জ্বলদর্চি

মধুমিতা মহাপাত্র


ম ধু মি তা  ম হা পা ত্র 


সংহতির কবি অমিয় চক্রবর্তী

বিশ্ব যুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন উত্তাল ভারতীয় জনমানস, কবি মানসও সেই তরঙ্গাভিঘাতে বিক্ষুব্ধ, তখন শান্ত, স্থিতধী এক  কবিমন স্বস্তির বার্তা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন,যার নাম অমিয় চক্রবর্তী। রবীন্দ্র  স্নেহময় -সান্নিধ্যের ঘনিষ্ঠ আবেষ্টনীর মধ্যে থেকেও যিনি আপন দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। কবি বুদ্ধদেব বসুর কথায়-- "সমকালীন বাংলাদেশের সবচেয়ে আধ্যাত্মিক কবি অমিয় চক্রবর্তী।.. সংগতি তাঁর সকল কাব্যের মূলমন্ত্র। ..অভাব,তর্ক,বোমা- ভাঙ্গাশহর, বাংলার দারিদ্র্য, মার্কিন সভ্যতা, প্রেমিকার বিচ্ছেদ, এই সব কষ্টময় জটিলতা একটি স্থির 'হ্যাঁ' ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে।"
১৯০১ সালের ১০ই এপ্রিল হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে কবি অমিয় চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী, মা অনিন্দিতা দেবী। জ্ঞান ও অনুভবে যিনি কর্মনিষ্ঠ পিতা ও লেখিকা মায়ের সার্থক উত্তরসূরী। হাজারীবাগ কলেজ থেকে বি.এ এবং পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করার পর তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য সচিব হিসেবে যোগ দেন। তাঁর কর্মজীবনের পরিসর ও ছিল বহুধাবিস্তৃত। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ছিল সমান পরিচিতি।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। সেই সঙ্গে বিদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক।বিশ্ব পথিক-কবির আনন্দময় পথ চলা অন্তহীন, পথের সঞ্চয় ও বৈচিত্রময়, আর এই জন্যই দেশ-কালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

দ্বন্দ্বময় জটিলতার ওই দুঃসময়ে সহজ-সরল ভাষ্যে কবি মাটির কাছাকাছি।" মাটি, বসুন্ধরা, যে নামেই হোক ভূমিস্পর্শ অভিযানই আমার  স্বপ্রকাশ, তারজন্য ভাষা নেই,ভাষ্য নেই। সংসারে একটি মৃণ্ময়ী বাসা বেঁধে ছিলাম সেই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কবিতা।"
গবেষক, পণ্ডিত অমিয় চক্রবর্তীর কবি হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ 'বিচিত্রা' পত্রিকায়। এছাড়াও কল্লোল, প্রবাসী প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ গুলি হল--'খসড়া',(১৯৩৮) 'একমুঠো'(১৯৩৯) 'মাটির দেয়াল'( ১৯৪২)'অভিজ্ঞান বসন্ত'(১৯৪৩) 'পারাপার'(১৯৫৩) 'পালাবদল'(১৯৫৯) 'ঘরে ফেরার দিন'(১৯৬১) 'হারানো অর্কিড'(১৯৬৬) 'পুষ্পিত ইমেজ।

আধ্যাত্মিক কবির ভাবনায় প্রেম ও অন্য মাত্রা পায়। এক্ষেত্রে সমকালীন কবিগণের মাঝে তিনি এক বিরল ব্যতিক্রম। তাঁর কবিতায় নারীর দৈহিক অনুষঙ্গ অনুপস্থিত, অথচ উপস্থাপনার গুনে হয়ে ওঠে রঙিন। না বলা কিছুর মাঝে পাঠকের অনুভব খুঁজে পায় প্রশস্ত ভাবনার পরিসর।বিশেষত পুষ্পিত ইমেজ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে--
"শুধু চাই সেই তাকে ধরণীর তীরে
শেষ নেই যে সুধার সেই তাকে ঘিরে।"

যন্ত্র সভ্যতার নির্মম যান্ত্রিকতার মাঝেও কবি দিতে পারেন এক প্রশান্তির আশ্বাস। মেলাতে পারেন, ঝড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়িটার ভাঙ্গা দরজাকে।
"... সভ্যতা যতই পাপ কাজে
যুদ্ধে হানে জ্যোতিবুদ্ধি, রক্তবহা যন্ত্রণা সমাজে
গঙ্গোত্রী ধারা নেমে বারবার অলক্ষ্য রঙ্গিত 
ধুয়ে মুছে দিয়ে গেল মুহূর্তে অক্ষয় লোকালয়"

পরবাসে কবির মন শুধুই খুঁজে ফেরে চিরন্তন বাংলাদেশকে। বিদেশ বিজন এর অনুসঙ্গ কবিতায় তাই বারবার ফিরে ফিরে আসে।দুরাবাসে থেকে মৃন্ময়ী বাসা, গোলক চাপার তল, খোয়াই, শান্তিনিকেতন, আলোয় মিশ্র আপন বাংলার আশীর্বাণীকে পেতে চান  অনন্য অনুভবে। পান্থ জীবনের বাঁশি কবিকে বিদেশের ক্ষণোজ্জ্বল সায়াহ্নে উদ্বেলিত করে।
"আন্তর্জাতিক মন শিকড় মাটিকে আঁকড়ে থাকে
যে মাটি এ বুকে আজো বাংলা পার্থিব।"
বর্ণময় কর্মজগৎ কবি অমিয় চক্রবর্তীকে বিপুল সম্মানের অধিকারী করে তুলেছে।দেশবাসী 'সাহিত্য একাডেমী' 'দেশিকোত্তম' 'পদ্মভূষণে' ভূষিত করেছে। বিদেশ থেকে পেয়েছেন ইউনেস্কো পুরস্কার। আর শান্তি, সুস্থিতির বাণী শুনিয়ে পাঠকমনে লাভ করেছেন অমরত্ব। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ১২ই জুন এই মহাপ্রাণ অমরলোকে যাত্রা করেন।
------

Post a Comment

1 Comments

  1. কবিকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধা ও প্রণাম 🙏

    ReplyDelete