জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব (৬)/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম -- পর্ব (৬)
সন্দীপ কাঞ্জিলাল

ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ 

মানুষ জন্মগ্রহণ করে এক জিজ্ঞাসু মন নিয়ে। তাই প্রত্যেকটি শিশু জন্মের পর সবকিছু হাত দিয়ে স্পর্শ করে তার স্পর্শ স্বাদ নিতে চায়। আবার কোন কিছু মুখের মধ্যে পুরে নিয়ে স্বাদ গ্রহণের মাধ্যমে বুঝতে চায় এটা কি। তারপর যখন বড় হতে থাকে, তখন বাড়তে থাকে তার জ্ঞান। তখনই জন্ম নিতে থাকে প্রশ্নের। এটা কি, ওটা কি, এটা কেন হল, কিভাবে হল, বিভিন্ন রকম প্রশ্নের অবতারণা করতে থাকে। উত্তর পেলে তার মন শান্ত হয়। তা না হলে তাকে নিয়ে চলতে থাকে একটার পর একটা প্রশ্ন। একে বলে অনুসন্ধান, সত্যানুসন্ধান। জানতে চাওয়ার এই ক্ষমতা থাকার জন্য মানুষ সমস্ত প্রাণী জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। 

  মাত্র এক লক্ষ বছর পূর্বেও আমাদেরই পূর্বপুরুষ বাস করত বনে জঙ্গলে নয়তো কোন পাহাড়ের গুহায়, খাবার হিসাবে খেতো গাছের ফলমূল নয়তো শিকার থেকে পাওয়া বন্য জন্তুর কাঁচা মাংস, কারণ আগুন হয়তো তখনও মানুষ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়নি। ছোট ছোট গোষ্ঠীভুক্ত হয়ে তারা একত্রে বাস করত বিভিন্ন বিপদ আপদ হতে একত্রে সাহায্য পাওয়ার জন্য। শিকার করতে গিয়ে কখনো শিকার করত, কখনো বা নিজেরাই হিংস্র জন্তুর শিকার হয়ে যেত। গ্রীষ্মকালে গরমের উত্তাপ থেকে বাঁচতে থাকতো উলঙ্গ এবং শীতকালে শীত নিবারণে ব্যবহার করত গাছের শুকনো পাতা, বাকল এবং পশুর চামড়া। লজ্জা নামক অনুভূতি তখনও তাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। এই অনুভূতি আধুনিক সভ্য সমাজেরই আবিষ্কার। পুরুষের সমস্ত শরীরের কোথাও লজ্জা নেই, লজ্জা কেবল দু উরুর মাঝের পুরুষাঙ্গে এবং নারীর লজ্জা চিহ্নিত হয় স্তনে এবং যোনিতে। তাই শরীরের অন্যান্য অংশ খোলা থাকলেও চলবে কিন্তু ঐ বিশেষ জায়গা সর্বদা ঢেকে রাখতে হবে পরে ওই বিশেষ জায়গারই নাম হয় লজ্জাস্থান। কি বিচিত্র মানুষের চিন্তা ভাবনা। 

