রা খ হ রি পা ল
এসময় ও রবীন্দ্রনাথ
রবীন্দ্রনাথের প্রভাব বাঙালি জীবনকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে আছে, দিনের কর্ম থেকে পরমার্থ পর্যন্ত। প্রতি মুহূর্তে বেদ উপনিষদ গীতা'র মতোই রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি। বরং সংস্কৃত ভাষা অধিকাংশ মানুষের কাছে অগম্য। সে ক্ষেত্রে
রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিজস্ব মাতৃভাষা,তার সংগীত মর্মস্থলে গিয়ে একজন নিরক্ষর মানুষকেও জ্ঞানী করে তুলতে পারে।
এই কারণে রবীন্দ্রনাথ বাঙালিদের খুব প্রিয়। স্বাভাবিক কারণে রবীন্দ্রসম্বন্ধীয় যাবতীয় তথ্য অনেকাংশই বাঙালিদের জানা,যা কিছু বলতে যাওয়া মানে বাতুলতা। এক্ষেত্রে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আশ্রয় নিলে প্রতিপাদ্যটি পাঠকদের কাছে নতুন লাগলেও লাগতে পারে ।
'এই সময় ও রবীন্দ্রনাথ', এই সময়ের ব্যাপ্তি কতটা? শুধু কি ২০২০ এর জানুয়ারি থেকে ধরে নেব ? ভাবনাটা অমূলক না। এই সময়টি বেশ ক্রুশিয়াল, সভ্যতা পুনর্জন্ম নিতে চলেছে। এতদিনকার প্রোষিত ধ্যানধারণার মূলে করোনা নামক ভাইরাসটি চরম আঘাত হেনেছে। ক্ষমতার চরমে আসীন মানুষ,অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থেকেও অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কৌটিল্য নীতি অনুসরণ করে আত্মগোপন করছে। লকডাউন,তার চলতি রূপ। ইতিমধ্যে বাড়তে বাড়তে মৃত্যুর সংখ্যা দুই লক্ষ পেরিয়ে গেল। চোখের সামনে মৃত্যু ঘটে যাচ্ছে। না পারছে ছুঁতে,গলা জড়িয়ে কাঁদতে পারছে না,কোলের শিশু আলাদা কেবিনে লড়ে যাচ্ছে, কোলে তুলে সান্ত্বনা দেওয়ার সুযোগ নেই।দিনের পর দিন ঘরের মধ্যে থেকে হাঁপিয়ে উঠছে। অগত্যা কি আর করা যায়? তুমি তো রয়েছো,-----''আমার সকল দুখের প্রদীপ----''।
হ্যাঁ, ঠিক এইখানে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি। যখন দিশাহীনতা স্বাভাবিক জীবনকে গ্রাস করে,হতাশা জীবনকে অর্থহীন করে তোলে,তখনই আসেন রবীন্দ্রনাথ। কখনও গান,কখনও কবিতা নিয়ে। আমরা একাত্ম হয়ে যাই আমার আমির সঙ্গে বিশ্বাত্মার। চেতনার ওলট-পালট ঘটিয়ে অলৌকিক আলোয় মুখরিত হয় জীবন। তখন ভয়, ব্যথা, বেদনার, ঊর্ধ্বে বিচরণ।
'তোমার ভ্রূকুটিভঙ্গে তরঙ্গিল আসন্ন উৎপাত,---
শুধালেম,'আরো কিছু আছে নাকি---
আছে বাকি
শেষ বজ্রপাত? '
নামিল আঘাত।
এইমাত্র ?-----
---'আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো'...
এই বোধ,সমস্ত সর্বনাশের মুখে নিজেকে অকুতোভয় করে তোলে। পলনাশ বলেছেন,---"I would read Gitanjali as I would read the Bible for comfort and for strength. "
বর্তমানে গৃহবন্দী অবস্থায় অনেকের মধ্যে ডিপ্রেশন দেখা দিয়েছে। পরিবারের একে অপরের কাছে একনাগাড়ে থাকার ফলে উদ্ভুত বা পুরানো সমস্যাগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে, রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠতে পারে অভ্রান্ত রেমেডি। গৃহবন্দি থেকে প্রথিতযশা শিল্পীরা করোনার বিরুদ্ধে জেগে ওঠার জন্য গান রচনা করছে,অনেক'কে দেখলাম কোরাসে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের মধ্যে সকল জটিলতাকে ভুলিয়ে দেওয়ার অমোঘ বাণী শক্তির সঙ্গে সুরের মাদকতা রয়েছে যথেষ্ট।কবি ইয়েটস গীতাঞ্জলি'র ভূমিকাতে বলেছেন, "I read Rabindranath every day,to read one line of him is to forget all the troubles of the world." সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের জাগিয়ে তুলতে পারেন রবীন্দ্রনাথ। যাঁরা একটু গভীরে গিয়ে কিছু পেতে চান,তাদের জন্যেও রবীন্দ্রনাথ উদারহস্ত।-----"কতদিন আর নিরুদ্দিষ্ট পাখায় ওড়া ?/বরং শাখামৃগের মতো লুটিয়ে পড়ি এ-ডাল সে-ডাল/তখন ছায়ান্তরালে অগাধ জ্যোৎস্না,অপার আশ্রয়/তুমি সীমার অসীমে প্রসারিত নীহারিকা/আমার দিক-শূন্যতা তোমার ছায়াপথ সরণী বেয়ে/ঠিক একদিন, দিগন্ত পেরিয়ে যাবে অনন্ত আশ্রয়।"
শুধু আজকের এই বিপদ নয়, রবীন্দ্র সমসাময়িক বা উত্তরকালে ঘটে যাওয়া যতগুলি বিপর্যয় দেখেছি, রবীন্দ্র- সাহিত্য সেখানে অনন্য হয়ে উঠেছে। তাঁর গান,কবিতা, উপন্যাস'কে আশ্রয় করে উত্তরণের পথ পেয়েছে মানুষ।' এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে','যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে,' বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা,' 'ও আমার দেশের মাটি,' আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি,' গানগুলির গুরুত্ব বোঝানোর অপেক্ষা রাখে না। দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের রচনা।---এর থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের গানে দেশাত্মবোধ ও আত্মনিবেদনের প্রশ্রয় কতখানি! দুটি স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশপ্রেমিকদের অস্ত্রই ছিল গীতা ও গীতাঞ্জলি।
অবশেষে, রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন থেকেও বর্তমান অবস্থায় উত্তরণের উপাদান যথেষ্ট পাওয়া যেতে পারে। বহুমৃত্যু তিনি দেখেছেন, বউঠানের মৃত্যু তার ভাবনার স্তরকে আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে,অসহায় কবির চোখের সামনে শমী ঝরে গেছে,কন্যা বেলা,স্ত্রী। তবু তিনি অবিচল থেকেছেন।---ক্রমান্বয় মৃত্যু মিছিল/শোকশিলা বুকে জমা রেখে/ নির্বিকার শীতল/আছড়ে পড়া কান্নার ঢেউ/বেলাভূমি জানে/মুঙ্গেরে খসে গেলে তারা/জ্যোৎস্নারা ঠিকঠাক থাকে/
ভোরের আকাশে বেলা শেষ হলে/ সূর্য উঠেছে তবু দারুণ শপথে।" এ এক জ্বলন্ত উদাহরণ। আমরা এই প্রদীপের উষ্ণতা নিয়ে ফের জেগে উঠব।
---------
0 Comments