জ্বলদর্চি

আরাধনা বিশ্বাস || পর্ব - ২


বাংলা গল্পের পরম্পরা || ২য় পর্ব

 আ রা ধ না  বি শ্বা স

 ছোটোগল্পের মুকুটে সোনার পালক

বাংলার সাহিত্যাকাশে নতুন এক জোয়ার এলো। গল্প লেখার দিকে সবার ঝোঁক বাড়লো। ছোটোগল্প তো অনেকেই লিখলেন, কিন্তু সেই ছোটোগল্পের মুকুটে সোনার পালক জুড়লেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তিনি গীতিকবি হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। গীতিকবিতার সাথে গল্পের এক অপূর্ব মেলবন্ধন তৈরী করে তাকে ছোটোগল্পের কলেবরে গৌরাঙ্গরূপ দিলেন। এক এক করে তিনি আমাদের অনন্যসুন্দর ছোটোগল্প  উপহার দিতে লাগলেন। আর পাঠক অবাক হয়ে তার রসস্বাদন করতে লাগলো।

বাংলা ছোটোগল্পের প্রথম আভাস পাওয়া যায়,  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'যুগলাঙ্গুরীয়', 'রাধারাণী' গল্পে। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় সেইসময় 'ভূত ও মানুষ', 'মুক্তামালা', 'মজার গল্প', 'ডমরুচরিত'  নামে বেশ মজাদার গল্পগুলি লিখছেন। সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের  'রামেশ্বরের অদৃষ্ট', 'দামিণী'তেও   ছোটোগল্পের কিছুটা লক্ষণ ছিলো।       
 
   ছোটোগল্প মাত্রই গল্প, কিন্তু গল্প মাত্রই ছোটোগল্প নয়, এ কথা যিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  তিনি তাঁর 'সোনারতরী' কাব্যের 'বর্ষযাপন' কবিতায় ছোটোগল্পের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। তাঁর ভাবনায় ছোটোগল্পের ক্ষুদ্রকলেবরের মধ্যে বৃহত্তের ইঙ্গিত থাকবে। গল্পের আরম্ভ ও সমাপ্তির মধ্যে একটা নাটকীয়তা থাকবে, যা গল্পের শেষে এক গভীর ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করবে। মানব জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্ত বা ঘটনা ছোটোগল্পের বিষয় হবে। 

   রবীন্দ্রনাথের প্রথম গল্প "ভিখারিনী" ১৮৭৪ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু,  তাঁর 'দেনাপাওনা'(১৮৯০) গল্পটিই প্রথম সার্থক ছোটোগল্প। এই গল্পটির মধ্যে দিয়ে তিনি পণপ্রথা নামক সামাজিক ব্যাধির ভয়ংকর পরিণতিকে তুলে ধরেছিলেন।               
 রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প সমূহ "গল্পগুচ্ছে"র  তিনখন্ডে মুদ্রিত হয়েছে। তাঁর এই গল্পগুলিকে  কয়েকটি পর্বে ভাগ করা হয়ে থাকে।

প্রেম বিষয়ক : নষ্টনীড়,  একরাত্রি, মহামায়া, দুরাশা, শেষের রাত্রি, মধ্যবর্তীনী। 
                                  
প্রকৃতি ও মানুষ : তারাপদ, মেঘ ও রৌদ্র,আপদ, অতিথি,বলাই।

অতিপ্রাকৃত : নিশীথে, ক্ষুধিতপাষাণ, গুপ্তধন, মণিহারা। 

হাস্যরসাত্মক : অধ্যাপক

সামাজিক: পোষ্টমাস্টার, নষ্টনীড়। 

গার্হস্থ্য : দেনাপাওনা, পণরক্ষা, ছুটি,      রাসমণির ছেলে, দিদি, কাবুলিওয়ালা প্রভৃতি। 

    তাঁর ছোটোগল্পগুলি  শিল্পের বিচারে যেমন উৎকৃষ্ট,  তেমনই গ্রামীণ সমাজ ও নাগরিক চিত্রের দর্পণ। রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পে মানুষ, প্রকৃতি এবং রহস্যলোকের অতিপ্রাকৃত ভাবের বিশেষ প্রভাব দেখা যায়।  তাঁর প্রেমের গল্পগুলিতে প্রেম, সৌন্দর্য, ও কল্পনার বিচিত্র সমন্বয় ঘটেছে।  দৈনন্দিন জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত তাঁর কিছু গল্প অতি উৎকৃষ্ট সৃষ্টি বলে মনে করা হয়। তিনি তাঁর শেষজীবনে লেখা রবিবার,  শেষকথা,  ল্যাবরেটরি গল্পে আশ্চর্য বুদ্ধিদীপ্তভাবে আধুনিক জীবনের সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম সার্থকভাবে বিশ্বসাহিত্যে ছোটোগল্পের দরজা খুলে দেন। বাঙালি-জীবনের আধারে তিনি বিশ্বমানবের ও বিশেষ করে নারীদের চিরকালীন সুখ, দু:খের কথা পরিবেশন করেছেন, তাই বিদেশেও তাঁর গল্প সমাদর লাভ করেছে। এ যেন সকলের প্রাণের গল্প, একান্ত নিজের কথা।       
    ছোটোগল্পকার হিসেবে  রবীন্দ্রনাথকে টলস্টয়,  মোপাসাঁ,  চেকভের পাশেই স্থান দেওয়া হয়। তাঁর গল্প আধুনিক কালেও সকলের চিত্ত আকর্ষণ করে থাকে। বর্তমানে তরুণ লেখক ও সমালোচকগণও "গল্পগুচ্ছে"র  ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।  

                                                               
-------

Post a Comment

1 Comments