জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬১/শ্যামল জানা

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬১

শ্যামল জানা


সাররিয়েলিজম্, অভিনব ক্যাটালগ ছটি পোস্টকার্ড

আর একটি সম্পূর্ণ অভিনব ধারণা ‘বইতে এলের্তে’-র অনুষঙ্গে ভাবা হয়েছিল৷ স্মরণিকা হিসেবে, ওই ১৯৫৯ সাররিয়েলিস্ট এগজিবিশনের যেন দলিল(As a document), এই ভাবনায়, ছটি ছয় রঙের পোস্টকার্ডের একটি সিরিজ করা হয়েছিল৷ এই পোস্টকার্ডে যাঁদের ছবি ছিল, তাঁরা প্রদর্শনীর অংশগ্রহণকারী শিল্পী ছিলেন না বটে, কিন্তু সমমানসিকতায় সাররিয়েলিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷ 

লেটারবক্স দু-রকমের হয়৷ একটি ব্যক্তিগত, বাড়িতে থাকে, যেখানে চিঠি আসে৷ আর একটি পোস্ট-অফিসের, যেখানে আমরা চিঠি পোস্ট করি৷ ‘বইতে এলের্তে’ প্রথমটির ধারণায়, ও এই ছটি পোস্টকার্ড যেন দ্বিতীয়টির ধারণায় প্রস্তুত৷ আমরা এই যে প্রদর্শনী করছি, এখানে তোমাদেরও অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান করছি, বার্তা পাঠাচ্ছি৷ এই বার্তা যেন পোস্ট করছি৷ এই রকম ছয়জন সমমানসিকতার শিল্পীর একটি করে শিল্প দিয়ে ছয়টি পোস্টকার্ড প্রস্তুত করা হয়েছিল৷ এবং তা যথারীতি ওই ‘Missives Lascives’(কামোদ্দীপক চিঠি)-র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই৷ কারণ আমরা জানি, সামগ্রিকভাবে প্রদর্শনীটির থিম ছিল যৌনতা৷ ফলে, এই ছটি পোস্টকার্ডে যে ছটি ছবি ছিল, স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেকটিরই বিষয় ছিল যৌনতা৷ কিন্তু সেগুলি এতটাই অভিনব ও স্বতন্ত্র ছিল যে কারোর সঙ্গে করোর কোনো রকম কোনো মিল ছিল না, শুধু বিষয়টুকু ছাড়া! কী রকম? বোঝার জন্য অন্তত দুটি ছবির আলোচনা একটু বিশদে এখানে করা হল৷ 

প্রথম ছবি— শিল্পী- হান্স বেলমের/ছবির নাম- লা পৌপি(সিরিজের একটি)/সিরিজটির সময়কাল— ১৯৩৩-৩৭৷





হান্স বেলমের জার্মানির একজন বিশ্বমানের শিল্পী ছিলেন৷ তিনি ১৯৩৩ সাল থেকে চার বছর ধরে একটি living pictures-এর সিরিজ করেছিলেন৷ নাম— La Poupée (ইংরাজিতে The Doll)৷ ‘লিভিং পিকচার্স’ হল একটি আর্ট ফর্ম৷ যেখানে কোনো একটি ইভেন্টকে বোঝাবার জন্য মডেল ব্যবহার করা হয়, এবং তাকে নানাভাবে অ্যারেঞ্জ করে তারপর তার ফোটোগ্রাফ করা হয়৷ হিটলারের নাজী-বাহিনী তৎকালীন মহিলাদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছিল, যে চরম যৌন-বিকৃতি ও ধর্ষণ করা হয়েছিল, তারই প্রতিবাদে তিনি এই The Doll নামে একটি ‘লিভিং পিকচার্স’-এর সিরিজ করেছিলেন৷ এটি করার জন্য তিনি প্রায় দু-ডজন ছবি তুলেছিলেন৷ যার থেকে তিনি দশটির মতো চূড়ান্ত বাছাই করেছিলেন (ছবি ১ খেকে ৬)৷ স্বাভাবিকভাবেই কাল-বিলম্ব না করে নাজী-বাহিনী সেই সব ছবি প্রকাশমাত্র "Degenerate"(নিষিদ্ধ ঘোষণা করে মিউজিয়াম থেকে শিল্পবস্তুটিকে সরিয়ে ফেলা৷) করে দিয়েছিল৷ শুধু তাইই নয়, তাঁকে জার্মানি থেকে তাড়িয়েও দেওয়া হয়েছিল৷ তিনি তখন ফ্রান্স-এ পালিয়ে গেছিলেন ১৯৩৮ সালে৷ তখন তাঁকে, তাঁর কাজকে, সাদর আমন্ত্রণ জনিয়েছিলেন সাররিয়েলিস্টরা, বিশেষত আন্দ্রে ব্রেতোঁ(এখানে বেলমের-এর একটি কাজ দিলেই কার্যসিদ্ধি হত৷ কিন্তু, বিষয়ের বীভৎসতা ও সৃষ্টির অভিনবত্ব বোঝানো যেত না৷ তাই, ৬টি ছবি রাখা হল৷)৷



দ্বিতীয় ছবিটির নাম— গুইলাউম টেল(ছবি-৭)৷ যেটি ১৯৩০ সালে এঁকেছিলেন সালভাদোর দালি৷ এটি আঁকার পিছনে অদ্ভুত একটি কাহিনি আছে৷ সেটি হল— সালভাদোর দালি যখন সদ্য যুবক, তখন একজন বিবাহিত মহিলা (নাম— গালা এলুয়ার) তাঁর জীবনে প্রবেশ করেন৷ স্বাভাবিকভাবেই এটা কেউ মেনে নেয়নি৷ অনধিকারপ্রবেশ হিসেবেই বিষয়টি চিহ্নিত হয়৷ এই বিষয়টিকেই দালি প্রতিবাদস্বরূপ ক্যানভাসে Guillaume Tell নামে আাঁকেন! ক্যানভাসে দেখা যায়— একজন হিরো, বয়স্ক দাড়িওলা, হাতে কাঁচি৷ কাঁচি এ জন্য যে, তিনি বাবা, ওই কাঁচি দিয়ে সদ্য যৌবনে পড়া তার সন্তানের যৌনাঙ্গ ছেদ করে তাকে খোজা করেছেন৷ এটা বোঝা যাচ্ছে এই কারণে যে, কাপড়ের ফাঁক দিয়ে তার পুরুষ্ট লিঙ্গ দেখা যাচ্ছে৷ শুধু তাইই নয়, ওপরে তারই প্রতীক(দুজনেরই গায়ের রঙ একই, সাদাটে) একটি তাগড়াই ঘোড়ারও পুরুষ্ট লিঙ্গ দেখা যাচ্ছে৷ একদম নিচে, বাঁদিকে, পাখির বাসায় লিঙ্গস্বরূপ একাধিক ডিম রাখা আছে৷ ওই দাড়িওলা যে শোয়ানো চৌকোনা থামের ওপর ডান পা ভাঁজ করে হাঁটু রেখেছে, সেই থামে আঁকা আছে একটি লম্বা কাপের ওপরে একটি ডিম, যা কিনা পুরুষ্ট লিঙ্গের জাক্সটাপজিশন৷ আর পাশে, প্রায়োলঙ্গ এক লাস্যময়ী নারীকে দেখা যাচ্ছে উচ্ছল যৌনতার প্রতীক হিসেবে, তারও গায়ের রং ওই দাড়িওলা ও ওপরের তেজী ঘোড়ার গায়ের রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেন এদের পুরুষ্ট লিঙ্গের কারণ সে৷ বৃদ্ধের মুখ দেখলে বোঝা যায় সে কামুক, যৌনবিকৃতির শিকার৷ অথচ সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত তার নিজের সন্তানের স্বাভাবিক যৌনতার উন্মেষকে পাপ হিসেবে সে বিবেচনা করছে৷ তাই তার বিশেষ অঙ্গ ছেদন করে তাকে খোজা করা হল৷ লিঙ্গ ছেদন করলে যে বীভৎসতা তৈরি হয়, যে গোল অংশ তৈরি হয়, তা থেকে গলগল করে যেভাবে রক্ত বেরয়, সেই বীভৎসতা ছবিতে দেখাতে চাননি শিল্পী৷ তাই, প্রতীক হিসেবে একটি কর্তিত গাছ দেখিয়েছেন৷ যার থেকে একটি ডাল ও তার থেকে একটিমাত্র পাতা বেরিয়ে ওই বীভৎসতাকে চাপা দিয়েছে৷ আর দ্বিতীয় প্রতীকের প্রয়োগে অনুরূপ দৃশ্য তৈরি করেছেন ক্যানভাসের একেবারে ডানদিকে৷ মানুষের সমান উচ্চতার একটি এপিটাফের ধরনে পাঁচিল৷ মানুষের যেখানে যৌনাঙ্গ থাকে, ঠিক সেইখানে যেন একটি পাইপ ছিল৷ কিন্তু তা কেটে নেওয়ার পর যে গোল অংশ, তা থেকে গলগল করে জল পড়ছে৷ সদ্য যুবক ছেলেটির গায়ের রং কালচে সবুজ-ধূসর, বিবর্ণ৷ তারই প্রতীক হিসেবে তার ঠিক মাথার ওপরে ওই একই বিবর্ণ রঙের একটি অল্পবয়েসি ঘোড়া৷ তাকেও যেন খোজা করা হয়েছে, যা মৃত্যুর সমান৷ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তার দাঁত বের করে নেতিয়ে পড়া দেখে৷ এই ঘোড়াটির চোখ আছে, কিন্তু খোবলানো, পিঁপড়ে ধরেছে৷ অথচ, ঠিক তার ওপরে, ওই বৃদ্ধের প্রতীক হিসেবে, যে সাদা হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়াটিকে দেখানো হয়েছে, তার চোখ নেই, যেন সে নিরপেক্ষ নয়৷ আর, ওই খোজা হওয়া পাণ্ডুরবর্ণের সদ্য যুবক ছেলেটি, তার ডান হাতে তর্জনি উঁচিয়ে তার বাবাকে প্রতিবাদ করছে!

