জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (দ্বাদশ পর্ব)/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী ।। পর্ব ― ৩১

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা : শূন্য থেকে 'শূন্যে' উড়ানের রূপকথা― (দ্বাদশ পর্ব)

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


'এ স্টার ইজ ডেড।'

'আকাশের স্বপ্ন দেখানোর মানুষটি আর নেই।'

মাত্র বিয়াল্লিশটি বসন্ত পার করেছিল তাঁর প্রাণের স্পন্দন। জ্বলেছিল তাঁর জ্ঞানের শিখা। তারপর ভোররাতে সুবাস ছড়ানো শিউলি ফুলের মতো অকালে ঝরে পড়ল তাঁর প্রাণবায়ু। চিরতরে। তিনি অসীম প্রতিভাদীপ্ত বৈজ্ঞানিক, স্বল্পায়ু ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা। সবেমাত্র কুঁড়ি থেকে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল তাঁর অফুরন্ত জ্ঞানের ভাণ্ডার। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর পাণ্ডিত্যের সৌরভ। মৃত্যুর এক বছর আগে ১৯৯৫ সালে 'সেরা শিক্ষক'-এর শিরোপা অর্জন করেছিলেন তিনি, পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মৃত্যুর পূর্বে কিছুদিন আগের কথা। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বর মাসের কুড়ি তারিখে 'দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া'র রিপোর্টার শ্রী সুব্রত রায় লিখেছিলেন―
'Now at 43, the scientist decided to ascertain the radius of the sun more accurately with the help of observations during the totally solar eclipse on 24th Oct., 1995.'
ক্ষণজন্মা এই বিজ্ঞানীর গবেষণা পত্রের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সত্তরটিরও বেশি। রিসার্চ পেপারগুলি বিভিন্ন সময় দেশবিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং উচ্চ প্রসংশিত হয়েছে। নিজের ও দেশের সম্মান উন্নত করেছে। সারাজীবনে অনেক পুস্তক লিখেছেন তিনি। ঈর্ষণীয় তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা। পাঠ্যপুস্তক আর জ্ঞান বিজ্ঞানের উপর লেখা তাঁর বইগুলো যেমন তথ্যের আকর গ্রন্থ তেমনি বর্ণনায় সাবলীল ও পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত। পঠনকালে পাঠকের হৃদয়ে বিশেষ আগ্রহের সঞ্চার ঘটায়।

তিনি ছিলেন গুণী শিক্ষকের ততোধিক গুণী বিদ্যার্থী। যিনি সর্বদা তাঁর চলার পথের শিক্ষাগুরুদের শিরে ধারণ করে রাখতেন। যথেষ্ট সম্মাননা প্রদর্শন করেছেন। গুরুদক্ষিণা ছিল তাঁর রক্তে। স্কুল জীবনে তাঁর প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মাস্টার মশাই শ্রী মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী। এ হেন লাহিড়ী স্যারকে উৎসর্গ করে তিনি লিখেছিলেন বই। 
      

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়বার সময় নামকরা প্রফেসর শ্রী অমল রায় চৌধুরীর সান্নিধ্যে আসেন। অমল স্যার তখন বিশ্বের বিজ্ঞানীকূলে এক পরিচিত নাম। রীতিমত বিখ্যাত। সেই প্রিয় অমল স্যারকে উৎসর্গ করলেন 'ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স' (Classical Mechanics) গ্রন্থখানি। ১৯৯৩ সালে অধ্যাপক যোশী'র সঙ্গে যুগ্মভাবে লিখেছিলেন পাঠ্যপুস্তকটি। ফিজিক্সে মাস্টার্স (M.Sc.) পাঠরত বিদ্যার্থীদের নিকট এটি অবশ্যপাঠ্য। স্বদেশ-বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত বইখানি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এম এস সি পাঠক্রমে পড়ানো হয়।