  প্রশ্ন করা এবং চিন্তা করা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি। এই প্রশ্ন এবং চিন্তা তৎকালীন সময়ে সঠিক উত্তর পেত না বলেই মানুষদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল কল্পনার। জন্ম দিতে হয়েছে দেব-দেবীর, যার আধুনিক সংস্করণ হিসেবে রূপ লাভ করেছে ঈশ্বর। পৃথিবীতে তাই দেব-দেবতার কোন অভাব নেই। আরো যে কত দেব-দেবী সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে, তার কোন ইয়ত্তাই নেই। তবুও সর্বশেষ এক হিসেবে দেখা যায় পৃথিবীতে মোট দেবদেবীর সংখ্যা তেত্রিশ কোটিতে এসে ঠাঁই নিয়েছে, আর ঈশ্বরের সংখ্যা দাঁড়িয়ে গেছে ৪২০০- এর ও অধিক। সেই সময় গোষ্ঠীর জন্য ছিল আলাদা আলাদা দেবদেবী, ছিল আলাদা আলাদা ঈশ্বর। সেসব ঈশ্বর ও আবার মানুষের মতোই রাগ করে, আবার খুশিও হয়, কখনো কখনো তো রাগের চোটে পুরো জাতিকেও ধ্বংস করে ফেলে। যার উদাহরণ পাওয়া যায় পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম ও ধর্ম গ্রন্থে আদ ও সামুদ জাতির প্রতি ইসলামের আল্লাহর আক্রোশ। এখানেই শেষ নয়, এক ঈশ্বর আবার আরেক ঈশ্বরের বেজায় শত্রু। প্রত্যেক ঈশ্বরই নিজেকে এবং নিজের ধর্ম ও ধর্ম গ্রন্থকে সঠিক ও সত্য হিসেবে দাবি করে এবং পৃথিবীর অন্য সকল ঈশ্বর, ধর্ম ও গ্রন্থ কে মিথ্যা বলে। এক ঈশ্বর আর এক ঈশ্বরের সহিত মারামারি কিংবা যুদ্ধ লেগেছে এমন তো শোনা যায় না, তবে এক ঈশ্বর অন্য ঈশ্বর প্রেমীদের কিন্তু ঠিকই ঘৃণা করতে শেখায় ধর্মগ্রন্থের মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয় ক্ষেত্র বিশেষে তো হত্যা করার ও আদেশ প্রদান করে। 

  পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মের ঈশ্বরই ব্যক্তি ঈশ্বরের ন্যায়। যেমন, মানুষের তোষামোদ করলে মানুষ যেমন খুশি হয়, তদ্রুপ ঈশ্বরকে তোষামোদ করলে ঈশ্বরও খুশি হয়। মানুষ যেমন খুশি হয়ে প্রতিদান স্বরূপ কিছু উপহার প্রদান করে, ঈশ্বরও তদ্রুপ খুশি হয়ে পরকালে অনন্ত সুখের স্থান উপহার দেন। মানুষের মত ঈশ্বরও রাগ করে, তাই শাস্তি স্বরূপ তৈরি করেছেন জাহান্নাম বা নরক। মজার বিষয় হলো, আগের যুগে রাজা-বাদশাহদের মতো ঈশ্বরেরও নির্ধারিত রাজ্য রয়েছে, রয়েছে নির্দিষ্ট সিংহাসন। রাজা যেমন নিজে কোন কর্ম না করে কেবল হুকুম করে এবং কর্ম সম্পাদন করে তার কর্মচারীগণ, ঈশ্বরও তদ্রুপ নিজে কর্ম না করে কেবল হুকুম দেন এবং তা পালন করেন তার কর্মচারীগণ দেবদেবী নয়তো ফেরেশতা। সত্যিই আজব সাদৃশ্য মানুষ আর ঈশ্বরের মাঝে। 

  বিংশ শতাব্দীর সূর্যাস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় মুখরিত। কিন্তু ধর্মের রথচক্র ও একই সঙ্গে পৃথিবীর বুকে এগিয়ে চলেছে। অথচ ধর্ম ও  জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ পরস্পর বিপরীতমুখী। জ্ঞান ও বিজ্ঞান মানুষের ধীশক্তির প্রয়োগ আর তথ্য যুক্তি-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। আর ধর্ম কল্পনা ও বিশ্বাসের বিপরীতমুখী প্রবণতায় অধিষ্ঠিত, যদিও সে কল্পনা ও বিশ্বাস প্রাণ পায় মানুষের জাগতিক অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির উৎস থেকেই। একদিকে মানুষের ধীশক্তির মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্ময়কর বিকাশ, আর অন্যদিকে একইসঙ্গে বিশ্বাস ও কল্পনায় বেঁচে থাকা ধর্মের প্রাবল্য চিন্তাশীল মানুষকে ভাবিত করে। অনেক মানুষের জীবনে দ্বৈত ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করে। একদিকে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আর অন্যদিকে ধর্মীয় সংস্কারের টানাপোড়েন ব্যক্তিসত্তাকে দ্বন্দ্বময় করে তোলে। ধীশক্তি যাকে মিথ্যা বলে জানে, বিশ্বাস তাকেই সত্য ভেবে আঁকড়ে থাকতে চায়। আরেক সংকট আসে ধর্মের নিজস্ব দ্বৈত রুপ থেকে। একদিকে ব্যক্তিমানুষ ধর্মকে নিজের ও পৃথিবীর কলুষের ঊর্ধ্বে এক সার্বিক শুভ আদর্শের রুপ দিতে চায়। আবার অন্যদিকে ইতিহাসে ধর্মীয় আদর্শের নামে যুদ্ধে ও সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে অগণিত মানুষের প্রাণ বলি, ধর্মের আড়ালে মানুষের বর্বরতা, বীভৎসতা, অন্ধ কুসংস্কার এবং ব্যভিচারের অসংখ্য উদাহরণ দেখে সংবেদনশীল মানুষ শংকিত হন। এ দ্বন্দ্ব ও চিন্তাশীল মানুষের মনকে আন্দোলিত, কখনো বা দিশেহারা করে। 

  এ দু'ধরনের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে অনেক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বিশুদ্ধ ধর্ম ও অশুদ্ধ ধর্ম, অথবা প্রকৃত ধর্ম ও বিকৃত ধর্মের মধ্যে পার্থক্য করেন। উদাহরণ স্বরূপ, অনেকে বলেন যে পরমেশ্বরে আত্মসমর্পণ, জীবে প্রেম, এবং সৎ পথে জীবনযাপন সদাচারই প্রকৃত এবং বিশুদ্ধ ধর্ম। বাকি সবই ধর্মের অপ্রয়োজনীয়। আর এসব অপ্রয়োজনীয়' বহিরঙ্গ থেকেই মানব সমাজে বিদ্বেষ, সংঘাত ও কুসংস্কার জন্মলাভ করে ধর্মকে অশুভ বা বিকৃত রূপ দেয়। বিশুদ্ধ ধর্মই সব ধর্মের নির্যাস। এই বিশুদ্ধ ধর্মকে অবলম্বন ও অশুদ্ধ ধর্মকে ত্যাগ করলে পৃথিবী থেকে বিদ্বেষ ও সংঘাত দূর হবে। আর মুছে যাবে জ্ঞানবিজ্ঞান ও ধর্মবিশ্বাসের মধ্যে আপাতমৌলিক বিরোধ। 

  সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর কল্পনার সঙ্গে বিজ্ঞানের মৌলিক বিরোধ আছে কিনা, সে কল্পনার বিভিন্ন রূপ থেকে মানুষে মানুষে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে কিনা, অথবা শুধুমাত্র ভক্তিজনিত ভাবাবেগের মাধ্যমে পৃথিবীতে সাম্য- স্বাধীনতা-মৈত্রীর আদর্শে সমাজব্যবস্থা নির্মিত হতে পারে কিনা, এসব বিষয়ে আমরা ক্রমশ পরে আলোচনা করব। কিন্তু এ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে রাখা প্রয়োজন যে সব ধর্মই সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরের তত্ত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। উদাহরণ স্বরূপ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম এই তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে নেই। কিন্তু তবু তারাও ধর্ম। অদ্বৈতবাদী হিন্দু ধর্ম সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকেই পরমাত্মার বিকশিত রূপ মনে করে। সেখানে স্রষ্টা ও সৃষ্টি, জীব ও শিবের মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই। অতএব সৃষ্টি থেকে আলাদা কোন সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর নেই। সমস্ত মহাবিশ্ব এবং জীবজগৎ পরম ব্রহ্মেরই আত্মপ্রকাশ মাত্র। প্রকৃতপক্ষে সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বরে বিশুদ্ধ বিশ্বাস শুধুমাত্র ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলাম ধর্ম, এই তিনটি মরুভূমিজাত ধর্মেরই কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে। সব ধর্মেরই অবশ্য কোনও না কোনও ইষ্ট আছে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার পরমেশ্বরের তত্ত্ব প্রতিটি ধর্মেই অপরিহার্য নয়। অতএব একথা বলা যায় না যে শুধুমাত্র একজন কল্পিত সৃষ্টিকর্তা বা পরমেশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করাই ধর্ম।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments