জ্বলদর্চি

করোনা কাল। আপনার শিশু কিশোরের মানসিক স্বাস্থ্য ও আপনি/ডা:পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

করোনা কাল। আপনার শিশু কিশোরের মানসিক স্বাস্থ্য ও আপনি
ডা:পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়

●●ছোটদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলা আমাদের অঙ্গীকার হোক।

        বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারী বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও শুধু যে  শারীরিক স্থিতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা,অর্থনীতি ও জীবন জীবিকাকে প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে এমন নয়, সাথে  মানসিক স্বাস্থ্যকেও বিপর্যস্ত করেছে। আমরা যারা সমাজবদ্ধ জীব তারা একা একা বাঁচতে পারি না। অথচ করোনার এই আপৎকালীন পরিস্থিতি ঘরবন্দি  আমাদের একাকীত্ব ও মানসিক বিপন্নতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের আরো অসহায় করে তুলেছে। সবথেকে বেশি সমস্যা আমাদের উত্তরপুরুষ উত্তরনারীদের নিয়ে। মানসিক স্থিতির দিক থেকে তারা এখনো অপরিণত। যুদ্ধ করতে শেখেনি তারা। পূর্বপুরুষের সাহায্য ও ভরসা প্রয়োজন তাদের। অথচ নিজেদের সমস্যাকে সরিয়ে রেখে তাদের পাশে তাদের  মানসিক সমর্থন  দেওয়া বড়দের পক্ষেও বড় সহজ কথা নয়। তবুও বড়রা তো বড় আর ছোটরা তো ছোটই! তাই নিজেদের সামর্থ্যকে ছাপিয়ে যেতে হবে তাদের, যাতে উত্তরপুরুষেরা আবার আলোয় ফেরে। আজকের নাতিদীর্ঘ আলোচনায় এই কঠিন যুদ্ধ নিয়েই খানিক আলোচনা করব। আলোচনা হোক ছোট ছোট ক্ষেত্র ধরে, যাতে এই বিশাল ও জটিল ব্যাপারটাক সহজ নেওয়া যায়।

   ●এই করোনা পরিস্থিতি ছোটদের সবথেকে বড় বিপন্নতা হলো স্কুল যেতে না পারা, খেলতে যেতে না পারা। সমবয়সীদের সঙ্গে মিশে ভাবের আদান প্রদান করতে না পারা। সব বয়সেরই একটা প্রাইভেসি আছে। প্রতিটি বয়স নিজের বয়সের মানুষদের সবথেকে কাছের মানুষ মনে করে। তাদের সংস্পর্শে আসতে না পারলে তাদের মানসিক অস্থিরতা এবং তার থেকে মানসিক বিকৃতি হয়, যেগুলো এখন হরদম হচ্ছে। বাবা মায়েদের তাদের সন্তানদের বন্ধু হওয়া কঠিন নয়, অসম্ভব। এ যেন সেই, 'দাও ফিরে সে অরণ্য।'..তবুও 
চেষ্টা করে যেতে হবে। চেষ্টায় হয় হার বা জিত হয়। নতুবা কিছুই হয় না।

   ●মানসিক ভাবে শিশু কিশোরদের পাশে থাকার জন্য বড়দের আগে বুঝতে হবে তাদের মানসিক  অস্থিতির প্রকারভেদ।

  প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তেমন প্রতিটি শিশু কিশোরও তাদের আচার আচরণ এবং ব্যবহারে ভিন্ন ভিন্ন। সুতরাং একই  সমস্যায় কেউ বিষণ্ণ, কেউ হতাশ, কেউ ক্রুদ্ধ, কেউ নীরব বা কেউ সরব হতে পারে। তাদের সঙ্গে মানসিক যোগাযোগ বাড়িয়ে এগুলো বুঝে নিতে হবে বড়দেরই।

   তাদের বন্ধু হয়ে তাদের সঙ্গে তাদের মতো মিশতে হবে। তাদের ইতিবাচক কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। তাদের ভালো থাকার জন্য বাড়ির পরিবেশ মতবিরোধশূন্য এবং বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে। করোনা সংক্রান্ত নেতিবাচক খবর যেগুলো তাদের মনে প্রভাব ফেলে সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। অনেক সময় বাড়ির কেউ সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়লে অথবা তার মৃত্যু হলে শিশু কিশোরেরা মনের দিক থেকে ভীষণ ভেঙে পড়ে। তখন আরো বেশি করে থাকতে হবে তাদের পাশে। দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে বা ভীত হলে চলবে না।

   ●এ তো গেল বাড়িতে বাবা মা অথবা অভিভাবকদের সঙ্গে থাকা শিশু কিশোরদের সমস্যার কথা। সুস্থ মানসিকতার দায়িত্বশীল ও সচেতন নাগরিক হিসেবে কিন্তু শুধুমাত্র বাড়ির ব্যাপারটা দেখলেই নাগরিকত্বের দায়ভার শেষ হয়ে যায় না। রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাড়ির বাইরেও অন্য বিপন্ন শিশু কিশোরদের জন্য কিছুটা সময় বের করতে হয়। অনেক শিশু অনাথ, তারা চাইল্ড কেয়ার ইনস্টিটিউটে বড় হয়। অনেকে আছে যাদের সে আশ্রয়ও জোটে না। অনেকেই আছে যারা পথশিশু,পরিযায়ী শ্রমিকদের শিশু। এরাও উত্তর নাগরিক। এদের সুস্থ ভাবে বাঁচার অধিকারের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আমাদের। তাদের অনুভবে এ বিষয়গুলো আনতে দেওয়া যাবে না যে তারা  সঙ্গীহীন, সহায়সম্বলহীন দলছুট।

   এ সমস্যা কিন্তু খুব জটিল কিছু নয় যদি আমরা একটু অনুভূতিপ্রবন হতে পারি তাদের প্ৰতি। তাদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের কথা বলতে দিই। তাদের বেঁচে থাকার প্রতিটি ইতিবাচক প্রচেষ্টার প্রশংসা করে তাদের এ নিশ্চয়তা দিই যে আমরা বড়রা তাদের পাশে আছি।

   ●কিছু কিছু শিশু কিশোর এই অতিমারীর আবহে  সাংঘাতিক মানসিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে গেছে, যাদের জন্য বিশেষজ্ঞ কাউন্সেলার ও মন চিকিৎসক দরকার। এরা হলো সেই সব শিশু কিশোরেরা যাদের চোখে ঘুম নেই, খিদে তেষ্টার বোধ চলে গেছে , ঘুমোলেও তারই মধ্যে যারা দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে পড়ে, যারা বিষণ্ণ অথবা আক্রমনাত্মক, একাকিত্বের ভয়ে ভীত, কারণ ছাড়া যারা পেট ও মাথা ব্যথার কথা বলে, বড়দের কাছ ছাড়া করতে চায় না, অন্ধকারে ভয় পায়, খেলাতে ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মেশাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, অকারণে কাঁদে, অকারণে হাসে। এদের প্ৰতি সতর্ক নজর দিতে হবে যাতে কোনো অবাঞ্ছিত দুর্ঘটনা না ঘটে।

   ●এ কথা আমরা এতদিনে বুঝে গেছি যে করোনা এত সহজে যাওয়ার জন্য পৃথিবীতে আসেনি। সুতরাং তা সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে চলা শিখতে হবে আমাদের। শেখাতে হবে আমাদের শিশুদের। তার জন্য সবথেকে আগে চায় রোগটি সম্বন্ধে নিজেদের অবহিত হওয়া।  সঙ্গে সঙ্গে শিশু কিশোরদের অবহিত করা। যাতে করে তা আমাদের কাছে অচেনা না থেকে চেনা শত্রু হয়। নিজেদের বুঝতে হবে, সঙ্গে ছোটদেরও বোঝাতে হবে স্বাস্থ্যবিধি কি, ভ্যাক্সিনের উপকারিতা কি, পুষ্টিকর খাদ্য, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও শরীর চর্চা কিভাবে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শুধু বোঝালেই হবে না। ব্যবহারে ও যাপনে দৃষ্টান্তমূলক কিছু করতে হবে তাদের সামনে।

   তাদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তাদের অতীত ইতিহাসের  কথা উদাহরণ দিয়ে বলতে হবে যেখানে তীব্র স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মানুষই জিতেছে। জেতার জন্য চায় হার না মানা মরিয়া প্রচেষ্টা। বোঝাতে হবে তাদের।

   ●সুযোগে আপনার শিশু কিশোরদের এসব  ভুল ধারণাগুলো দূর করে তাদের সাহসী ও সচেতন করে তুলুন। (যেগুলো করোনার বিরুদ্ধে মানুষের যুদ্ধকে এখনো পর্যন্ত সহজ না করে কঠিন করে দিয়েছে)।
তাদের বলুন, এমন নয় যে করোনাতে শুধু শিশু এবং বৃদ্ধরাই আক্রান্ত হতে পারে, বরং তরুণ বয়সীরাও সমান সম্ভাবনায় আক্রান্ত হতে পারে তাতে। এমন নয় যে গৃহপালিত পশুদের দিয়ে এ রোগের সংক্রমন হতে পারে। এমন নয় যে এন্টিসেপ্টিক মাউথ ওয়াশ,গার্গল, এন্টিবাওটিক,করোনা প্রতিরোধ করতে পারে। সিগারেট অথবা মদ করোনা ভাইরাসকে মেরে ফেলার ক্ষমতা রাখে(এ অযৌক্তিক হাস্যকর ধারণাগুলোও আছে) না। এমন নয় যে স্টিম বা প্রখর রোদ করোনা ভাইরাসকে কাবু করতে পারে। বাইরে থেকে আনা সবরকম খাদ্য বস্তুই  আসলে সংক্রমণে সাহায্য করে। এমন নয় যে গরম পরিবেশ করোনা ভাইরাসকে মেরে ফেলে। এমন নয় যে ভারতীয়রা বেশি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকে তাই তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেশি।

   ●মনে রাখবেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড়দের থেকে ছোটদের মানসিক সমস্যার ঝুঁকি বেশি। যেমন ভাঙা সংসার, বাবা ও মায়ের সর্বদা মতবিরোধ ও কলহ, দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, পারিবারিক হিংসা,শিশু বা কিশোরদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা তাদের প্ৰতি শারীরিক/মানসিক নির্যাতন, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশু কিশোরদের গৃহবন্দি জীবন, শিশু কিশোরদের প্ৰতি যৌন নির্যাতন, তাদের দীর্ঘক্ষণ অনলাইন থাকা, আইসোলেশন বা কোয়ারেনটাইনে অভিভাবকদের চোখের আড়ালে থাকা। এগুলো যাতে না ঘটে তার জন্য আমাদের সার্বিক প্রচেষ্টায় থাকতে হবে। এ সবের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত ও সামাজিক প্রতিরোধ জারি রাখতে হবে।

   ●শিশু কিশোরদের নিরাপদে রাখা এই মুহূর্তে বড়দের কাছে দায়িত্বের সাথে সাথে চ্যালেঞ্জও বটে। মনে রাখবেন, আপনাকে আচরণে সংযত ও পরিণত হতে হবে। মিষ্টভাষী হতে হবে। ছোটদের বিপন্নতা বুঝতে তাদের প্ৰতি আরো বেশি সহানুভুতিশীল হতে হবে। ছোটদের তাদের পছন্দ মতো কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে। তাদের কাছে আচার আচরণ ও যাপনে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। তাদের স্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো শেখাতে হবে। যৌন হয়রানি ও পারিবারিক হিংসা থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে।

  ●ছোটদের বোঝান, অন্য রোগগুলোর মতো করোনাও একটা রোগই এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা সেরে যায়। অযথা ভীতি সমস্যাকে জটিল করে।

  ●তাদের বোঝান, আজ যারা বড়, তারা একদিন ছোট ছিল। তাদের জীবনেও সমস্যা ছিল। তার বিরুদ্ধে লড়াই জিতেই তারা বড় হয়েছে। সুতরাং ব্যাপারটা কঠিন কিছু নয়।

  ●তাদের বোঝান বড়দের অভিজ্ঞতা তাদের লড়াইয়ে সবথেকে বড় অস্ত্র।

   কেবলমাত্র এসব সমবেত প্রচেষ্টাই ছোটদের আগামী দিনের জীবনকে ঝুঁকিহীন করতে পারে। অন্য কিছু নয়। সরকারের প্রতি বা প্রশাসনের প্ৰতি অভিযোগ নয়। নিজেদের বিপন্ন ভাবা নয়। সে সবের সময় পরে পাওয়া যাবে। এখন  অর্জুনের পাখির চোখ শুধু এ ভয়ংকরতম বিপদ থেকে রক্ষা পেতে ঐক্যবদ্ধ সামগ্রিক লড়াই। আজ থেকে এ লড়াই নিজে শুরু করুন। অন্যদের উদ্বুদ্ধ করুন। অন্য দেশগুলো পারছে যখন, তখন আমরাও পারব। দরকার শুধু আত্নবিশ্বাস, অদম্য জেদ ও প্রচেষ্টা। মাভৈ। চরৈবেতি।

--------------------------------
(●ঋণ স্বীকার: UNICEF
 ● NIMHANS toll free 24 hours 
    HELPLINE for specislised
    help: 08046110007)

ডা:পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
শিশু  ও নবজাতক বিশেষজ্ঞ
চার্নক হাসপাতাল। কলকাতা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
আরও পড়ুন 

Post a Comment

1 Comments

  1. কারো কোনো অর্ধন থাকলে করতে পারেন।

    ReplyDelete