জ্বলদর্চি

সংক্ষিপ্ত মহাভারত- ১০/সুদর্শন নন্দী

সংক্ষিপ্ত মহাভারত
পর্ব ১০
সুদর্শন নন্দী

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুপক্ষেরই হাজার হাজার সৈন্য মারা পড়ে। মারা পড়ে আত্মীয়স্বজন। এবার  মৃতদের সৎকারের সময় আসে। শতপুত্র হারানোর শোকে গান্ধারী কৃষ্ণকে এই মহাধ্বংসের জন্য দায়ী করেন ও কৃষ্ণকে অভিশাপ দেন যে, কুরুবংশের মতই কৃষ্ণের যদুবংশও ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রশোকে একপ্রকার পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন। সঞ্জয় আর বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে বললেন, মহারাজ এখন শ্রাদ্ধাদির সময় উপস্থিত। শোকের মোহে এই কাজ অবহেলা করবেন না।
 তখন ধৃতরাষ্ট্র, পরিবারের স্ত্রী-পুরুষ সবাইকে  নিয়ে  কাঁদতে কাঁদতে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করলেন। কুলবধুগণ বিধবার বেশে  বের হলেন।এদিকে পাণ্ডবেরাও কৃষ্ণ, সাত্যকি আর দ্রৌপদী প্রভৃতিদের নিয়ে কুরুক্ষেত্রের দিকে আসছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র ও অন্যান্যরা তাঁদের দেখে কৌরব বিধবাদের দুঃখ আরও বেড়ে গেল, কারণ তাঁদের ধারনাতে এই পাণ্ডবেরাই যত নষ্টের গোঁড়া তারাই সমস্ত  দুঃখের কারণ।

   এরপর পাণ্ডবেরা একে একে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র বিরক্তভাবে যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করলেন ও তাঁর সাথে দু একটি কথা বলেই জিজ্ঞাসা করলেন, ভীম কোথায়?  ভীমের প্রতি রাগে তিন তখনো ফেটে পড়ছিলেন। ভীমকে পেলে তিনি তাকে বধ না করে ছাড়বেন না। ধৃতরাষ্ট্রের এই মনোভাব কৃষ্ণ আগেই বুঝতে পেরে, তার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন। তাই ধৃতরাষ্ট্র ভীমের কথা জিজ্ঞাসা করামাত্র, তিনি একটা লোহার ভীম এনে তাঁর  সামনে উপস্থিত করলেন। সেই লোহার মুর্তিটাকে আলিঙ্গন করবার ছলে, ধৃতরাষ্ট্র তাকে এমনি চাপ দিলেন যে, তা একেবারে চূর্ণ হয়ে গেল! ধৃতরাষ্ট্রের দেহে লক্ষ হাতির জোর ছিল, তাই তিনি যে লোহার ভীম চূর্ণ করবেন এটি আশ্চর্যের বিষয় নয়।  
   ভীম চূর্ণ করে ভীমের যথেষ্ট সাজা হয়েছে ভেবে ধৃতরাষ্ট্রের  রাগ চলে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তেই  আবার তিনি “হা ভীম! হা ভীম!” করে কাঁদতে লাগ্লেন। এবার কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, “মহারাজ! দুঃখ করবার কোন প্রয়োজন নাই। ওটা লোহার ভীম ছিল। ভীমকে বধ করতে যাওয়া আপনার উচিত হয় নি। আপনার পুত্রেরাই এই যুদ্ধ ও মৃত্যুর জন্য দায়ী।   সুতরাং ভীমকে তার জন্য দোষী করা ঠিক নয়।
 কৃষ্ণের কথায় ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “কৃষ্ণ! তোমার কথাই সত্য। শোকে বুদ্ধিনাশ হওয়াতে আমি এসব করেছিলাম।” এই বলে ধৃতরাষ্ট্র ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেবকে আলিঙ্গনপূর্বক আশীর্বাদ করলেন।
পাণ্ডবদের রাজ্যলাভের পর ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী পনের বছর পাণ্ডবদের আশ্রয়ে থাকেন। পাণ্ডবরা তাদের যথেষ্ট সম্মান করলেও ভীম গোপনে ধৃতরাষ্ট্রের অপ্রিয় কাজ করতেন কারণ তিনি ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায় আচরণ ভুলতে পারেন নি। অবশেষে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী বাণপ্রস্থ অবলম্বন করে গঙ্গাতীরে রাজর্ষি শতযুপের আশ্রমে উপস্থিত হন। কুন্তী, বিদুর ও সঞ্জয়ও তাদের সাথে আসেন। এখানে তারা আশ্রম তৈরী করে বাস করতে থাকেন। ব্যাসদেব একদিন তাদের দেখতে এলে গান্ধারীর অনুরোধে ধৃতরাষ্ট্রের শোক লাঘবের জন্য অলৌকিক তপস্যা বলে যুদ্ধে নিহত স্বজনদের পুনর্জীবিত করে দেখান। বনবাসকালে গান্ধারী কেবল জল পান করে তপস্যা করতেন। অবশেষে তৃতীয় বছরে তারা অরণ্যে প্রবেশ করেন। একদিন হঠাৎ সেখানে দাবানল সৃষ্টি হয়। ধৃতরাষ্ট্র বন প্রবেশের পূর্বে যে যজ্ঞ করেছিলেন যাজকগণ সেই আগুন নির্জন বনে নিক্ষেপ করেছিলেন তা থেকেই দাবানল সৃষ্টি হয়। সেই আগুনে গান্ধারী, কুন্তী ও ধৃতরাষ্ট্র জীবন ত্যাগ করেন।
  এদিকে ৩৬ বছর পর গান্ধারীর অভিশাপের ফলস্বরূপ কৃষ্ণের যদুবংশের সদস্যরা প্রভাস তীর্থে মদ্যপ অবস্থায় পরস্পরের সাথে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে মুষল যুদ্ধে প্রাণ হারান। বলরাম শেষনাগ রূপে দেহত্যাগ করেন এবং সামান্য এক ব্যাধের নিক্ষিপ্ত শরে কৃষ্ণ নির্বাণপ্রাপ্ত হন। এমনকি দ্বারকা নগরীও সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়।
  এসমস্ত অশুভ লক্ষণ প্রত্যক্ষ করে পাণ্ডবেরা রাজ্যত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন ও অভিমন্যুর পুত্র পরীক্ষিৎকে সিংহাসনে বসিয়ে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদী হিমালয়ের পথে গমন করবেন ঠিক করেন।  ঋষি বেদব্যাস  অর্জুন ও তাঁর ভাইদের রাজ্য ত্যাগ করে প্রস্থান করতেই বললেন কারণ তাঁরা যে উদ্দেশ্যে পৃথিবীতে এসেছিলেন তা পূর্ণ হয়েছে । অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে ব্যাসের উপদেশ জানান এবং তাঁর ভাইয়েরা এবং দ্রৌপদী মহাপ্রস্থানের জন্য রাজি হন । 
পরীক্ষিৎকে রাজ্যে অভিষিক্ত করে এবং যুযুৎসুর উপর রাজ্য পালনের ভার দিয়ে যাদবদের একমাত্র বংশধর কৃষ্ণপৌত্র বজ্রকে ইন্দ্রপ্রস্থে অভিষিক্ত করে যুধিষ্ঠির হিমালয় অভিমুখে যাত্রা শুরু করলেন । যাত্রাপথে এক কুকুর তাঁদের পিছু নিল । তাঁরা বহু দেশ ঘুরে লৌহিত্য সাগরের তীরে উপস্থিত হলেন ।অর্জুন আসক্তিবশত গাণ্ডীব ধনু ও অক্ষয় তূণ যুগল সঙ্গে এনেছিলেন এতে অগ্নি মূর্তিমান হয়ে সেগুলো বরুণ দেবকে ফেরত দিতে বলেন । অর্জুন তাই ধনু ও তূণ লৌহিত্য সাগরের জলে নিক্ষেপ করলেন । পৃথিবী প্রদক্ষিণের ইচ্ছায় তাঁরা প্রথমে দক্ষিণে গেলেন এরপর লবণসমুদ্রের উত্তর তীর দিয়ে পশ্চিম দিকে গিয়ে সাগর প্লাবিত দ্বারকা নগরী দেখে উত্তর দিকে চললেন।
   পাণ্ডবগণ বালুকার্ণব ও মেরুপর্বত দর্শন করে যোগযুক্ত হয়ে দ্রুত চলতে লাগলেন । যেতে যেতে সহসা দ্রৌপদী যোগভ্রষ্টা হয়ে ভূপতিত হন । ভীম তাঁর মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করলে যুধিষ্ঠির বলেন অর্জুনের প্রতি এঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল । কিছুক্ষণ পর সহদেব পড়ে গেলে ভীম তাঁর মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করেন; উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেন সহদেব ভাবতেন তাঁর চেয়ে বিজ্ঞ আর কেউ নেই । এরপর নকুল পড়ে গেলে ভীমের প্রশ্নের জবাবে যুধিষ্ঠির বলেন নকুল মনে করতেন তাঁর তুল্য রূপবান আর কেউ নেই । কিছুদুর গিয়ে শোকার্ত অর্জুনও পড়ে গেলেন । অর্জুনের মৃত্যুর কারণ হিসেবে যুধিষ্ঠির বলেন অর্জুন একদিনেই সকল শত্রু নাশ করার গর্ব করতেন যা তিনি পারেন নি; তাছাড়া তিনি অন্য ধনুর্বেদদের অবজ্ঞা করতেন ।  সবার শেষে ভীমও পড়ে গেলেন তিনি তাঁর আসন্ন মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞাসা করলে যুধিষ্ঠির বলেন ভীম অত্যন্ত ভোজন করতেন এবং অন্যের বল না জেনেই নিজ বলের গর্ব করতেন।  
  এরপর ইন্দ্র রথে চেপে যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে তাঁকে রথে উঠতে বলেন কিন্তু তিনি তাঁর আত্মীয়দের ফেলে যেতে রাজি হন না ।  ইন্দ্র বলেন তাঁরা দেহত্যাগ করে আগেই স্বর্গে গেছেন । এতে যুধিষ্ঠির তাঁর সাথে আসা কুকুরকেও সঙ্গে নিতে প্রস্তাব করেন । কিন্তু ইন্দ্র বলেন যাঁর সাথে কুকুর থাকে তিনি স্বর্গে যেতে পারেন না । কিন্তু যুধিষ্ঠির বলেন শরণাগতকে ভয় দেখানো, স্ত্রীবধ, ব্রহ্মস্বহরণ ও মিত্রবধ এই চার কার্যে যে পাপ হয় ভক্তকে ত্যাগ করলেও সেই পাপ হয় তাই তিনি ভক্তকে ত্যাগ করবেন না । তখন কুকুররূপী ভগবান ধর্ম নিজ রূপ ধরে বলেন স্বর্গে তাঁর তুল্য কেউ নেই । তিনি স্বশরীরে স্বর্গারোহণ করে অক্ষয়লোক লাভ করবেন । 
(তথ্য সহায়তাঃ কাশিদাসী মহাভারত,  ছেলেদের মহাভারতঃ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বাংলা উইকিপিডিয়া)

পেজ-এ লাইক দিন👇
আরও পড়ুন

Post a Comment

0 Comments