জ্বলদর্চি

শ্যামল জানা || পর্ব -১

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -১


শ্যা ম ল  জা না

প্রাককথন

পেন্টিং বা চিত্রকলার ইতিহাস মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন৷ সেই, ছবি আঁকার প্রথম দিন থেকে, বা সূত্রপাত থেকে, যদি আমরা ধরি, তাহলে, সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত ছবি আঁকার ইতিহাস অন্তত দুশোর বেশি ধাপ পেরিয়ে গেছে৷ এবং, এই প্রতিটি ধাপের একটি নিজস্ব নামও আছে৷ প্রথম নামটি হল— গুহাচিত্র (Cave Painting)৷ পরের ধাপটি হল— আদিম ধ্রুপদচিত্র(Ancient Classical Art)৷ এইভাবে চলতে চলতে প্রায় ৬৪ হাজার বছর অতিক্রম করে, অন্তত পঁয়তাল্লিশটা ধাপ পেরিয়ে আধুনিক চিত্রকলার(Modern Art)সূত্রপাত হয়েছে৷ এই আধুনিক চিত্রকলাই আমাদের আলোচনার বিষয়৷ তবে, হঠাৎ করে ঠিক এইখান থেকেই আলোচনা শুরু করা যায় না! প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতেটা পাকিয়ে নিতেই হয়৷
গুহাচিত্র থেকেই যে পৃথিবীর চিত্রকলার ইতিহাস শুরু হয়েছে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়৷ কতদিন আগে? ২০১৮ সালের একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রচীন ছবিটি পাওয়া যায় আইবেরিয়ার একটি গুহার দেওয়ালে৷ যেটি চৌষট্টি হাজার (৬৪,০০০) বছর আগে আইবেরিয়ার গুহার দেওয়ালে এঁকেছিল আজকের মানুষের পূর্বপুরুষ নিয়নডার্থালরা৷ তবে, এতে কোনো প্রাণীর শরীরের ছবি ছিল না(non-figurative)৷ আর, বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এর পর দীর্ঘ কুড়ি হাজার(২০,০০০)বছর পার করার পর, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় বাহান্ন থেকে চল্লিশ হাজার(৫২,০০০-৪০,০০০)বছর আগে গুহার দেওয়ালে প্রথম প্রাণী-শরীরের ছবি(figurative)আঁকা হয়েছিল ইন্দোনেশিয়ার বোর্নিও দ্বীপের “লুবাং জেরিজি সালেহ” গুহার দেওয়ালে(ছবি-১)৷


এই তথ্য মাত্র গত বছর, ২০১৯ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন৷
আর, সবচেয়ে নিকটতম(Earliest)যে গুহাচিত্রের নিদর্শনটি পাওয়া যায়, সেটি আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর(১০,০০০ বছর)আগে, প্যালিওলিথিক বা প্রস্তরযুগে, আমাদের দেশ ভারতবর্ষের মধ্যপ্রদেশের ভীমবেটকার গুহায়৷
এই সময় বা আরও খানিকটা আগে থেকে মানুষেরা ছিল যাযাবর৷ আর, এই সময়ের পরে পরেই ক্রমে ক্রমে মানুষের যাযাবরত্ব ঘুচল৷ চাষ-বাস-পশুপালন-এর সাথে সাথে মানুষের স্থায়ী বসবাস হল৷ আর প্রকৃতির গুহার ওপরে নির্ভরতা থাকল না৷ সে নিজেই নিজের আস্তানা বা ঘরবাড়ি বানাতে শিখল৷ ফলে গুহাচিত্রের অবসান ঘটল৷ বলা যায়, এখান থেকেই পরিবারের সূত্রপাত ঘটল৷ তৈরি হল সমাজ৷ মানুষ তার সৌন্দর্যবোধ, সৃষ্টিশীলতা, শিল্পকর্ম, ইত্যাদিগুলিকে ছবি আঁকার বদলে উপাদান সংস্কৃতিতে (Material culture) কেন্দ্রীভূত করল৷ অর্থাৎ, দৈনন্দিন জীবনে যে সব অপরিহার্য উপাদান, যেমন, খাবার পাত্র, জলপানের পাত্র, সেগুলি রাখার পাত্র ইত্যাদি নানা ব্যবহার্য উপাদানগুলি যাতে সুন্দর দেখায়, সেগুলিকে তারা রং করল, তার ওপর নকশা আঁকল, ছবি আঁকল৷ আর, বাড়িঘর যাতে আরও মজবুত হয়, দেখতে সুন্দর হয়, বিজ্ঞানসম্মত হয়, এক কথায় স্থাপত্যর(Architecture)ওপর তারা জোর দিল৷
এভাবেই পাঁচ হাজার বছর কেটে গেল৷ এল ব্রোঞ্জযুগ৷ গ্রীকদেশের ক্রীটদ্বীপ ও এজিয়ান দ্বীপে গড়ে উঠল মিনোয়ান সভ্যতা আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে৷ এল গুহাচিত্রের পরের ধাপ বা দ্বিতীয় ধাপ— আদিম ধ্রুপদচিত্র(Ancient Classical Art)৷ এর তিনটি ভাগের মধ্যে প্রথমটিই হল মিনোয়ান আর্ট(ছবি-২) ও তার পরের দুটি হল— অ্যানশিয়েন্ট গ্রীক আর্ট ও রোমান আর্ট৷ 
এভাবে আরও পাঁচ হাজার বছর পেরিয়ে নতুন শতাব্দী থেকে শুরু হল— মেডিভ্যাল আর্ট(Medieval art)৷ এই পিরিওডটিতে ধাপ আছে চোদ্দটি৷ আদিম ধ্রুপদচিত্রের প্রথম থেকেই, অর্থাৎ মিনোয়ান আর্ট থেকেই বাড়ির দেওয়াল চিত্রিত করার(Fresco)সূত্রপাত ঘটে গেছিল৷ একটু অন্যভাবে বললে বলা যায়— আদিম মানুষের গুহার দেওয়ালে আঁকার যে অভ্যাস বা প্রবৃত্তি, সেটাই এই ফ্রেসকোয় রূপান্তরিত হয়েছিল আরও আধুনিকভাবে৷ শুধু তাইই নয়, এই ফ্রেসকোর ভেতরেই থেকে গেছিল স্বতন্ত্র আধুনিক চিত্রকলার বীজ৷ মেডিভ্যাল আর্ট-এর অষ্টম ধাপের নাম বাইজানটাইন আর্ট৷ যার সময়কাল ৮৪২ থেকে ১৪৫৩ সাল৷ এর ঠিক মাঝামাঝি সময়ে ইতালিতে জন্মালেন এক চিত্রকর৷ নাম চিমাবুয়ে(১২৪০–১৩০২)৷ ইনি সমস্ত ঐতিহ্যকে ভেঙে চুরমার করে একধাপে অনেকটা সামনে এগিয়ে দিলেন চিত্রকলাকে৷ আগে চিত্রকলা কোনো একক ব্যক্তির আঁকা বা শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হত না।  হত সময়ের নিরিখে৷ যেমন মিনোয়ান আর্ট, বাইজানটাইন আর্ট ইত্যাদি৷ বলতে গেলে এই চিমাবুয়ের থেকেই এককভাবে কোনো ব্যক্তি চিত্রকর হিসেবে চিহ্নিত ও মর্যাদা পেতে শুরু করল(ছবি-৩)৷

মেডিভ্যাল আর্ট-এর পর এল রেনেশাঁর কাল(১৩০০-১৬০২)৷ এরও তিনটি ভাগ৷ রেনেশাঁ থেকে নিও-ক্ল্যাসিসিজম-এ যেতে(১৫২০-১৬০০) পেরোতে হল সাতটি ধাপ৷ তারপর রোমান্টিসিজম(১৭৮০-১৮৫০), যার ছটি ধাপ৷ আর, রোমান্টিসিজম থেকে মডার্ন আর্ট বা আধুনিক চিত্রকলায়(১৮০৩-১৮৪৮) পৌঁছোতে লাগল বারোটি ধাপ৷ (ক্রমশ)

-----

Post a Comment

10 Comments

  1. খুব ভাল লাগল শ্যামলদা ৷

    ReplyDelete
  2. শ্যামল জানার পক্ষেই সম্ভব ছবির ইতিহাস নিয়ে এমন হৃদয়গ্রাহী মনোরম আলোচনার অবতারনা করা। মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। অপেক্ষাইওর রইলাম।

    ReplyDelete
  3. পড়লাম
    ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  4. আহা! শ্যামল যেন বড় করে লেখে। তৃপ্তি পাব, সংগ্রহেও রাখা যাবে ।

    ReplyDelete
  5. এত কম শব্দে এক অলৌকিকপ্রায় মহাকাব্য লেখা যায়? জানা ছিল না।

    ReplyDelete
  6. Khub valo ekta kaaj suru holo . Lekhok ke Jaladarchi ke dhanyabad .

    ReplyDelete
  7. খুব ভালো লাগলো, আগামী পর্বের অপেক্ষায়

    ReplyDelete
  8. ভীষণ ভালো শ্যামল দা। আরও তথ্যসমৃদ্ধ লেখার আশায় রইলাম

    ReplyDelete
  9. অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম যা আমার চেতনাকে সমৃদ্ধ করবে।

    ReplyDelete
  10. চিত্রশিল্প নিয়ে এরকম সমৃদ্ধ লেখা আমাদের জ্ঞানের ভান্ডারকে করবে পুষ্ট। এত প্রাচীন আমাদের সভ্যতার বাসভূমি আর চিত্রকলা তখন থেকে সরব মানব মনে,ভাবলেই এক আলাদা ভালোলাগা জাগ্রত হচ্ছে।সর্বোপরি সবকিছু একত্রিত করে এরকম একটা লেখা উপহার যিনি দিলেন উনার জন্য রইল অফুরান শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।

    ReplyDelete