১৯৯১ সালে অধ্যাপক যোশী'র সঙ্গে যৌথভাবে পুনরায় তিনি লিখলেন 'আওয়ার সোলার সিস্টেম' (Our Solar System)। সহজবোধ্য ইংরেজিতে লেখা এই বইটি উইলি ইষ্টার্ন লিমিটেড প্রকাশনা থেকে ১৯৯২ সালে বের হয়। এটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রিয় রিসার্চ গাইড অধ্যাপক জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকর-এর উদ্দেশ্যে।

এছাড়াও ১৯৯৫ সালে লেখা 'Challenge of Astronomy', সূর্য গ্রহণের ওপর ১৯৯৪ সালে লেখা 'A night fall on a sunny morning', ১৯৯৫-তে 'Myths and Superstition and their Classical Scientific Explanation' এবং ১৯৯৫-তে লেখা আরও একটা বই 'এবারের পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ' বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। আরও বেশ কিছু বই তিনি লিখে গেছেন যা মুদ্রণের অপেক্ষায় ছিল, অথবা লিখনের পর্যায়ে ছিল। 'নক্ষত্রের জন্মমৃত্যু', এম এস সি আর পি এইচ ডি স্টুডেন্টদের জন্য 'Introductory course on Astronomy and Astrophysics', 'Total Solar Eclipse' এবং ১৯৯৬-র ঘটনা সম্বলিত 'Total Solar Eclipse' পুস্তক গুলি হয় ছাপাখানাতে প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল অথবা রচনা হচ্ছিল, যা অচিরেই ধাক্কা খেল।

(দুই)
ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (IUCAA), পুনে-এর মাসিক নিউজলেটারের নাম 'খাগোল' (Khagol)। প্রিয় ছাত্র ড. রানার অকাল প্রয়াণে 'খাগোল'-এ আঠাশতম সংখ্যায় অধ্যাপক জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকর লিখলেন―
'His small stature and outwardly sedate demeanor hid a highly motivated and restless human being. I discovered this, right from the times when Rana joined me as a Ph.D. student more than sixteen years ago when we are both at the T.F.I.R., Bombay.'

একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিক নিউজপেপার লিখেছিল ― 'A star is dead'। 

প্রিয় ছাত্রের প্রয়াণে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক অমল কুমার রায়চৌধুরী লিখেছিলেন―
'Narayan was the best science student that I have ever seen. I knew that he will not remain with us for a long time, but couldn't think that he will leave so early. If he could enjoy a longer and malady free life, then one day he would have been regarded as the greatest Bengali scientist.'

বৈজ্ঞানিকের আবাল্য বন্ধু ছিলেন চিকিৎসক গৌর হরি রাউৎ। বন্ধু গৌর-ই প্রথম ১৯৬৯ সালে স্কুল ফাইনালে নারানের দ্বিতীয় স্থানের সংবাদ পাওয়া মাত্র রাতের অন্ধকারে ফুলের মালা নিয়ে হাজির হয়েছিল এবং গলায় মালা পরিয়ে বন্ধুকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেছিল। এ হেন বন্ধুর কল্পনায় এখন ছেলেবেলার স্মৃতি ভীড় জমায়। তিনি স্মরণ করলেন―
'অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, মহান জগদীশ বোসের পর এই বর্ণময়, শ্রেষ্ঠ প্রতিভাবানের জীবন শেষ হয়ে গেল পুনার একটি হাসপাতালে। পৃথিবীর বেঁচে থাকা আমরা, অর্থাৎ যারাই একবার ওর কাছাকাছি হয়েছি, তারা সবাই জানি কী প্রতিভাধর মানুষ ছিল নারায়ণ। জ্ঞানের গরিমায় আলোকিত করে গেছে পশ্চিমবাংলা, ভারত তথা পৃথিবীর মহাকাশ বিজ্ঞানকে।'
        

প্রেসিডেন্সি কলেজে বি এস সি এবং এম এস সি-তে তাঁর সহপাঠী ছিলেন আই এ এস শ্রী শ্যামল সরকার। তিনি বলেছেন―
'ওর চলে যাওয়াতে রেডিও-ফিজিক্স এবং রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি বিষয়ের প্রাণপুরুষ চলে গেল। আমেরিকা, কানাডা ও ইংল্যান্ডের পদার্থবিজ্ঞানীদের টেক্কা দেওয়ার ও ভুল ধরার মানুষটি চলে গেল। সেরা বাঙালির নামটি অনেকের কাছে অজানা রয়ে গেল।' 

ডাঃ বি সি রায় হাসপাতালের শিশু শল্য চিকিৎসক-শিক্ষক তাঁর বান্ধবী সুমিত্রা বিশ্বাস জানান―'বিদেশে জন্মালে ওর নাম নিশ্চয়ই নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতো।' 

তাঁর এক স্নেহধন্য ছাত্র শ্রী বিপ্লব বিশ্বাস স্মৃতিচারণায় বলেছেন―'এই সৌরজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং বিস্ময়কর বস্তু হল আমাদের সূর্য। অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র রানাও তেমনি নিজের আলোকে আলোকিত উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।'

সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির-এর একদা প্রধান শিক্ষক শ্রী শ্রীনিবাস নন্দ স্যারের চোখে তাঁর সেরা ছাত্র ছিলেন নারায়ণ। শোকে অনুতপ্ত প্রিয় হেড মাস্টার মশাই। তিনি বলেছেন―'নারান নেই, থাকবে তার সুনাম, তার আবিষ্কার এবং তার শিক্ষক প্রীতি। সে তো এক নক্ষত্র।'

অঙ্কের প্রিয় মাস্টার মশাই শ্রী চিত্তরঞ্জন দাস বলেছেন―'একজন বিজ্ঞানী সে হাঁটু গেড়ে প্রণাম করছে সকলের মাঝে এর থেকে বেশি আর কি পাওনা থাকতে পারে একজন সাধারণ শিক্ষকের?'

বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর শ্রী সন্তোষ কুমার ঘোড়ই-এর আক্ষেপ―'বিয়াল্লিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই তরুণ এই প্রতিভা অকালে ঝরে যায়। শেষবার ও আমাকে 'স্যার, আসছি' বলে ট্রেনে উঠল। কেন আর আসবে না? কেন দেখা করবে না? কেন স্টেটসম্যান পত্রিকার পাতায় পড়তে হল 'এ স্টার ইজ ডেড'?'
তিনি আরও বলেছেন―'পদার্থবিদ্যার একজন অধ্যাপক হয়ে বিস্ময়াবিষ্ট হতাম তার বিষয়ের গভীরতা ও তথ্যনিষ্ঠ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে। ঝকঝকে তার প্রতিভাদীপ্ত লেখাগুলি জ্ঞানপিপাসু পাঠকের কাছে না পরিবেশন করলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসাবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে অপরাধী থেকে যাব। তাই মূলত বিজ্ঞানমণীষায় প্রকাশিত নারায়ণের লেখাগুলি দিয়ে সাজিয়ে দিলাম 'নিউটনের আপেল এবং নারায়ণ'।' আজ্ঞে হ্যাঁ, ছাত্রপ্রতিম নারায়ণ চন্দ্র রানা'র স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রফেসর ঘোড়ই ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতার বইমেলায় প্রকাশ করেছিলেন 'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ' বইখানি। ২০১৩ সালের এপ্রিলে সাবড়া রামকৃষ্ণ বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষক শ্রী বাদল চন্দ্র দে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ রচনা করেছেন।
        
(তিন)
১৯৯৬ সালের শেষ ভাগ। ততদিনে বিজ্ঞানীর জীবন প্রদীপ গেছে নিভে। অথচ মৃত্যুর পরে এল তাঁর কাজের স্বীকৃতি। 'ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট এফোর্ট ইন সায়েন্স পপুলারাইজেসন (জেনারেল)―১৯৯৬।' জনসাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ভারত সরকার মরনোত্তর তাঁকে ব্রোঞ্জ মেডেল, গোল করে গোটানো বিশেষ উদ্ধৃতি সংবলিত কাগজের পুঁথি এবং নগদ এক লক্ষ টাকা পুরস্কার প্রদান করে। পুঁথি, মেডেল আর পুরস্কার অর্থ গ্রহণ করেছিলেন প্রয়াত বৈজ্ঞানিকের মা নাকফুড়ি দেবী। সঙ্গে ছিলেন গ্রামের সমাজসেবী শ্রী নারায়ণ চন্দ্র মাইতি। গোল করে গোটানো লেখ্যপটে উল্লেখিত রয়েছে―
'Prof. Narayan Chandra Rana contributed greatly to the popularisation of science, particularly in the field of Astronomy and Astrophysics. His untimely death on August 22, 1996, at the young age of 42 years, cut short a brilliant career which encompassed a variety of interests and activities. He worked incessantly for the advancement of science and promotion of scientific temper. Prof. Rana had conducted a variety of programmes / activities including campaigns built around events like the total solar eclipse of 1995, as also workshops on making sky globes, telescopes and portable planet etia, besides writing of books and scripts on astronomy. He organised school students' Summer programmes mobilized amateur astronomers of the country and was responsible for the creation of the confederation of Indian Amateur Astronomers' Association. Prof. Rana planned and successfully carried out an experiment for measuring the width of the umbral shadow at the time of the total solar eclipse of October 24, 1995, in order to determine the solar photospheric radius with an army of amateur astronomers, consisting mostly of school / college students.'

তাঁর অকাল প্রয়াণের পরের বছর। ১৯৯৭ সাল। সেবার স্বাধীনতার গোল্ডেন জুবিলী। পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে ভারত সরকার দেশের ইতিহাসে এ যাবৎকালের কৃতী বৈজ্ঞানিকের যে তালিকা উন্মোচন করে, তাতে ঠাঁই পান অখ্যাত সাউরি'র উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানা।
       
অধ্যাপক রানা'র মৃত্যুর পর সাউরি'তে গড়ে ওঠে 'নারায়ণ চন্দ্র রানা ফাউন্ডেশন'। সাউরি'তে নিজেদের বসতবাটির সম্মুখে প্রিয় অনুজ সুজন রানা তার দাদার একটি আবক্ষ মূর্তি বসিয়েছেন ২০০০ সালের উনত্রিশে এপ্রিল। উদ্বোধন করেছিলেন মেদিনীপুরের সাউটিয়ার আরেক কৃতী সন্তান পরমাণু বিজ্ঞানী ও ড. মেঘনাদ সাহা'র ছাত্র অধ্যাপক ড. সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র।

২০০৪ সাল ড. রানা'র পঞ্চাশতম জন্মজয়ন্তী। সেবছর প্রয়াত বৈজ্ঞানিকের পঞ্চাশতম জন্মদিন মহাসমারোহে পালন করা হয় অক্টোবর মাসের দশ তারিখে। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে সেদিন উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞানীর এম এস সি ক্লাসের বন্ধু ড. চিন্ময় ঘোষ এবং স্থানীয় সাংসদ শ্রী প্রবোধ পান্ডা সহ অগণিত শুভানুধ্যায়ী। সাউরিতে ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা'র ৫০ তম জন্ম জয়ন্তী পূর্তি উৎসব উপলক্ষে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। সম্পাদনা করেন শিক্ষক শ্রী নারায়ণ চন্দ্র মাইতি। তিনি উক্ত স্মরণিকায় ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা স্মরণে একটি ছোট্ট কবিতা লিখেছিলেন―
'অর্ধশত বর্ষ পরে     তোমায় স্মরণ করে
            গুন মুগ্ধ তব ভক্ত জন।
বিজ্ঞান সাধক তুমি     মহাবিশ্ব কর্মভূমি
            বর্নময় তোমার জীবন।।
এসেছিলে ক্ষণ তরে     এই ধরণীর পরে
            তুমি ছিলে গ্রামের গৌরব।
নয়নের মণি করে     রেখেছি তোমারে ধরে
            স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ'পর।।
গ্রহসূর্যতারা সাথে     গবেষণা দিনেরাতে
            সদা কর্মময় ছিলে তুমি।
অকাল প্রয়াণ তব     দুঃখ ছিল নব নব
            হাহাকারে ভরে জন্মভূমি।।
তুমি তো নক্ষত্র আজ     বিরাজ নক্ষত্র মাঝ
            তব আলো কর বিকিরণ।
তোমারে আদর্শ করি     যাবে সবে লক্ষ্য ধরি
            তাই আজ এ স্মৃতি তর্পণ।।

বিজ্ঞানীকে নিয়ে অনেক প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্মৃতিচারণা, জীবনী প্রকাশ পেলেও তাঁকে নিয়ে রচিত কবিতা সম্ভবত এটিই প্রথম ও শেষ; আর দ্বিতীয়টি নেই। 
       

অবিভক্ত মেদিনীপুরের প্রথম ডিগ্রি কলেজ (প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৭৩ সাল) মেদিনীপুর কলেজ গড়ে তুলেছে 'এন সি রানা স্কাই অবজারভেশন সেন্টার' (N C Rana Sky Observation Centre)।

সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দির ভোলেনি তার এই কৃতী ছাত্রকে। তাঁকে ভোলেননি বর্তমান স্কুল কর্তৃপক্ষ। শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের একটি আবক্ষ মূর্তি বসানো হয় স্কুল প্রাঙ্গণে। মূর্তিটি উন্মোচিত করা হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসের আট তারিখে। উন্মোচন করেন কলকাতার এম পি বিড়লা প্লানেটোরিয়ামের বর্তমান অধিকর্তা ড. দেবীপ্রসাদ দুয়ারী। 

(চার)
এপ্রিল থেকে জুলাই। ২০২১ সাল। বিগত তিন মাসাধিক কাল আমার মনন-চিন্তনে অবিচ্ছেদ্য বিরাজমান ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সে সহাবস্থান অটুট ছিল কল্পনায়। দারিদ্র্যের পাহাড় প্রমাণ চাপ আর শূন্য থেকে তাঁর উল্কা গতির উত্থান অচিরেই বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল আমার ক্ষুদ্র হৃদয়ে। যে প্রকারে সামুদ্রিক সুনামির ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরভূমিতে, তছনছ করে দেয় সভ্যতার সব লক্ষণ; সে-রূপে বারেবারে প্রতিকূলতার আগমন ঘটেছে প্রফেসর রানা'র সম্মুখে। সকল দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য, প্রফেশনাল জেলাসি আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তাঁর সম্মুখে বাধার আকাশ সমান প্রাচীর নির্মাণ করেছে। অথচ, এ হেন কঠিন পরিস্থিতির বিপক্ষে সবসময় রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। সাময়িক বিরাগভাজন হয়েছেন। মানুষ ভুল বুঝেছে। কিন্তু তিনি সরে যাননি তাঁর আদর্শ মসৃণ সৎ পথ থেকে। কখনও হার স্বীকার করেননি। সংগ্রামের কন্টক বিছানো রাস্তা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে অনেক রক্ত ক্ষয় হয়েছে তাঁর। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ভূমিতে দাতা কর্ণের ন্যায় তাঁর রথের চাকা ধরিত্রীর বুকে আকস্মিক গ্রোথিত হয়েছে। তবুও তিনি বিচ্যুত হননি তাঁর আদর্শের রাস্তা থেকে। উঠে দাঁড়িয়েছেন অমিত বিক্রমে। অসম্ভবকে সম্ভব, দূরকে আপন করেছেন অবলীলায়। সাফল্য স্বেচ্ছায় তাঁর দোরগোড়ায় হানা দিয়েছে। এমনই অদম্য তাঁর মনের জোর। অকল্পনীয় তাঁর স্পৃহা। অসম্ভব তাঁর জেদ। অমর তাঁর লড়াই। ক্ষণজন্মা এই বিজ্ঞানী আমাদের শিখিয়েছেন হার-না-মানা এক জীবন সংগ্রাম। তবুও শেষ রক্ষা হল না। বাইশে আগস্ট ১৯৯৬ সাল। নশ্বর শরীরের বিরুদ্ধে লড়াই করতে করতে তিনি চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। যাওয়ার কালে তিনি প্রমাণ করে গেলেন―অর্জুন না, দাতা কর্ণ-রূপী তিনিই শ্রেষ্ঠ। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে তাঁর অসম লড়াই চিরকাল উৎসাহ সঞ্চার করবে। তাঁকে হারাতে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছে। স্বল্প বয়সে মৃত্যুবাণ নিক্ষেপ করেছে নিয়তি, তাঁর বুকে। দুর্বল হার্টে। অথচ আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে হয়তো জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যেতেন একদিন। তা-ই কি এ ছলনা? এ ভেদাভেদ?

