জ্বলদর্চি

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম পর্ব --১২/সন্দীপ কাঞ্জিলাল

নাস্তিকের ধর্মাধর্ম  পর্ব --১২
সন্দীপ কাঞ্জিলাল
ধর্মে ঈশ্বরের প্রবেশ

 এবার আলোচনা করবো এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির জন্য দায়ী ব্রহ্ম না বিজ্ঞান? 

  ১৯২০ সালে লস অ্যাঞ্জেলসের 5 হাজার ফুট উঁচু মাউন্ট উইলসন পাহাড়ের চূড়ায় এক নিমগ্ন তপস্বী যিনি সেই সময়ের শক্তিশালী দূরবীন নিয়ে ফোকাস করলেন মহাশূন্যে এক সুদূর নীহারিকার উপর। তিনি দেখতে পেলেন ওই নীহারিকা আসলে একটি ছায়াপথ। তিনি বিস্মিত হলেন মহাশূন্যে ভাসমান দ্বীপের মতো আরো অনেক ছায়াপথ--'আইল্যান্ড ইউনিভার্সেস'। এই জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবলের আগে আমরা জানতামই না পৃথিবীর ছায়াপথের বাইরে আরো অনেক ছায়াপথ আছে। হাবল দেখতে পেলেন যেন এক নতুন অপরিচিত মহাবিশ্ব। যেখানে ছায়াপথগুলো শুধুই চলছে। শুধু চলছে না, তারা পরস্পরের কাছ থেকে খুব দ্রুত দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব এই ভাবেই ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে। 

  জর্জ লেমাত, জর্জ গ্যামোর মতো বিজ্ঞানীরা বাখ্যা করলেন হাবলের আবিষ্কার এর অন্তর্নিহিত গুরুত্ব। যদি একথা সত্যি হয় যে ছায়াপথেরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাহলে একথাও সত্যি  সুদূর অতীতে এক সময়ে তারা কাছাকাছি ছিল। কত কাছে? পাওয়া গেল উত্তর। এতটাই কাছে যে তারা সবাই এক বিন্দুতে ছিল। এই একতার ধারণায় আইনস্টাইনের সমীকরণ পৌঁছে ছিল কয়েক দশক আগে, যাকে বলা হয় সিঙ্গুল্যারিটি। যে সিঙ্গুল্যারিটির মধ্যে মহাবিশ্বের নিয়ম-কানুন আর খাটে না, ভেঙ্গে পড়ে। সংকুচিত হতে হতে নীহারিকাগুলি এতটাই কাছে যে তারা এক হয়েছিল। এইভাবে সংকুচিত হলে পদার্থের তাপমাত্রা যে কোনো ডিগ্রিতে পৌঁছতে পারে, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। সেই প্রচণ্ড তাপমাত্রার ফলেই মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। সেই মহাবিস্ফোরণ থেকে মহাবিশ্বের ক্রমাগত প্রসার। আজও যা চলছে। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল মহাবিস্ফোরণের নাম দিলেন বিগ ব্যাং।

  জর্জ গ্যামো বললেন, বিগ ব্যাং তৈরি করেছিল এক ভয়ঙ্কর অগ্নিগোলা। সেই অগ্নিগোলার 'আফটার গ্লো' মহাবিশ্বের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকলেও, সেই চিহ্ন আজও আছে। গ্যামোই গণিতের সাহায্যে দেখালেন কিভাবে অগ্নিগোলার তাপমাত্রা কমেছে মহাবিশ্বের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে। 

  বিগ ব্যাং থিয়োরি যে ভয়ংকর তাপমাত্রার কথা বলে, সেই তাপমাত্রায় ছিল শুধুই এনার্জি। আর ধুলোর মতো বিভিন্ন মৌলকণা। তারপর যতই মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে আর ঠান্ডা হচ্ছে, ততই এনার্জি জমাট হলো পদার্থের মৌলকণায়। এনার্জি হয়ে যাচ্ছে পদার্থ। অর্থাৎ এক অমূর্ত হয়ে উঠছে মূর্ত। যা ছিল অমূর্ত তাই প্রকাশিত হচ্ছে বাস্তব কায়ায়। বিগ ব্যাং এর তিন চার মিনিটের মধ্যেই হাইড্রোজেন এবং হিলিয়ামের মত হালকা অ্যাটমিক এলিমেন্ট জন্মেছিল। তারপর নক্ষত্রদের চুল্লিতে সৃষ্টি হল অপেক্ষাকৃত ভারী অ্যাটমিক এলিমেন্ট, লোহা পর্যন্ত। এরপর সুপারনোভা নামে তারা-বিস্ফোরণের ফলে যে শকওয়েভ তৈরি হলো তারই মধ্যে জন্মালো মহাবিশ্বের আর সব পদার্থ। বিগ ব্যাং এর মত ঘটনা ঘটানোর জন্য বিশাল এনার্জি এলো কোথা থেকে? 

  ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালান গুথ তাঁর ইনফ্লেশনারি থিয়োরির সাহায্যে উত্তর দিয়েছিলেন এইসব প্রশ্নের। কোনও কোনও অবস্থার মধ্যে মহাকর্ষ বিপরীত বল প্রয়োগ করতে পারে। অর্থাৎ মহাকর্ষ না টেনে ঠেলে দিতে পারে। সূত্রটির নাম গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি। আমাদের সামনে প্রথম উন্মোচিত হলো সেই মহাবিশ্ব যার আকার একটি পিনের ডগার থেকেও ছোট- কত ছোট কল্পনা করাও শক্ত। এতই ছোট যে সেটাকে 'জায়গা' বলাই যায় না। একটি প্রোটনকে প্রথমে বিলিয়ন খণ্ডে ভাগ করে সেই ভাগের একটি খণ্ডকে একশো মিলিয়ন খন্ডে ভাগ করলে তবে সেই ক্ষুদ্রতার একটা আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। কত বড় একটি প্রোটনের সাইজ? একটি বালুকণাকে হাজার বিলিয়ন ভাগে ভাগ করলে তবে পাওয়া যাবে একটি প্রোটনের সাইজ। মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে ঠান্ডা হচ্ছে। তারই ফলে ভেঙ্গে গেল ইউনিফায়েড 'গাট' সিমেট্রি। আসলে একটি মুহূর্ত তৈরি হল ফলস ভ্যাকুয়ামের। এরফলে জন্মাল কিছুটা নেগেটিভ গ্র্যাভিটি। 

  পরেই শুরু হয়ে গেল মহাবিশ্বের স্ফীতি। এই স্ফীতির গুননীয়ক ১এর পিঠে অন্তত ৩০ টা শূন্য। অকল্পনীয় এনার্জি উৎসারিত হল ওই স্ফীতি থেকে। এই স্ফীতিকালে মহাশূন্য প্রসরিত হয়েছিল আলোর চেয়েও বেশি গতিতে। আমার কথা শুনে অনেকেই হয়তো বলে উঠবেন, কোনও কিছুর পক্ষেই আলোর গতিকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আইনস্টাইনের স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি মহাবিশ্বের ওপর যে স্পিডলিমিট চাপিয়ে দিয়েছে তা মহাশূন্যের প্রসরের গতির উপর প্রযোজ্য নয়। প্রযোজ্য শুধু বস্তুর ওপর। ইনফ্লেশন থিওরি বলছে মহাশূন্য প্রসারিত হচ্ছে আমরা যে মহাবিশ্বকে জানি তারও বাইরে। আমরা কোন মহাবিশ্বকে জানি- যে মহাবিশ্ব একটি ক্ষুদ্রতম বিন্দু থেকে প্রসারিত হতে হতে এতই বৃহৎ যে তার ছায়াপথের সংখ্যাই অন্তত একশো বিলিয়ন। এত বড় একটা জিনিসকে আমাদের ধারণা করার ক্ষমতা সত্যিই নেই। যেহেতু মহাবিশ্বের আকার ছিল অকল্পনীয় ক্ষুদ্র, তাঁর ভিতরে যা কিছু ছিল, তা ছিল একটি থার্মাল ব্যালেন্স এর মধ্যে। 

  প্রায় চোদ্দো বিলিয়ন বছর ধরে যে মহাবিশ্ব ধ্বংস হলো না তার কারণ মহাবিশ্বের প্রসারে অসামান্য 'টিউনিং'। এই টিউনিং এর সূক্ষ্মতা অসামান্য। এই টিউনিং এর গন্ডগোল সামান্যতম ও যদি হত, তাহলে মহাবিশ্ব ভেঙে পড়তো কিংবা ছিটকে বেরিয়ে যেত। মহাবিশ্বের এই ভারসাম্য বজায় রাখছি আর সব কিছুর সঙ্গে আপনি আমিও। তাই মহাবিশ্ব আমাদের ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। (ক্রমশ) 
  (এরপরের আলোচনা 'একমেবাদ্বিতীয়ম কী?)

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments