দূর দেশের লোকগল্প— ২৪৯
রাজার ছেলের চারটি বিদ্যা
নেপাল (এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
এক দেশে এক রাজা ছিল। সব ছিল রাজার ঘরে। ঘরে তার বউ ছিল। তার ছেলে ছিল। তার মেয়েও ছিল। কিন্তু ঘরে সব থাকলে কী হবে? মনে সুখ ছিল না রাজার।
দেশের রাজা সে। তবু তার মনে সুখ নেই। থাকবে কী করে? রাজার যে ছেলে, পড়াশুনোয় তার মন নাই। কত সাধ্য সাধনা, কত চেষ্টা চরিত্র। কিন্তু পড়তে তার মনই চায় না। পণ্ডিতমশাই আসেন। হাজারো চেষ্টা করেন। আর, মুখ গোমড়া করে বাড়ি ফিরে যান।
ফলে, রাজার মনের কষ্ট আর যায় না। মাথায় দুশ্চিন্তা চেপে থাকে সব সময়। ভাবনায় ডুবে থাকে মানুষটা। ছেলেকে ডেকে কত বোঝায়-- একদিন আমি তো থাকবো না। তখন এই রাজ্য তোমাকেই দেখতে হবে। কিন্তু পেটে যদি বিদ্যা না থাকে, রাজ্য চালাবে কী করে তুমি?
রাজপুত্র সব শোনে চুপটি করে। কোন কথারই প্রতিবাদ করে না। কিন্তু কোন কথাই মাথায় নেয় না। পড়াশোনার ধার-পাশ দিয়েও যায় না সে ছেলে। এমনটি হলে, কী করে সুখ থাকবে রাজার মনে?
একদিন রাজা ভাবলো, এবার ছেলের বিয়ে দিই।
সে কথা শুনে, রানি তো আহ্লাদে ডগমগ-- খুব ভালো কথা। এক্ষুনি দিয়ে দাও বিয়ে। বউ এলে, সে ঠিক একে শিখিয়ে পড়ে নিতে পারবে।
ধুমধাম করে রাজার ছেলের বিয়ে হয়ে গেল। দেখা গেল, সত্যিই কাজ হয়েছে সেই ওষুধে। বিয়ের পর বউ এসেছে ঘরে। পড়তে বসার জন্য ছেলেকে বোঝাতে লেগেছে বউ।
একদিন বউ বলল-- তুমি একটা কথা বুঝছো না। আর ক’দিন বাদে বাবা যখন থাকবে না, তুমিই তো রাজা হবে। কী করে তুমি রাজ্য চালাবে তখন? তাহলে কি আমাকে হাল ধরতে হবে তখন? মুখ দেখাবে কী করে তাহলে তুমি? গোটা রাজ্যের লোক কী বলবে তোমাকে? মান সম্মান-- তার কোন দাম নেই জীবনে?
এরকম হাজারো কথায়, দিন নেই রাত নেই পাখি পড়া করে ছেলেকে বোঝায় বউ। দেখা গেল, কাজ হয়েছে তাতে। ছেলের মতি যেন ফিরেছে। ছেলে ভাবলো, সত্যিই তো ভুল হয়ে গেছে। বাবার কথা শুনে পড়াশোনাটা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু এখন কি আর পড়াশোনা করা যাবে? কী করে বসবে ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে? লোক হাসাহাসি হবে। টিটকিরি দেবে সবাই। মুখ দেখাবে কী করে?
