রা জ কু মা র আ চা র্য
শব্দ ভরা খাতা
সরষে খেতের পাশে সরু রাস্তায়
বসেছে ফেরিওয়ালা
তার পেছনে কুয়াশা-ভরা পুকুর
পাড়ে ফোটা গাদার হলুদ রং
চুইয়ে পড়া রোদে মিশে যায়
ফেরিওয়ালা ওজন করছে
লক্ষ শব্দ লেখা বাতিল স্কুলের খাতা
মায়ের সঙ্গে কিশোরী এক
জরিপ করছে ওজনের বাটখারায়
বাতিল খাতার ভেতর ঢুকে পড়ছে শীত
বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে লেখা
দিদিমণির বকুনি খেতে খেতে লেখা
পড়তে বসে রাতে ঢুলে ঢুলে লেখা
তরুণ মাস্টারমশাইয়ের প্রেমাতুর হাতে লেখা
বীজগণিতের সূত্র
একটি বছরের সমস্ত শিক্ষাতাপ
আশ্চর্য ঝোলার ভেতর ঢুকে যেতে
সামান্য কয়েকটা নোট ও কিছু খুচরোর আকাল নিয়ে
নিবেদিতা কন্যা বিদ্যামন্দিরের নবম শ্রেণীর অংশ
ঢুকে পড়লো ঘরের ছাউনি দেওয়া ঘরে
তার নরম শরীরের ফর্সা দুটি পা শেষবারের মতো
ভেসে উঠল এক তরুণ পথভ্রমণকারীর চোখে
দিগন্তের ছিন্ন মেঘে বিকেলের বলাকাটি হারল...
অনিবার্য কোনও শর্ত নয়
আামার চাকরি হারাবার ভয় নেই, কারণ আমার কোনও চাকরি নেই।
চাকরি করতে হবে, জীবনের জন্য এমন তো কোনও শর্ত নেই।
বেঁচে থাকার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়
কিন্তু কী আশ্চর্য, অর্থ ছাড়াই আমি আশ্চর্যভাবে বেঁচে আছি।
আমার প্রেম হারাবার কোনও ভয় নেই, কারণ আমি প্রেমিকাকে
এখনও খুঁজে পাইনি।
যদিও জীবনের জন্য প্রেম অনিবার্য কোনও শর্ত নয়;
তবুও আমি তাকে নিস্তব্ধতার ভেতর খোঁজার চেষ্টা করি।
এই যে একলা ঘরের শীতের রাত, চারপাশ দিয়ে ভেসে আসছে
নিস্তব্ধতার শব্দ, আমি বিগ্রহের রূপ ধরি যদি একবার ছুঁয়ে যায় প্রেম।
রাতের ভেতর রাত আসে, আরও রাত, তারপরও আসে রাত...
আমার বন্ধু হারাবার কোনও ভয় নেই, কারণ বন্ধু শব্দটার মানে
সত্যি সত্যিই আমি খুঁজে পাইনি।
এই যে জীবন— হেমন্তের মাঠে দাঁড়িয়ে
উপলব্ধি হয়তো করা যেত কিন্তু হেমম্তের মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন
জীবনানন্দ। হেমন্তের মাঠে মাঠে ছড়িয়ে আছে খড়।
আমার নিস্তব্ধতা হারাবার ভয় আছে, পাতা থেকে শিশির না ঝরে
পড়ার ভয় আছে, ধুলো রাস্তা হারাবার ভয় আছে, দূরের অস্পষ্ট
গাছেদের সারির ছবি হারাবার ভয় আছে...
এই একলা একলা দিঘির পাড়, মাঝদুপুরে দূরে দূরে জমে থাকা
কুয়াশা অন্ধকার, মধ্যরাতে বারান্দায় আসা বৃষ্টি হারাবার ভয় আছে...
স্নানে নামি জলের ভেতর
বিদ্যুতের উপর বসেছে মাছরাঙা,
ছায়া ডুবে আছে হেমন্তের জলে।
আমি ছুঁয়ে দিই জল, স্নানের আগে.
মৃদু হিম স্পর্শে জল কেঁপে কেঁপে যায়—
ছায়ায় সমান্তরাল দুটি তার, আঁকে
দীর্ঘ বাঁকা পথ, প্রতিটি জীবনের মতো।
মাছরাঙা লাফায় পথের বাঁকে বাঁকে,
আমি ছায়া ছুঁয়ে বসে থাকি স্থির হয়ে।
ছায়ার কম্পন থামে, পথ সোজা হয়.
স্থির মাছরাঙা; খোঁজের গভীরে তার চোখ
সোজা পথে স্নানে নামি জলের ভেতর...
অন্ধগলির চশমা বিক্রেতা
আমার বাবা অন্ধ, তবে জন্মান্ধ নয়।
ক্লাস নাইনে পড়ার সময়
কীভাবে যেন তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
তারপর থেকে অন্ধ গলিতে দাঁড়িয়ে
তিনি চশমা বিক্রি করেন
সেই কবে থেকে আজও তিনি
অন্ধগলির চশমা বিক্রেতা।
আমার মা প্রায় জন্মান্ধ।
জন্মের কয়েক বছর পরে শিশুরা যখন
ঘরের বাইরে পৃথিবীর অপূর্ব জগতকে দেখতে শেখে
ঠিক তখন থেকেই তিনি চিরদিনের মত অন্ধ!
বাবার চশমা বিক্রিতে মা সহযোগিতা করেন।
আমার অন্ধ বাবা, আমার অন্ধ মা মিলে
ছোটবেলায় আমাদের জন্য খাবার কিনে আনতেন,
আমরা একটু একটু করে বড় হয়ে উঠি।
আমাদের রোজ নিয়ম করে বিদ্যালয়ে পাঠাতেন,
আমরা শিক্ষিত হয়ে উঠেছি।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে
আমরা এখন মস্ত বড় শিক্ষিত হয়ে উঠেছি !
বাবা অন্ধ হয়ে আছেন,
মা প্রায় জন্মান্ধ।
এখন চারিদিকে এত আলোর শিখা, এত সবুজের আহ্বান,
এত মানুষের দল, এত দোকানপাটের মিছিল,
তবু কোথাও মিছিল নেই ! কোথাও আলো নেই!
আমাদের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে
আমাদের দৃষ্টি ধীরে ধীরে ক্ষীন হয়ে আসে।
এই কয়েক মাস হল
আমি বাবার সঙ্গে নেমে এসেছি অন্ধগলিতে।
বাবার মতো
আমিও এখন অন্ধগলির চশমা বিক্রেতা।
নিঃসঙ্গ
ঝিম মেরে আসা শীতের সকালে হাঁটছি পাহাড়তলের রাস্তায়। দেখলাম কতদিন ভাল করে খায়নি মনে হয় লোকটা। প্রায় উলঙ্গ জীর্ণ বিবর্ণ চেহারার লোক। ছানি-হাতুড়ির স্বশব্দে নীরবে পাথর কেটে কেটে অপূর্ব সব মূর্তি নির্মাণেরত।
অপেক্ষার পর, শিল্পী মুখ তোলে, ভেসে ওঠে তার সমুদ্র চোখ। ভালবাসার অন্তিমকণা স্ফীত হয়ে ওঠে। সময়ের ধ্বনিতে মৌলিক আর্তনাদ ভেসে থাকে। পেছনে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি জঙ্গল। গাছেদের ফাঁকে ফাঁকে দৃষ্টি কিছুটা গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে বনগহনে, সেখানে গাছেরা আঁধারে নত। ধ্বনিময় সন্ধ্যাতারা।
বিমূর্ত ছায়া, নীরবতায় ঘেরা নিঃসঙ্গ পাহাড়ের কণ্ঠস্বর।
-----
5 Comments
ভালো লাগলো
ReplyDeleteবেশ ভালো কবিতা। আনন্দ পেলা।।
ReplyDeleteসন্দীপ কাঞ্জীলাল
ReplyDeleteবেশ ভালো কবি।। আনন্দিত।
বেশ ভালো
ReplyDeleteপ্রথম থেকে চারটি কবিতাই আগে পড়েছি,ভালোলাগা কবিতা। শেষ কবিতাটি আগে পড়েছি কি না মনে নেই। প্রত্যেকটি কবিতাই ভালো লাগল।
Delete