ছবিতে খুব স্পষ্টভাবেই দুটি পক্ষ তৈরি হয়েছে৷ একটি ছেলেটির পক্ষ৷ যে পক্ষের রং কালচে সবুজাভ-ধূসর ও বিবর্ণ৷ যার মধ্যে পড়ছে কর্তিত গাছ ও তার পাতা, ছেলেটি ও অল্প বয়েসী নেতিয়ে পড়া মৃত ঘোড়াটি৷ দ্বিতীয় পক্ষটি হল তার দাড়িওলা বাবার পক্ষ৷ এ পক্ষের রং সাদাটে৷ যার মধ্যে পড়ছে লাস্যময়ী নারী, দাড়িওলা ও ওপরের তেজী ঘোড়া৷




বাকি শিল্পীদের ছবিগুলি ও সৃষ্টির সময়কাল হল— 

৩. আর্সিলে গোর্কি/ দ্য ওরেটর/ ১৯৪৭(ছবি-৮)৷ ৪. হোয়ান মিরো/ লে পিইগে/ ১৯২৪(ছবি-৯)৷ ৫. ম্যাক্স ওয়াল্টার সাভানবার্গ/ বুকে দে লুমিইরে এট দে ক্রিপুসকুলেস/ ১৯৫৮৷ ৬. ক্লোভিস ত্রৌইলে/ লে পালাইস দেস মের্ভেইলেস/ ১৯৪৯(ছবি-১০)৷