একদিন বউ বলল-- শোনো গো, একটা কথা বলি তোমাকে। বিদ্যের আবার বয়স আছে না কি? ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।
এই কথাতেই হলো বিপদ। কথাটা ছেলের মাথায় ধরে গেল বেশ। ভাবল, ঠিকই তো। ইচ্ছা থাকলে উপায় কেন হবে না? হয় কি না, চেষ্টা করে দেখতে হবে।
এই চিন্তা করতে করতে ভাবল, ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। বউকে বলল—বউ, আমি চললাম। দেখি, কোথায় একজন সঠিক লোক পাওয়া যায়, যার কাছে কিছু বিদ্যে শেখা যাবে।
বউ তো শুনে ভারি খুশি। হাসিমুখে বলল—যাও, দেখো চেষ্টা করে। নিশ্চয়ই তুমি সফল হয়ে ফিরবে।
কাউকে কিছু না জানিয়ে, একদিন চুপি চুপি রাজবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল ছেলে। নেবার মধ্যে একটা গেঁজেলে তিনটে সোনার টুকরো, আর কতগুলো টাকা ভরে নিল কেবল।
কতদিন ধরে পথ চলতে লাগলো রাজার ছেলে। একদিন যেতে যেতে দেখল, একজন চাষি মাঠে কাজ করছে। লোকটা লাঙ্গল চালাচ্ছিল। রাজার ছেলে মাঠে নেমে চাষির কাছে পৌঁছে, আলের ওপরেই ধপাস করে বসে পড়লো। চাষী তো অবাক। এ আবার কে! গায়ে এমন জমকালো পোষাক। এমন লোক মাঠে নামলো কেন? বসলই বা কেন এমন করে!
চাষির তো কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু জবাব কিছু আসছে না মাথায়। তাকিয়ে রইল ছেলেটার দিকে।
রাজার ছেলে চাষিকে জিজ্ঞেস করল—ওহে, শুনছো? কাছাকাছি কোন পণ্ডিত লোকের দেখা পাওয়া যাবে কি না, খবর দিতে পারো?
চাষি তো অবাক। এমন একটা মানুষ, তার কাছে এসেছে পন্ডিতের খবর নিতে! একটু অবাক হল মনে মনে। হাসলও একটু। লাঙ্গলের গরু দাঁড় করিয়ে, বলল-- হঠাৎ পন্ডিতের খোঁজ কেন গো? হলোটা কী?
রাজার ছেলে বলল-- তাহলে একটু এসো, সব কথা খুলে বলি তোমাকে।
লাঙ্গল গরু রেখে, আলের উপরে এসে বসে পড়ল চাষি। বলল—বল, কী বলবে।
রাজার ছেলে তাকে সব কথা খুলে বললো। দিয়ে শেষে বলল—আসলে মাথায় বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে, রাজ্য চালানো যাবে না। তাই সেই বুদ্ধির খুঁজেই তো বেরিয়েছি। একজন পন্ডিত পেলে খুব ভালো হয়। আছে না কি তোমার সন্ধানে? চেনাজানার মধ্যে কেউ যদি থাকে তো, আমাকে বল।
পোশাক আশাক দেখে প্রথমেই কেমন একটু খচখচ করছিল মনে। কে এই ছেলে? এখন ছেলের মুখেই সব শুনে, চাষি বুঝে গেল তারই দেশের রাজার ছেলে এ। সাথে সাথেই মাথায় একটা ফন্দি এসে গেল লোকটার। রাজার ছেলে বাইরে বেরিয়েছে ঘর ছেড়ে। খালি হাতে কি আর বেরিয়েছে? পয়সাকড়ি কিছু সাথে আছে নিশ্চয়ই। দেখা যাক, দু-এক টাকাও যদি বাগিয়ে নেওয়া যায়।
চাষি বলল-- এখানে আলের উপর বসে হবে না গো। চলো, ওই পিয়াল গাছের তলায় যাই। জুত করে না বসলে কি আর ঠিকভাবে কথা বলা যায়?
দু’জনে উঠে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসল। চাষি বলল-- শোন গো, ভালোমানুষের পো। বিনি পয়সার বিদ্যে কোন কাজে লাগে না, এটা তো বাপু জানো নিশ্চয়।
রাজার ছেলে বলল— হ্যাঁ, এটা আমি জানি।
চাষি বলল-- দাম দিয়ে বিদ্যে কেনো। সে বিদ্যা তোমার কাজে লেগে যাবে।
রাজপুত্র বলল—দাম দিতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তেমন লোক পাই কোথায়? সেই লোকের খোঁজেই তো বেরিয়েছি। তুমি খোঁজ দাও, আমি দেবো পয়সা।
চাষি বলল-- তুমি যদি দাম দাও, আমিও তোমাকে বিদ্যে দিতে পারি। এমন বিদ্যে দেব, যে বিদ্যে সারা জীবন তোমাকে কাজ দেবে।
রাজার ছেলে বলল-- তাহলে বলো, কী বিদ্যে দেবে তুমি আমাকে?
চাষি বলল-- তিনটে বিদ্যা দেবো আমি তোমাকে। প্রথম বিদ্যে-- তুমি হলে গিয়ে রাজার ছেলে। দেশে বিদেশে কত জায়গায় যেতে হবে তোমাকে। বন্ধুবান্ধব, কুটুম্বজন, বা ধরো তোমারই কোন প্রজার বাড়ি। যেখানেই যাও, বসতে বললেই কিন্তু বসে পড়বে না কক্ষনো। প্রথমে আসনটা একটু সরিয়ে দেবে। তারপর বসবে। এই হলো আমার প্রথম বিদ্যে।
বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিলো চাষি। রাজপুত্র কথার খেলাপ করল না। গেঁজেল বের করে, তার থেকে একটা সোনার টুকরো চাষির হাতে তুলে দিল।
সোনার টুকরো পেলে, কে না খুশি হয়? চাষি বলল-- এবার তাহলে আমার দ্বিতীয় বিদ্যেটা শোনো। তুমি হলে গিয়ে রাজার ছেলে। কখনও হয়ত তোমার স্নান করবার দরকার পড়লো বাইরে। সে নদী হোক বা পুকুর বা দীঘি, সবাই যে ঘাটে নেমেছে, কখনো সেখানে স্নান করতে নামবে না। প্রথমে নিজের জায়গা পছন্দ করবে। এদিক-ওদিক চেয়ে জায়গা বেছে নিয়ে, তবেই সেখানে স্নান করতে নামবে। দাও, এবার আমার দ্বিতীয় বিদ্যের দাম দাও।
চাষি আবার হাত বাড়িয়ে দিল। রাজপুত্রও কথা মত আর একটা সোনার টুকরো তার হাতে তুলে দিল।
লোকটা বলল—অন্য কোথাও যেতে হবে না তোমাকে। তিন নম্বর বিদ্যাটাও আমিই বলি তোমাকে।
রাজার ছেলে বলল—তাই হোক। বলো, কী তোমার তৃতীয় বিদ্যে?
চাষি বলল-- তুমি হলে গিয়ে রাজার ছেলে। কত লোক তোমার পরামর্শ নিতে আসবে। কত লোক বিচার চাইতে আসবে তাদের অভিযোগ নিয়ে। সাত তাড়াতাড়ি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে না। বেশিরভাগ লোকের মতলবটা কী, মন দিয়ে শুনবে। বোঝার চেষ্টা করবে। তোমার নিজের ধারণাটা কখনোই আগেভাগে চাপিয়ে দেবে না।
--দাও, আমার তৃতীয় বিদ্যের দাম। বলেই, আবার হাত বাড়িয়েছে চাষি। রাজার ছেলেও কথামতো আর একটা সোনা টুকরো তুলে দিল তাকে। তিনটা টুকরো পেয়েছে। চাষির তো আনন্দ ধরে না। সোনার টুকরো তিনটে ট্যাঁকে গুঁজে বলল-- তোমাকে এবার শেষ বিদ্যেটা বলি আমার।
রাজার ছেলে বলল—আমার কাছে কিন্তু সোনার টুকরো নেই আর। তবে, কয়েকটা টাকা আছে আমার।
চাষি হেসে বলল-- তুমি না রাজার ছেলে। এর মধ্যে ফুরিয়ে গেল? যাকগে, ঠিক আছে। এবারে যেটা বলবো, তার জন্য দাম দিতে হবে না তোমাকে। এই বিদ্যেটা তোমাকে আমি মাগনা দিচ্ছি।
এই বলে, চাষি বলল-- তুমি হলে গিয়ে রাজার ছেলে। অনেক কিছুই দেখে বা শুনে, তোমার মাথা গরম হতে পারে। কিন্তু হুট করে রাগের মাথায় কিছু করে বসবে না কখনো। মাথা ঠান্ডা রেখে, মন দিয়ে সব শুনবে। তাতে যদি দোষী মনে হয়, তখন তাকে সাজা দিও। কিন্তু কোনদিন তোমার হাতে একজন নির্দোষীও যেন সাজা না পায়। এইটা মাথায় রাখবে।
এবার হাসি মুখ করে চাষি বলল-- তোমার বিদ্যে পুরো হয়ে গেছে। এবার তুমি যেতে পারো।
গাছের তলা ছেড়ে উঠে পড়ল রাজপুত্র। দু’পা গিয়ে খেয়াল হল, তিন-তিনটে সোনার টুকরো খরচ হয়ে গিয়েছে। এখন সামান্য কিছু খুচরো পড়ে আছে মাত্র। মনে হল, যতসব অকাজের কথা। আর তাতেই তিন তিনটে সোনা জলে চলে গেল।
কত দূর গিয়ে, খিদে লেগেছে রাজার ছেলের। একটা বাজারে গিয়ে ঢুকতেই, চারদিক থেকে দোকানদাররা তাকে ছেঁকে ধরল। তার পোশাক দেখে, সবাই তাকে কেউকেটাদের কেউ একজন বলে ভেবেছে। সবাই তাকে ডাকতে লাগলো। এ বলে আমার দোকানে আসুন। ও বলে আমার দোকানে। সবাই বলে, আমার দোকানে আসুন। এখানে সব ভালো জিনিস পাবেন।
রাজার ছেলে একটা দোকানে ঢুকেছে মিঠাই কিনতে। দোকানদার তো আনন্দে গদগদ। তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এসেছে। একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল-- বসে পড়ুন, হুজুর। দোকানের সেরা মিঠাই আপনাকে দিচ্ছি আমি।
রাজার ছেলের পেটে খিদে। আসন দেখে বসে পড়তে যাচ্ছিল। হঠাৎই চিড়িক করে উঠল মাথার ভিতরে। সেই চাষিটার কথা মনে পড়ে গেল। প্রথম বিদ্যেটা তো দিয়েছিল আসন দেখেই না বসে পড়তে। থমকে গেল ছেলেটা। এই বেলাই প্রথম বিদ্যেটা পরীক্ষা করে নেওয়া যাক। পরখ করে নেওয়া যাক, কেমন বিদ্যে দিয়েছে লোকটা।
বসার আগে আসনটা যেই না একটু টেনে দিয়েছে, অমনি তার চক্ষু চড়কগাছ। আসনের তলায় গভীর এক গর্ত। বসে পড়লেই, কপালে নির্ঘাৎ মরণ লেখা ছিল আজ তার।
বড় জোর বাঁচা গিয়েছে। কী বিপদই না হতে যাচ্ছিল। চটপট দোকান থেকে বেরিয়ে এল। প্রথম বিদ্যেটার কথা ভাবতে ভাবতে আবার চলতে লাগল। বিদ্যের দামটা যে জলে যায়নি, এটা বুঝতে দেরি হোল না তার।
কতদূর যেতে যেতে ঘেমে নেয়ে অস্থির। রাজার ছেলে ভাবল, স্নান করে নিই। শরীরটা জুড়াবে তাতে। কিছুদূর গিয়ে পথের পাশেই বড় একটা পুকুরও পেয়ে গেল। বেশ বড় ঘাট। অনেক লোক স্নান করছে সেই পুকুরে। রাজপুত্র ভাবল, বেশ ধকল গেছে সারা দিন। জলে দুটো ডুব দিলেই, শরীর শীতল হয়ে যাবে।
