জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা -৫৪(উৎসব -৩)



সম্পাদকীয়,

এখন পরিস্থিতি ততটা ভয়াবহ নাহলেও কোভিডের আতঙ্ক কিন্তু পুরোপুরি কাটেনি। ওদিকে কৈলাসের খবর তোমরা কি কিছু জানো? ঐ যে চন্দ্রানী আন্টির তোলা প্রচ্ছদের ছবিতে দেখছো না, মা দুগগার সাজুগুজু আর ব্যাগ গোছানো প্রায় কমপ্লিট! অথচ গনেশের ডেঙ্গু, হাঁপানি, আমাশা, জন্ডিস, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড, সব একসঙ্গে হয়েছে। ভাবতে পারছো? আমি তো মহুয়া আন্টির লেখায় সে খবর পেয়ে অবধি খুব চিন্তায় আছি। গতবছর মা নমো নমো করে ঘুরে গেলেন সে তো আমরা সবাই জানি। এবছরও? গতবছরে এই কোভিডের জন্য ডাক্তার, পুলিশ, সমাজসেবকরা যা করেছে সে কথা তাঁর উপন্যাসে খুব সুন্দর ভাবে লিখে পাঠিয়েছেন গৌর জেঠু। হয়তো কোভিডের এই আতঙ্ক এক সময় কমে আসবে। আর বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের ছড়ার মতো 'এক মিষ্টি রঙের ভোর' আসবে। আমরা আবার মেতে উঠব উৎসবে। উৎসব মানেই তো কেবলই দুগগাপুজো নয়। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন আর ব্রত। সানঝা ব্রত, বালুকা ব্রত, ইতু... বাকিগুলোর নাম বলবে ছড়াকার মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় আন্টি। উৎসবের যখন শেষ নেই তখন এসো এবারো পুজোর সময় অল্প অল্প ঠাকুর দেখি। বাকিটা বাড়িতে বসে টিভিতে দেখে নিই। তোমরা হয়তো বলবে, এ তো বিজ্ঞের মতো কথা হয়ে গেল। তাহলে শোনো, আজ ইন্দিরা আন্টির লেখা তিব্বতী রূপকথার গল্পে বিজ্ঞ বাদুড়ের গল্প পড়ে আমারো খুব ইচ্ছা হল তোমাদের একটুস জ্ঞান দিই। জ্ঞান শুনে মনখারাপ হল নাকি! আমার তো অন্য কারণে ভীষণ ভীষণ মনখারাপ। সেটা হল এই সংখ্যায় শেষ হয়ে যাচ্ছে সুব্রত আঙ্কেলের নাটক তোতাকাহিনী। মন কেমনের কি আর শেষ আছে? শুভশ্রী আন্টির লেখায় তেমন এক মন কেমন করা গদ্য পড়ে নিতে পারো। তবে পুজোর সময় মন কেমন করে থাকলে চলবে কেন? তাই  তোমাদের মন ভালো করতে তোমাদের সবচেয়ে প্রিয় ভূতের গল্প নিয়ে হাজির অমিতাভ আঙ্কেল। এখানেই শেষ নয় এবারের সংখ্যা। তোমাদের বন্ধু শাশ্বতী তোমাদের অবন ঠাকুরের গল্প বলেছেন। কথক ঠাকুর অবন ঠাকুরের দেড়শততম জন্মবার্ষিকী চলছে সে কথা তো ভুললে চলবে না, তাই না! আর ও কথা ভুললেও চলবে না, আমাদের দেশ বহু ভাষাভাষির বহু ধর্মের দেশ। সে কথা আমাদের তার গল্পের মাধ্যমে মনে করিয়ে দিয়েছে খুদে গল্পকার ঋতব্রত। ঠিক তাই জন্যই আমরা সকলে উৎসবে মেতে উঠি। কারণ উৎসব হল মানুষে মানুষে মিলিত হওয়ার দিন। মিলনের এই দিনে মায়ের বিভিন্ন রঙের ছবি এঁকে আমাদের উৎসব সংখ্যা ৩ ভরিয়ে দিয়েছেন চিত্রশিল্পী বিমলেন্দ্র চক্রবর্তী, শিল্পী সরকার, মৃণ্ময়ী হাওলাদার, চোইন রায়, আর আমাদের ছোটোবেলার খুদে শিল্পীরা।    - মৌসুমী ঘোষ





বিজ্ঞ বাদুড় 
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় 

তিব্বতীদের প্রাচীন কিংবদন্তী বেশ মজার। সে যুগে তিব্বতের মানুষদের সঙ্গে পশুপাখীদের ওঠাপড়া, ঘনিষ্ঠতা ওদের ধর্মে সর্বজনবিদিত। সে দেশের মানুষরা পশুপাখীদের ভাষা বুঝত আর পশুপাখীরাও ওদের কথাবার্তা বুঝতে পারত। তিব্বতের ছোট ছোট রাজ্যে এক একজন শক্তিশালী রাজা থাকতেন।  তিনি অনেক দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোল করে তাঁর পশুপাখী, মানুষ সম্বলিত রাজ্যপাট পরিচালনা করতেন। রাজধানী আর রাজ্যের মধ্যে দূরত্ব থাকত বেশ কিছুটা। আর সেই ব্যাবধানে থাকত ঘন জঙ্গলময়তা। পশুপাখীতে ভরে থাকত সেই জঙ্গুলে অঞ্চল। তখন এই পৃথিবীটা ছিল নতুন এক্কেবারে। সবে সেখানে দু একজন করে মানুষের বসতি গড়ে উঠতে শুরু করেছে। সবাই বেশ মিলেমিশে থাকতে শুরু করেছে। এই পৃথিবী কে বাসযোগ্য করে তোলার আশায়। একের ওপর অন্যের নির্ভরশীলতা আর বিশ্বাসভাজনতা তাদের শান্তিপূর্ণ এই বসতির অন্যতম মাত্রা যুক্ত করছিল । সেই রাজ্যের সকলে খুব খুশিতে থাকত কেবল রাজার রাণী ছাড়া।    

জঙ্গলের নানারকম পাখীরা মিষ্টি সুরে গান গাইত। পাখীদের সেই মধুর কনসার্টে খুব অসুবিধে হত রাণীর। এত কিচিরমিচির অসহ্য লাগত তাঁর। একদিন রাণী সেই কলকাকলি সহ্য না করতে পেরে রাজা কে বললেন পাখীদের ধরে একে একে তাদের স্বরগ্রন্থি কেটে দিতে। 
রাজা বললেন, বেশ, তাই হবে। 

এদিকে রাণীর রাজপ্রাসাদের জানলার নীচে একটা বাদুড় ঝুলত সর্বক্ষণ। তাকে দেখে মনে হত সে ঘুমোচ্ছে কিন্তু সে রাজারাণীর কথাবার্তা সবসময় শুনতে পেত।পাখীদের স্বরগ্রন্থি কেটে দেওয়া হবে শুনে বাদুড়টা খুব দুঃখ পেল। 

ইতিমধ্যে রাজা তাঁর সব অনুচর, মন্ত্রী সকলের হাতে ছোট ছোট চিরকূটে দু এক কথায় লিখে বাদুড়ের কাছে দিতে বললেন। রাজ্যের অন্যতম প্রধান পত্রবাহক ছিল বাদুড়ের বাবা। সে যেন সব ঘরে ঘরে রেখে আসে সেই চিঠি। 

আর চিরকূটে লেখা রইল 
"আগামী তিন দিনের মধ্যে রাজ্যের যত পাখী আছে সকলে যেন রাজবাড়ির বাগানের পক্ষীশালায় নির্ধারিত স্থানে জমায়েত হয়'  
বিজ্ঞ বাদুড়টি শুনতে পেল সেই কথা। আর ভাবতে থাকল, রাণীর এমন দুষ্টু প্ররোচনায় রাজা এ কেমন সিদ্ধান্ত নিলেন? ঠিক আছে, আমিও তিনদিন পরে এই চিরকুট পৌঁছে দেব, তাঁর আগে নয়। পাখীদের যেমন করেই হোক বাঁচাতেই হবে।   

তিনদিন পর বাদুড়টি রাজার দরবারে হাজির হল।রাজা তাকে দেখে অগ্নিশর্মা। তিনি বললেন, কি ব্যাপার? চিঠি বিলি হয় নি কেন? গতকাল অব্ধি একটি পাখীও হাজির নেই। বাদুড়ও খুব রেগে ছিল। সে বলল,পাখীদের না হয় কোনও কাজকর্ম নেই সারাদিন, আপনি যখন ডাক দেবেন তারা তক্ষুনি হাজিরা দিতে পারে রাজ দরবারে। কিন্তু আমার আর আমার বাবার অনেক কাজ আছে।আমাদের রাত জেগে সব কাজ করতে হয়।     

রাজা বল্লেন, তোমাদের কি এত কাজ বাপু ? 
বাদুড় বলল, আপনি জানেন না বুঝি? দিন আর রাত কে সমান রাখা আর রাজ্যে নারী আর পুরুষের অনুপাত সমান রাখাই আমাদের কাজ। তাই প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর হার কমাতে আর বাড়াতে হয় আমাদের।  
রাজা বললেন, এসবের কথা আগে তো শুনিনি। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটি। তা কি করে এই কঠিন কাজটি কর তোমরা? একটু বুঝিয়ে বল দেখি। 

বাদুড় বলল, কেন? রাত যখন ছোট হয় তখন আমরা ভোরের দিকে একটু বিশ্রাম নি। আর রাত যখন বড় হয় তখন সন্ধ্যের দিকে একটু আরাম করি।এভাবেই আমাদের দিন আর রাত সমান থাকে। এছাড়াও দেখুন রাজামশাই সকলের মৃত্যু তো আর একসময় ঘটে না। একজন অন্ধ আরেকজন খোঁড়া মানুষ কত কত দিন ধরে বেঁচে থাকে আর কত সুস্থ মানুষ হঠাত করে মারা যায়। এভাবেই তো জন্ম আর মৃত্যুর অনুপাত ঠিক থাকে। আবার দেখুন যখন নারীর থেকে পুরুষের সংখ্যা বেড়ে যায় তখন আমাদের নারী আর পুরুষের সংখ্যা সমান রাখতে নারীকে পুরুষ অথবা পুরুষ কে নারীতে রূপান্তরিত করতে হয়। 

রাজা বুঝতে পারলেন বাদুড়ের কথা।কিন্তু তাকে বুঝতে দিলেন না যে তিনি বুঝেছেন। আবার মনে মনে একটু ভয়ও পেলেন বাদুড়ের বিশাল কর্মকাণ্ডের কথা জেনে।এবার যদি বাদুড় রাজা কে কখনো নারীতে পরিণত করে ফেলে? সেই চিন্তা রাজাকে গ্রাস করে ফেলল।  
নিজে মনে মনে খুব অনুতপ্ত হলেন রাজা। ছিঃ! কি নীচমনা তিনি। স্ত্রীয়ের সব কথা কি শুনতে হয়? নিজেকে ধিক্কার দিলেন । লজ্জিত হয়ে বললেন, ঐ চিরকূটগুলি তুমি আর তোমার বাবা যেন খবরদার পৌঁছে দিও না কারো ঘরে। আমি এই বলে দিলাম, রাজ্যের সব পাখীরা বেঁচে থাকবে। কারোর স্বরগ্রন্থি কাটা হবে না। আমি আর এ রাজ্যের রাজা থাকব না। আমি ভাল মানুষ ন‌ই। আজ থেকে কোকিল হবে আমার এই রাজ্যের রাজা। সে রাজ্য শাসন করবে আর হুপো হবে তার মহামন্ত্রী। আর আমার মত নিকৃষ্ট একজন মানুষের রাজা থাকার চেয়ে আজ থেকে পাখীদের মত সুন্দর জীবের এ রাজ্যের রাজা হওয়াই শ্রেয়। আর এটাই হবে আমার জন্য যোগ্য শাস্তি। ঈশ্বর আমার মত মানুষের থেকে পাখিদের মঙ্গল করুন। প্রকৃতি আর পরিবেশের লাভ হবে।আমাদের তিব্বত আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।



সাহেব ভূত 
অমিতাভ দাস


 ছক্কুমামা যে একদা পুলিশে চাকরি করতেন তা তোমরা বোধহয় জানো না । আমিও জানতাম না। কথায় কথায় আজ বললেন তিনি। আসলে বিচিত্র জীবন তাঁর। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে।
            আজ তো ঝড়-জলের রাত ।শুনছি নিম্নচাপ ।আগামী তিন দিন খুব নাকি বৃষ্টি হবে ।থেকে থেকে ঝড় উঠছে বিকেল থেকেই । কারেন্ট অফ হয়ে গেছে সেই দুপুরবেলায়।
ঘরের ভিতর মোমবাতি জ্বেলে বসে আছি ।আমি আর ছক্কুমামা । দাবা খেলছিলাম ।
মামা একটা সিগারেট ধরিয়ে বললে, 'এসব রাতে আমার ভূতের কথা মনে পড়ে ।'
--'মানে' ?
--'মানে ভৌতিক গা ছমছম গল্প' ।
--'তাহলে বলেই ফেলো ।শোনা যাক তোমার গুলগাপ্পা গপ্সো' ।
 এসব বললে মামা রাগ করেন। যদিও আজ বেশ চুপচাপ আছেন।
     বাইরে সুপুরি গাছগুলো দেওয়ালে ধাক্কা দিচ্ছে । বিড়ালটা শুয়ে আছে দরজার কোনে। 
     'গল্প শোনার আগে এক কাপ চা চাই আমার'। চিনি ছাড়া লিকার চা ছক্কুমামার বেশ পছন্দের। ভেতর ঘরে বলে এলাম। কিছু সময় পর চা চলে এলো।

                চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে মৌজ করে টান দিলেন তাতে। বললাম, 'তোমার গল্প কদ্দূর?'  মামা মৃদু হেসে বললেন: 'ধৈর্য বৎস-- ধৈর্য..'.তারপর জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন,  'প্রথম জীবনে আমি পুলিশ ছিলাম। নাইট ডিউটি থাকত প্রায়-ই ভিক্টোরিয়াতে । কত গল্প শুনেছিলাম যে সাহেব ভূতেরা নাকি রাতে বাগানে হাঁটাচলা করে। ইচ্ছে করত তাদের দেখতে। জানিস তো আমার সাহস সব সময়-ই একটু বেশি। তবে সত্যি সত্যি নিশুতি রাতে শুনতাম ভারী বুটের শব্দ। কখনো বা শুনতে পেতাম ঘোড়ার খুরের টগবগ টগবগ চলার শব্দ। এক ছন্দ এক লয়ে। কেউ কেউ নাকি ছায়ামূর্তি দেখেছিল। আমি অবিশ্যি দেখিনি কখনো তেমন কিছু। চল্লিশ বছর আগে ভিক্টোরিয়ায় কিন্তু এতো  আলো ছিল না রাতের বেলা। 

               সেদিনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল । পেছনের গেটে আমার দুই সহকারী ডিউটি করছিল। রাত তখন দুটোর মতোন বাজে। লালবাজার থেকে একটা ফোন আসে।ফলে একটা জরুরী খবর দিতে আমি হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছেই  যাচ্ছিলাম।পাথরে ওপর বুটের শব্দ ,  নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছিল । বেশ রহস্যময় পরিবেশ। আমিও হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম সাহেব ভূতের কথাই। যদি দেখা পাই এখন...যদি সামনে এসে দাঁড়ায়...ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজের মনে হেসে উঠলাম।

       হঠাৎ আমার সব ভাবনাগুলো তালগোল পাকিয়ে গেল। দূর থেকে একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ ভেসে আসছে। কোথা থেকে আসছে? চমকে উঠি। বিপদের গন্ধ পাচ্ছি যেন। নিজেকে সজাগ ও আরো সতর্ক করলাম। আবার ভাবছি ওরা কী কোনো বিপদে পড়ল! যত কাছে যাই আরো জোরালো হয় শব্দ। বৃষ্টি তো পড়ছিল-ই ঝিরিঝিরি। এবার যেন তেড়েফুঁড়ে এলো-- বেশ জোরে। যদিও মাথার ওপর ছাতা আছে। হাঁটতে হাঁটতে আমার দুই সহকারী পুলিশকর্মী কাছে যেতেই দেখি ওরা  দু'জন দু'জনকে জড়িয়ে  ধরে আছে শক্ত করে আর গোঁ গোঁ  শব্দ করছে মুখ দিয়ে। খুব কাঁপছে। কথা আটকে গেছে ওদের। যেন বোবা হয়ে গেছে। আমায় দেখছে তবু কিছুই বলতে পারছে না।'
--'তারপর?' জানতে চাইলাম আমি। 
ছক্কুমামা বললে,' তারপর আর কী-- যা হয়--আমাকে দেখে ভেবেছে সাহেব ভূত। কাছে গিয়ে ঠেলা দিতেই ওরা বিস্ফারিত চোখে তাকায় আমার দিকে। আর বেশ জোরে শব্দ করে চিৎকার করে বলে ওঠে: ভূ উ উ উ ত...'



মিষ্টি রঙের ভোর
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

এই ছেলেটা ভেলভেলেটা  যতই  বলুক লোকে
আকাশ থেকে এক খানা নাম পেড়েই দিলাম তোকে। 
কৃষ্ণচূড়া নামটা কেমন ? পছন্দ নয় তোর?
ঠিক আছে তুই আমার কাছে ‘মিষ্টি রঙের ভোর’। 

তোকে দিলাম পূবের আকাশ শীতল দখিন হাওয়া
নামের পোশাক পরিয়ে তোকে নতুন করে পাওয়া। 
 ডাকনামে আজ  ডাকি তোকে বৃষ্টি যখন আসে 
 সব অপমান ধুইয়ে দিলাম হৃদয় জলোচ্ছ্বাসে।


 গুচ্ছ কবিতা
মৌসুমী চট্টোপাধ্যায় দাস
     
শিবের গীত 

হরেক ব্রত বাংলা জুড়ে
নারীর হাতে পালন চলে,
কিছু ব্রতর হাল হকিকত
এসো জানি ছড়ার ছলে৷ 

অনেক ব্রতই ভুলছে এখন
ব্যস্ত নগর, ত্রস্ত রুটিন,
গ্রাম বাংলা তবুও খোঁজে
ছোট্ট ব্রতের এক দুটো দিন৷ 


আলোই খাওয়া 

রাঢ় বাংলার মা জেঠিরা 
বড় মাপের কাঁকুড়টিকে
বিশেষ করে পাকিয়ে রাখেন
দেবেন বলে মা ষষ্ঠীকে৷
শুক্লা ষষ্ঠী এলে তাকে
কুঁড়ে নিয়ে জামবাটিতে
দই বাতাসা চালগুঁড়িতে
পানীয় বানান শুদ্ধ হাতে৷
আলপনাতে হলুদ কাপড়,
ভোগ নিবেদন সারা হলে
আলোই খাবে শিশু কিশোর,
আলোই খাবে পাড়া মিলে৷ 


সানঝা ব্রত 

মালদা জেলায় সানঝা ব্রত কাতিক মাসের শেষে,
বানায় বেদী ধাপে ধাপে, চূড়োর মতো মেশে৷
আলপনা দেয় কুমারীরা, দেয় সিঁদুরর টিপ,
ফুল জল ফল নকুলদানা, শুদ্ধ মনের দীপ৷
পুজোর শেষে নানান গানে ভাসান অনুষ্ঠান,
স্নানের শেষে প্রসাদ পেতে ফের সানঝার থান৷ 


 ইতু  

ইতুর ব্রত সূর্য ব্রত, সূর্য কৃষির মিত্র,
সরায় পুজো শস্যদানা, কৃষিই জীবন ভিত তো!
কার্তিকের শেষ থেকে পরের সংক্রান্তি
রবির বারে পুজতে ইতু নেই মেয়েদের ভ্রান্তি৷
শাঁখে শাঁখে মুখরিত জলাশয়ের ধার,
ভাসিয়ে সবুজ ইতুর সরা জানায় নমস্কার৷ 


কাত্যায়নী  

কোচবিহারের কাত্যায়নী কুমারীদের 'বত্ত',
ময়নাগাছের ডালের 'সুকুর', ফুল শোলা সাজ কত্ত৷
'বাসকুম' বা ঘট ভরতে গান করে যায় জলে,
সুকুর ঘিরে পূজন, গাওন চার প্রহরে চলে৷
ব্রতর শেষে 'পাতলি' ভাসে, বর চেয়ে নেয় গানে,
কাত্যায়নী আদ্যাশক্তি, সকল লোকে মানে৷ 


বালুকা ব্রত 

উথ্থানে একাদশী, কার্তিক মাস,
বালুকা ব্রতেতে মাতে কুমারীর দল,
হবিষ্যি পাঁচদিন, তুলে কাদা-বালি
দেব গড়ে; ধূপ দীপ, দেয় জল ফল৷
ষষ্ঠ প্রভাতে তুলে বালুকা মূর্তি
গান গেয়ে রথে দেয় নদীতে ভাসান,
সুবর্ণরেখা জানে এ ব্রতর কথা,
পুরুত মন্ত্র নেই; আছে শুধু গান৷ 

 
ধান ভানা 

এমন অনেক শতেক ব্রত
বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে আছে,
পন্ডিতে তা রাখছে লিখে,
কালের স্রোতে হারায় পাছে৷
অসুখ বিসুখ, মেয়ের বিয়ে,
ছেলের আয়ু, হাজার বিপদ
মুক্ত হবার চেষ্টা নিয়ে 
নারীর ছিল এই সম্পদ৷
আজকে শিক্ষা স্বাস্হ্য যখন
এগিয়ে গেছে ব্যস্ত পায়ে
সংস্কৃতির ধারক হয়ে 
ব্রতর থাক কোথাও গাঁয়ে৷ 

                       



জীবনতরীর এক অধ্যায়
শাশ্বতী কর
দ্বাদশ শ্রেণী, অশোকনগর আদর্শ বিদ্যাপীঠ

কারোর জীবনে এক ধাপ উত্তীর্ণ আর কারোর জীবনের প্রদীপ নিভে যাওয়া,এমন‌ই এক ঘটনা ঘটল ঠাকুরবাড়ির মহলে।দিনটা ৭আগস্ট,১৯৪১।অবনীন্দ্রনাথের ৭০ তম জন্মদিন। কিন্তু ঐ দিনই শোকের ছায়া গ্রাস করল তার জীবনের শেষ অধ্যায়কে। চলে গেলেন তাঁর প্রিয় 'রবিকাকা'।৭০ বছরের অবন ঠাকুর পাঁচ নম্বর বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় বসে একেঁ চলেছেন তাঁর কাকার অন্তিম যাত্রার ছবি  যা পরে প্রবাসীতে ছাপা হয়েছিল।

রবি কাকা ছিলেন তাঁর জীবনের অনুপ্রেরণা, তার সাথেই প্রথম আর্ট নিয়ে যোগ। রবি কাকার জন্য রাজি হয়েছিলেন ৭০ তম জন্মদিন পালনে । অবন ঠাকুর লিখেছিলেন-"রবিকা বলতেন অবন একটা পাগল"।

ছোট থেকে ছিলেন অবন ঠাকুর খুব দুরন্ত কিন্তু পরবর্তীতে বাড়ির প্রায় সমস্ত সদস্যই ভয় পেত তার গাম্ভীর্যকে । কিন্তু রবিকাকার কাছে তিনিই আবার অন্যরকম।

 কোনদিনও যেতে চাইতেন না স্কুলে। প্রতিদিন অজুহাত ঠিক থাকত  পেটে ব্যথা ,মাথা ধরা ইত্যাদি। তবে বাড়ির ছোট ছেলেটির প্রতি দয়া হলে কোন কোন দিন ছোটপিসি মা বলতেন-'ও গুনু, নাইবা গেল অবা আজ স্কুলে"। আবার রামলালকে ও বলতেন-" রামলাল, আজ আর ও স্কুলে যাবে না ,ছেড়ে দে ওকে"। আর ব্যস পিসিমার কথাই যে শিরধার্য! যাওয়া বন্ধ হল স্কুলে।

স্কুলে যেতে না চাইলেও স্কুলের যে জিনিসটি তাকে বারবার হাতছানি দিত তা হল স্কুলের একটি ঘরে কাচের আলমারিতে তোলা একটি খেলনা জাহাজ আর গোটা কয়েক নানা ধরনের শঙ্খ। রানি চন্দ্রকে তিনি বলেছিলেন-"আর কোন বিদ্যের হাতেখড়ি তো আর হলো না ,তবু ভাগ্যিস ওই হাতে খড়ি টুকু হয়েছিল ।তাই না তোমাদের এখনো একটু ছবি-টবি এঁকে খুশি রাখতে পারি"।
তবে একদিন স্কুলের ইংরেজি শিক্ষকের রাগের কোপে পড়ে বন্ধ হয়েছিল স্কুলে যাওয়া  এবং বাবার আদেশ বাড়িতেই শুরু হয়েছিল লেখাপড়া।এই সুযোগ‌ই  হয়তো তার জীবনের বাঁকের বদল ঘটাল। ছোট থেকেই তিনি ছবি দেখতে খুব ভালোবাসতেন। ছোট পিসিমার আদরের অবার তাই বেশিরভাগ সময় কাটতো তার ঘরে কারণ পিসিমার ঘরের প্রায় দেওয়াল জুড়ে ছিল অয়েল পেন্টিং এ আঁকা- 'শকুন্তলা','কাদম্বরী'র ছবি।অবাক হয়ে দেখতেন সেগুলো। একদিন ছোটপিসি মশাইয়ের দেওয়া একটি ছবি প্রথম কপি করেছিলেন । আর তারপরই  খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই  তাঁর হাতে রং-তুলিরা কথা বলতে শুরু করল।
আর বাকি থাকল সাহিত্য জগৎ। সাহিত্য জগতে তাঁর সৃষ্টি দুর্লভ  যা আজও শিশু-কিশোরদের  কল্পনার জগতে পাড়ি দেওয়ার জন্য সুযো‌গ করে দেয়। তবে অবন ঠাকুর বারবার বলেছেন-"গল্প লেখা আমার আসতো না। রবিকা ই আমার গল্প লেখার বাতিকটা ধরিয়েছিলেন"।

শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অন্যতম ছাত্র-দরদি আবার খামখেয়ালি ও বটে। বিখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসু ছিলেন অবন ঠাকুরের অন্যতম প্রিয় ছাত্র। একদিন নন্দলাল বসু 'উমার তপস্যা' নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। ছবিটা দেখেই শিক্ষকের সরাসরি প্রশ্ন ছাত্রকে -"এত রং কম কেন? আর কিছু না করো উমাকে একটু চন্দন ,ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে দাও"।
শিক্ষকের মনকে আনন্দ দিতে না পারায় হতাশ নন্দলাল ফিরে গেলেন ছবিটাকে নতুনভাবে সাজাতে। 
আর এদিকে শিক্ষক অবনঠাকুরের সারারাত ঘুম এলো না। মনে মনে ভাবলেন ,"এমন ভাবে তিনি কেন বললেন নন্দলালকে? সে হয়তো উমাকে অন্যভাবে দেখেছেন..!"ভুল শুধরে নেবার জন্য ভোর হতেই ছুটলেন ছাত্রের ঘরে। ঘরে ঢুকে দেখলেন ছাত্র রং তুলি হাতে ছবিটিকে বদলানোর কথা ভাবছেন। তাকে আচমকাই থামিয়ে বললেন ,'তোমার উমা ঠিক‌ই আছে।......আর একটু হলেই ভালো ছবিখানা নষ্ট করে দিয়েছিল আর কি!'.... নিজের ভুল স্বীকার করতে এতোটুকু ও কুন্ঠা বোধ করতেন না ছাত্রদের কাছে।
কলকাতায় যখন প্লেগ এর প্রাদুর্ভাব প্রবল। সেই ঢেউ আছড়ে পড়ল অবন ঠাকুরের নিজের ঘরে, ছিনিয়ে নিয়েছিল তার ছোট্ট মেয়েটিকে। সেই কষ্টকে ভুলে থাকতে প্রানের প্রিয় জোড়াসাঁকো কে ত্যাগ করেছিলেন। এই সময়ে এঁকেছিলেন 'শাহজাহানের মৃত্যু 'নামক বিখ্যাত ছবিটি। অবনীন্দ্রনাথের কথায়-"মেয়ের মৃত্যুর যত বেদনা বুকে ছিল সব ঢেলে দিয়ে সেই ছবি আঁকলুম"।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে একটু একটু করে অন্তর্দ্বন্দ্বে ও অন্যান্য কারণে অবন ঠাকুরের পরিবার কে ছাড়তে হয়েছিল প্রাণের প্রিয় জোড়াসাঁকো কে। তবুও স্মৃতি থেকে একটুও মোছেনি জোড়াসাঁকো, শেষ দিন পর্যন্ত আকাশের উজ্জ্বল তারার মতো সযত্নে বাস করেছিল মনের গহীনে। এমনই ছিল ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় মাতানো সুখ- দুঃখের ইতিহাসে গড়া অবন ঠাকুরের জীবন ধারার টুকরো টুকরো ইতিহাস। তার কথায় 'উজান -ভাটির খেলা' অর্থাৎ বসন্তে যখন জোয়ার ফুল ফুটিয়া ভরে দেয় দিক-বিদিক, আবার ভাটার সময়ে এসে তা ঝরিয়ে দিয়ে যায়'।




মানুষের এ দেশ

ঋতব্রত সিংহ মহাপাত্র 
চতুর্থ শ্রেণী, সরস্বতী দেবী ইন্টারন্যাশানাল স্কুল, বাঁকুড়া

পাশাপাশি গ্রাম নেই।রাস্তার ধারে একটি রুম নিয়ে ছোট্ট একটা ঘর।ঘরের দরজা থাকলেও জানালা ভাঙা। শিষ্যদের নিয়ে সাধু অম্বিকাচরণ তীর্থে চলেছেন।ক্লান্ত অনুভব করায় সেইরাতে সিদ্ধান্ত নেন ওখানেই বিশ্রাম নেবেন।সকাল হতেই আবার যাত্রা শুরু করলেন তারা।যাবার আগে একটা কৃষ্ণ মূর্তি রেখে গেলেন ঘরটার মধ্যে রাত কাটানোর চিহ্ন স্বরূপ। 

  কিছুকাল পরে একদল পাদ্রি ফিরছিলেন ঐ পথ ধরে ,তারাও রাত্রি যাপন করলেন ওখানে।যাবার সময় চিহ্ন স্বরূপ যিশুর ক্রশ রেখে গেলেন 

  প্রায় ছ মাস পর ঐ পথ দিয়ে তীর্থ সেরে ফিরছিলেন আম্বিকাচরণ।সেই পাদ্রির দলও ঐ দিন এসে পৌঁছাল সেখানে।

   দু দলই দেখলো ঐ ঘরটির সামনে নামাজ পড়ছে একদল ফকির।দেখে দলবল নিয়ে ছুটে এলেন আম্বিকাচরণ, 'এইখানে আমাদের কৃষ্ণ আছেন।তোমরা এইখানে নামাজ পড়ছো কেন?'

-কৃষ্ণ নয়,এ আমার যিশুর জায়গা এখানে পুজো বা নামাজ কিছুই করা চলবে না। বললো পাদ্রির দল।

-চুপ।এখানে আমরা নামাজ পড়েছি,এ হলো আমাদের আল্লার জায়গা।দাবি করলো ফকিরেরা।

   এই নিয়ে বচসা চলতে চলতে হাতাহাতি শুরু হবার উপক্রম হলো।

   সেই সময় ঐ পথ দিয়ে স্কুল থেকে ফিরছিল তমাল।কান্ড দেখে থমকে দাঁড়াল কিছুক্ষণ। বোঝার চেষ্টা করলো কি কারণে এই ঝামেলা হচ্ছে। ক্লাসে খুব ভালো পড়াশোনা করে ও।স্যারেরা বলেন ওর উপস্থিত বুদ্ধিও দারুণ। ও ওদের সামনে গিয়ে বললো 'আপনারা থামুন।আমি ফয়সালা করে দিচ্ছি এটা কার জায়গা।'দিশেহারা সাধু, পাদ্রি আর ফকিরের দল থমকাল ওর কথা শুনে এবং সিদ্ধান্ত নিলো ও যা ফয়সালা করে দেবে তা ওরা মেনে নেবে।

   রাস্তার ধারে পড়ে থাকা একটা ইঁটের টুকরো নিয়ে ঘরের দেওয়ালে একটা ভারতের ম্যাপ আঁকলো।তার তলায় লিখলো,"হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন—

শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।"

  -মানে কি?জিজ্ঞাসা করলো সকলকে।

মাথা নামিয়ে সবাই বললো ঠিক এই দেশ হিন্দুরও না,মুসলমান বা ক্রিশ্চিয়ানের ও নয়।এই দেশ মানুষের।

-ঠিক ।বলে তমাল।তবে শুধু মানুষের নয়।এই গ্রাম, এই রাজ্য,এই দেশ ,এই পৃথিবী মানুষের পাশাপাশি এখানে বসবাসকারী জীবজন্তুর, গাছপালার।ভগবান বলুন, আল্লাহ্ বলুন বা যিশু বলুন সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন প্রকৃতি ও ঐ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদকে টিকিয়ে রাখার জন্য। 

  সবাই মন দিয়ে তমালের কথা শুনে।তারপর সমস্বরে বলে,'বাবা তুমি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছো।বুঝতে পেরেছি এই দেশ কোন জাতির নয়।মানুষের। আর এই পৃথিবী শুধু মানুষের নয়।জীবজন্তু সহ সবারই। 

   


এসো মা দুর্গা
মহুয়া ব্যানার্জী

স্বর্গে হুলস্থুল। কৈলাসে ঝামেলা। কি হয়েছে? শিব বাবা মা দুর্গা কে মর্তে যেতে বারণ করেছেন। পুজোর আর মাত্র কিছুদিন বাকি। মা দুর্গা তার শাড়ি, গয়না সব গোছাতে বসেছেন। এর মধ্যে নন্দী এ কী সংবাদ নিয়ে এল! গোছান বন্ধ করে ত্রিনয়নী রাগী স্বরে বলে উঠলেন, ’বলি ভাং খেয়ে তোর বাবার কি মাথা খারাপ হয়েছে?সারা বছর এই দশমীর আধ বেলা নিয়ে সাড়ে চার দিনের অপেক্ষায় থাকি। বাপের বাড়ীর যত্ন আত্তি পাবো বলে। মর্ত্যের মানুষ গুলো কতো আদর আপ্যায়ন করে। তাছাড়া এই দুর্গাপুজোকে ঘিরে মানুষগুলো সব ভুলে কেমন আনন্দে মাতে।মা হয়ে ছেলেমেয়েদের খুশি দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। এসব বুঝি সহ্য হল না তোর বুড়ো শিব বাবার?’ বলেই কপাল চাপড়ে বিলাপ শুরু করলেন।    

নন্দী প্রমাদ গনে। মা কে থামানোর জন্যে তাড়াতাড়ি হাত জোড় করে। বলে, 'মা মাগো কেঁদো না মা।বাবাকে বরং জিজ্ঞেস কর কেন তিনি এমন আদেশ দিলেন।‘ এমন সময় লক্ষ্মী খুব সেজেগুজে মায়ের কাছে এল। মায়ের হাত ধরে আদুরে গলায় বলে উঠল, ‘ও মা বাবাকে একটু বোঝাও না গো। আমি সেই কবে থেকে অপেক্ষা করছি, দুর্গাপূজায় সেজেগুজে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে শুধু নানারকম ভাবে সেলফি তুলবো। ধুররর সব ভেস্তে গেল। ভাল্লাগেনা।‘ 
এই সময় খুব বিরক্ত ভাবে কার্ত্তিক এসে মায়ের কাছে নালিশ করতে লাগলো ‘ মা মহিষাসুর কাকুকে বকে দাও তো। সেই সকাল থেকে আমার জিম দখল করে ব্যায়াম করেই যাচ্ছে। আমাকে একটুও ব্যায়াম করতে দিচ্ছে না। আমাকেও তো  দুর্গাপুজোয় সেলফি তুলতে হবে । তাই আমার ফিগারের যত্ন নেওয়াটাও খুবই জরুরি।‘ কার্তিকের এই কথা শুনে লক্ষ্মী বলেউঠল ‘কাঁদিস না কাতু।আমি তোকে বরং আমার লক্ষ্মীঝাঁপি থেকে টাকা দেব। তুই রিপড জিন্স আর টি শার্ট কিনে নিস। খালি গায়ে আর থাকতে হবে না। দেখবি প্যান্ডেলে তোকেই সবাই দেখবে। দিদির কথায় কার্তিকের আনন্দ আর ধরে না। সে তো ইয়াআআ বলে একপাক নেচেই নিল। সেই নাচের চোটে তার বাহন ময়ুর বেচারা ভয় পেয়ে ফড়ফড় শব্দে একটু উড়ে  নন্দীর পিঠে চড়ে বসল।  
সরস্বতীর এসবে মন নেই। সে সকাল থেকে একমনে কানে হেডফোন লাগিয়ে সঙ্গীত চর্চায় ব্যস্ত। আজকাল পুজোর সময় ক্লাবগুলোতে নানারকম জলসা হয়। এত রকমের গান শুনতে হয় , তাই নিজেকে একটু আপডেট করে নেওয়া জরুরি। তার সেই একাগ্র সাধনায় বিঘ্ন ঘটাল ভাই কার্তিকের চেঁচামেচি। 
কান থেকে হেডফোণ খুলে সরস্বতী বলে উঠল, ’দিদি আজকাল তুই খুব বাজে খরচ করছিস। কাতু কে বেশি আদর না দিয়ে একটু ইন্টার গ্যালাক্টিক ডিভাইস  খুলে গুগল সার্চ করে মর্ত্যের খবর গুলো জানতে বল। আমার আই ফোন এখানে কাজই করছে না। আর তো কটা দিন বাকি পুজোর।‘ উফফফফ;বলি থামবি তোরা! আর আমার মাথা গরম করিস না। এবছর মর্তে যাওয়া ক্যান্সেল। কোন পূজা হবে না। রেগে বলে উঠলেন মা দুর্গা।এমন সময় ভৃঙ্গী হাপাতে হাঁপাতে এসে বলল তাড়াতাড়ি চলুন সবাই, বাবা ডাকছে, গনেশের আবার শরীর খারাপ হয়েছে। সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে শিবের কাছে ছুটল। 

শিবের ফ্যাসাদ

কি ফ্যাসাদে পড়লাম রে বাবা, অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে শিব বলে উঠলেন। বলি ও ধ্বন্বন্তরী কি বুঝছ বল দিকিনি? সেই যে গনেশ পুজোয় মর্তে গেল তারপর থেকেই তো বাছা আমার শয্যাশায়ী। অমন তরমুজের মত ভুঁড়ি কেমন চুপসে আলু হয়ে গেছে গো! এই বলে ভোলেবাবা ফোঁত ফোঁৎ করে খানিক কেঁদে নিলেন। 
মা দুর্গা সদলবলে মহেশ্বর কাছে এসে গনেশের অবস্থা দেখে ‘ওগো আমার গনশুর একি হল গোওওওও বলে তারস্বরে  কান্না জুড়লেন। এই সব গোলমালের মধ্যে  রোগা অসুস্থ গনেশ উই মা ,উই বাবা,অ নন্দি, অ দিদি বলে সমানে কাৎরাতে লাগল। মহিষাসুর বিরক্ত হয়ে বলে উঠল ‘এই জন্যে বলেছিলাম এবার স্বর্গে নতুন যুবক ডাক্তার বহাল করুন,এই বুড়ো টাকে দিয়ে আর চলবে না”।
এই তুমি থাম তো। কার্ত্তিক খেচিয়ে উঠল। উঃ উনি যেন সবজান্তা।রাগে গজগজ করতে করতে কার্ত্তিক মহিষাসুরের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুমি আমাদের ফ্যামিলি মেম্বার নও। নেহাত মা তোমায় খুব লাই দেয় তাই। তাই বলছি মেলা ফ্যাচ  ফ্যাচ না করে এখান থেকে যাও।‘ তারপর বৈদ্য ধ্বন্বন্তরী কে বলে ও ধনু দাদু গণেশ কে সুস্থ করে দাও, দুর্গা পুজোয় মর্তে যেতে হবে তো। শিব ধমকে ওঠেন ‘না! এবছর মর্তে যাওয়া হবে না, ওই মর্ত থেকেই তো গনেশের রোগের উৎপত্তি হয়েছে ।‘  মা দুর্গা বললেন তবে তো মহা মুশকিল। পুজো বন্ধ হলে মানুষেরা তো দেবতার আশীর্বাদ পাবে না। মা চিন্তিত ভাবে ধ্বন্বন্তরী কে এর উপায় বার করতে আদেশ দিলেন। 

কি উপায়? ধ্বন্বন্তরী তো নিজের মাথা চুলকে, দাড়ি মুচড়ে, কান খুচিয়ে অনেক অনেক ভাবলেন, তারপর গনেশের ভুঁড়ি টিপে, শুঁড় শুঁকে ভয়ানক গম্ভীর ভাবে বলে উঠলেন “ আরে! এর তো ডেঙ্গু, হাঁপানি, আমাশা, জণ্ডিস, ম্যালেরিয়া,  চিকুনগুনিয়া, টাইফয়েড সব একসাথে হয়েছে।এইসব উৎকট রোগের নাম শুনে নন্দী তো মুচ্ছো গেল, আর শিবের মাথা বনবন,কাতুর কান কনকন, লক্ষ্মীর গা ঝনঝন করতে লাগল।
মা দুর্গা চিন্তিত ভাবে গালে হাত দিয়ে বসে রইলেন। এমন সময় সরস্বতী বললেন, ‘মা এ সব হয়েছে মানুষদের নিজেদের বোকামির জন্যে। আমি ওদের বিদ্যা দিয়েছিলাম, সেই বিদ্যার জন্যে ওরা কেউ বিজ্ঞানী, কেউ ডাক্তার, কেউ বা শিক্ষক হয়ছে।কিন্তু দেখো এতো বিদ্যা বুদ্ধি সত্তেও মানুষেরা নিজেদের পরিবেশকে রক্ষা করতে পারছেনা। ওদের লোভ আর বোকামীর জন্য জল, হাওয়া, খাদ্য, এমনকি ভুমি পর্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। দূষণে পরিবেশের  ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। আর তারি কারনে এত রোগ অসুখে ভরে গেছে পৃথিবী।‘ ‘তবে কি এ সমস্যার সমাধান হবে না?’ মা জিজ্ঞেস করেন। সবাই নিরুত্তর। 
মুশকিল আসান
ওদিকে হয়েছে কি মা সরস্বতীর হাঁস তার অন্য বন্ধু হাঁসেদের সাথে মর্ত্যে রোজ হারুদের পুকুরে খেলা করতে আসে। এই পুকুর টা হারু খুব পরিষ্কার রাখে, এই গ্রামটাও হারু ও তার বন্ধুরা মিলে একদম ঝকঝকে রেখেছে। তাই সরস্বতীর হাঁস তার অন্য বন্ধু হাঁসেদের এই জায়গা টি খুব পছন্দের। হারুর সাথেও ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। রোজ ওকে তারা  নানা রকম গল্প  শোনায়। আজ হারুর আব্দারে মা সরস্বতীর হাঁস তাকে পিঠে নিয়ে মেঘের উপর দিয়ে উড়তে উড়তে একেবারে কৈলাসে এসে উপস্থিত হয়েছিল। সেখানে তখন এইসব কথাবার্তা চলছিল। হারু তো  তার বন্ধু হাঁসের কথামত এতক্ষন ধরে কৈলাস পর্বতের পাথরের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। অবাক হয়ে হারু দেবতাদের দেখছিল। কেমন আলোময় চারপাশ। কত সুন্দর নির্মল প্রকৃতি এখানে। আড়াল থেকে ওনাদের কথা শুনে মানুষ হিসেবে  সে খুবই লজ্জা বোধ করছিল। বন্ধু হাঁসের কথামত সে আড়াল থেকেই একটু পরে চলে যেত । যার পিঠে চেপে এখানে এসেছে সে বিপদে পড়ুক তা হারুও চায় না। কিন্তু এইসব কথা শুনে হারু নিজেকে আর স্থির রাখতে পারলো না। সে ভুলে গেল যে সে এখানে অনধিকার প্রবেশ করেছে। সব ভুলে সে এবার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে মা দুর্গার পা জড়িয়ে কেঁদে উঠল। 
এই এটা কে রে? ওমা এযে মানুষ! এ এখানে কি করে এলো? এই বলে সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠতেই সরস্বতীর হাঁস সব ঘটনা খুলে বলল। 
হারু  হাতজোড় করে বলে উঠল, ‘মা গো তুমি মর্তে চল মা। আমরা মা সরস্বতীর দেওয়া বিদ্যা বুদ্ধি দিয়েনিজেদের পরিবেশ রক্ষা করতে শিখছি মাগো।  বৃক্ষরোপণ করছি, দূষণের হাত থেকে বাঁচার উপায় নিয়ে এখন অনেক বোঝানও হচ্ছে। আমরা আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছি মা। মানছি যে অনেকেই এখনও পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব বোঝেনি। তবুও আমারা তো চেষ্টা করছি মাগো।  কিছু খারাপ নির্বোধদের জন্য আমাদের কেন শাস্তি দেবে মা গো। তুমি আমাদের মতো ছোটদের আশীর্বাদ কর মা আমরাই যেন  নিজ পরিবেশ রক্ষা করতে পারি। এই শুনে মা করুন নয়নে শিবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ওগো এইসব ছোটছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে এবারের মত মর্তে যাওয়ার অনুমতি দাও।  শিব বললেন, তথাস্তু। 
হারু অ্যাই হারু পুকুর পাড়ে ঘুমচ্ছিস কেন? হারু চোখ খুলে দ্যাখে তার মা। মা হাসি মুখে বলে কি রে এভাবে খেলতে খেলতে কেউ ঘুমিয়ে পড়ে? চল ঘরে চল ।হারু ভাবে সে কি তাহলে স্বপ্ন দেখছিল। সে তার মাকে সব কথা বলতে যাবে ওমনি পুকুরে সাদা রাজহাঁস টা কেমন যেন মিচকে হেসে চোখ টিপল। এসব কথা হারু কিন্তু কাউকে বলেনি । সে শুধু মনে মনে আবাহন জানাল এস মা দুর্গা কলুষনাশীনি। তোমরাও কাউকে বোলো না যেন। আর হ্যাঁ নিজের আর নিজের  পরিবেশের খেয়াল রেখো।খুব আনন্দে থাকো।



মন কেমনের ঘুড়ি 
শুভশ্রী সাহা


এমন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির দিনে একদৌড়ে সকাল বেলায় বড় রাস্তায়। বড় বড় হেডলাইটের আলো ফেলে চলে যেত বাস লরি আর স্কুল বাসের সারি। এমন রাত রঙা  আলোতেও দিব্যি  চোখ পড়ে যেত দুই নম্বর থেকে পনের নম্বর বাসে। সেই হলুদ রঙা জানলায় সার সার সাদা শার্ট নীল টাই, নীল স্কার্ট। তারপরেই রেস রেস রেস। কি আনন্দ বেল পড়ার আগে পর্যন্ত!  ভিজে মাঠ লম্বা ঘাস, কাদা জল সার সার ফুল ভিজছে আর ভিজছে  কমলা ঠোঁট নিয়ে রাজহাঁসের দল।  এরাও তাদের মতো লাইন করেছে। চ্যাপেলের বেল পড়তেই সব এক দৌড়ে প্রেয়ার লাইনে! তারমধ্যে অর্ধেক ভেজা সারা, কেডস চুপ চুপকরছে। প্রিন্সিপাল সিস্টারের ঘরের সামনে চারজন নিল ডাউন, সাত জন কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। এরা রেনকোট আমব্রেলা লেস দুস্টু পোড়োর দল!  দিয়েছে ক্লাসরুম ভিজিয়ে!  সিস্টার ঝড়ের গতিতে বকছেন, কিন্তু এদের চঞ্চল চোখ বাইরের দিকে।

শ্বাস পড়ল ছোট্ট বুকের উপর! স্কুল নেই স্কুল নেই কতদিন! বন্দী সে, জানলার বাইরে একটানা ঝুম বৃষ্টি শুধু। মন খারাপ করে শেডের তলায় কাবুলদের বাড়ির চুমকি বসে আছে। মা বেরিয়ে যাবে, বাবাও,  সে আর ঠাম্মি একা একা। ঠাম্মা অবশ্য বেরোতে পারে না দৌড়তে পারে না একজায়গায় বসে থাকে। এমন বৃষ্টি দিনে মন খারাপ লাগলে ঠাম্মার কোলে মাথা দিয়ে সে শুধুই পুজো ভেকেশনের কথা ভাবে! আসবে আসবে আবার আসবে আবার সেই দিন। স্কুলের ধুসর রঙ  বদলে আবার  নীল হয়ে যাবে। রেখামাসি দুধ দিয়ে গেলে অপছন্দের   দুধই সে এক চুমুকে খেয়ে নিল। 

ঝপাঝপ উনুনে কয়লা পড়চে। মার হাত চলচে ম্যাসিনের মতু! বাব্বা এ সমুয়ে মা খুব ব্যস্ত থাকে, সে শুধুই দুটো হাত দেখতে পায়। ঠোঙ্গার মধ্যে ঝপাঝপ পড়ছে কচুরি। কেউ  খায় রুটি, রুটি আর ডাল পয়সা কম তাই তেবড়ানো থালাতেও চলে, কিন্তু কচুরী ইস্টিলের প্লেটে। ডিম টোসের দাম সব চেইয়ে বেশি। একুন তার মেনু মুকুস্তু হয়ে গেচে।  ইস্কুল বন্দ দু বচুর পেরায় হয়ে গেল।।একুন সেও  দোকানের থালা বাটি মাজে। যিদিন চাল, সোয়াবিন দেয় সিদিন আবার ইসকুলের গেটে দাঁড়ায় সে।  কি মজাই না হতো ইসকুলে, কত্ত কিচু জেনে গিচিল সে! এই সব দাম সে যোগ কত্ত তো, বলতে পারত মুকে মুকেই! আর একুন কেলাস হয় নে তার। ওই সপ ফোন মোন সে কোতায় পাবে! এই সবে সবে দোকান হচ্চে আবার, কত্তদিন সুদু চা বিক্কিরি চলেচে! বাবা লোগের বাড়ির দোর দালান বাগান পোষ্কার করে চালিয়েচে, মা ও যে দিদা মারা গেল করোনিতে, আগে তার গু মুত কাড়ত! সনঝে বেলায় দোলোদের বাড়ি থে মাছ ভাজার সুবাস বেরোয় , ডালে রুটি গুলতে গুলতে সে স্বপ্ন দেখে চিকেন ভাতের।। আহ! কবে আবার দুকানটায় ভিড় ভাট্টা হবে মা চিকেনের গিলা মেটে আনবে কষে কষে মা রানবে! ঢোঁক গেলে বিউটি। সুড়ুৎ করে জিভের জল ঢুকিয়ে নেয় ভেতরে। সে জানে তার নাম বিউটি, মানে সুন্দর!!
 
ঢিল ছুঁড়লো নিলু পুকুরে । বর্ষায় ভরা পুকুরে ডব করে ডুবে গেল  ঢিলটা।  নিলু দেখল একবার তাকিয়ে, তার জ্বলে জ্বলে চোখে আগুন  লাগা।
 চড় বড়িয়ে বৃষ্টি নেমেছে চারদিকে। পেলাস্টিকের  ব্যাগটা টেনে  দিল  মাথায়। আজ সে কিছুতেই বাবার সাথে মুরগী  বেচতে যাবে না!  তার ভুলুকেও আজ বাবা নিয়ে গেছে। কত সাধ করে মোরগটাকে সে পেলেছিল। করোনা অসুখ আসার পর তার ইস্কুল কবে থেকে বন্ধ।  সব খেলা বন্ধ। ভুলুটা কত্ত বড় হয়ে গেছে এখুন! লোভীর দল! চোখ ভেঙে জল এল তার! কদিন আদারে বাদারে ঘুরে সে কত শাক বিক্কিরি করেছে। সেন দিঘিতে এপার ওপরে জল,  আর কি পুষ্ট কলমী শাক জলের ধারে। শাক কাকে বলে, আহা সুষনী  কলমী নটে  হিঞ্চে তোলার থেকে দেখতেই ভাল লাগে।  শাগের ও একটা জলজ গন্ধ আছে। না? কী পোড়া রোগ এল এক কাজ গুলো সব গেল। লাইনের ওপারের বাড়ি গুলো বড়লোক। বাজার রেশন ধরে দিলে ফুরনের টাকা  দিত। আজ ক মাস যাবত সব বন্ধ। র‍্যাশানের কটা চাল ইস্কুলের ভাতের চাল, মার কাজের বাড়ি,  মিলয়ে মিশিয়ে চলছে। বাবার তো শুধুই রোববার আয় হয়।৷ বলখেলার মাঠে প্রায়  ড়ুব লাগানোর মত জল। সেদিকে তাকাতে তাকাতে চোখে জল এল তার। বড় বীণাপানির গোলকিপার ছিল সে, লাইনের বাড়ির কাকি একটা ন্যকড়ার জুতো দিয়েছিল তাকে!!  জুতোটা কোথায় গেল!  কোথায়! হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এল ইস্কুলের ধারে।
ইস্কুলের ধারের কৃষ্ণচূড়াটা একটেরে হয়ে ভিজে একসা। পাশের খালের জলে ঢলে আছে ডালগুলো। গেটটুক সামান্য ফাঁক। চোখ রাখতেই দেখতে পেল বেদী সাজাচ্চে  গেট কাকু!  ইসসসস কাল পতাকা তোলার দিন! ভুলে গেছিল।  যাহ! কাল ঘুড়ি ওড়াবার দিন।
শাক বিক্রিরির টাকায় ঘুড়ি কিনবে সে।  পেটকাটি চাঁদিয়াল   লাল কালো কমলা সবুজ--

 স্বাধীনতার ঘুড়ি উড়বে  সারা আকাশ জুড়ে!


অনিকেত

গৌর বৈরাগী


(পাঁচ)

কানাইলাল স্কুলের পাশ দিয়ে যাবার সময় প্রতিকার সান্যাল এর নজর পড়ল স্কুলের ভেতরে। ওখানে গ্যাস জ্বেলে কীসব রান্নাবান্না হচ্ছে। হ্যাঁ, ওইতো বড় বড় দুটো কড়া, বড় বড় দু’টো ডেকচি, হাঁড়ি। একজন পুলিশকেও  নজরে পড়ল। ভাবগতিক দেখে মনে হল লোকটা দেখভাল করছে। প্রতিকার বুঝল সে একটা সাবজেক্ট পেয়ে গেছে।

সাবজেক্ট বলে সাবজেক্ট। থানা বন্ধ রেখে এসব কি হচ্ছে। মাথায়  আগুন চড়ে গেল প্রতিকারের। থানা বন্ধ রেখে ফিস্টের খাওয়া দাওয়া হচ্ছে। না, আজই গিয়ে একখানা কড়া চিঠি লিখতে হবে সম্পাদকীয় কলমে। তাতে ওপর মহলের দ্রুত হস্তক্ষেপের আবেদন জানানো হবে। পাশে অনি ছিল। সে বলল, ভেতরে গিয়ে একবার দেখবেন নাকি প্রতিকার কাকা!

—ভিতরে কী আর দেখার আছে? সবই তো দেখতে পাচ্ছি। এ যে দেখছি অরাজক অবস্থা।

অনি বলল, ওই যে লোকে বলাবলি করছে কী একটা পোকা এসেছে। তার জ্বালাতেই নাকি দোকানপাট বন্ধ, বাজার হাট বন্ধ, আদালত বন্ধ, এমনকি থানাও। তাই থানা বন্ধ করে পিকনিক করতে হবে! পাশ দিয়ে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে যাচ্ছিল। বয়স কত হবে, কুড়ি বাইশের মধ্যে। প্রতিকার কাকার কথাটা তাদের কানে গিয়ে থাকবে।

মেয়েটি বলল, কিছু বলছেন কাকা?

—হ্যাঁ বলছি। ওই  পোকার জ্বালায় সব বন্ধ রয়েছে তাই তো।

—হ্যাঁ তেমনি তো হবার কথা। কথা বলল মেয়েটি, লকডাউনে এখন সব বন্ধ। কিন্তু পিকনিক বন্ধ নয়। 

একটু রাগের গলাতেই বললেন প্রতিকার, বেশ জমিয়ে পিকনিক হচ্ছে দেখছি।

—পিকনিক! এবার অবাক গলা ছেলেটার, আপনি পিকনিক কোথায় দেখলেন?

—এই যে ইস্কুলে। স্কুলের সামনের মাঠে ঐতো এলাহি আয়োজন রান্নাবান্নার।

—আপনার ভুল হচ্ছে কাকু। এই লকডাউন পিরিয়ডে অসহায় কিছু মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতেই এই আয়োজন। আর এলাহি আয়োজন নয়, সামান্য ডাল ভাত আর একটা তরকারি। কথাগুলো পুরোটা যে বিশ্বাস হচ্ছে তা নয়। সরেজমিন দেখার জন্য প্রতিকার বললেন, ভেতরে গিয়ে কি আমি একবার দেখব?

 মেয়েটা উৎসাহী গলায় বলল,  আসুন না কাকু। শুধু বলাই নয় সেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখাল। চার বস্তা চাল, এক বস্তা ডাল, স্তূপাকার আলু, পিয়াজ আর তরিতরকারি আর ডিম। লোককে কিছু বলতেই হচ্ছে না কাকু। যে শুনছে এই কথা, সঙ্গে সঙ্গে যার যা ক্ষমতা দু’হাত ভরে দিয়ে দিচ্ছে। আসলে এই  কোভিড ১৯ একটা বিচ্ছিরি রোগ। আর খুব ছোঁয়াচে। ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে সরকার লকডাউন জারি করেছে। টোটাল লকডাউন, বাজার দোকান সব বন্ধ। বাড়ি থেকে বের হওয়াও বন্ধ। যাদের বয়স কম তারা টুকটাক কিছু ম্যানেজ করছে। অসুবিধা হয়েছে সিনিয়র সিটিজেনদের নিয়ে। তাদের বিপদ বেশি তাই তাদের বাইরে বেরোনো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যেসব বাড়িতে শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আছেন তারা করবেটা কী? সেই তাদের কথা ভেবেই এই রান্নাঘর।

ছেলেটা বলল, শুধু তাদের কথা নয়, আরও একটা অসুবিধা হয়েছে। যে বাড়িতে একবার করোনা ঢুকছে সে বাড়ি তখন বয়কট করছে সবাই। সে বাড়িকে তখন কনটেইনমেন্ট জোন এর মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। সে বাড়ির লোকজন বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবে না। তাদের কথা ভেবেও আমাদের এই আয়োজন। আমরা একটা ছোট্ট দল করেছি কাকু। কোথায় কার অসুবিধে খোঁজ নিচ্ছি। খাবার পৌঁছে দেয়া তো আছে সেই সঙ্গে কার ডাক্তার দরকার কার ওষুধ দরকার সেসবের ব্যবস্থা করছি। হাসপাতালে পৌঁছতে হলে পুলিশের সাহায্য নিয়ে সেটাও করতে হচ্ছে আমাদের।

প্রতিকার কাকু বললেন, পুলিশও সাহায্য করছে তাহলে?

—হ্যাঁ তা তো বটেই। এইতো কালকের ঘটনা। মেয়েটি কথা বলল, বড়বাজার একজন অসহায় মানুষ রাস্তায় শুয়ে ছিল। করোনার ভয়ে তার কাছে কেউ যায় না, তাকে ছোঁয়া তো দূরের কথা। অথচ লোকটা বেঁচে আছে, শুধু একটু জল চাইছে। কিন্তু ভয়ে লোকটাকে জল  দিতেও কেউ যাচ্ছে না। তখন কি হল জানেন?

প্রতিকার কাকা অবাক গলায় বললেন, কী হল? আমাদের থানার বড়বাবু আর দুজন কনস্টেবল গিয়ে লোকটাকে উদ্ধার করল। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল পাঠাল। শুনতে শুনতে অবাক হলেন প্রতিকার সান্যাল। পুলিশের এই ভূমিকার কথা তিনি জানতেন না। না এদিকটা তো ভেবে দেখা হয়নি। এবার এই নিয়েও চিঠি লেখা দরকার। তিনি বললেন, আমি কি তোমাদের কিছু সাহায্য করতে পারি।

 —নিশ্চয়ই পারেন। তবে তার আগে আমরা আপনাকে একটু সাহায্য করি। বলে সে একটা মাস্ক এগিয়ে দিল প্রতিকার কাকুর দিকে। আর একটা দিল অনুকে। এদু’টো ঝটপট পরে নিন, রাস্তায় কিন্তু পুলিশ ধরবে।

—ঠিকই বলেছ তোমরা। রাস্তায় দু’একজন লোককে দেখলাম সকলেই মুখে মাস্ক নিয়ে হাঁটছে। আসলে আমি এত সব কিছু জানতেই পারি নি। চব্বিশ ঘন্টা চিঠি লেখা নিয়েই ব্যস্ত থাকি তো। মনে করতাম সমাজের খুব উপকার করছি। কিন্তু এখন দেখছি…

কথাটা শেষ হবার আগেই একটা পুলিশের ভ্যান এসে দাঁড়াল। ভ্যান থেকে নেমে বড়বাবু এগিয়ে এলেন। বললেন, এদিককার কতদূর স্বাগতা? স্বাগতা নামের মেয়েটি বলল, স্যার খাবার মোটামুটি রেডি। শুধু প্যাকিংটা বাকি আছে।
                 —তার আগে তোমাদের একটা কথা বলি স্বাগতা। কথায় কথায় আমাকে স্যার বলে ডেকো না। শুধু দাদা, অরিন্দমদা বলতে পারো।

প্রতিকার সান্যাল এমনটা কোনদিন দেখেননি, এমনটা কিছু শোনেনও  নি। পুলিশরা কি বদলে গেল! নাকি এমনই ছিল পুলিশরা, তার চোখেই শুধু পড়েনি। হঠাৎ এ দিকে চোখ পড়ল বড়বাবুর। প্রতিকার সান্যাল এর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনি, আপনারা?

তারা কিছু বলার আগেই স্বাগতা মেয়েটি বলল, উনি হয়তো আমাদের চেনেন না কিন্তু আমরা চিনি ওনাকে। উনি কাগজের চিঠি লিখে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। চিঠি মানে প্রতিবাদপত্র। ওনার নাম প্রতিকার সান্যাল।

—খুব ভালো হলো। আমাদের এখানকার কিছু অসুবিধার কথা আপনি উপর মহলে চিঠি মারফত জানান। তাহলে কিছু কাজের কাজ হবে। এই সময়ে এটা খুব দরকার। কথা বলতে বলতে হঠাৎ অনির দিকে চোখ পড়ে বড়বাবুর। তিনি বেশ অবাক হয়ে বলেন, তোমার হাতে চটি কেন। এদিকে পা দেখছি খালি।

প্রতিকার কাকাও ঘটনাটা খেয়াল করেন। কী আশ্চর্য, তাহলে কি এতক্ষণ ছেলেটা খালি পায়ে হাঁটছিল! খালি পায়ে আদালত চত্বর তারপর খালি পায়ে থানা, আবার থানা থেকে এই কানাইলাল স্কুল। তিনি নিজেও তো খেয়াল করেননি। ইস বড় ভুল হয়ে গেছে। বড়বাবু আবার বলেন, পায়ের চটি তোমার হাতে কেন?

আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল অনি। কিন্তু কিছু বলতে শুরু করলে গড়বড় করে ফেলবে ছেলেটা। তাই হাল ধরেন প্রতিকার। বলেন, না মানে চটির ফিতেটা ছিড়বো ছিড়বো হয়ে গেছে। তাই ওটা হাতে নিয়েই হাঁটছে এতক্ষণ।

তা সারিয়ে নিলেই হয়। বড়বাবু বলতে গিয়ে হঠাৎ যেন মনে পড়েছে তেমন গলায় বলে ওঠেন, সারাবেই বা কোথায়! এখন তো সবই বন্ধ। জুতোর দোকান বন্ধ, রাস্তার ধারে যে জুতো সারাইওলারা থাকে তারাও বসছে না। আচ্ছা দাঁড়াও, বলে পাশে দাঁড় করান পুলিশ ভ্যানের দিকে বড়বাবু এগিয়ে যান। তারপর ভ্যান থেকে হাতে একজোড়া নতুন বুট জুতো বার করে এগিয়ে দেন অনির দিকে, নাও দেখত এটা তোমার পায়ে হয় কিনা। 

অনি লজ্জায় কাঁপা হাতে বুট জুতো পায়ে পরে। জুতোটা তার পায়ে বেশ ফিট করেছে।  আজকের দিনটা তার অন্যরকম মনে হয়। যে ঘটনাগুলো আজ সকাল থেকে ঘটে গেল তার মধ্যে জড়িয়ে আছে ওই জুতো। হাওয়াই চটির বদখত শব্দ নিয়ে অহি-নকুল কাকার সঙ্গে গন্ডগোল। তারপর দেখা হলো প্রতিকার কাকার সঙ্গে। সেখানেও মূল কেন্দ্রে ওই জুতো। আবার এখন হাওয়াই চটি থেকে বুট জুতোয় তার পদোন্নতি।

বড় বাবু বললেন, আচ্ছা তোমার নামটা তো জানা হলো না। এতক্ষণ ঘোরাঘুরি করার পর অনি একটু সহজ হয়েছে। সহজ গলাতেই বলল, আমার নাম অনি। 

—অনি তো ডাক নাম। ভালো নাম কী?

—ভালো নাম অনিকেত, স্যার। 

—অনিকেত মানে কী? অনি আবার ক্যাবলা হয়ে যাচ্ছে। আসলে সে অনিকেত মানে জানে না। এটা লজ্জার কথা। তাই সে চুপ করে ছিল। বড়বাবু তখন প্রতিকার সান্যাল এর দিকে তাকালেন। তাকাতেই পারেন। লোকটা খবরের কাগজে চিঠি লেখে। বাংলাটা নিশ্চয়ই ভালোই জানে। অনিকেতের  মানে তার পক্ষেই জানা সম্ভব। এড়িয়ে যেতে তিনি তখন ফাঁকা রাস্তা দেখছিলেন। আকাশ দিয়ে উড়ে যাওয়া চিল দেখছিলেন। এতে করে ব্যাপারটা বোধ হয় আন্দাজ করতে পারলেন বড়বাবু। তাই সোজা তাকালেন স্বাগতা নামের মেয়েটির দিকে। বললেন, তুমি তো কবিতা লেখ, তুমি নিশ্চয়ই অনিকেত মানে জানবে।

স্বাগতা বলল, হ্যাঁ স্যার। অনিকেত মানে হল গৃহহীন। অনিও এই প্রথম শুনল তার নামের মানে। আশ্চর্য! তার সঙ্গে বেশ খাপ খেয়ে যায়। সত্যি সে এখন গৃহহীন, কর্মহীন, একলা একজন লোক। এইরকম যখন সে ভাবছে তখনই বড় বাবুর পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। বড়বাবু মোবাইল কানে তুলে বললেন, বলছি। কথা শেষ করে বড় বাবু বললেন, এক্ষুনি একবার যেতে হবে আমাদের। দেরি হলে চলবে না। যারা যারা যাবে গাড়িতে উঠে পড়ো, কুইক।

(ছয়)

এটা পুরনো এলাকা। চারদিকে ছড়ান-ছেটান বাড়ি। কয়েকটা বাড়ি বেশ পুরনো। নতুন বাড়ি দু'চারটে হয়েছে।  ভ্যান এসে দাঁড়াল একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে। বড়বাবু গাড়ি থেকে নেমে জিজ্ঞেস করার জন্য এদিক ওদিক তাকালেন। কিন্তু রাস্তাঘাট শুনশান। রাস্তায় একটাও লোক নেই। বাড়ির সব জানালা-কপাট বন্ধ। কোন বাড়ি থেকেই কোন শব্দ রাস্তায় এসে পৌঁছাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে একটা বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়ালেন। ভেতরে একটা শব্দ হলো বটে কিন্তু এক মিনিট দু মিনিট করে প্রায় তিন মিনিট কেটে যাওয়ার পরও দরজা খুলল না। বাধ্য হয়ে পাশের বাড়ির কলিংবেল বাজালেন বড়বাবু। এবার কাজ হল। জানলার পাল্লা খুলে একজন তাকাল। 

বড়বাবু বললেন, আপনার নাম।ভদ্রলোক নাম বলতে বড় বাবু বললেন, আপনি স্বাস্থ্য ভবনে ফোন করেছিলেন? পুলিশ দেখে ভদ্রলোক বললেন, হ্যাঁ স্যার। এই সামনের বাড়িতেই পেশেন্ট আছে। সাসপেক্ট করছেন করোনা। কী করব আমরা তো যেতে পারছি না তাই ফোনে খবরটা জানিয়েছি। দু’জনই বৃদ্ধ। তার মধ্যে একজন জ্বরে বেহুশ। বড়বাবু বললেন, ঠিক আছে আপনারা সাবধানে থাকুন যা করার আমরা দেখছি। তারপর বড়বাবু এ দিকে ফিরে বললেন,  আমি অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি। এক্ষুনি রোগীকে হাসপাতালে শিফট করতে হবে। স্ট্রেচারে করে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে আনতে দু’জন লাগবে। 

অনিকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সে নিজে থেকেই বলল, আমি আছি। কথাটা বলেই অবাক হয়ে গেল। সে সবসময়ই গুটিয়ে থাকে, সবার পেছনে থাকে। কথা বলে না। কিন্তু এখন সে এগিয়ে গেল কি করে, সে নিজেই বুঝতে পারছে না। শুধু এগিয়ে যাওয়াই নয়। রোগী মানুষটার পায়ের দিকে ধরল সে। স্ট্রেচারে  করে এম্বুলেন্সে রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিল। তখন অবশ্য সে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তার গায়ে অন্য একটা প্লাস্টিকের পোশাক। প্লাস্টিকের মুখোশে তার মুখ ঢাকা। হাতে গ্লাভস। এই সময় সে দেখল তাকে কেউ অনি বলে ডাকছে না। সে অনি থেকে অনিকেত হয়ে গেছে। 

এই রোগী টাকে বেডে দিয়ে ফিরতেই আর একটা ঘটনা ঘটল। অ্যাম্বুলেন্সে আর একটা পেশেন্ট এসে দাঁড়িয়েছে হাসপাতাল চত্বরে। এক ভদ্রমহিলা চিৎকার করে একজন বয়কে ডাকছে। কিন্তু নিষ্ফল ডাকাডাকি। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারও তার কথায় পাত্তা না দিয়ে গ্যাট হয়ে ড্রাইভারের সিটে বসে আছে। ভদ্রমহিলা একবার জোড়হাত করে ড্রাইভার এর কাছে যাচ্ছে। একবার একজন পথচারীর দিকে এগিয়ে গেলেন। গলায় কাতর আবেদন, আমার স্বামীর করোনা হয়নি, অন্য অসুখ। হাসপাতালে এডমিশন না করলে হয়তো মারা যাবেন। কেউ একটু দয়া করুন ভাই।

কিন্তু দয়া করার জন্য কেউই তখন প্রস্তুত নয়। আশেপাশের কয়েকজন ভদ্রমহিলার কথা না শোনার ভান করে চলে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বর মাসের ভ্যাপসা গরম চারপাশে। সূর্যের তেজে পুড়ে যাচ্ছে সবকিছু। হাসপাতাল চত্বরে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে কিছু ছায়া। আশ্রয় বলতে শুধু ওই ছায়াটুকু। আর চারপাশে দাবদাহ। অনিকেত পেশেন্টকে বেডে পৌঁছে দিয়ে এইমাত্র নিচে নেমে এসে এই ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পেল। সে সব কিছু দেখার পর ভাবল একটা কিছু করা দরকার। দারোগা সাহেব আর ওই ছেলে মেয়ে দুটি রুগীকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। এখন যা কিছু করতে হবে সব নিজেকেই। তাকে পরামর্শ দেবার কেউ নেই। সে একা একা এতদিন কিছুই করেনি। একা একা কিছু করার সাহস ও তার নেই। কিন্তু মাসিমার ওই করুণ আবেদন  সে এড়িয়ে যেতে পারল না। এগিয়ে গেল। বলল, পেশেন্ট কোথায় মাসীমা।
             —এইতো এইতো। জলে ডোবার আগে মহিলা যেন হাতে খরকুটো পেলেন। আবেগে তিনি অনিকেতের হাত দু’টো জড়িয়ে ধরে বললেন, এইতো তোমার মেসোমশাই শুয়ে আছে। এক্ষুনি কিছু ওষুধ না পড়লে হয়তো আর বাঁচান যাবেনা। তুমি পায়ের দিকটা একটু ধরো বাবা। আমি মাথার দিকটা ধরছি। হাসপাতালে স্ট্রেচার খুঁজেও পাই নি। এভাবেই ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাব।

অনিকেত আস্তে করে বলল, ইনি কে হন আপনার?

—আমার স্বামী। কাল থেকে হঠাৎ পায়খানা আর বমি। প্রতিবেশী সকলেই দেখছে, এমনকি ছেলেকেও খবর পাঠিয়েছি। কিন্তু করোনার ভয়ে কেউ কাছে আসেনি। এদিকে রোগীর ধাত ছেড়ে গেছে। চোখ বন্ধ। মুখে গ্যাজলা উঠছে।

—ঠিক আছে মাসিমা। খুব নরম গলায় খুব আন্তরিক ভাবে বলল অনিকেত। আপনি চিন্তা করবেন না আমি আছি। অনিকেতের সারা শরীর  এখনো মাথা থেকে পা পর্যন্ত প্লাস্টিকে মোড়া। হাতের গ্লাভসও সে খোলেনি। তাকে এখন মনে হচ্ছে অন্য গ্রহের মানুষ। সে পৃথিবীর নয়। কেননা এই করোনাকালে জেনে শুনে কেউ বিপদে ঝাঁপ দেয়! (ক্রমশ)





নাটক (শেষাংশ)

তোতাকাহিনী

মূল কাহিনী - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নাট্যরূপ - সুব্রত নাগ

[ চরিত্র :- রাজা, মন্ত্রী, রাজপণ্ডিত, কোতোয়াল, ভাগনে, স্যাকরা ও নিন্দুক]


[পঞ্চম দৃশ্য]

[মহারাজ ও মন্ত্রীমশাই পাশাপাশি বসে কথা বলছেন]


রাজা        -    তারপর মন্ত্রী, কী খবর তোতার?

            দরকার যা কিছু, হচ্ছে তো যোগাড়?

            শিক্ষা যে শুরু হল ঢাক ঢোল বাজিয়ে

            তোতা যদি ফেল করে সব যাবে কাঁচিয়ে

            টুইটারে ফেসবুকে দিয়েছ তো ছবি?

            লিখে দেবে ‘শিক্ষায় এক আজনবি।’

            [হন্তদন্ত হয়ে ভাগনা প্রবেশ করে।]

ভাগনে        -    সর্বনাশ, সর্বনাশ, মামা থুড়ি রাজা

            শক্ত দেখে কড়া দেখে ভাবুন একটা সাজা।

            ছুঁচো, ইতর, বেল্লিক - নয়তো আহাম্মক

            নয়তো স্পাই, টিকটিকি - সিওর প্রবঞ্চক।

মন্ত্রী        -    গালমন্দ না করে কী হয়েছে বলো -

ভাগনে        -    দুজন মিলে এক্ষুনি আমায় করুন ফলো।

রাজা        -    এই ভাগনে, ভয় পাসনে একটুখানি জিরো

            কে করেছে মস্তানি, কে হয়েছে হিরো?

ভাগনে        -    যা হয়েছে শুনলে আপনার গায়ে দেবে কাঁটা

            সোনার খাঁচা ভাঙতে গেছে - এমন বড়ো পাঁঠা!

রাজা        -    বলিস কী? বলিস কী? সোনার খাঁচায়, হাত?

ভাগনে        -    তবেই বুঝুন - এ কি আর যেমন তেমন বাত?

            ঠোঁটে কামড়ে, নখে আঁচড়ে কাটছে খাঁচার শিক

            ক্যুইক অ্যাকশন্ না নিলে পাখি ফুড়–ৎ ঠিক।

মন্ত্রী        -    অকৃতজ্ঞ, অর্বাচীন, নির্বোধ এক পাখি

            সোনার খাঁচা কাটতে গেছে! একে কোথায় রাখি? 

            [মহারাজ পায়চারি করছেন। হাতের তালুতে ঘুষি মারছেন।]

রাজা        -    হুম্ - হুম্ - ভাবছি সেটাই, এত সাহস কেন?

            জানি না কেন হচ্ছে মনে সাবোতাজ যেন।

            ধরে আনো নিন্দুককে, ঢোকাও তাকে জেলে,

            পিটিয়ে স্রেফ বানাব কিমা, হাতে একবার পেলে।

ভাগনে        -    স্যাকরা মশাই আসুক না হয় করুক রিপেয়ার

            সিসিটিভি বসিয়ে দিন ভীষণ দরকার।

মন্ত্রী        -    খতরনাক পাখি ওটা স্যাকরা ট্যাকরা ছাড়ো

            কামার ডেকে সোনার উপর লোহার কোটিং মারো।

রাজা        -    পণ্ডিতকে হাঁক দিও তো - সিলেবাস তো ভাস্ট

            আর যা কিছু পড়ছে পড়–ক - মর‌্যাল এথিক্স মাস্ট।

            [রাজা, মন্ত্রী ও ভাগনা মঞ্চ ছেড়ে চলে যায়।] [নিন্দুক চুপি চুপি ঢোকে।]


নিন্দুক        -    কেউ নেই তো? এদিক ওদিক? ঘাপটি মেরে কোথাও?

            দেখলে আমায় মারবে চাবুক, বেয়নেটের খোঁচাও।

            ধরতে আমায় রাজার সেপাই খুঁজছে আঁতি পাঁতি

            ভরলে  জেলে থার্ড ডিগ্রী- চড়, ঘুঁষি, কিল, লাথি।

            তাই তো এখন ফেরার আছি, থাকছি আড়ালে

            ফাটক থেকে বাঁচতে হবে, ভীষণ সামালে।

            অনেকদিন তোতাটার খবর নিইনি কোনো

            কী হাল যে করল পাখির রাজা- ভাগনে দেনো।

            ছোলা তো দূর, জলও নেই, শুকিয়ে তোতা কাঠি

            একহাতে পেন পণ্ডিতের - অন্যহাতে লাঠি।

            দিনের আলো নিভল বুঝি - ফুরিয়ে এল বেলা

            পুঁথির চাপেই দম হাঁসফাঁস পক্ষী শিক্ষার খেলা।

            সব কি খেলা? নয়তো খেয়াল - সবই বুঝছ ভাই,

            তোতাশিক্ষার বাহিনীতে তোতাটাই যে নাই। [মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়।]


[ষষ্ঠ দৃশ্য]

[নিন্দুকের প্রবেশ]

নিন্দুক        -    পাখিটা তো মারাই গেল - কেউ জানে না কখন,

            জানল সবাই সকাল বেলায় দেখতে গেল যখন।

            কেউ কি চোখের জল ফেলল? করল কি কেউ শোক?

            নীল আকাশে তাকিয়ে ছিল পাখির খোলা চোখ।

            অভিমানে নীরব হল, বলল না আর কথা

            যবে থেকে হারিয়েছিল ওড়ার স্বাধীনতা।

            [নিন্দুকের প্রস্থান। রাজা-মন্ত্রী উত্তেজিত হয়ে প্রবেশ করেন।]

রাজা        -    একি শুনি মন্ত্রীমশাই, এ কি শুনি প্রাতে?

            পাখিটা নাকি মারা গিয়েছে কালকে গভীর রাতে?

মন্ত্রী         -    ঠিক শুনেছেন মহারাজ, ঠিক শুনেছেন কানে

            খবরখানা আমিও পেলাম যাচ্ছি যখন øানে।

রাজা        -    শিক্ষা শেষ হওয়ার আগেই মরল তোতা কেন?

            পোষ্টমর্টেম করে পাখির তদন্ত হয় যেন।

            ভাগনেটাই বা গেল কোথায়? কী বলবে বলুক

            সেপাই কিছু ডাকো দেখি, আমার সঙ্গে চলুক। [ভাগনার প্রবেশ।]

ভাগনে        -    এই যে মামা থুড়ি রাজা যাবেন কেন আবার?

            মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শিক্ষা হল সাবাড়।

রাজা        -    বলিস কী হে? এই যে  শুনি দেহ রেখেছে পাখি

            তুই বলছিস শিক্ষা সাবাড়? গুজব এটা নাকি?

ভাগনে        -    জ্ঞান হয়েছে যেদিন থেকে আপনার এই ভাগনা

            সেদিন থেকেই সত্যি কথা বলতে ভয় পায় না।

            পাখি মরার মিথ্যা খবর, গুজব রটায় যারা

            সম্পূর্ণ শিক্ষা কী তা - বলুক দেখি তারা।

            পাখি কেন স্তব্ধ জানেন - শিক্ষা পূর্ণ তাই,

            ধ্যান গম্ভীর, মৌন নিথর - নড়ন চড়ন নাই।

রাজা        -    শাবাস, শাবাস তোতাপাখি এখন একদম চুপ!

ভাগনে        -    শাস্ত্রে বলে মহান শিক্ষার এই তো আসল রূপ।

রাজা        -    উড়ছে না আর, গাইছে না আর, চাইছে না দূর পানে।

            মূর্খ তোতা শিক্ষা পেল, জ্ঞানী মনে প্রাণে।

            শোনো মন্ত্রী, শোনো ভাগনে - আমার ইচ্ছে শোনো

            এই শিক্ষা ছাড়া অচল অন্য শিক্ষা কোনো।

            নোটিশ ঝোলাও চতুর্দিকে ঢ্যাঁড়া পিটাক লোক,

            সবার জন্য এই শিক্ষাই এখন চালু হোক। [সবাই বেরিয়ে যান। নিন্দুক পুনরায় ঢোকে।]

নিন্দুক        -    শুনলেন তো রাজার আদেশ - থাকবেন কি বোকাই?

            পুঁথি নির্ভর জ্ঞান ঠাসা সব শুকনো তথ্যে বোঝাই।

            প্রাণের খুশি মনের আরাম যে শিক্ষায় আছে

            সেই শিক্ষাই অমৃত - আসুন না তার কাছে।

            ভূমার দিকে তাকিয়ে তোতা ছেড়েছিল শ্বাস,

            শিক্ষা থাকুক ভূমা জুড়ে, ভূমায় হোক বাস।

    [ নেপথ্যে ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’ গানটির মিউজিক বাজতে থাকে। মঞ্চ অন্ধকার হয়ে আসে।]   


জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


আরও পড়ুন 

জ্বলদর্চি



Post a Comment

0 Comments