জ্বলদর্চি

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল 


উপেনের দুই বিঘা জমি আর নেই 

রবিবাবু আপনার উপেনের ' দুই বিঘা জমি' আর নেই। সে জমি বাবুর নিজস্ব শোভাবর্ধনে চলে গেছে।  তাই সে এখন পরিযায়ী শ্রমিক। সে এবার মে দিবসে অংশ নিতে পারেনি। না পারলেও তারই রক্তে ভেজানো জামা লাল পতাকা হয়ে রাস্তার ধারে পড়েছিল। মে দিবস যে ভোরে পালিত হবে, সেই রাত্রে উপেন রাজপথে হাঁটছে, বাড়ি ফিরবে বলে। লকডাউনে বন্ধ সারা দেশ। পরিযায়ী শ্রমিক সাইকেলের চাকা, অনবরত ঘুরে চলেছে বাবুকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে হবে। সাইকেল কি মানুষ যে তাদের কথা ভাবতে হবে। ট্রলি ব্যাগে শোয়ানো পাঁচ বছরের ছেলে। বউয়ের হাতে চটের থলি। তাতে আধপোড়া কয়েকটা রুটি আর তোবড়ানো প্লাস্টিকের বোতলে জল। তাদের দেখে মনে পড়ে যায় -  "মনে হয় বাড়ি ফিরছে, / বাড়ির দুপাশ জুড়ে  অদৃশ্যের ভাঙা রাস্তা  / আকাশ ফুরিয়ে গেল। পৌঁছোবে কখন?" [ ' সরল কবিতা ' - শ্যামলকান্তি দাশ ] কবির সন্দেহ ঠিক, তারা বাড়ি পৌঁছতে পারেনি। হাঁটতে হাঁটতে যখন তার সরল হৃদয়টা কামারের হাপরের মত লাফাচ্ছে, তখন তার ছেলেটা জিজ্ঞেস করছে বাবা কখন বাড়ি যাব? উপেন বলছে -  সবুর কর বাবা, ভোর হোক। বাড়ি থেকে এবার চলে আসার সময় একটা নারকেল চারা লাগিয়েছিল। সে ভাবছে নিশ্চয় তার বৃদ্ধা মা জল দিয়ে বড় করে তুলেছে। আরও সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সে পরিষ্কার তার পৈতৃক ভিটার কোথায় কী দেখতে পাচ্ছে, যেমন কাঁচের গায়ে অবিকল মানুষ নিজেকে দেখতে পায়।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা মাল বোঝাই লরি উপেন, উপেনের বউ-ছেলে এবং আরও কয়েকজন শ্রমিককে পিষে দিয়ে গেল! তারা সকলে কয়েক টুকরো মাংসের খণ্ড হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। যেন রাজপথ রক্তে স্নান করে সদ্য এলো। তখনও তার চুল থেকে জলের মতো রক্ত ঝরছে। উপেনের ছেলের কাটা হাতের কাছে পড়ে আছে রুটি, আর তার মায়ের হাতটা জলের বোতলের কাছে। উপেনের হাত মুষ্টিবদ্ধ! আশ্চর্য, হাত  দিয়ে পারছে না ছেলেটা রুটি ধরতে, বউটা পারছে না তাকে জল গড়িয়ে দিতে, উপেনের হাত মুষ্টিবদ্ধ তবু কিছুতেই পারছে না তুলতে। অথচ এই হাত দুটো সমস্তক্ষণ তাদের সঙ্গে ছিল। উপেনের জামাটা রক্তে ভিজে লাল। ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটে আট ঘন্টা কাজের দাবিতে ঐতিহাসিক লড়াই, সেখানে যে পতাকা তোলা হয়েছিল অবিকল সে রঙের। উপেন মে দিবসে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।  কিন্তু তার জামাটাকে পতাকা করে দিয়ে গেল। উপেন তুমি রবিবাবুর নিজের হাতে গড়া, তাই তার কথা ধার করে বলি, - " তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবার দাও শকতি"। 

মে দিবস ঘটা করে উৎসবের মেজাজে পালন হয়। গাঁয়ে - মানে - না  - আপনি - মোড়ল নেতারা রক্তবর্ণ পতাকা উত্তোলন করে আর লম্বা ফিরিস্তি দেয় শ্রমিকের উন্নতির জন্য তারা দিন রাত এক করছেন।  কেশববাবু আপনি আমাদের প্রায় সব অঙ্ক শিখিয়েছেন, শুধু রাজনীতির অঙ্কটা শেখাননি। এদেশে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা আর তাদের দুরবস্থা দেখলে বোঝা যায়, এ অঙ্কে কত মার প্যাঁচ কত মিথ্যা। যারা দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে, তারা নিজেরাও জানে না তাদের কল্যাণের জন্য ঘোষিত কর্মসূচি,  তাদের অপরাধ তারা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। মরলে মরবে বাড়িতে মরবে।  সেই ইচ্ছাটুকু রাষ্ট্র পূরণ করতে পারে না। মনে পড়ে কবি সুনীল মুখোপাধ্যায়ের "পাখির চোখ - ১০" কবিতায়, -  "থাকুক না ঠিক ঘুমের মধ্যে, রঙের মধ্যে / এক জীবনের সারাংসার......."। 
মে দিবস উদযাপন করে শ্রমিক দিবস হিসাবে, কিন্তু জানে না শ্রমিকের সংখ্যা কত। আবার চাইতে গেলে উল্টোপাল্টা বিবৃতি। এরা যেন রাস্তার খেঁকিকুকুরের মতো পোকার জ্বালায়  নিজেদের ল্যাজ নিজেরা কামড়াচ্ছে। শ্রমিকের কল্যাণের কথা ভাবে বলে এরা মধ্যরাতে লক-ডাউন  ঘোষণা করে। শ্রমিকের দুরবস্থায় ফেলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। যে দেশপ্রেম গড়তে জানে না, তা বিদ্বেষ হয়ে সব ভাঙতে চায়। এখন লম্বা বিবৃতি নয়, ট্যুইট নয়, শ্রমিকের রক্তহীন ফ্যাকাসে হাতে চাই একটি করে রেশন কার্ড আর টাকা। স্টপেজ আসার আগে যাদের তোমরা তাদের জোর করে নামিয়ে দিচ্ছো, সময়ও আছে সেই অপেক্ষায় কখন তোমাদের নামাবে। এখনও সময় আছে উপলব্ধি করো মে দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য।  শ্রমিকের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা চাই। 

উপেন তুমি মারা যাওনি, তুমি আছো, তোমাকে - "খুঁজি না রাস্তার নামে / জানি নেই মর্মর মূর্তিতে / তুমি থাকবে, তুমি আছো, / আমাদের নিত্য দুঃখ জয়ের সংগ্রামে।" [ নজরুল, তোমাকে - কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ]
     

--------

Post a Comment

1 Comments

  1. Sandip kanjilal
    ধন্যবাদ। জলদর্চি । পৃথিবীতে সব চাইতে বেশি ভয় শ্রদ্ধা হারানোর ভয় । তুমি সাহিত্যের জন্য যা করছো সত্যি শ্রদ্ধার ।
    যদিও বয়সে তুমি ছোটো ।

    ReplyDelete