ঘাটে নামতে যাবে, আবার সেই চাষির কথা মনে পড়ল। সেই দ্বিতীয় উপদেশ। ঘাটে না নেমে, সরে এল খানিক দূর। বেছে বেছে একটা জায়গা পছন্দও হলো। জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করল বেশ তৃপ্তি করে। আহা, কী ঠান্ডা জল, কী শীতল। সারা শরীর যেন জুড়িয়ে গেল। জামা কাপড় পরে, আবার চলতে লাগলো রাজার ছেলে।
কিছুদূর গিয়েছে, হঠাৎ মনে পড়ল, হায়-হায় গেঁজেলটা তো ফেলে এসেছি পুকুরপাড়ে। যাহ, কী হবে এখন? তড়িঘড়ি আবার ফিরে চলল পুকুরপাড়ে। সেখানে পৌঁছে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ছেলেটা। যেমন জিনিষ তেমনি পড়ে আছে। কেউ হাত দেয়নি। সাথে সাথে বুঝতে পারলো, ভাগ্যিস ঘাটে না নেমে ফাঁকা জায়গায় স্নান করতে নেমেছিল। ফাঁকা জায়গা। কেউ নেই। তাই জিনিসটা ফিরে পাওয়া গেল।
আবার চলতে লাগল রাজার ছেলে। রাত হয়ে গেলে একটা গ্রামে ঢুকলো। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে মোড়লের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। তাকে বলল-- তোমার বাইরের এই বারান্দাটায় আজকে রাতের মতো একটু থাকতে দেবে আমাকে?
মোড়ল বলল-- থাকো না। কে মানা করছে? গিয়ে দেখো, আরো একজন শুয়ে আছে আগে থেকে।
রাজার ছেলে গিয়ে দেখল, সত্যি সত্যি একজন লোক সেখানে শুয়ে আছে। কোন কথাবার্তা না বলে, সেও গিয়ে এক পাশে শুয়ে পড়ল। এক সময় সকাল হলো। তখন দেখা গেল, রাতের ঘুমের মধ্যেই সেই লোকটা কখন মারা গেছে।
হই-হই পড়ে গেল গ্রামে। মোড়ল গিয়ে আর পাঁচজন মাতব্বরকে নিয়ে আলোচনায় বসলো। শেষে সবাই মিলে মত দিল, এই দ্বিতীয় অতিথি, যে পরে এসেছে মানে রাজার ছেলে, তাকেই মরা লোকটার সৎকার করতে হবে। রাজপুত্র এ কথা শুনে, ভয়ানক রেগে বলল-- আরে ভাই, আমি কেন এর সৎকার করতে যাব।
ছেলেটা আপত্তি করতে থাকলো। কিন্তু গাঁয়ের লোকরাও শুনবে না। কোথাকার কে, কী জাত তার নাই ঠিক। পরিচয় জানা নাই, গাঁয়ের লোকেরা তার সৎকার করতে যাবে কেন? গাঁয়ের লোক সবাই বেঁকে বসলো। কোন জাতের মড়া তার নাই ঠিক । ছোঁয়াছুঁয়ি করা যায় কখনো? বাইরের লোক মরেছে। তার সৎকার বাইরের লোককেই করতে হবে।
রাজপুত্র ভীষণ রেগে গিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল। অমনি আবার মাথায় চিরিক করে উঠলো। হঠাৎই মনে পড়ে গেল সেই চাষির কথা। ভেবে দেখল, বেশিরভাগ লোক যা বলছে সেটা মেনে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
রাজার ছেলে রাজি হয়ে গেল। বিদেশীর মড়া ঘাড়ে তুলে, গ্রামের বাইরে একটা নদী চরে শ্মশানে চলল। জঙ্গলের কাঠ কেটে মড়া চিতায় তুলতে যাবে, অবাক হয়ে গেল রাজার ছেলে। লোকটার কোমরে বাঁধা একটা থলি। তার মধ্যে অনেকগুলো মোহর। নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করে উঠতে পারছে না।
সাথে সাথেই চাষির শেখানো বিদ্যেটা মনে পড়ে গেল তার। ভাগ্যিস গাঁয়ের লোকগুলোর কথা অবহেলা করেনি। কাজ শেষ হলে, নদীতে স্নান করে এবার বাড়ি রওনা হলো রাজপুত্র। রাজধানীতে যখন পৌঁছালো তখন রাত হয়ে গেছে। রাজপুত্র মনে ভাবল ভালই হলো। কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে এলাম যখন, তখনও কেউ জানতে পারবে না। চুপচাপ ঘরে ঢুকে পড়লেই হল।
খানিক বাদে হাসতে হাসতে রাজবাড়িতে পৌঁছে গেল ছেলে। নিজের ঘরে ঢুকতে যাবে, দেখল দরজার গোড়ায় একজোড়া ঙ্গরা জুতো। একটা তরোয়ালও ঠেকনা দিয়ে দাঁড় করানো। ভেতরে তার বউ কোনও একজনের সাথে কথা বলছে। রাগে গণগণ করছে রাজপুত্রের গলা। জিজ্ঞেস করল—ভেতরে কি কেউ আছে?
ভেতর থেকে বউ কথা বলল। ভয় পাবে কি, তার বরং গলায় হাসি-- আছেই তো। আরও একজন আছে। তুমি দেখবে তাকে?
আগুন জ্বলছে রাজার ছেলের মাথায়। তরবারি হাতে তুলে নিয়েছে। ভেতর থেকে বউ বললো-- আছে গো, আছে। তোমার বোন আছে ভেতরে। তুমি তো চলে গেলে। আমি নতুন বউ। একা একা ভয় করতো আমার। তাই সেদিন থেকে আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকি। রাজপুত্র কিন্তু বিশ্বাস হতে চাই না। সে বলল—তাহলে, তরোয়াল কেন?
বউ বলল—সে তো আমরা ভয় দেখাবার জন্য রেখেছি। কেউ ঘরে ঢুকতে গেলে, তরোয়াল দেখেই ভয় পেয়ে যাবে।
--কিন্তু এই নাগরা জোড়া? এটা আমার বোনের? সত্যি করে বলো, কে আছে ভেতরে?
ভেতরে দুজন মেয়ের তখন সে কী খিলখিলিয়ে হাসি। তার বোন বললো-- হায় ভগবান। নিজের জুতো জোড়াও তুমি চেনো না, দাদা। তুমি রাজ্য চালাবে কী করে?
তার বউ বলল—তাহলে, তুমিই বোঝ। রাজ্যের প্রজাদের কপালে কী দুর্ভোগই না আছে তোমার দাদার হাতে।
ততক্ষণে চাষির মাগনা দেওয়া শেষ বুদ্ধিটা মনে পড়ে গেছে রাজার ছেলের। সাথে সাথে আগুন নিভে গিয়েছে। রাগ নেমে গেছে মাথা থেকে। সে নরম গলায় বলল-- ঠিক আছে, আগে তো দরজা খোলো। পরে বোঝা যাবে, কার কপালে কত দুর্ভোগ আছে।
ভেতর থেকে বউ বলল-- আগে কথা দাও, মুন্ডু কাটবে না আমাদের। বলে দুজনে আবার হাসতে লাগলো ঘরদোর ফাটিয়ে।
রাজপুত্রও তখন হেসে ফেলল। বলল—দূর বুদ্ধু, তাই কখনও পারি? তোমরা দুজনেই তো আমার আপনজন। সামান্য হলেও কয়েকটা বুদ্ধি এখন আছে আমার মাথায়। এবার থেকে এইটা জেনে রেখো সবাই তোমরা।
আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল সারা রাজবাড়িতে। রাজা নিশিন্ত। বলল—যাক, বাঁচা গেল। এবার নিশ্চিন্তে মরতে পারব।
0 Comments