জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৪৯





সম্পাদকীয়,

কাকাবাবুকে চেনো তো? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা চরিত্র কাকাবাবু। না চিনলে কাল পীযূষ আঙ্কেলের লেখা পড়ে জেনে নিও। কাকাবাবুর কিন্তু পায়ের সমস্যা ছিল। ক্রাচ নিয়ে চলতেন। তাতে কি? তাতেও উনি ইয়েতি অভিযানে পাহাড়ে চড়েছিলেন। আরে শুধু কি কাকাবাবু এই যে প্যারা অলিম্পিক হচ্ছে টোকিওতে, সেখানে কত কত প্রতিযোগী শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করে সোনা রূপা ব্রোঞ্জ পেয়ে দেশের নাম উজ্জ্বল করে চলেছে। তবে শুধু প্যারা অলিম্পিক নয় এবারে টোকিও য় আগের বছরে যে অলিম্পিক হবার কথা ছিল তাও হয়েছে। কোভিডের জন্য পিছিয়ে যাওয়া এই অলিম্পিক অনেকের কাছে এক আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। খেলার এমনই মজা। আর এই মজার মজার খেলার কথা এবারের সংখ্যায় শুনিয়েছেন অর্ঘ্য আঙ্কেল আর তোমাদের বন্ধু শ্রেয়সী। মজার ব্যাপার হল খেলার কথা ভাবতে শুরু করলে না ভেবে থাকা যায় না কিন্তু সেটা তো বড়রা বুঝতেই চায় না। সেজন্যই তো সাম্যময় স্যারের কাছে মার খেল। সাম্যময় কে? জানতে হলে পড়তে হবে আবেশ আঙ্কেলের গল্প। এছাড়া আরো কত কত খেলার কথা মনে পড়ছে। এই যেমন ধরো চু কিত কিত। সেটা নিয়ে পুরুলিয়ার আঞ্চলিক ভাষার ছড়া লিখেছেন দেবাশিস আঙ্কেল। এতেও শেষ নয় ছোটোবেলা। যারা খেলা নয় গল্প শুনতে ভালোবাসো তাদের জন্য পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প লিখেছেন সুব্রত আ্যঙ্কেল। আর রঞ্জনা আন্টি পাঠিয়েছেন ছড়া তোমাদের ভালোবাসার স্কুল নিয়ে। এতসবের পরেও যা না বললেই নয় তা ছড়া লিখে বলেছে তোমাদের বন্ধু অনমিতা। সেটা হল, 'পুজো আসছে'। হ্যাঁ গো হ্যাঁ, পুজো এলো বলে। আর আনন্দের কথা হল, বিলম্ব দাদু ফিরে এসেছে ফুলকুসুমপুরের ত্রিপাঠী বাড়িতে। তোমরা এবার জন্মাষ্ঠমীর তালের বড়া আর মালপোয়া খেতে খেতে ছবিগুলো দেখে জানাও এবারের সংখ্যা কেমন লাগলো। -- মৌসুমী ঘোষ।


টোকিওয় ভারতীয় হকির সূর্যোদয়

অর্ঘ্য দে

 "আমাদের রক্তে খেলা  

খেলার ছলে বিপ্লবী বেশ,

আমরাই কখনো মুখ, কখনো দল... কখনো দেশ” 


স্বাধীনতার আগে ১৯২৮ থেকে ১৯৩৬ সাল অব্দি বিশ্ব-হকি ছিল একচেটিয়া ভারতের দখলে। এই সময়টা অলিম্পিক-হকি মজে ছিল মেজর ধ্যানচাঁদের হকিস্টিকের জাদুতে। ১৯৩২ সালের লস এঞ্জেলস অলিম্পিকে আমেরিকাকে ফাইনালে ২৪-১ গোলে হারিয়ে দ্বিতীয়বার সোনা জেতে ভারত। গোলের এই ব্যবধানের রেকর্ড আজও অক্ষত। স্বাধীনতার পরেও ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৪ সাল অব্দি অলিম্পিকে হকিতে ভারতের সোনার পদক বাঁধা ছিল। ১৯৬০ সালে রোম অলিম্পিকে ভারত রুপোর পদক পায়। ১৯৮০ সালে মস্কো অলিম্পিকে স্পেনকে ৪-৩ গোলে হারিয়ে শেষবারের মতো সোনা নিয়ে আসে। সেটি ছিল অষ্টম অলিম্পিক সোনার পদক এবং মোট অলিম্পিক পদকের হিসেবে এগারোতম। জেতার একচেটিয়া অভ্যাসটা এরপর হারিয়ে ফেলে ভারতের হকি দল। তারপর শুরু হল দীর্ঘ পদকশূন্যতা।            


      এবারের অলিম্পিকের পুল ম্যাচে আমাদের ছেলেদের হকি দলের পারফরমেন্স ছিল চোখে পড়ার মতো। শুরুটা মনপ্রীতরা করেছিল নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩-২ গোলে জিতে। তারপর প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৭-১ গোলে গুঁড়িয়ে গেছলো আমাদের ছেলেরা। সেই আঘাত সামলে তারপর আবার জয়ে ফিরল। পরের তিনটি ম্যাচে আর আটকানো যায়নি মনপ্রীতদের। এই নজিরবিহীন জয়ের ধারাবাহিকতায় ভারতের ছেলেদের হকি দল একচল্লিশ বছর পরে অলিম্পিকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠল।        

      টোকিও অলিম্পিকে হকির সেমিফাইনালে বেলজিয়ামের সঙ্গে হেরে সোনার পদকের সোনালি স্বপ্নটা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্তু ব্রোঞ্জ ম্যাচে জার্মানির সঙ্গে হার-না মানা লড়াই দেখে ফাইনালে না উঠতে পারার দুঃখ ভুলে গেলাম। জার্মানির মতো দলকে হারিয়ে অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জেতা আর ফাইনাল জেতা একই ব্যাপার।

       এই ম্যাচটা প্রত্যেক হকিপ্রেমী ভারতীয়র মনে থাকবে। ১-৩ এ পিছিয়ে থেকেও খেলায় ফিরে আসা। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে অপ্রতিরোধ্য মনোভাবে সামান্য সময়ের ব্যবধানে দু’ দুটো পেনাল্টি কর্নার আদায় করে নিল। হার্দিক, সিমরনজিৎদের পরপর দুটো পেনাল্টি কর্নারকে গোলে বদলে দেবার অব্যর্থ প্রচেষ্টা। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। তখনই যেন জার্মানরা মনের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ল। অবিশ্বাস্য তৃতীয় কোয়ার্টার। আরো দু’টো গোল। এই জমি না-ছাড়ার মানসিকতা নিয়ে যদি বেলজিয়ামের সঙ্গে খেলতে পারত, ভারত ফাইনালে সোনা পেত, পেতই। অলিম্পিকে পুল ম্যাচের শুরুর দিকে বলেছিলাম ভারতীয় হকির ঐতিহ্য এক দিন না এক দিন ফিরবে, তবে এত তাড়াতাড়ি ফিরবে ভাবতে পারিনি। যাই হোক মনপ্রীত আর তার সঙ্গীদের স্টিকে ভারতীয় হকির একচল্লিশ বছরের পদকের খরা তো কাটল। এও তো কম পাওনা নয়! 

      আশ্চর্যজনকভাবে এবারের অলম্পিকে ভারতের মেয়েদের হকি দলটিও পৌঁছেছিল সেমিফাইনালে। হকিতে এবারে জোড়া পদকের স্বপ্ন দেখছিলাম আমরা। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিকে ছেলেদের দল শেষবারের মতো সোনার পদক নিয়ে দেশে ফিরেছিল, সেই অলিম্পিকেই মেয়েদের দল আয়োজক দেশ সোভিয়েত ইউনিয়ানের কাছে হেরে ৪র্থ হয়ে শেষ তাদের অলিম্পিক সফর। তারপর কেটে গেছে চল্লিশটা বছর। এরপর মেয়েদের দল অলম্পিকে খেলেছে মাত্র দু’বার। গত রিও অলিম্পিকে রানি রামপালের দল শেষ করেছিল ১২ তম দল হিসেবে। এবারে টোকিও অলিম্পিকে একটুর জন্যে ব্রোঞ্জটা ফসকে গেল। তবে শুরুটা রানিদের কিন্তু মোটেই ভালো হয়নি। টুর্নামেন্টের শুরু থেকেই পুল ম্যাচে পরপর তিনটে ম্যাচে হার। পুল ‘এ-র শেষ খেলায় বন্দনার হ্যাটট্রিক গোলে প্রতিপক্ষ দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৪–৩ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালের পথ পরিষ্কার করেছিল রানিরা। অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে আমরা পৌছালাম সেমিফাইনালে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি না তো? রানি, বন্দনা, গুরজিতদের সামনে তখন পদকের হাতছানি। ইতিহাস লেখার সুযোগ। সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার কাছে ২-১ গোলে হেরে বন্ধ হয়ে গেল ফাইনাল ওঠার দরজা। তখনও ব্রোঞ্জের আশা শেষ হয়ে যায়নি। রিও অলিম্পিকে সোনাজয়ী গ্রেট ব্রিটেনের কাছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেও হেরে গেলাম আমরা। খেলায় তো হার-জিত থাকেই তাই না? প্রতিদিন অভাবের সঙ্গে লড়াই করা রানি, বন্দনা, নেহা, সবিতারা যেভাবে খেলে গেল তাতে ফিরে এল ভারতীয় হকির হারিয়ে যাওয়া সেই ঐতিহ্য, সম্মান। ওরা ব্রোঞ্জ জিতেতে পারেনি, কিন্তু জিতেছে তার থেকেও অনেক বড় কিছু। ওরা জিতেছে অসংখ্য ভারতবাসীর মন, বিশ্বাস। আমরাও পারি, শেষ হয়ে যায়নি আমাদের হকি। এগারো বাঘিনী অ্যাস্ট্রোটার্ফে লিখল অন্য এক ইতিহাস। ওরা মুখ থেকে দল হয়ে দেশ হয়ে উঠল।




সনামণির বে

দেবাশিস দণ্ড


দল দল দলনি

রাঙা মাথায় চিরনি

বর আইসবেক অখনই...

ক্যানে আইসবেক

ক্যানে আইসবেক

ভাগাইন দিব ত্যাখনই।


আম কুড়াতে যা ন খুকু

আম কুড়াতে যা

ডালে চড়ে কঁচকচায়ে

আঞ্জির পাকা খা।

চু কিতকিত  চু কিতকিত

চু কিতকিত থা

বাজাইন দে ন হারমনিট

সা রে গা মা পা।


ক্যানে যাবিস জল আইনতে

পদ্মদিঘীর ঘাটে

বইসবি ক্যানে আনাজ লিয়ে

খামড়াবেড়ার হাটে?


সাত দুগুণা চইদ্দ বঠে

দশ দুগুণা কুড়ি

দেইখতে দেইখতে সিঁরায় গেল

খুকুর পেরাইমারি।

পইড়তে  পইড়তে ডাগর হ্যল-

হাই ইস্কুল পাশ

ভাল মন্দ বিচার ক্যইরতে

শিখল বারোমাস।


মেয়ামানুষ লয় ব খুকু

মানুষ বঠে আগে

সনামণি লায়েক হঁছে

দেখ ন কেমন লাগে।


চাঁদ উঠেছে ফুল ফুইটেছে

কদমতলে কে?

কদমতলে উকিলবাবু

সনামণির বে।




মিঠি র সেদিন 

সুব্রত দেব


ঘুম ভাঙতেই মিঠি চমকে ওঠে। এ কি! এ আমি

কোথায়? ধূ ধূ করছে মাঠ।  দূরে সাদা ওটা কি?

 ধপধপে সাদা রং। পাশে একজোড়া পাখনা, ঘাড়ে 

সাদা কেশর। ও মা! এ তো  পক্ষীরাজ ঘোড়া।

মিঠি একবার ভালো করে চোখ কচলে তাকায়।

না! স্বপ্ন নয়।নিজেই নিজের শরীরে চিমটি কাটে।না - 

ও তো জেগেই আছে। তাহলে। তাকে এখানে কে আনলো।

আরে আরে পক্ষীরাজ ঘোড়ার পাশে বড় সাদা ওটা কি! ঘোড়ার ডিম! তাই তো মনে হচ্ছে। মিঠি যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে। এবার দেখল ডিমটা ধীরে ধীরে ফাটছে আর তা থেকে বেরিয়ে আসছে একটা পক্ষীরাজের ছানা। মিঠির চোখ তো ছানা বড়া।

ঘোড়ার ডিম! তা আবার হয় নাকি। কিন্তু ও  তো স্পষ্ট দেখল ডিম ফেটে পক্ষীরাজ ছানা বের হচ্ছে।পক্ষীরাজ ঘোড়া! সে তো দাদাইয়ের কাছে রূপকথার গল্পে শুনেছে।তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে উড়ে চলেছে পক্ষীরাজ ।পিঠে তার রাজকুমার।

ইস! ও যদি অমন পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে উড়ে যেতে পারত ---- যেই না ভাবা অমনি দেখল মাঠের পক্ষীরাজ ঘোড়া ও তার ছানাটি উড়ে এসে ওর পাশে নামল।কিছু বোঝার আগেই ওকে চাপিয়ে নিল ওর পিঠে।ছানাটি উড়ে চলল পাশে পাশে।  এ কি! ওর গায়ে ঝলমল করছে

রাজকুমারীর পোশাক।সাদা কুচি দেওয়া থাক থাক 

ফ্রক, রুপোলি ঝালর।মাথার কালো চুলে রুপোলি হেয়ার ব্যান্ড। এমন পোশাক ওকে কে দিল? ওর বন্ধু

রূপাই এর এমন সুন্দর একটা ফ্রক আছে।তবে কি রূপাই -- ভাবা শেষ হয় না , দেখে ওকে নিয়ে পক্ষীরাজ উড়ে চলেছে নীল আকাশের বুকে। পাশ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তুলো মেঘের দল। উড়ছে কত পাখি। মিঠি একবার নিচে তাকিয়ে দেখে। - আরে !

ওটা কি! সরু সুতোর মত।নদী নাকি।হ্যাঁ তাই তো।

বাড়ি ঘর গুলোকে ছোট্ট দেখায়।দেখতে দেখতে পক্ষীরাজ ওকে পৌঁছে দেয়  মেঘের দেশে ।

 মিঠিকে দেখেই মেঘবালিকা ছুট্টে আসে।- এসো

বন্ধু। 

মিঠি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে - আমি কোথায় এসেছি?

তুমি তো মেঘের দেশে এসেছ,চলো তোমাকে

ঘুরে ঘুরে আমাদের দেশ দেখাই।

মিঠি তুলোর মত হালকা হয়ে মেঘ বালিকার সাথে ভেসে বেড়ায়। - ওই দেখো চীনের পাঁচিল, ওই দেখো

হিমালয়।  ওই দেখো কৈলাশ।

ওই খানে মহাদেব থাকে?

থাকে তো, ওই বরফের পাহাড়ের গুহায় 

মহাদেব  ছেলে মেয়ে বউ নিয়ে থাকে।

কি মজা! আচ্ছা ওদের শীত করেনা?

না, ওরা ঠাকুর তো ।

অনেকক্ষণ ঘুরে মিঠি র বেশ খিদে পাচ্ছিল।

মেঘবালিকা বলে - তোমার খিদে পাচ্ছে, দাঁড়াও।বলে

 একটা স্বচ্ছ গেলাসে করে এক গেলাস সরবত

মিঠি র  দিকে বাড়িয়ে ধরে - এই নাও।

সরবত   পান করে মিঠির সারা শরীর মন জুড়িয়ে যায়। - আ! কী সুন্দর।

মিঠি র এবার চোখ জুড়ে ঘুম নামে। তুলো মেঘের নরম বিছানায় কখন যে চোখ লেগে যায়, ও নিজেই

বুঝতে পারে না। ঘুম ভাঙতে দেখে  আকাশে ঝিকমিক চিকমিক করছে তারারা। ওর ভালো লাগে

কিন্তু এবার ওর বাড়ির জন্য মন কেমন করতে থাকে। ও ভাবে ও দুষ্টুমি করলেই মা বলত - আর দুষ্টুমি করলে তোকে কিন্তু দূরে কোথাও রেখে আসব।

মা কি তাই সকাল বেলা ওকে তেপান্তরের

মাঠে রেখে এসেছিল, আর পক্ষীরাজ ঘোড়া ---

না, এবার ওর চোখে জল এসে যায়।

মেঘবালিকা বলে - এমা তুমি কাঁদছ, বাড়ির জন্য মন কেমন করছে? আচ্ছা আমি এখনি পক্ষীরাজকে

বলে দিচ্ছি।

ব্যস! কথামাত্র কাজ। পক্ষীরাজ ওকে নিয়ে  শন শন

করে উড়ে চলল। দূর থেকে মিঠি ঢাকের আওয়াজ

শুনতে পেল।তারপর হঠাৎ  দেখে ও ওদের পাড়ায় পুজো মণ্ডপে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখতে পেয়েই মা ছুটে

আসে - এতক্ষন কোথায় ছিলি তুই, আমরা চারদিক

খুঁজছি। ও মা! তোকে এত সুন্দর জামাটা কে দিল।

ও মার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ছুট্টে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে।





ছেলেবেলায়

 রঞ্জনা বসু


স্কুল ফেরত পথের বাঁকে

ছেলেবেলা ছবি আঁকে,


অবাক চোখে দেখছিল

তাই তো খুশির বেগ ছিল।


সাত রাজার ধন চতুর্দিকে

সবুজ মনের ঘরটি ভরে


ভাবতে ভাবতে অনেক দূর

ছন্দে নাচে সেই নুপুর


এমন মজা বলব কি তা

সবাই যেন বন্ধু- মিতা


স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে নিয়ে

সময় যেন এগিয়ে চলে


হৃদয় তখন মত্ত মাতাল

আলো হাসির রঙিন সকাল


সেই খুশিটা পথের পাশে

গপ্পোকথা ছড়িয়ে রাখে


রামধনু রঙ আকাশটাকে

জয় করে নেয় ছেলেবেলা


আকাশ আসে হাতের কাছে

তেমন একটি গল্প বলা।




খেলার সময়

আবেশ কুমার দাস


ঘরের পেছনেই মাঠ। জমজমাট বিকেল। টেবিলটা জানলার একদম লাগোয়া নয় ঠিকই। কিন্তু কানে আসেই পঞ্চাশ গ্রাম বল তক্তায় পিটোনোর ঠকাঠক আওয়াজ। আর থেকে থেকেই চেঁচামেচি। ঘরে বসেই টের পাওয়া যায় কী ঘটছে মাঠে। জিকো চিৎকার জুড়েছে। আপ্পুও কম যায় না। সবার উঁচুতে তুলেছে গলা। আরও অনেকের গলা শোনা গেল। নির্ঘাত আউট নিয়ে বচসা। বেচারা আম্পায়ার। ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে কী করে আঙুল তোলে নিজেরই দলের ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে!

    একটু দেরিতেই খেলা শুরু হয়েছে আজ। শীতের ছোট বেলা। ঝুপ করে নেমে আসে অন্ধকার। তাও যে খানিক অপেক্ষা করেছিল সবাই, বোঝাই যাচ্ছে। আগের দিন সাঁইত্রিশ রান করা ব্যাটসম্যানকে কে আর রাতারাতি ভুলে যায়!

    কী জিজ্ঞেস করছি তখন থেকে, সংবিৎ ফেরে যদুবাবুর হুংকারে, কোথায় পড়ে রয়েছে মন? তিন-তিনবার জিজ্ঞেস করলাম এই নিয়ে, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ কীভাবে সৃষ্টি হয়...

    এই রে! তিনবার জিজ্ঞাসা করে ফেলেছেন স্যার! আর সে...

    এখুনি হচ্ছিল এক বিপদ।

    উত্তরটা যদিও জানাই ছিল। ভূগোল প্রিয় সাবজেক্ট তার। পড়াশুনোতেও ফাঁকি দেয় না মোটেই। ঝামেলাটা আর গড়াল না বেশি দূর। স্যারের মুখে যদিও লেগেই রইল অপ্রসন্ন ভাবটা। কিন্তু চোখে জল আসছিল সন্তুর। বিকেলের আলো থাকতেই যে কেন প্রায়দিনই পা টেনে টেনে উদয় হন যদুবাবু...

    ঠকাঠক আওয়াজটা থেমে গিয়েছে হঠাৎই। থেকে থেকে এখন শুধুই হুশহাশ ধ্বনি। উইকেটে লাগতে লাগতেও বারেবারে বেঁচে যাচ্ছে ব্যাটসম্যান। টুটুলের গলা ভেসে এল, ভাই আমাদের বেঙ্কটেশ প্রসাদ...

    ওহ। নাটা কুন্তল নেমেছে।

নতুন ছেলেটাকে দেখতে দেখতে তাক লেগে যাচ্ছিল ময়ূখের। কী নাম বলল যেন! সাম্যময়। তা সবার শেষে নেমে তেত্রিশ রানের আনবিটন পার্টনারশিপটাই শুধু নয়, বিরাট বিরাট দুটো ছক্কাও হাঁকিয়েছে সাম্যময়। তাই রানটা পৌঁছল একটু ভদ্রস্থ চেহারায়। এখন বলটাও করছে খাসা। টিংটিঙে চেহারা হলে কী হয়। বেশ জোর আছে বলে। মাঝেমধ্যে আবার আউটসুইং-ও ছাড়ছে। শুরুতে বল দিলেই হত।

    সেই কবে থেকে টিভিতে ক্রিকেট দেখছে ময়ূখ। তখন সৌরভ গাঙ্গুলীর শেষের দিক। ইন্ডিয়া খেলা অবশ্য ছেড়ে দিয়েছিল আগেই। সাম্যময়ের বোলিং অ্যাকশন দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল আইপিএলে গাঙ্গুলীকে বল করতে দেখার কথা। অবিকল অমনি বোলিং গ্রিপ আড়াল করে ছুটে আসা। সিম দেখতে না পাওয়ায় সমস্যা হয় ব্যাটসম্যানের। বাইরের বলটা ধরতে না পেরেই যেমন উইকেট দিয়ে গেল শঙ্খ। শেষ হোক খেলা। জানতে হবে কোথায় বাড়ি সাম্যময়ের। নিয়ম করে আসতে বলবে রোজ। টানা ক’দিন খেলিয়ে দেখে নেবে। তেমন বুঝলে নামিয়ে দেবে তরুণ সংঘের বিরুদ্ধে ম্যাচে। বুড়োদাও সম্ভবত রাজি হয়েই যাবে।

    তালতলার মাঠে অবশ্য রোজই আসে সাম্যময়। দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। খেয়াল করলেও শুরুতে পাত্তা দেয়নি ময়ূখ। পাত্তা দেওয়ার মতো চেহারাও নয়। শুধু সিড়িঙ্গেমার্কা বলেই নয়। চোখমুখ দেখলেই মনে হয় মুখচোরা। জামাকাপড়ও কেমন আদ্যিকেলে। সস্তার ছিটের কাপড় থেকে দর্জির হাতে বানানো ঢলঢলে প্যান্টজামা। খেলার মাঠে কী করবে এ ছেলে! নেট প্র্যাকটিসের সময় রোজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেও তাই মাথা ঘামায়নি ময়ূখ।

কিন্তু গতকাল যা হয়ে গেল!

ইন্দ্রনীলের হাত ফসকে পড়ে যাওয়া ফুলটসে লং অফের উপর দিয়ে সপাটে চালিয়েছিল আলি। ওদিকেই রোজ দাঁড়িয়ে থাকে সাম্যময়। বল তখনও আকাশে। ক’ পা পেছনে ছুটে শূন্যে শরীর ছুঁড়ে দিয়ে যেভাবে একহাতে ক্যাচ নিয়েছিল ছেলেটা, বুড়োদা অবধি তাজ্জব। কিন্তু ওখানেই শেষ নয়। নির্ভুল নিশানায় একেবারে ইন্দ্রনীলের হাতে থ্রো করেছিল অতঃপর লাল বলটা।

তখনই আলাপ। জিজ্ঞাসা করেছিল ময়ূখ, রোজ দেখি এসে দাঁড়িয়ে থাকো। নাম কী গো তোমার?

সাম্যময় হালদার।

কোথায় থাকো?

এদিকেই।

ছোট ছোট উত্তর। যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তার থেকে বাড়তি একটা শব্দও খরচা করা নেই। বড্ড লাজুক ছেলে। আবার জিজ্ঞাসা করেছিল ময়ূখ, ক্রিকেট খেলো?

এবার মুচকি হেসেছিল সাম্যময়, খেলতাম। এই বলে নয়...

মানে টেনিস বলে খেলেছে! বিশ্বাস হয়নি ময়ূখের। দু’ দফায় যা খেল দেখাল একেবারে ওস্তাদের মার। মনে হয় লাজুক বলেই চেপে যাচ্ছে নিজের কথা। পাছে ডাকা হয়। তবে জোরাজুরি করলে নেমেই পড়বে হয়তো। খেলাটা তো ভালবাসেই। নইলে স্রেফ নেট প্র্যাকটিস দেখতে রোজ বিকেলে এসে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত!

গতকাল আর বেশি এগোয়নি কথা।

কিন্তু আজই ডেকে নিতে হবে সাম্যময়কে, কে জানত!

তরুণ সংঘর বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে দিন পনেরোর মধ্যে শুরু হচ্ছে স্থানীয় লিগের খেলা। নিজেদের মধ্যে একটা ওয়ার্ম আপ ম্যাচ খেলার কথা ছিল আজ। কাকু আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডাক্তারের বাড়ি ছুটতে হয়েছে ধ্রুবকে। আসতে পারেনি। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল বুড়োদা। তাদের তালতলা ইউনাইটেডের ট্রেনার। তখনই বলেছিল ময়ূখ, ছেলেটা রোজ আসে। কাল দেখে মনে তো হল খেলতে পারবে...

তা ভালই খেলছে সাম্যময়। যদিও ম্যাচটা সম্ভবত হেরেই যাবে ময়ূখরা। রান বিশেষ ওঠেনি। তবে আজকের প্লাস পয়েন্ট হল সাম্যময়কে খুঁজে পাওয়া।

বছরখানেক হল স্থানীয় লিগে খেলার সুযোগ পেয়েছে তালতলা ইউনাইটেড। একেবারে আনকোরা দল। খেটেখুটে দাঁড় করাচ্ছেন বুড়োদা। ক্লাবও বেশিদিনের নয়। মাঠটা যদিও পুরনোই। ক্রিকেট পিচ অবশ্য হালেই হয়েছে। আসলে শেষ ক’ বছরে বেশ বদলে গিয়েছে তালতলা জায়গাটা। তারই পরিণাম তালতলা ইউনাইটেড। মাত্র বছর দশ আগেও এলাকাটা নাকি ছিল পাড়াঘরের মতো। এত ফ্ল্যাটবাড়ি গজিয়ে ওঠেনি। ময়ূখদের লাবণী অ্যাপার্টমেন্টসই যেমন এখনও তিন পুরোয়নি। তা কী ভাগ্যি এত আবাসনের চক্করে মাঠটাই শেষমেশ হাপিস হয়ে যায়নি। তাদের মতো বাইরে থেকে আসা ফ্যামিলিগুলোর ছেলেদের বিকেলে খেলাধুলোর একটা ব্যবস্থা হয়েছে।

আচমকাই ঘটল ঘটনাটা।

সাম্যময়ের ওভারগুলো দেখেশুনে খেলে দিয়ে উলটো দিক থেকে আর্যর বলে স্কোর এগিয়ে নেওয়ার ছক কষেছিল পিটার আর ইন্দ্রনীল। লুজ বলটা পেয়ে মিড উইকেটের উপর দিয়ে হাঁকিয়েছিল পিটার। মাটি থেকে কম করেও দশ ফুট উঁচু দিয়ে সীমানার বাইরে উড়ে যাচ্ছিল লাল বলটা। ওখানে সাম্যময়কে রেখেছিল ময়ূখ। হঠাৎ সবাই সবিস্ময়ে দেখল সাম্যময়ের ডান হাতটা লম্বায় দীর্ঘ হয়ে অতখানি উঁচুতে উঠে দিব্যি পেয়ে গিয়েছে বলের নাগাল।

নিমেষের স্তব্ধতা। যাকে বলে পিন ড্রপ সাইলেন্স।

পরক্ষণেই গায়ের রোম খাড়া হয়ে ওঠে সক্কলের। মাঠময় আওয়াজ ওঠে ‘ভূ... ভূ... ভূত’। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে ব্যাট আর উইকেট। ভণ্ডুল হয়ে যায় খেলা। আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে যে যেদিকে পারে ছুট লাগায়।

একটু একটু করে তখন আলো কমে আসছে শেষ নভেম্বরের বিকেলের।

ঘরের ভেতর ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। মাঠের দিক থেকে চেঁচামেচিও কমে আসছিল। নষ্ট হয়ে গেল পুরো বিকেলটাই। সামনের সপ্তায় ক্যাম্বিস বলের খেলা আছে সাহাপাড়ার সঙ্গে তাদের তালতলার। ফুল হ্যান্ডে খেলা থাকলে সৌরভ গাঙ্গুলীর বোলিং অ্যাকশন নকল করে সে। ইংল্যান্ডে গিয়ে দুটো সেঞ্চুরিই শুধু নয়, জীবনের প্রথম দুই টেস্টে ছ’টা উইকেটও নিয়েছে সৌরভ। বাঁ হাতে ব্যাট করা তো সম্ভব নয়। কাজেই...

সেদিনও কি এমন হবে! খেলার সময় পড়াতে চলে আসবেন না তো যদুবাবু!

অন্যমনস্কতায় খেয়ালই করেনি সে লাইট জ্বালিয়ে দিতে বলেছেন যদুবাবু।

হুঁশ ফিরল আবার এক বাঘা হুংকারে, কথা কানে যায় না! লাইটটা জ্বেলে দিতে বললাম। এত অমনোযোগী কেন...

বলতে বলতেই গাল লক্ষ করে বিরাশি সিক্কার এক থাপ্পড় কষিয়েছিলেন স্যার। আর ক্ষমা নেই। ভয়ে মাথা নামিয়ে নিতে গিয়েছিল সন্তু। থাপ্পড়টা সপাটে এসে পড়ল কানের পাশে। পরক্ষণেই...

আকাশের আলোর সঙ্গে সঙ্গেই চোখের সামনে থেকে দুনিয়ার সব আলো নিভে যেতে টের পেল সে।

আঁতকে উঠেছিলেন যদুবাবুও। ব্যস্ত হয়ে পা টেনে টেনে উঠে এসেছিলেন যত তাড়াতাড়ি পারেন। ব্যাকুল হয়ে ডাকছিলেন অচেতন সন্তুকে ঠেলা দিতে দিতে, সন্তু, কী হল সন্তু... সাম্যময়...



আগমনী 
অনমিতা মুখার্জি
ষষ্ঠ শ্রেণী, ত্রিবেনী টিস্যুস বিদ্যাপীঠ, হুগলি

নীল আকাশে মেঘের ছবি
পুকুরপাড়ে কাশের মেলা
শিউলিতলা ফুলে ভরা —
মেঘ ও রোদের মজার খেলা।
ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ ধ্বনি
আসবে কবে দুগ্গামণি ?
শরৎকালের ভোরের আলোয় 
ঐ শোনা যায় আগমনী।
শাপলা-শালুক ,পদ্মে ভরা
দীঘির জলের বাড়ায় শোভা।
বাতাসে আজ পূজোর গন্ধ,
প্রকৃতি আজ মনোলোভা ।।



প‍্যারালিম্পিক্স নিয়ে আমার অনুভূতি
শ্রেয়সী মুখোপাধ‍্যায়
(দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী)


শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশ্বে অনুষ্ঠিত বৃহত্তম ক্রীড়া অনুষ্ঠানের নাম হল "প্যারাঅলিম্পিক"। সাধারণ অলিম্পিকের তুলনায় প্যারালিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় দুটি সাময়িক পর্যায়ে। যথাক্রমে  গ্রীষ্মকালীন এবং শীতকালীন এবং দুই বছরের সময়ের ব্যবধানে এটি সম্পন্ন হয় । অনেকগুলি অলিম্পিক প্রতিযোগিতা যেমন, অনলাইন স্কিং, ক্রস কান্ট্রি স্কীং শীতকালীন অন্যান্য খেলা এবং সাইক্লিং যেগুলো অলিম্পিকের সাথে সাথে ভ্যালেন্টি কেউ হয়ে থাকে । শারীরিক প্রতিবন্ধীতার অবস্থার উপর ভিত্তি করে পরিকাঠামোর আরো কিছু নতুনত্ব লক্ষ করা যায় । ১৯৮৯ তে সংগঠিত "আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি" বিশ্বব্যাপী এই ক্রীড়ানুষ্ঠান পরিচালনা করে। প্যারালিম্পিক মূলত ছয়টি শ্রেণীতে বিভক্ত । যথাক্রমে শারীরিক বিকলাঙ্গ, সেরিব্রাল পালর্সি, দৃষ্টিহীনতা, সুষুম্নাকা ণ্ড সংক্রান্ত প্রতিবন্ধিতা এবং বুদ্ধিজীবী অক্ষমতা। এছাড়াও যোগ করা হয়েছে বামন অর্থ যেটি উপরোক্ত কোন শ্রেণীর অন্তর্গত নয়। প্রতিযোগিরা পুনরায় শ্রেণীভূক্ত হতে পারে যদি তাদের শারীরিক উন্নতি অথবা অবনতি দেখা যায়। 
ইতিহাস খুঁটিয়ে দেখতে হলে পাওয়া যাবে, স্যার লুডউইস গাটম্যান ব্রিটিশ বিশ্ব যোদ্ধাদের নিয়ে একটি ক্রীড়া মূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন হাজার ১৯৪৮ সালে যাদের সুষুম্নাকাণ্ড সংক্রান্ত প্রতিবন্ধীতা দেখা দিয়েছিল। তার চার বছর পরে ১৯৫২ সালে নেদারল্যান্ডের প্রতিযোগীগণ  ব্রিটিশ-এর সাথে যুক্ত হয়। ১৯৬০ সালে প্রথমবারের জন্য আন্তরাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে রুমে আয়োজিত হয় প্যারালিম্পিক। শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজিত হয় ১৯৭৬ সালে সুইডেনে  যথাক্রমে ১৯৪৪ সালে এবং  ১৯৯২ তে ফ্রান্সে। ২০০১- এ  আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সম্মেলন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যেই শহরটি অলিম্পিক আয়োজন করবে কিছুদিনের ব্যবধানে সেই শহরে প্যারালিম্পিক আয়োজিত হবে। ১৯৬০ সালে ৪০০  জন খেলোয়াড় নিয়ে শুরু হলেও ২০২০   সালে প্যারালিম্পিক এ প্রতিযোগী সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪,৫৩৭ জন।

প্যারালিম্পিক্সে ভারতের রবিবার 29 / 08 / 2021 দিনটা বর্ণময় কেটেছে। টেবিল টেনিসে ভবানিবেন পটেল, হাইজাম্পে নিশাদ কুমারের পর একই দিনে ভারতের তৃতীয় পদক এনেছেন ডিসকাস থ্রোয়ার বিনোদ কুমার।

সোমবারও 30 / 08 / 2021 ভারতের এক ঝাঁক অ্যাথলিটের ভাগ্যপরীক্ষা। জ্যাভলিন থ্রো থেকে শুরু করে ডিসকাস, শ্যুটিং, নামছেন ভারতের একাধিক অ্যাথলিট। রবিবার পুরুষদের ডিসকাস থ্রোয়ে এফ ৫২ ইভেন্টে ১৯.৯১ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ব্রোঞ্জ জিতলেন ভারতের বিনোদ।এশীয় রেকর্ডও ভেঙে দিলেন বিনোদ। ১৯.৯১ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে বিনোদের থ্রো। তাঁর চেয়ে সামান্য বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে (১৯.৯৮ মিটার) রুপো জিতে নিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ার সান্দোর ভেলিমির। পোল্যান্ডের কোসেউইচ পিওতর ২০.০২ মিটার ডিসকাস ছুড়ে সোনা জিতে নিয়েছেন।

তবে রবিবার রাতের দিকে আচমকা তাঁর পদক নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ভারতীয় ক্রীড়ামহলে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে আচমকাই সংশয় তৈরি হয়েছে বিনোদের পদক প্রাপ্তিকে ঘিরে। তিনি ব্রোঞ্জ পদক নিয়েই দেশে ফিরবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে!

কিন্তু কেন? কারণ, বিনোদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ধরন নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন প্রতিপক্ষ অ্যাথলিটরা। ডিসকাস থ্রোয়ে এফ ৫২ ইভেন্টের যোগ্যতা পেয়েছিলেন বিনোদ। যাঁদের পেশিশক্তি ত্রুটিপূর্ণ হয়, তাঁরা এই ইভেন্টে অংশ নিতে পারেন। পাশাপাশি শরীরের কোনও অংশের মুভমেন্ট সঠিক না হলে, অঙ্গ না থাকলে বা দুই পায়ের মাপ সমান না হলে এই ইভেন্টে অংশ নেওয়া যায়। বিনোদের ক্ষেত্রে ২২ অগাস্ট প্যারালিম্পিক্সের আয়োজকরা সেই মাপকাঠি দেখে এফ ৫২ ইভেন্টের জন্য বিনোদকে নির্বাচিত করেছিলেন। তাঁর প্রতিপক্ষরা কী নিয়ে সেই নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, তা এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। উদ্যোক্তারা শুধু জানিয়েছেন যে, এই ইভেন্টে পদক বিতরণ স্থগিত রাখা হয়েছে। সোমবার সন্ধের দিকে তা দেওয়া হবে।

02/09/2021 ভারতের যোগেশ কাথুনিয়া পেয়েছেন রৌপ্য পদক, সুমিত আন্টিল পেয়েছেন স্বর্ণপদক, সিংরাজ আধানা পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক, মারিয়াপ্পান থাঙ্গাভেলু রৌপ্য পদক , শরদকুমার পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক, ভাবিনা প্যাটেল পেয়েছেন রৌপ্য পদক , নিশাদ কুমার পেয়েছেন রৌপ্য পদক, অবনী লেখারা পেয়েছেন স্বর্ণপদক, দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া পেয়েছেন  রৌপ্যপদক , সুন্দর সিং  গুরজার  পেয়েছেন ব্রোঞ্জ পদক ।



স্মরণীয়
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
কলমে - পীযূষ প্রতিহার

তোমরা কি রাজা রায়চৌধুরী কে চেন? মনে পড়ছে না? আচ্ছা দাঁড়াও মনে করিয়ে দিচ্ছি। কাকাবাবু কে জানো? সন্তু? এবার মনে পড়েছে? সেই 'সবুজ দ্বীপের রাজা', 'কাকাবাবু হেরে গেলেন', 'মিশর রহস্য', 'ইয়েতি অভিযান' সিনেমা গুলো দেখেছ? যদি না দেখে থাকো তবে এই লকডাউনে মনখারাপ কাটানোর জন্য দেখে নিতেই পারো। এই বিখ্যাত কাকাবাবু চরিত্র কে সৃষ্টি করেছেন জানো? তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ১৯৩৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের মাদারিপুর জেলার মাইজপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা কালিপদ গঙ্গোপাধ্যায় ও মা মীরা দেবী। তিন-চার বছর বয়সেই তারা সপরিবারে কলকাতা চলে আসেন। সেখানে স্কুল শেষ করে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ,দমদম মতিঝিল কলেজ ও সিটি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৪ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ করেন। পরবর্তীতে মার্কিন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক মি. পল কলকাতা এলে তার সঙ্গে সুনীলের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান এবং পাঠ শেষ করে সেখানে কিছুদিন সেখানে উপগ্রন্থাগারিক হিসেবে চাকরি করেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি 'কৃত্তিবাস' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। ১৯৫৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'একা এবং কয়েকজন' প্রকাশিত হয়। 'দেশ' পত্রিকায় তার প্রথম উপন্যাস 'আত্মপ্রকাশ' ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। পরবর্তী কালে এই দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে চাকরি করেন বহুদিন। তার বিখ্যাত কয়েকটি উপন্যাস হল 'প্রথম আলো','সেইসময়','পূর্ব পশ্চিম', 'অর্ধেক জীবন','অরন্যের দিনরাত্রি','রানু ও ভানু','মনের মানুষ' ইত্যাদি। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজেকে কবি বলেই মনে করতেন। 'নীরা' নামক নারী চরিত্র নিয়ে অসংখ্য কবিতা তাকে ভীষন জনপ্রিয়তা এনে দেয়।তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল 'আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি','যুগলবন্দী'(শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে যৌথভাবে),'হঠাৎ নীরার জন্য','রাত্রির রদ্যেঁভু' ইত্যাদি।

'সেই সময়' নামক ঐতিহাসিক উপন্যাসের জন্য ১৯৮৫ সালে 'সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার', ১৯৭২ এবং ১৯৮৯ সালে 'আনন্দ পুরস্কার', ১৯৮২ সালে 'বঙ্কিম পুরস্কার' লাভ করেন অসাধারণ সাহিত্য সৃষ্টির জন্য। ২০০২ সালে তিনি কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান 'সাহিত্য একাডেমি' এবং পশ্চিমবঙ্গ 'শিশুকিশোর একাডেমি' র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি একাধিক ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন তার লেখায়। তিনি নীললোহিত,নীল উপাধ্যায় এবং সনাতন পাঠক ছদ্মনামে লিখতেন। আত্মকথনের ভঙ্গিতে নীললোহিতের কাহিনীগুলো বাঙালি পাঠকের কাছে এক নতুন স্বাদ নিয়ে আসে। শিশু কিশোরদের জন্য কাকাবাবু চরিত্র তার এক দারুণ জনপ্রিয় সৃষ্টি। মোট ৩৬ টি কাকাবাবু কাহিনী তিনি লিখেছেন। ১৯৭৪ থেকে আনন্দমেলায় ধারাবাহিক ভাবে কাকাবাবু  উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ছোটদের জন্য অনেক গল্পও তিনি লিখেছেন। 'উদাসী রাজকুমার' নামের একটি উপন্যাস ছোটদের কাছে খুবই জনপ্রিয়।

২০০৩ সালের ৪ এপ্রিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় মরনোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেন। ২০১২ সালের ২৩শে অক্টোবর এই মহান সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।



ফুলকুসুমপুর খুব কাছে ২২

রতনতনু ঘাটী

সকালবেলা তখনও সূর্য গাছপালার মাথায় রোদ মাখাতে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেনি। মাখন দলপতি ফতুয়া পরে ত্রিপাঠীদের বাড়ির সামনে দিয়ে কোথাও যেন যাচ্ছিল। ইচ্ছেদাদু দুঃখী মুখে দোতলার বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে আছেন। আজ সকালে এক চুমুক চাও খাননি পর্যন্ত। ইচ্ছেদাদুকে অমনভাবে বসে থাকতে দেখে মাখন দলপতি রাস্তা থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘ও ত্রিপাঠীমশাই, আপনাদের বিলম্বকুমারকে ভোরবেলা তেমোহানি নদীর পাড়ে হাঁটুর উপর মাথা ঠুকিয়ে বসে থাকতে দেখে এলাম গো।’
   দাদু ্বাক গলায় বললেন, ‘তাই নাকি?’ তক্ষুনি তিনি শুধুকাকাকে ডাক দিলেন, ‘তুই শিগগির যা তো শুধু, তেমোহানি নদীর পাড় থেকে বিলম্বকে হিড়হিড় করে টেনে আন তো! হতভাগা কোথাকার!’
   ততক্ষণে কুয়াশামাসি এসে বিলম্বদাদুর খবর শুনে সব কাজ ফেলে মাথায় হাত দিয়ে উঠোনে বসে পড়ল। কাজে ফাঁকি দেওয়ার ফিকির পেলে আর দেখতে হয় না কুয়াশামাসিকে। আজ ইচ্ছেঠাকুরমার পুজোর ফুল তোলায় মন বসল না। পরিপালন খাটুয়া এসে আজ রোববার বলে হযবরল চিড়িয়াখানার সব পোষ্যদের খাঁচা খুলে ছেড়ে দিল। তক্ষুনি ঠাকুরমার মুখে কাল রাত থেকে বিলম্বদাদুর নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর শুনে পরিপালনকাকু বললেন, ‘আমি বিলম্বদাদুকে খুঁজতে যাব বড়মা?’
   ঠাকুরমা শুকনো মুখে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘যেতে হবে না! তুই তোর কাজ কর!’
   তিন্নি, বিন্নি আর বুম্বাও ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তারা এসে দাদুর কাছ থেকে বিলম্বদাদুর সঠিক খবরটা জানার জন্যে দাদুর চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। 
   ইচ্ছেদাদুর গম্ভীর মুখের সামনে একমাত্র বিন্নিই কথা বলার সাহস রাখে। কেননা, বিন্নির লেখাপড়ায় মাথা দারুণ। অঙ্কে একশোয় একশো পায়। কুইজে ফার্স্ট। এজন্যে সে দাদুর কাছ থেকে আলাদা একটা পক্ষপাত আদায় করে নেয়। বিন্নি বলল, ‘দাদু, বাড়িতে একটা অবাক কাণ্ড ঘটেছে! আমাদের পুরনো বই-খাতা বিক্রির টাকা বিলম্বদাদু একটা ছোট টিনের কৌটোয় ভরে ওর গুটনো বিছানার ভাঁজে রেখে দিত। বিলম্বদাদু একদিন আবছা অন্ধকারে টাকাগুলো গুনে দেখছিল, আমি নিজের চোখে সেদিন দেখেছি। কাল রাত থেকে তো বিলম্বদাদুকে পাওয়া যাচ্ছে না। এখন নীচে গিয়ে দেখে এলাম, বিছানা যে-কে সেই গোটানো হয়ে আছে। কিন্তু বিছানার ভাঁজে সেই টাকা রাখার কোটৌটা নেই!’ 
   বুম্বা তিন্নিদিকে বলল, ‘দিদি, তুই সেই কথাটাও দাদুকে বল!’
   দাদু মুখ তুলে তাকালেন, ‘কী কথা রে?’
   তিন্নি বলল, ‘আমরা বিলম্বদাদুকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমরা জানি, তোমার কৌটোয় তো অনেক টাকা আছে। সে টাকা কি তুমি তোমার দেশের বাড়িতে নিয়ে যাবে নাকি? কিন্তু ঠাকুরমা যে বলে, তোমার নাকি বাড়িই নেই? তা হলে সে টাকা নিয়ে তুমি কী করবে বিলম্বদাদু?’
   বিলম্বদাদু বলেছিল, ‘আমি ঠিক করে রেখেছি, এবছর তোদের নিয়ে ওই টাকা দিয়ে ঠাকুর কিনে এনে সরস্বতী পুজো করব। ফুলের মালা কিনব, ফলমূল আর বাতাসা কিনব। বড়বাবুর কাছ থেকে একটাও টাকা নেব না। সব আমার এই জমানো টাকায় হবে।’ তিন্নি চিন্তা-মাখানো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘দাদু, বিলম্বদাদু কাল রাত থেকে তো নিরুদ্দেশই হয়ে গেল, তা হলে আমাদের সরস্বতী পুজো আর হবে না?’
   সকাল-সকাল ফুলকুসুমপুর গ্রামের অনেক লোকজনও বিলম্বদাদুর নিরুদ্দেশের খবর পেয়ে এসে উঠোনে জড়ো হয়েছে। ইচ্ছেদাদুর দারুণ মনখারাপ। তিনি মন ভার করে বসে আছেন, দোতলা থেকে নামেননি।
   ফুলকুসুমপুর থানা থেকে একজন সেপাই এসে নীচে বিলম্বদাদুর খোঁজ করল। তখন ইচ্ছেদাদু একতলায় নেমে এলেন। 
   সেপাই জিজ্ঞেস করল, ‘ত্রিপাঠীবাবু, কে যেন থানায় বলে এল, আপনাদের বিলম্বকুমার নামের কাজের লোকটিকে নাকি ভোরবেলা তেমোহানি নদীর পাড়ে বসে থাকতে দেখা গেছে? এ কথা শুনে আমি দৌড়ে গেলাম নদীর ধারে। কিন্তু নদীর ধারে কাউকেই দেখতে পেলাম না। উনি কি বাড়িতে ফিরে এসেছেন? খবর নিয়ে আমাকে এক্ষুনি বড় দারোগাসাহেবকে ইনফর্ম করতে হবে।’
   দাদুর মুখ থেকে ‘না’ কথাটাই বেরিয়ে এল। কারণ, দূরের ঝাঁকড়া কদম গাছের দিকে তাকাতেই ইচ্ছেদাদু দেখতে পেলেন, শুধুকাকার একাই বাড়ি ফিরে আসছেন। সঙ্গে বিলম্বদাদু নেই।
   বিলম্বদাদুকে দেখতে না পেয়ে ইচ্ছেদাদু বললেন, ‘না সেপাইমশাই, ওই তো আমার ছোট ছেলে নদীর ধার থেকে ফেরত আসছে।’ তারপর সেপাইমশাইকে বললেন, ‘আসুন। বাড়িতে একটুখানি বসবেন চলুন। এক কাপ চা খেয়ে তারপর যাবেন!’
   প্রায় তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে সেপাই বলল, ‘না স্যার, আমার কি আর দম ফেলার জো আছে? আপনার বাড়ি থেকে মিসিং ডায়েরি করা হয়েছে। এক্ষুনি উপরমহলে খবর পাঠাতে হবে। না হলে আমাদের বড় দারোগাসাহেবের লালবাজারের ট্রান্সফারের প্রোমোশন আটকে যাবে যে! আমি চলি ত্রিপাঠীবাবু!’
   তক্ষুনি বাঁ দিকে সান্ধ্যকীদের বাড়ির দিক থেকে বিলম্বদাদুকে আসতে দেখতে পেলেন। ইচ্ছেদাদু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘ওই যে, মহাপুরুষ আসছেন!’
   দাদুর সামনে এসে প্রণাম করে মাথা নিচু দাঁড়াল বিলম্বদাদু। বাড়ির সামনে অত লোক দেখে একটু ঘাবড়ে গেছে। দাদু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলি শুনি?’
   ছোটরা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। যেন এখনই এবছর সরস্বতী পুজো হবে কিনা তার ফাইলান ডিসিশান হবে। বুম্বা দুম করে বলে ফেলল, ‘আমাদের সরস্বতী পুজোর কী হবে?’
    ‘তোদের কাজটাই তো সেরে এলাম রে!’ 
   ইচ্ছেদাদু রাগত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওদের আবাক কী কাজ? কোথায় গিয়েছিলি?’
   ‘বাবু, তেমোহানি নদীর ধার থেকে ফিরে আসার সময় খপ করে মনে পড়ে গেল, বুম্বাদের আমি কথা দিয়েছিলাম, এবছর সরস্বতী পুজো করব। তাই হারাধন পটুয়ার বাড়িতে গিয়ে নগদ টাকা দিয়ে ঠাকুরের বায়নাটা সেরে এলাম!’ 
   রাগের কালো মেঘ সরে গিয়ে ইচ্ছেদাদুর মুখে একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল। বাড়ির সামনে থেকে মানুষের ভিড়ও পাতলা হতে শুরু করল। সেপাইমশাই ফিক করে হেসে থানার দিকে রওনা দিলেন। 
   ইচ্ছেঠাকুরমা বললেন, ‘এসো বাবা বিলম্ব! শিগগির একটু কিছু মুখে দেবে এসো! সারারাত কিচ্ছুটি খায়নি বেচারা!’ 
(এর পর আগামী রোববার)


গল্পে গল্পে ক্যুইজ 
রাজীব কুমার ঘোষ

পর্ব ৯

কী করে টাইম মেশিন বানাতে হয় (পর্ব ৩)
আগের পর্বে অতীতে যাবার টাইম মেশিন বানাবার একটা সহজ কৌশল বলে দিয়েছি। এবার এসো আগের দিনের ক্যুইজের উত্তর দেখে নিই।

‘দ্য ডায়েরি অফ এ ইয়ং গার্ল’, পৃথিবী বিখ্যাত এই ডায়রিটি লিখেছিল একটি কিশোরী, তার নাম অ্যান ফ্র্যাঙ্ক (বাংলায় অনেকে ‘অ্যানা’ লেখেন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাৎসি বাহিনি যখন নেদারল্যান্ড আক্রমণ করে তখন অ্যান তার পরিবারের সঙ্গে একটি বাড়িতে লুকিয়ে পড়ে, কারণ তারা ইহুদি ছিল। তোমরা নিশ্চয়ই অ্যাডলফ় হিটলারের নাম শুনেছ, যিনি জার্মান নাৎসি নেতা ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার পর জার্মানির আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় নানাভাবে, ছলে-বলে হিটলারের দল জার্মান দেশের লোকেদের মন জয় করে নিয়েছিল। তার মধ্যে একটা ছিল যে, জার্মানির দুরবস্থার জন্য তারা ইহুদিদের দায়ী করেছিল অযৌক্তিকভাবে। তারা লোকদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল দেশের দুরবস্থার জন্য দায়ী ইহুদিরা। আসলে সাধারণ লোক দেশের অবস্থার পিছনে জটিল কারণগুলো বুঝতে চায় না বা পারে না, তারা সহজ কারণ খোঁজে। ঠিক যেমন আমরা কোনো খেলায় ভারত হারলে একজন বা কয়েকজন ব্যাটসম্যান বা বোলারের ওপর দোষ চাপাই। আসলে তারা কারণ হলেও একমাত্র কারণ তো নন। খেলাটা একটা দল খেলে, হার জিতের দায় আসলে গোটা দলের। এই ঘৃণার রাজনীতি করতে করতে নাৎসি বাহিনি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য একটি কাজ করেছিল, যাকে আমরা ‘হলোকাস্ট’ বলি। খুব সংক্ষেপে যাকে বলতে পারি হাজার হাজার ইহুদিদের ধরে নিয়ে এসে গণহত্যা। ভুল বললাম, হাজার নয় লক্ষ লক্ষ। আনুমানিক সংখ্যাটা শুনলে চমকে উঠবে — ষাট লক্ষ। এর বেশি আমি বলবনা তোমাদের। ছোটোদের এইসব কথা বলতে মন চায়না কিন্তু মানুষের ইতিহাস কখনো গৌরবের আবার কখনো লজ্জার, ভয়ংকর। সুতরাং বুঝতেই পারছ কেন অ্যান-এর পরিবার লুকিয়ে পড়েছিল। বাইরে তারা মোটেই বেরোতে পারত না। এই অবস্থাটা তোমরা করোনার জন্য এখন অনুভব করতে পারছ। তাও তো তোমরা বাইরে তাকিয়ে দেখতে পারছ। ভয়ে অ্যানরা তাও করতে পারত না। এই বন্ধুবান্ধব বিহীন অবস্থায় অ্যান ১৯৪২ সালের ১২ জুন থেকে ডায়রি লিখতে শুরু করে। ১ অগাস্ট ১৯৪৪ সাল অবধি সে ডায়রি লিখেছিল। তারপর তার পরিবার ধরা পড়ে। অ্যান একদিক থেকে সৌভাগ্যবতী ছিল, তাকে জার্মানদের গ্যাস চেম্বারে মরতে হয়নি, সে টাইফাস রোগে মারা যায়। অ্যানের ডায়রিটি কিন্তু ঘটনাচক্রে তার বাবার হাতে পৌঁছে গিয়েছিল। পরিবারে তিনিই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। ১৯৪৭ সালে মূল ডাচ ভাষায় এটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালে অনুবাদ হয় ইংরাজিতে। তারপর কত ভাষায় যে অনুবাদ হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাতেই তুমি অনেক অনুবাদ পাবে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও একটি অনুবাদ করেছিলেন। এবার তোমরা বুঝতেই পারছ কেন এই ডায়রিটি উল্লেখযোগ্য। তোমাদের মধ্যে এই করোনা সময়কে কেউ ডায়রিতে ধরে রেখেছ নাকি, প্রথম লক-ডাউন থেকে। যদি তোমাদের বয়সী কেউ ধরে রাখো তাহলে জেনে রেখো সেই ডায়রিটিও একটি অসম্ভব মূল্যবান দলিল। 

আজকে ভবিষ্যতে যাবার টাইম মেশিন বানাবার কৌশল তোমাদের জানানোর কথা ছিল কিন্তু অ্যান ফ্র্যাঙ্কের কথা বলতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। জানা থাকা সত্ত্বেও যতবারই এই কিশোরীটির কথা ওঠে মন খারাপ হয়ে যায়। অ্যান ফ্র্যাঙ্ক বেঁচে থাকলে বড় লেখক হতেন। যুদ্ধে এইরকম কত কত অ্যান ফ্র্যাঙ্কদের আমরা হারিয়েছি ভাবলেও কষ্ট হয়। জার্মানিতে হিটলার শক্তি দখলের আগেই কিন্তু বহু ব্যক্তি বুঝে গেছিলেন কী হতে চলেছে, কিন্তু তারা ছিলেন সংখ্যালঘু। কী করে তারা বুঝেছিলেন? তাদের কাছে কি ভবিষ্যতে যাবার টাইম মেশিন ছিল? পরের বার আসব ভবিষ্যতে যাবার টাইম মেশিন নিয়ে। 

আজকের প্রশ্ন, প্রশ্ন নয়, শিক্ষক দিবসে তোমাদের জন্য উপহার। 

তোমরা হয়ত টের পাচ্ছ না, রোবট যুগ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। তোমরা এখন পৃথিবীতে রোবট যুগের একদম শুরুর দিকে আছ। তোমারা এবং তোমাদের পরে আরো তিন থেকে পাঁচ প্রজন্ম অবধি হয়ত এই প্রথম রোবট যুগ চলবে, তারপর আসবে আরো উন্নততর কোনো রোবট যুগ। 

আমার এই কথাটা এখন অদ্ভূত লাগলেও, তোমাদের যখন চল্লিশ বছর বয়স হবে তখন তোমাদের এই জ্বলদর্চির ছোটোবেলাতে (ঘোষ স্যারের নাম ভুলে গেলেও) ঘোষ স্যারের বলা এই কথাটা মনে পড়বে। সেদিন তোমরা বিশ্বাস করবে যে ঘোষ স্যার টাইম মেশিন বানিয়েছিলেন। 

এখন এই রোবটদের ক্রিয়াকলাপ বা কাজকর্ম তিনটি সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, যাদের ইংরাজিতে বলা হয় ‘থ্রি লজ অফ রোবোটিক্স’। তোমরা শুনলে চমকে উঠবে এই তিনটি সূত্র কোনো বিজ্ঞানী দেননি, দিয়েছিলেন এক কল্পবিজ্ঞান লেখক। দিয়েছিলেন তার লেখা একটি গল্পের মধ্যে। ভেবে দ্যাখো বড়রা ভাবে গল্প-টল্প এইসব লেখালেখি হল শুধু বিনোদন, এর কোনো গুরুত্ব নেই। বড়দের পাল্লায় পড়ে তোমরাও অনেকসময় এটা ভেবে ফেলো। তাই তো তোমরা ক্লাসের পড়ার জন্য কত কত বই কেন কিন্তু নিয়মিত কোনো ছোটোদের ম্যাগাজিন নাও না বা নিয়মিত গল্পের বই কেনো না। এবার ভেবে দ্যাখো একজন লেখকের দেওয়া সূত্রের ওপর নির্ভর করে এই পুরো রোবট ব্যাপারটাই দাঁড়িয়ে আছে। তোমরা নিশ্চয়ই খবর রাখো রোবটদের দিয়ে কত কাজ করাই আমরা, এমনকি মানুষের অপারেশনও। আজকের প্রশ্ন, এই লেখকের নাম কী? কোন গল্পে প্রথম তিনি দিয়েছিলেন এই তিনটি সূত্র? এই তিনটি সূত্র কী কী?


পাঠ প্রতিক্রিয়া
( ছোটোবেলা ৪৭ বিশেষ সংখ্যা পড়ে দ্বাদশ শ্রেণীর শাশ্বতী কর যা লিখল)

কি বন্ধুরা তোমরা ভালো আছো তো? আবার তোমাদের সাথে কথা হচ্ছে।কি করব বল? মাঝপথে এত বৃষ্টি এলো যে আসতেই দেরি হয়ে গেলো।যাই হোক, আজকের সংখ্যায় চিত্রগ্রাহক নিলাব্জ ঘোষ  এর ছবিটা দেখেই মনটা ভরে গেলো । অনেক কথা মনে পড়ে গেল আর তার সাথে  সবার  লেখাগুলো পড়ে আর ছবি গুলো দেখে গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল।

 আমার মতে, স্বাধীনতা দিবস কোন একদিন বলে পালিত হতে পারে না দেশকে যদি সত্যি ভালবাসতে হয় তবে আগে অসহায় মানুষকে ভালোবাসা উচিত। দেশ তো আর বইয়ের পাতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে না? থাকে স্বইচ্ছায় কোন অসহায় মানুষকে কিছু সাহায্য করার মধ্যে দিয়ে।তাই নয় কি? যে সমস্ত নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব তাদের আত্ম বলিদান এর মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করেছেন তা তো তাদের আত্মত্যাগ এর মাধ্যমেই, একেই তো বলে দেশপ্রেম। তাই নয় কি?
আমি সবার লেখা পড়ে কেমন লাগলো তা একটু বলি কেমন-
মুক্তি দাসের 'অগ্নিযুগের অগ্নিকিশোর' লেখাটা পড়ে আমার চোখে জল  এসে গেছিলো। এই ধরনের লেখা পড়লে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। সত্যিই তো আজকের এই দেশ স্বাধীন হয়েছে এরকম অল্প বয়সী কিছু কিশোর-কিশোরী ,তরুণ-তরুণীদের আত্ম বলিদান এর মধ্যে দিয়ে। বলার কিছু নেই লেখাটা ভীষণ ভালো লেগেছে । অনেক ধন্যবাদ  স্যার আপনাকে এত সুন্দরভাবে ইতিহাসটাকে গল্পের ছলে তুলে ধরার জন্য। 
সৌনক বসুর আঁকা খুব সুন্দর হয়েছে।😊

সন্দীপন রায়ের 'প্রত্যাশায় স্বাধীনতা'কবিতাটা ভীষন ভালো লেগেছে।আশা আছে বলেই তো আমরা  একটা  সুন্দর দিনের জন্য  অপেক্ষা করি। রাজদীপ দাসের আঁকাটি  খুব সুন্দর হয়েছে।কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার কথা মনে করালো আঁকাটি। বহ্নিশিখা ঘটকের 'অথ সমুদ্র দর্শনং কথা' গল্পটি বেশ মজাদার। খুব ভালো লাগলো পড়ে। কল্পনার ডানা মেলে আমরা কোথায় না পৌঁছতে পারি।করোনার জেরে বাড়ির মধ্যে বন্দি থাকতে থাকতে সবার‌ই ইচ্ছা করছে ঘুরতে যেতে তাই আমরাও টুটুল এর মতো স্বপ্ন দেখছি তাই তো? অনমিতা মুখার্জির আকাঁটা ও খুব ভালো লাগলো। বন্দনা সেনগুপ্তের 'আমরা করব জয়' কবিতাটি ভীষণ ভালো লাগলো পড়ে। সন্দীপ দত্ত এর 'পরিকল্পনা'গল্পটা খুব ভালো লেগেছে।
সুহেনা মন্ডলের 'জীবনের লক্ষ্য' কবিতাটি  খুব ভালো লাগলো। খুব সুন্দর লেখাটা।
রতনতনু ঘাটী মহাশয় 'ফুল কুসুমপুর খুব কাছে' উপন্যাসটি নিয়ে আমার বলার কিছু নেই আমার ভীষণ ভালো লাগে পড়তে। চিড়িয়াখানার নামটা খুব মজার 'হ-য-ব-র-ল'। শেষ অংশটা একটু কৌতূহল তৈরি করলো।
সবশেষে বলি সংখ্যার প্রত্যেকটি লেখা আঁকা গুলি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।

আমার মনে হয় দেশের মানুষের মধ্যে যদি নবজাগরণ না ঘটতো, আমাদের দেশ যদি স্বাধীন না হতো তাহলে হয়তো আজ নারীদের স্বাধীনতা, তাদের শিক্ষার বিকাশ ঘটতো না। সমাজের কাছে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়তাম তাই যে মানুষগুলো জন্য আজ আমরা নিজেদের স্বাধীনতাকে ফিরে পেয়েছি, ফিরে পেয়েছি ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই দেশকে তাদের কাছে আমাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত, গভীর শ্রদ্ধা জানানো উচিত। 🙏 বন্দেমাতরম।।

আরও পড়ুন 

Post a Comment

0 Comments