এখানে দুটি ছবি নিয়ে একটু বলা প্রয়োজন৷ একটি হচ্ছে হোয়ান মিরো-র আঁকা ‘লে পিইগে’— এই ছবিটি তৎকালীন (বা আজও) ছবি আঁকার সমস্ত রকমের ধারা, সমস্ত রকমের ধ্যান-ধারণাকে ভেঙে তছনছ করে দিয়েছিল ও অতীতের ছবির গ্রেট সিরিজগুলির থেকে নিজেকে অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে মুক্ত করতে পেরেছিল৷ সাধারণত পেন্টিংয়ের মধ্যে আকাঙ্ক্ষার মৌলিক সমন্বয়(Radical fusion of desire)-কে ধরা একেবারে অসম্ভব বলা যায়৷ অথচ শিল্পী এখানে এই জটিল বিষয়টিকে অত্যন্ত শক্তিশালী তুলিতে সম্পূর্ণভাবে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন! সামান্য কটা রেখায় তিনি অপার ও সরাসরি প্রকৃতিকে(Raw nature)পূর্ণ অনুভূতিতে ধরতে পেরেছিলেন৷ ছবিটি একই সাথে কামোদ্দীপক যৌনধর্মী অথচ লিরিক্যাল! এটি ছিল তাঁর স্বদেশের ল্যান্ডস্কেপ৷ যার শিকড়ে ছিল আদিমতা ও স্বতন্ত্র দেহাতি অনুভূতিতে ভরা, যা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে৷ মানুষ, জীবজন্তু ও প্রকৃতি-র মধ্যে যে প্রতীকি সম্পর্ক তাকে তিনি ভেলকি দেখানোর মতো করে কবিতার অনুভূতিতে ধরেছেন! তাছাড়া, ছবিতে যে কাজগুলি আছে, তার বেশিরভাগই দেখা যাচ্ছে প্রত্যক্ষ, এবং অধিকাংশ অশ্লীল যৌনধর্মীতায় ব্যাপ্ত, এবং এর সাহায্যেই শিল্পী অল্প রেখায় ঐক্যবদ্ধ বিশ্বের রূপরেখা নির্ধারণ করেছেন৷ অথচ কোথাও দর্শকদের চোখে অশ্লীল হিসেবে ধরা পড়ছে না৷

ক্লোভিস ত্রৌইলে-র আঁকা ‘লে পালাইস দেস মের্ভেইলেস’ ছবিটিও একটি অসম্ভব অনুভূতির ছবি৷ যেন যৌনতাকে উৎসবের মতো উদযাপন করা হচ্ছে! ছবিতে যাদের দেখা যাচ্ছে, তারা যেন শিল্পীর তুলিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছে৷ যেন জীবনটা পূর্ণ নাটক ও স্ফূর্তিতে ভরা, এ ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে নয়জন মহিলা, পিছনের ছোট্টটা ধরলে দশজন৷ ও একজন পুরুষ৷ মহিলাদের সবাই যুবতী এবং বক্ষ উন্মুক্ত৷ প্রত্যেকের গায়ের রং স্বতন্ত্র৷ বেশিরভাগই ককেশিয়ান৷ একজন জিপসি কালো রঙের মহিলা আছে৷ তারা কন্ডোমের বেলুন ফোলাচ্ছে৷ আর, নাচগান বাজনায় ভরপুর৷ তারা যেন যৌনতায় ভরা এই শরীরের উদযাপন করছে৷ বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে— এই যে এতজন একসাথে হুল্লোড় করছে, তারা কিন্তু একত্রিত নয়! প্রত্যেকে স্বতন্ত্র৷ একসাথে থাকলেও নিজে নিজেকেই উদযাপন করছে(Celebration of individuality)যৌনতা একত্রিত হতে শেখায় না৷      (ক্রমশ) 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments