের গানের ফাঁকে ফিলার নয়,আবৃত্তি এখন গোটা সান্ধ্য আসরের একাই বিনোদন। তাই আবৃত্তি শেখার প্রচলন এখন হয়েছে। বর্তমানে একটি শহরে আবৃত্তি প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান কম নয়। অভিভাবক-অভিভাবিকারাও বুঝেছেন যে গান,নাচ,আঁকার মতোই এই শিল্পটিকেও ছোটদের শেখাতে হবে।তাই ছোটদের আবৃত্তি শেখানোর ইচ্ছে অনেক বেড়েছে যা এই শিল্পের ভবিষ্যতকে অবশ্যই সুন্দর করবে।

চর্চা শুরু:
আবৃত্তির প্রতি- কবিতার প্রতি ভালোবাসা ছোটদের ছোটবেলা থেকেই তৈরি করতে সাহায্য করে তার বাবা, মা, ঠাকুমা, দাদুরা। যখন ছোটরা কথা বলতেই শেখেনি, বুঝতে শেখেনি,তার সামনে মায়েরা অথবা বাবারা যখন'ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে','আমি হব সকাল বেলার পাখি', 'তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে', 'ভয় পেয়ো না ভয় পেয়ো না' ইত্যাদি আবৃত্তি করেন, তখন নিজেদের অগোচরে ছোটরা সেগুলি আয়ত্ত করতে থাকে। তাই খুব ছোট থেকেই বাড়িতে অভিভাবক অভিভাবিকারা অডিও সিস্টেমে ছোটদের উপযোগী গান, কবিতা, সংস্কৃত মন্ত্র ইত্যাদি চালাতে পারেন। এতে ছোট্ট বন্ধুরা নিজেদের অজান্তেই অনেক কিছু রপ্ত করতে পারে। মা বাবারা চান তাদের সন্তানরা মুখে বুলি ফুটলেই কবিতার স্কুলে ভর্তি করে দিতে। আমার ব্যক্তিগত মতে, অন্তত পাঁচ বছর হলেই ছোটরা কিছুটা বুঝতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানে সে চর্চা শুরু করতে পারে। এর ব্যতিক্রম রয়েছে।অনেক সময় দেখি,সাড়ে তিন থেকে চার বছরের ছেলে মেয়েরাও খুব সহজে রপ্ত করতে পারছে।

এই খুদেরা যারা মা বাবার হাত ধরে চর্চা করতে আসছে তাদের মধ্যে একদল যারা কিছুই শিখে আসে নি আবার অন্য একদল মা বাবার মুখে মুখে কিছু ছড়া বলতে শিখেছে।এই দু'রকম ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষককে আবৃত্তি করে দেখিয়ে দিতে হয় যা শুনে শুনে শিশুরা কন্ঠে ধরে নিতে পারে।অবশ্যই এমনভাবে ছড়া বা কবিতা নির্বাচন করতে হবে যাতে ছোট্ট শিশুদের ভালোলাগার পাশাপাশি উচ্চারণের ভুল ত্রুটি গুলি সংশোধন করতে করতে যাওয়া যায়। সাধারণত শিশুরা জীবজন্তু, পশুপাখি বিষয় পছন্দ করে। ছোটদের জন্য ছড়া বা কবিতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে।

আত্মবিশ্বাস তৈরি করা:

ছোটদের তাদের পছন্দমতো কবিতা করতে দিলে আবৃত্তির মধ্য দিয়ে তারা তাদের জড়তা কাটাতে পারে এবং অনেকের সামনে বলতে বলতে নিজেদের মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয়।অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো কোনো শিশু স্বভাবগত লাজুক প্রকৃতির।তাদের ক্ষেত্রে এই জড়তা কাটাতে একটু অসুবিধে হয় বৈকি। এক্ষেত্রে ওই ছোট্ট শিশুটিকে অনেকে মিলে একসঙ্গে কোরাস কবিতা করানো যেতে পারে। একসাথে গলা মেলাতে মেলাতে সেই শিশুটির মধ্যে লজ্জা ধীরে ধীরে কমে যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
শিশুদের হাতে শিশুসাহিত্য:

এই শিশুদের হাতে শিশুসাহিত্য তুলে দিলে তাদের কল্পনার জগতের বিস্তার ঘটে। বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্যের ভান্ডার খুবই সমৃদ্ধ। ঠাকুরমার ঝুলি, বুড়ো আংলা,নালোক, হিরু ডাকাতের গল্প, নন্টে ফন্টে ইত্যাদি যত পড়বে ততই ছোট্ট বন্ধুদের কবিতার প্রতি ভালোবাসা গড়ে উঠবে।

ছন্দের জগতে ছোটরা:

ছোটরা তাল ও ছন্দ খুবই পছন্দ করে।আমরা যদি একটু মন দিয়ে শুনি তাহলে দেখব ছোটরা নিজেরাই প্রত্যেকে এক বিশেষ ছন্দে কথা বলছে। এই ছোট্ট বন্ধুদের দিকে সজাগ থেকে যদি তাদের পছন্দমতো কবিতা আবৃত্তি করানো যায় তবে এই শিল্পের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে।কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় কোন কোন শিশুর মধ্যে তাল জ্ঞান থাকেনা। বাড়িতে গান শোনার বা শিল্পের বাতাবরণ না থাকায় এটা হতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের দলগত ছন্দের কবিতা আবৃত্তি করানো যেতে পারে যা তাদের তালবোধ জাগিয়ে তুলবে।

প্রতিযোগিতা:

বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখি অভিভাবক অভিভাবিকা রা তাদের শিশুটিকে প্রতিযোগিতায় প্রাইজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য আবৃত্তি শেখাতে আসে। হ্যাঁ প্রতিযোগিতা অবশ্যই শিশুদের জড়তা কাটানোরজন্য, উৎসাহিত করার জন্য কাজে লাগে কিন্তু পুরস্কার না পাওয়ার ব্যর্থতা এবং সে জন্য অভিভাবকের প্রতিক্রিয়া শিশুটিকে আবৃত্তির প্রতি নিরুৎসাহিত করতে পারে। তাই আমার মনে হয় আবৃত্তিচর্চার মূল শিক্ষাক্রমকে ব্যাহত করে এমন কোন প্রতিযোগিতার জন্য শিশুটিকে জড়িয়ে ফেলা কখনই উচিত নয়।বরং একক বা কখনো দলগত আবৃত্তির পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শিশুটিকে অনুষ্ঠান করালে তাতে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং সকলের কাছে সে পরিচিত হয়। যে সমস্ত শিশুরা ভালো আবৃত্তি করে তারা প্রতিযোগিতায় যেতেই পারে কিন্তু অভিভাবক কে অবশ্যই নজর রাখতে হবে যে সেই শিশুটির প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে ভুল অহংকার যাতে কখনোই তৈরি না হয় যা পরিপূর্ণ শিল্পী হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।

অন্যদের আবৃত্তি শোনা:

এটা খুব দুঃখের বিষয় খুব কম অভিভাবকই আছেন যারা নিজের শিশুর আবৃত্তির অনুষ্ঠান ছাড়াও অন্যান্য আবৃত্তির অনুষ্ঠানে শিশুটিকে সঙ্গে নিয়ে যান শুনতে। আবার এমনও দেখা গেছে নিজেদের পরিবেশনার পরই অভিভাবক অভিভাবিকারা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছেন। অন্যদের আবৃত্তি শুনলে আপনার ছেলে-মেয়ে উৎসাহ পাবে।তাদের ইচ্ছে করবে নিজের পরিবেশনা আরও ভালো করতে। অবশ্য এর ব্যতিক্রম রয়েছে,আমি এমন অভিভাবকদেরও জানি যারা শিশুর আবৃত্তির জন্য নিবেদিতপ্রাণ। মোটকথা আবৃত্তির এক সামগ্রিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে হবে ছোটদের চারপাশে।
উচ্চারণ:

ছোটদের ক্ষেত্রে অনেক সময় উচ্চারণের অপরিপক্কতা দেখা যায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের জন্য। এর মধ্যে বেশি থাকে র,ড়,ঢ়,শ,স,ত,ট,ঁ- বর্ণের বিভ্রাট। এক্ষেত্রে অভিভাবক অভিভাবিকাকে সতর্ক হতে হবে। ছোটবেলায় ছোটদের আদর করার সময় অনেক বড়রাই আধো আধো উচ্চারণ করে কথা বলেন। এই আদিখ্যেতা আপনার শিশুর পক্ষে ভালো নয় তাই এগুলি পরিহার করাই শ্রেয়।

পড়াশোনার অজুহাত:

অনেক সময় আমরা দেখি পড়াশোনার অজুহাতে শিশুটির পছন্দের আবৃত্তি বিষয়টিকে বন্ধ করে দেয়া হয়। ক্লাস নাইনে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ক্যারিয়ার গঠনের নামে ছোটবেলার আবৃত্তিচর্চার আপাত ইতি হয়ে যায়। পরবর্তীকালে শিল্প ক্ষেত্রে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি অথবা প্রতিজ্ঞা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আর সফল হয়ে ওঠে না।এক্ষেত্রে আমি অবশ্যই বলব পড়াশোনাটা আগে জরুরী। শ্রী কাজল সুর বলেন 'আবৃত্তি করে ব্রেকফাস্ট জোটানো যেতে পারে কিন্তু ডিনার লাঞ্চ নয়।' 

ছোটদের আবৃত্তিচর্চায় যা অবশ্যই মনে রাখা উচিত:

১) চেঁচিয়ে কথা বলবেনা,চেঁচিয়ে কাঁদবেনা।
২) অনেক রাত করে ছোটরা ঘুমাবে না। তবেই সকাল সকাল উঠতে পারবে।
৩) ফ্রিজের ঠান্ডা জল খাবে না। আইসক্রিম যতটা সম্ভব না খেতে পারলে ভালো।
৪) রোজ সকালে মধু খাওয়ার অভ্যেস ভালো।
৫) কবিতা পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যারা নিতান্ত ছোট তাদের কবিতা শোনার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।
৬) ছোটদের ক্ষেত্রে আবৃত্তির জন্য কবিতা নির্বাচন অত্যন্ত জরুরি একটা ব্যাপার।বয়স উপযোগী আবৃত্তি করা অবশ্যই জরুরি। অনেক সময় আমরা দেখি ছোট্ট বন্ধুরা বড়দের কবিতা আবৃত্তি করছে। একে উৎসাহ না দেওয়াই উচিত। 
৭) ছোটদের ছন্দবদ্ধ কবিতা আবৃত্তি করতে দিলে ভালো।তাতে ওদের মন বসবে। 
৮) যদিও আবৃত্তির ক্ষেত্রে কণ্ঠই একমাত্র মাধ্যম তাই হাত-পা নেড়ে কবিতা বলা ছোট থেকেই পরিত্যাগ করা আমাদের উচিত। তবে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নিজের মনোভাব বা অভিব্যক্তি বোঝানোর ক্ষেত্রে সে অবশ্যই হাত পা নাড়তে পারে।
৯) ছোটদের কবিতা মুখস্থ করানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত 
১০) কবিতার অন্তর্নিহিত অর্থ সুন্দর করে ছোটদের মতো করে বোঝাতে হবে যাতে সে কবিতাটির রস আস্বাদন করতে পারে।
১১)ছোটরা যেন বড়দের অনুকরণ করতে গিয়ে স্বরের কারসাজি না করে কবিতার বিষয়টি জেনে বুঝে স্বাভাবিক স্বরে আবৃত্তি করাই ভালো।
১২)ধীরে ধীরে ছোটদের শেখাতে হবে শ্বাস নেওয়াশ্বাস ছাড়া, ছন্দ, অভিব্যক্তি, বাচনভঙ্গি, বিরাম এর ব্যবহার।
১৩)ছোটরা এমন কিছু খাবে না যাতে অ্যাসিড হতে পারে কারণ পেটের অ্যাসিড গলার পক্ষে খারাপ।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে 'কবিতার ক্লাস' নামক গ্রন্থে বলেছিলেন-'কোন ব্যক্তি তার পরিশীলিত কন্ঠের ওঠানামা,সুস্পষ্ট ও অর্থবহ উচ্চারণে,ছন্দের সৌন্দর্যে,কবিতা বা গদ্যের ভাব ও আনুগত্য স্বীকার করে,কবিতা গদ্য সম্পর্কে নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি অভিজ্ঞতা দিয়ে যে মায়াময় কন্ঠের তৈরি করেন তাই আবৃত্তি।'
এই মায়াময় কণ্ঠ রূপ তৈরি করার জন্য ছোট থেকেই চর্চা করতে হবে। সাধনা করতে হবে।

হ্যাঁ,আবৃত্তি কে বৃত্তি করার জন্য শেখার দরকার নেই।ছোট আবৃত্তি শিক্ষার্থী একদিন বড় শিল্পী না হোক বড় মানুষ হয়ে উঠবে এই আশায় ছোটদের জন্য এই শিল্পচর্চা।চর্চার মধ্যে থেকে যদি ছোটদের মধ্যে আবৃত্তির জন্য সর্বোপরি বৃহত্তর জীবনের জন্য ভালোবাসা জন্মায় তবেই এই আবৃত্তিচর্চার সার্থকতা।

জ্বলদর্চি পেজ- এ লাইক দিন👇

আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. আবৃত্তি শেখার জন্যে কোন স্কুলে ভর্তি হওয়া যায়?

    ReplyDelete