বিগত একাদশ পর্বে আমার লেখনীতে এ হেন মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যু ঘটিয়েছি আমি। কলমের শেষ কালি যেন নিংড়ে নিয়েছে আমার সমস্ত শক্তি, উদ্দিপনা আর প্রাণের নির্যাস। সে-পর্বের প্রতিটি অক্ষর রচনার সময় আমার হাত কেঁপে কেঁপে উঠেছে। একবার নয়, দুবার নয়, বারবার। সমস্ত বেদনা বুকে চেপে রেখে মনকে সান্ত্বনা দিয়েছি― অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র রানা'র মতো শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু কখনও হয় না। নীলকণ্ঠ রূপে তিনি মৃত্যুহীন, অমর। আমাদের হৃদয়ে একচিলতে সলতে। যা সারাজীবন জাজ্বল্যমান। আমার আপনার হৃদয়ে চিরকালীন শ্রদ্ধার আসন পাতা থাকবে বিজ্ঞানের এ হেন পূজারী'র জন্য। আসলে বৈজ্ঞানিকের মৃত্যু হয় না। মৃত্যু হয় তাঁর নশ্বর দেহের। রূপকথা বনে যায় তাঁর অমর লড়াইয়ের কাহিনী। বিখ্যাত হয় তাঁর আবিষ্কার। সেজন্য তিনি মহান। তিনি প্রণম্য। আদর্শ। প্রেরণার আর এক নাম।

শেষ করি সেই লালন ফকির-এর কথা দিয়ে। মননের অপূর্ণ বাসনা আর অভিজ্ঞতা লব্ধ চিন্তন দিয়ে তিনি বলেছিলেন―
             'মিলন হবে কত দিনে
             আমার মনের মানুষেরও সনে।।' (সমাপ্ত)


তথ্য সহায়তা :
'নিউটনের আপেল ও নারায়ণ'― ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই,
'মেদিনীপুরের বিশ্বজয়ী ড. নারায়ণ চন্দ্র রানা জ্যোতির্পদার্থ বিজ্ঞানী'― বাদল চন্দ্র দে
বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক-শিক্ষক শ্রী অতনু মিত্র
বিশিষ্ট শিক্ষক শ্রী অশোক ভৌমিক
শ্রী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী―শ্রী মণীন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ীর ভাইপো
'বিস্মৃতপ্রায় বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারায়ণচন্দ্র রানা'― নন্দগোপাল পাত্র,
'N C Rana : Life and His Contribution on Astrophysics Science'― Utpal Mukhopadhyay and Saibal Ray,
'মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা'― ভাষ্করব্রত পতি,
উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্লগ

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments