জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৬/শ্যামল জানা


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৫৬

শ্যামল জানা

সাররিয়েলিজম্, মার্শেল দুশাম্প ও তাঁর অভিনবত্ব, ও অভিনব ক্যাটালগ

    সারা পৃথিবীতে এখন দৃশ্যশিল্পে বা দৃশ্য সংক্রান্ত কোনো ইভেন্টে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই থিম ব্যবহার করা হয়৷ আজকের দিনে থিম ছাড়া বড় কোনো দৃশ্য সংক্রান্ত ইভেন্ট ভাবাই যায় না! এর সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের দুর্গাপুজো৷ এখন পাড়ার গলিতে একটা ছোটো পুজো হলেও, সেখানে থিম ব্যবহার করা হয়৷ এই থিম-এর আবিষ্কারক কিন্ত মার্শেল দুশাম্প৷ তিনিই এর সূত্রপাত করেন ১৯৩৮ সালে৷ প্যারিসে Exposition Internationale du Surréalisme. শীর্ষক প্রদর্শনীতে, যার পূর্ণ আলোচনা আমরা ‘পর্ব-৫৪’-তে করেছি৷ তারপর আমেরিকার নিউ ইয়র্ক-এ ১৯৪২ সালে যে অভিনব প্রদর্শনীটি হয়েছিল— “ফার্স্ট পেপারর্স অফ সাররিয়েলিজম্”, যেখানে দড়ি দিয়ে মাকড়সার জাল করে প্রদর্শনীকক্ষ মুড়ে দেওয়া হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে আমরা আগের পর্বে সম্যক আলোচনা করেছি৷ এরও স্রষ্টা ছিলেন মার্শেল দুশাম্প৷ তাঁর মতো একেবারে আমূল পাল্টে দেওয়া অভিনব সৃষ্টিশীল চিন্তা করার মতো মগজ আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাসে পাওয়া যায় না বলাটাই ঠিক৷

    আশা করি আমাদের মনে আছে ‘পর্ব-৩০’-এ আমরা উল্লেখ করেছিলাম কিউবিজম অনুপ্রণিত ‘রেডিমেড’ গ্রুপের কথা, যা মার্শেল দুশাম্প-এর মগজপ্রসূত৷ যেখানে ১৯১৩ সালে তিনি শিল্প সংক্রান্ত সমস্ত ধারণাকে তছনছ করে দিয়ে ফেলে দেওয়া একটি বাতিল ফ্রক সমেত সাইকেলের চাকাকে একটি কিচেন টুলের ওপর এমনভাবে প্রতিস্থাপন করেছিলেন, যেন কিচেন টুলটি পেডেস্টাল, ও সাইকেলের চাকাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য(Sculpture)(ছবি-১)৷ চাকা একটি ঘূর্ণমান চলমান ব্যবহারিক বস্তু৷ অথচ তাকে, তার ব্যবহারিক দিককে, সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়ে বিস্ময়করভাবে তাকে একটি নতুন কনসেপ্টে ব্যবহার করা, তাকে স্থির শিল্প হিসেবে প্রতিপন্ন করা— তখনকার দিনে কেন, আজকের দিনেও শিল্প ভাবনায় এই অভিনবত্ব কল্পনাও করা যায় না৷ এই অভিনবত্ব কি শুধুই চমক দেওয়ার জন্য? নাকি অভিনব এক প্রতিবাদ? সালটা(১৯১৩)লক্ষ করলেই বোঝা যাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাতের সময়৷ এই অযাচিত যুদ্ধ সাধারণ সতঃস্ফূর্ত চলমান মানুষকে হতবাক করে দিয়েছিল! স্তব্ধ করে দিয়েছিল! এটাকে তার প্রতীক হিসেবে ভাবতে আমাদের অসুবিধা হয় না৷


    ধরা যাক ১৯১৭ সালে করা মার্শেল দুশাম্প-এর ‘ফাউন্টেন’ নামের শিল্পকর্মটি(‘পর্ব-৪০’-এ আমরা আলোচনা করেছি৷)(ছবি-১)৷ একটি পেডেস্টালের ওপর একটি প্রস্রাব করার পোর্সিলেনের বেসিনকে বসিয়ে দেওয়া আছে৷ যেন এটি একটি উৎকৃষ্ট ভাস্কর্য৷ এই গা ঘিনঘিনে আপাত অর্থহীনতার(Nonsense) অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে— সেই সময়ের বুর্জেয়া পুঁজিপতিরা ছিল অত্যন্ত খারাপ ও ঘৃণ্য মানুষ৷ সাধারণ মানুষদের অমানবিকভাবে শোষণ করে ব্যক্তিগত পুঁজি বাড়াত তারা৷ অথচ ক্ষমতার জোরে তারাই ছিল সমাজের সবচেয়ে উঁচু তলার গন্যমান্য ও অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষ! এই একই ধারণা(Concept) এই ‘ফাউন্টেন’ শিল্পকর্মটির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছে৷ যেন, একটা গা ঘিনঘিনে নোংরা প্রস্রাবের বেসিনকে দেখানো হল একটি উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম বা ভাস্কর্যরূপে৷ এইভাবে তিনি চুল আঁচড়াবার চিরুনি, বোতল শুকোবার তাক, এই সব ফেলে দেওয়া অবাঞ্ছিত বস্তুদের রিকনসেপ্ট করে শিল্পে বদলে দিয়েছেন, যা অভাবনীয় বললেও কম বলা হবে৷ ফলে, তিনি সুকুমার কলার(Fine Arts)যে গূঢ় তত্ত্ব, এত দিনকার যে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা সব ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিলেন৷ বাণিজ্যিক মান ও নান্দনিক মূল্যর মাঝখানে যে সীমারেখা, তা ভেঙে প্রায় ধূলিস্যাঁৎ করে দিয়েছিলেন৷ এই যে অতি বিস্ময়কর প্রতিভা(Extraordinary genius) মার্শেল দুশাম্প-কে সেই সময়ের আধুনিক আভাঁ গার্দ শিল্প আন্দোলনে প্রথম সারির সবচেয়ে অগ্রবর্তী স্থানে বসিয়েছিল৷ আর, তাঁর এই যে অভিনব সব শিল্পসম্ভার ইয়োরোপ আমেরিকা তথা সারা বিশ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল বিশ শতক জুড়ে৷

ধরা যাক নিউ ইয়র্ক-এ ১৯৪২ সালে যে অভিনব প্রদর্শনীটি হয়েছিল— “ফার্স্ট পেপারর্স অফ সাররিয়েলিজম্”, তার ক্যাটালগটি৷ এটিও করেছিলেন মার্শেল দুশাম্প৷ যথারীতি অভিনবত্বের জন্য হইচই ফেলে দিয়েছিলেন৷

সাধারণত কোনো চিত্র-প্রদর্শনীর যে পঞ্জী বা ক্যাটালগ হয় তাতে থাকে— ছবির প্রদর্শনী কত তারিখ থেকে কত তারিখ পর্যন্ত হচ্ছে৷ কোন গ্যালারিতে বা কোন বাড়িতে হচ্ছে, তার পূর্ণ ঠিকানা৷ প্রদর্শিত হলে ছবিগুলিকে সংখ্যার সাহায্যে অবস্থানক্রম চিহ্নিতকরণ, তার বর্ণনা, কে এঁকেছে, তার সঠিক মাপ, তার দাম কত, ইত্যাদি ইত্যাদি৷ আর সঙ্গে থাকত বড়জোর একটা ভূমিকা৷ এতদিন পর্যন্ত ক্যাটালগ বলতে এই রকমই বোঝাত৷ মার্শেল দুশাম্প এসে সব ধারণা একেবারে ভেঙে তছনছ দিলেন৷ তিনি বললেন, প্রদর্শনীতে এসে শুধু ছবি দেখলে হবে না৷ যিনি ছবিটি আঁকছেন ছবির পাশাপাশি তাঁকেও অবশ্য বোঝা দরকার৷ তিনি ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’-এর মতো, শিল্পীদের ‘ফাউন্ড ফোটোগ্রাফ’ ব্যবহার করলেন ক্যাটালগ-এ৷ ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’ নিয়ে আমরা আগে আলোচনা করেছি৷ যে, শিল্পে, বিশেষত ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে আমি যে রেডিমেড বস্তুটি ব্যবহার করছি, সেটি দেখে অন্য আর একটা কিছু মনে হবে, সেটি নয়৷ যেমন, পিকাসোর একটি ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’ ভাস্কর্য আছে৷ যার নাম— ‘বেবুন অ্যান্ড ইয়ং’৷ 

যেখানে তিনি একটি খেলনা মোটরগাড়ি দিয়ে একটি বেবুন-এর মুখ তৈরি করেছিলেন(ছবি-২)৷ অর্থাৎ, আমি ওপর ওপর যে মোটরগাড়িটা দেখছি, সেটি মোটরগাড়ি নয়, সেটি আসলে বেবুনের মুখ৷ 


ঠিক সেরকম, আমি ক্যাটালগ-এ শিল্পীর যে ফোটোটি ব্যবহার করছি, সেটি ওপর ওপর যে মানুষটিকে দেখছি, তাঁর নয়, মানুষটির চরিত্রটা ঠিক যা, আমি তাঁকে সেইভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছি৷ এ জন্য তিনি একজন শিল্পীর সঠিক বৈশিষ্ট বোঝাবার জন্য অন্য আর একটি উপযুক্ত ফোটো ব্যবহার করলেন, তাঁর নয়৷ যেমন, তিনি মার্শেল দুশাম্প(নিজের)/ রোজে সিলেভি-কে দেখালেন তৎকালীন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ও ফোটোগ্রাফার ‘বেন শাহন’-এর তোলা একটি চিন্তাগ্রস্ত মহিলার মুখের ফোটোগ্রাফ দিয়ে৷ এই রকম অভিনব চিন্তার সাহায্যে, যা কখনো আগে হয়নি, তিনি ৫২ পৃষ্ঠার ক্যাটালগটি ডিজাইন করলেন৷ যেখানে তিনি সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন, তা হল— যেটা আমি মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছি, তার ব্যাপ্তিযোগ্যতা কত বেশি বাড়ানো যায়; আর, একটা প্রদর্শনীকে যে ক্যাটালগ-এর মাধ্যমে দেখছি, বোঝার চেষ্টা করছি, তার ক্ষমতা কত বেশি বাড়ানো যায়, তার আপ্রাণ চেষ্টা করা৷ যার ভূমিকা লিখেছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে বড় আর্ট ডিলার ‘সিডনি জেইনস্’৷ এটা তো গেল ক্যাটালগ-এর ভিতরের টেক্সট্ অংশটি৷ এর বাইরের মলাট বা প্রচ্ছদটিও তিনি করেছিলেন চমকে দেওয়ার মতো অভিনব, এবং যথারীতি এই ভাবনাটিও আগে কেউ ভাবেনি৷
সাধারণভাবে আমরা প্রচ্ছদ বলতে যা বুঝি, যেটি প্রথম আমাদের চোখে পড়ে সেটি হল— প্রথম প্রচ্ছদ(Front Cover)৷ যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি লেখা থাকে৷ যেমন, প্রদর্শনীর নাম, কোথায় হচ্ছে, কবে থেকে হচ্ছে৷ কতদিন চলবে... ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এতদিন ধরে এটাই ছিল দস্তুর৷ তিনি এই কনসেপ্টটা ভেঙে দিলেন৷ কোনো লেখাই তিনি প্রথম প্রচ্ছদে রাখলেন না৷ যেন, এই লেখাগুলিও যেহেতু দৃশ্য৷ প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবিটি যখন সৃষ্টি করেন শিল্পী, তখন তিনি তাতে কোনো লেখা যুক্ত করেননি৷ পরে, তাতে যে কোনো অতিরিক্ত দৃশ্য যুক্ত করা মানে ছবিটির সৌন্দর্য ভিষণভাবে ব্যাহত করা৷ যা কিছু প্রয়োজনীয় লেখা, তিনি দিলেন পিছন প্রচ্ছদে(Back Cover)৷ প্রথম প্রচ্ছদে কী ছিল? একটি এবড়ো-খেবড়ো পাথরের দেওয়াল-এর ছবি৷ যেটি শিল্পী কার্ট সেলিগম্যান-এর উনিশ শতকের চিনির ডেলা তৈরি করার একটি ফার্ম হাউস ছিল, তার পাথরের দেওয়ালের ছবি৷ এই ছবিটি দুশাম্প নিজেই ওখানে গিয়ে তুলেছিলেন৷ তোলার আগে তিনি ওই দেওয়ালে পাঁচবার গুলি চালিয়েছিলেন৷ দেওয়ালে গুলি লেগে যে ছোটো ছোটো গর্ত তৈরি হয়েছিল, সেখানে তিনি আবার গুলিগুলো আটকে দিয়েছিলেন৷ তারপর সেই দেওয়ালের ছবি তুলেছিলেন(ছবি-৩)৷ 

আর, সেই ছবি দিয়েই ওই ক্যাটালগ-এর ফ্রন্ট কভার করেছিলেন৷ ব্যাক কভার জুড়ে তিনি একটি সুস্বাদু সুইস চিজ-এর ছবি ব্যবহার করেছিলেন৷ এবং ওই চিজের যে প্রচুর ফুটো থাকে, তার ওপরেই প্রদর্শনীর নাম লিখেছিলেন এবং নিচে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি দিয়েছিলেন(ছবি-৩)৷ ভেতরে, সিডনি জেইনস যে ভূমিকা লিখেছিলেন, যেখানে অংশগ্রহণকারী সমস্ত শিল্পীদের নাম দেওয়া ছিল৷ সেখনেও এই ফুটোযুক্ত সুইস চিজের ছবি দুশাম্প ব্যবহার করেছিলেন৷ আর, স্বচ্ছতা বজায় রাখার জন্য প্রদর্শনীকক্ষে দড়ি দিয়ে তিনি যে মাকড়শার জাল তৈরি করেছিলেন, তার ছবিও দিয়েছিলেন৷              (ক্রমশ)

আরও পড়ুন 


Post a Comment

2 Comments

  1. ৫৪\৫৫\৫৬ সংখ্যক অধ্যায়গুলি আজ একযোগে পড়ে ফেললাম।
    যতটা প্রিয়শিল্প ততই বিস্মিত হচ্ছি।
    কেবল মাত্র লেখার জন্য লেখা নয়,
    সাধারণের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে তাকে
    পৌঁছে দেবার সাফল্যে এই লেখাটি
    উদ্ভাসিত।
    শিল্প সম্পর্কিত নিবন্ধ কখন যেন
    আমাদের তৎকালীন সমাজ,সভ্যতা,
    অর্থনীতি, রাজনীতি,ভূগোল,বিজ্ঞান
    ইতিহাসের সাথে সম্যক পরিচয় সাধন করে চলেছে।
    এই সাধনালব্ধ লেখাটি কালজয়ী।

    ReplyDelete
  2. যতটা শিল্প চর্চার ইতিহাস পড়ছি
    (হবে) ততই বিস্মিত হচ্ছি।

    ReplyDelete