জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (পাকিস্তান)/চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প-- এশিয়া (পাকিস্তান)

চিন্ময় দাশ

সোনার দেশ হিন্দুস্তান 

(পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর ইরান যেখানে এক বিন্দুতে এসে মিলেছে, সেটা একেবারে প্রত্যন্ত এক  পাহাড়ি এলাকা।  সেখানে ভাষা বালুচ। যা আসলে ইরানীয় ভাষা পরিবারের একটি। উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ি এলাকার মানুষজন এই ভাষা ব্যবহার করেন।
সেখানকারই এক যুবক দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে ভারতে পৌঁছে, ভাষার কারণে কী বিড়ম্বনায় পড়েছিল, তাই নিয়েই এই গল্প।)

  একটি যুবক ছেলের বহুদিনের সখ, সে বাইরের দেশে বেড়াতে যাবে। যুবক বয়স. এই বন-পাহাড়ে ঘেরা দেশে থাকতে থাকতে একেবারে বিরক্ত উঠেছে সে। গোটা দুনিয়াটাই কী এরকম? না কি, অন্য রকম কিছুও দেখা যাবে বাইরে বেরুলে? ভেবে ভেবে মন উড়ুউড়ু তার। 
দু'-একজন বন্ধুকে বলল বটে, কেউ রাজি নয়। কেমন সব মানুষ এরা? এই পাহাড় জঙ্গল পার হয়ে গেলে, নিশ্চয় কত নতুন নতুন দেশে যাওয়া যাবে। আলাপ হবে কত মানুষের সাথে। কত কিছু দেখা যাবে। জানা যাবে কত কিছু। বন্ধুরা কিন্তু কেউ রাজি হল না। তারা বলল-- যেতে হয়, তুমি একাই যাও ভাই। ফিরে এসো। তোমার কাছে শুনি সব। তখন দেখা যাবে। 

  কি আর করা যায়? একলাই পথে নেমে পড়ল ছেলেটি। 

  কত দিন ধরে কত দেশে ঘুরে বেড়াল সে-- চীন, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া এইসব। ঘুরতে ঘুরতে একদিন ঢুকে পড়ল ভারতবর্ষে। একটা শহরে ঢুকে ভারী ভালো লাগল তার। একেবারে ছবির মতন সাজানো। সুন্দর ঝকঝকে রাস্তাঘাট। ঝাঁ-চকচকে সাজানো-গোছানো দোকানপাট। কত রকমের মনোহারি জিনিষপত্রের পসরা সাজানো।
একটাই অসুবিধা ছেলেটার, মানুষজনের ভাষা বুঝতে পারছে না। তার ভাষাও বুঝছে না কেউ। অনেক কষ্টে, হাত-মুখ-চোখের অনেক কসরত করে বোঝা গেল, দেশটার নাম হিন্দুস্তান। বেড়াতে বেরিয়ে, যে দু-একটা নতুন শব্দ শিখেছে এত দিনে, তা দিয়ে কোনও কাজই হচ্ছে না এখানে। কোন কাজেই লাগছে না সেগুলো। 
সেদিন শহরে ঘুরতে ঘুরতে অনেক বেলা হয়ে গেছে। পেট চুঁই-চুঁই করছে খিদেয়। বেশ বড়সড় দেখে একটা মিষ্টির দোকান দেখে, দাঁড়িয়ে পড়ল ছেলেটা। কত রঙের, কত রকমের মিষ্টি শোকেশের ভিতর। থরে থরে সাজানো মিষ্টি সব। দেখলেই জিভে জল চলে আসে। কিন্তু হলে কী হবে? কোন মিষ্টির কী নাম, দাম কত কোনটার-- কিছুই তো জানা নাই! বুঝে গেছে, না দোকানি, না কর্মচারী কেউ তার ভাষা বুঝবে না।
অগত্যা সোজা দোকানদারের কাছে পৌঁছে, আঙ্গুল তুলে একটা মিষ্টি দেখালো ছেলেটা। মনের ভাব, ঐ মিষ্টিটা আমাকে দাও। 

  ছেলেটা যে অনেকক্ষণ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোকেশটা দেখছিল, দোকানি সেটা দেখেছে। সে ভাবল, ছেলেটা মিষ্টি পছন্দ করে, নাম জানতে চাইছে। খুশি হয়ে হাসি মুখ করে নাম বলল-- খাজা।

  ছেলেটার তো আনন্দ ধরে না। এই একটা কথা অনন্ত বুঝতে পারা গেছে। দোকানি তাকে মিষ্টি খেয়ে যেতে বলছে-- খা যা। মানে, খেয়ে যাও। সে তো মিষ্টি দিতেই বলেছিল দোকানিকে। দোকানি তাকে খেয়ে যেতে বলছে। 

  এদিকে পেটের ভিতর ক্ষিদেটা তো চাগাড় দিয়ে উঠেছিল। দেরি না করে, গপাগপ মিষ্টি খাওয়া আরম্ভ করে দিল সে। একটা করে খাজা তুলছে আর মুখে পুরছে। তুলছে আর মুখে পুরছে। দেখতে দেখতে পুরো রেকাবি সাবাড় হওয়ার জোগাড়! পেটটি যখন মোটা হোল বেশ, ছেলেটি হাত গুটিয়ে উঠে দাঁড়াল। খুশি মুখে দোকানি এসে দাম চাইল তার কাছে-- পয়সা দাও।
কিন্তু ছেলেটা তো এক বর্ণও বুঝল না সে কথার। সে হেলতে দুলতে রাস্তায় নেমে গেল। কত চেঁচামেচি করল দোকানি। কানেই তুলল না সে।

  কী আর করে? দোকানি তখন শহরের কোতোয়ালের কাছে গিয়ে নালিশ ঠুকে দিল তার নামে। সব শুনে, একজন সেপাইকে পাঠানো হল লোকটাকে ধরে আনবার জন্য।

  হয়েছে কী, সেই কোতয়াল লোকটার দারুণ প্রতাপ। যেমন রাগী, তেমনি তেজীয়ান। দুষ্টু লোক পেলে, তার আর রেহাই নাই। যে একবার এই কোতোয়ালের পাল্লায় পড়েছে, হয় সে জীবনে আর মন্দ কাজে যাবে না। নয়তো, শহর ছেড়েই পালাবে তল্পিতল্পা গুটিয়ে।
হয়েছেও ঠিকঠাক তাই। বে-আইনি কাজ শহর থেকে যেন উবেই গিয়েছে। বেশ শান্তিতে আছে মানুষজন। কোন ঝুটঝামেলা নাই। হলে কী হবে, ঝামেলা হয়েছে কোতোয়ালের নিজেরই। কাজকম্ম নাই। বসে বসে হাতে-পায়ে খিল। কোমরে বাতের বাসা হয়ে যাচ্ছে। ভুঁড়ি গজিয়েছে বড়সড় একটা কুমড়োর মতনটি। এত দিন বাদে একটা অভিযোগ পেয়ে, মনে মনে বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল মানুষটা।

  বেশি সময় লাগল না। সেপাই পাঠিয়ে ধরে আনা হোল ছেলেটাকে। খুব হম্বিতম্বি করল কোতোয়াল। ডানা ঝাপটে, আশপাশের গাছের পাখিরা উড়ে পালাল তার ধমক-ধামকের তোড়ে। কিন্তু একটা কথাও তো মগজে গেল না ছেলেটার। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। 
একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে, একটা বুদ্ধি এল কোতোয়ালের মাথায়। একটা নাপিত ডেকে, পুরো মাথাটা কমিয়ে দিল ছেলেটার। সেপাইটি মিনমিন করে জানতে চাইল-- এটা কী হল, হুজুর!
  বিশাল এক ধমক কোতোয়ালের-- হতভাগা কোথাকার। এই সাধারণ ব্যাপারটা বুঝতে পারলি না? এ ব্যাটা বিদেশী লোক। আমাদের একটা কথাও মগজে ঢুকছে না ওর। এদিকে তো ভরপেট মিষ্টি খেয়ে বসে আছে। কিছু না বলে, এমনি এমনি ছেড়ে দিই যদি, দেশে ফিরে গিয়ে, বগল বাজাবে আর বলবে, দারোগা ব্যাটা কিছুই করতে পারেনি আমার। কিন্তু আমাকে তো চেনে না। দ্যাখ, আজ তোর কী হাল করি আমি।  

  সেপাইকে হুকুম করল-- এক ভাঁড় ভুষো কালী আর একটা গাধা ধরে নিয়ে আয়।

  পরিষ্কার করে মাথা কমিয়ে, ভালো করে ভুষো কালী মাখানো হল ছেলেটার মাথায়। তারপর তাকে গাধার পিঠে চাপানো হল, উল্টো দিকে মুখ করিয়ে। 
কোতোয়াল তাতেও দমবার পাত্র নয়। একদল বাজনদার ডেকে আনা হল। ছেলেটাকে গাধার পিঠে চাপিয়ে গোটা শহর ঘোরানো হবে। বাজনদারেরা যাবে তার পিছন পিছন। 
 
  একেবারে শোভাযাত্রার মত ব্যাপার। এমনটা কত কাল কেউ দেখেনি। সারা শহরের লোকজন যেন ভেঙে পড়েছে রাস্তার দু'ধারে। যারা জায়গা করতে পারেনি, বাড়ির ছাদে, বা গাছের ডালে চড়ে বসেছে তারা। ফূর্তির সীমা নাই লোকেদের। ভিড় করে দেখতে লাগল সকলে। ঘরবাড়ির দরজা-জানালা-ছাদ সব জায়গায় থিকথিক করছে মানুষ। আনন্দে উল্লাসে চিৎকার করছে সবাই। যেন বিরাট এক উৎসব লেগেছে শহর জুড়ে।

  মজার ব্যাপার হল, ছেলেটা বুঝতেই পারছেনা, এত সব ব্যাপারের মানেটা কী? সে ভাবছে, হলামই বা বিদেশী? অতি সাধারণ একজন লোক আমি। আমার জন্য এত বড় সম্বর্ধনার দরকারটা কী? আসলে, হিন্দুস্তানের মানুষজন খুব উঁচু মনের। বিদেশীকে খাতির-সম্মান করতে জানে! 

  নিজেকে বেশ সৌভাগ্যবান আর কেউকেটা মনে হতে লাগল তার।

  গাধাটা চলেছে দুলকি চালে। কাতারে কাতারে মানুষ চলেছে গাধার পিছনে। ছেলেটাকে তো উল্টোমুখ করেই বসানো হয়েছে। লোকগুলো তার সামনেই। সে প্রতিসম্মান জানাতে হাসিমুখে হাত নাড়তে লাগল জনতাকে। মাথা নুইয়ে আদাব জানাতে লাগল। তাতে আরও মজা পেয়ে, উদ্বেল হয়ে উঠল মানুষজন। এক সময় শহরের সীমানায় পৌঁছে, তাকে নামিয়ে দেওয়া হল গাধার পিঠ থেকে। 

  এই ঘটনার পর, আর কোন দেশে যেতে মন চাইল না ছেলেটার। ভাবল, হিন্দুস্তান সফরের এই স্মৃতিটাই বরং জমিয়ে রাখা যাক বুকের মধ্যে। সোজা ঘরমুখো হয়ে, দেশে ফিরে এল সে।

  গ্রামে ফিরতেই, বন্ধুরা ছেঁকে ধরল তাকে। কেমন বেড়াল হল? কোন দেশ কেমন? কোন জায়গাটা তোমার বেশি ভালো লেগেছে? এমনি হাজারো সব প্রশ্ন। 
ছেলেটা বলল-- একসাথে সব কথা কি আর বলা যায়? শেষ কথাটার জবাব দিই আগে। সেরা দেশ যদি বলতে হয়, সে হল হিন্দুস্তান। এমন দেশটি কোত্থাও খুঁজে পাবে না তোমরা। 

-- কেন, কেন? কেমন সে দেশ। একটু বলো, শুনি।  সবাই ছেঁকে ধরল তাকে। 
ছেলেটার তো ভালো লাগার ঘোর কাটেনি তখনও। সে একেবারে পুলকিত হয়ে, বলতে লাগলো--তাহলে, বলি শোন। সে এক আশ্চর্য দেশ। দেশটা যেমন ধনী,মানুষজন তেমনি দয়ালু আর সজন। সব কিছুই সেখানে বিনি পয়সায় পাওয়া যায়। গাঁটের কড়ি খরচ করতে হয় না। 

  বন্ধুরা বলল-- বলছটা কী? অমন আবার হয় না কি?
-- তাহলে আর বলছি কেন? ছেলেটার উৎসাহের শেষ নাই. সে বলে চলল-- খিদে লেগেছে? সামনের যে কোনও মিষ্টির দোকানে ঢুকে পড়। পছন্দ করে, যে কোনও মিষ্টি দেখিয়ে দাও দোকানিকে। সে নিজেই তোমাকে খেয়ে নিতে বলবে। তারপর পেট ভরে খাও, আর ঢেকুর তুলতে তুলতে বেরিয়ে পড়ো।

  বন্ধুদের তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আজগুবি কথা নয় তো? এমন দেশ আবার হয় না কি? সে কথা বলতেই, ছেলেটা বলে উঠল-- হয় বন্ধু, হয়। দুনিয়ার কতটুকুই বা দেখেছি আমরা। ক'টা দেশের কথাই বা জানি?  শুধু তাই নয়, আরও বলি শোন। যদি দারোগার কানে যায়, যে তুমি বিদেশী মানুষ, অমনি মদত করবার জন্য, লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে যাবে তোমাকে। 

  বন্ধুরা বলল-- তুমি যে কি বলছ, মাথায় ঢুকছে না আমাদের।

  ছেলেটা বলল-- একটুও বানিয়ে বলছি না আমি। যা বলছি, আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। আমাকেই দ্যাখো না, দোকানে মিষ্টি খেয়েদেয়ে রাস্তায় হাঁটছি, শহরের দারোগা লোক পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। অনেকদিন ঘুরে বেড়িয়েছি তো, আমার চুল-দাড়ি সব উস্কোখুস্কো হয়ে ছিল। নাপিত ডাকিয়ে, সুন্দর করে পরিষ্কার করে দিল সব। একেবারে ন্যাড়ামাথা নিয়ে ঘুরব কী করে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভারী যত্ন করে কলপও করে দিল মাথায়। 

  তখনও বিশ্বাস হচ্ছে না বন্ধুদের। ছেলেটা মুচকি হেসে বলল-- শেষ করতে দাও আমাকে। আরও অনেক আছে।

  নিজের পকেটের পয়সায় বাজনদারের দল ডেকে আনল দারোগা। একেবারে শোভাযাত্রা করে গোটা শহর ঘোরানো হল আমাকে। বাজনদারেরাও থাকল আমার সাথে। শহর যেন ভেঙে পড়েছিল আমাকে দেখতে। সে কী উল্লাস মানুষের। যদি দেখতে তোমরা।

  কথা শেষ করে ছেলেটা বলল-- তোমাদের কোন দোষ নাই। নিজের বেলায় না ঘটলে, আমিও কি আর বিশ্বাস করতাম? মোটেই না।

  বন্ধুরা লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, বলল-- আমাদের এই শোনাই সার। তোমার মত কপাল কি আর হবে আমাদের? 

  ছেলেটা বেশ গর্বিত মুখ করে বলল-- সেসব আমি জানি না। তবে একটা কথা হলফ করে বলতে পারি তোমাদের। আবার যদি কখনও বেরোবার কপাল হয়, আবারও হিন্দুস্তানেই যাব আমি। পারলে, বার বার যাব। আহারে, কী সোনার দেশ হিন্দুস্তান!


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments