জ্বলদর্চি

মধুমিতা মহাপাত্র


ম ধু মি তা  ম হা পা ত্র  

বাংলা সাহিত্যে নবযুগের দিশারী মাইকেল মধুসূদন দত্ত

বাংলা সাহিত্যে 'আধুনিকতা' শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যার নাম প্রথমেই মনে আসে তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ঊনবিংশ শতাব্দীর যুগ প্রভাবকে অন্তরে ধারণ করে সাহিত্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সুচারু সমন্বয়ে এক নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেন তিনি। মননে তিনি যে ধারণাকে লালন করেছিলেন তা প্রকৃত অর্থেই যুগজীবনকে আধুনিকতার দিশা দেখাতে পেরেছিল।
বাংলার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে মাইকেল মধুসূদন দত্তের আবির্ভাব। তারিখটা ছিল ১৮২৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি। যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত, মাতা জাহ্নবী দেবী। অতি শৈশবের তাঁর কিছু চারিত্রিক গুণের মধ্যে ভবিষ্যতে সফল হওয়ার সম্ভাবনা লুকিয়ে ছিল, যেমন পড়াশুনায় গভীর আগ্রহ ও কাব্যপ্রীতি। বাল্যকাল থেকে রামায়ণ ও মহাভারতের প্রতি ছিল প্রবল আকর্ষণ যা ভবিষ্যৎ কবি জীবনের ভিতটিকে সুন্দর করে গড়ে দিয়েছিল।গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে তিনি হিন্দু কলেজের জুনিয়র বিভাগে ভর্তি হন। সেখানেই অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলেন রিচার্ডসনকে। যার সংস্পর্শ তাঁর মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ কে বাড়িয়ে তোলে। এই অনুরক্তি থেকেই তিনি বাবা-মা আত্মীয়-স্বজন এর আপত্তি উপেক্ষা করে ১৮৪৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে হিন্দু কলেজ ত্যাগ করে বিশপস কলেজে ভর্তি হতে হয়, এতে তাঁর প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে অন্য একটি দরজা খুলে যায়। বিশেষত পাশ্চাত্য ভাষাশিক্ষার সুযোগ হয়। বিশপস কলেজে গ্রীক, ল্যাটিন ভাষা চর্চার ফলে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। যার ফল তাঁর সৃষ্টিতে প্রতিফলিত হয়।খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের জন্য তিনি পিতার বিরাগভাজন হন এবং অর্থ উপার্জনের জন্য শিক্ষা জীবনের ইতি টেনে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। প্রথমে মাদ্রাজে একটি অনাথ বিদ্যালয়ে পরে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেইসঙ্গে বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা Spectator এর সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৪৮ সালে রেবেকা থম্পসন ম্যাকটাভিসের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের চার সন্তান হয়, কিন্তু বিবাহিত জীবন স্থায়ী হয়নি, পত্নীর সঙ্গে  বিচ্ছেদ ঘটে। ১৮৫৮ সালে তাঁর এক সহকর্মীর কন্যা এমিলিয়ে হেনরিয়েটা সোফিকে বিবাহ করেন। মধুসূদন এবং হেনরিয়েটার দুই পুত্র এবং এক কন্যা ছিল।
    ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণেই প্রথম জীবনে ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন। Captive Ladie, Visions of the past নামক গ্রন্থ দুটি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ইংরেজি সাহিত্য চর্চায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাতে তিনি আশানুরূপ সাফল্য পাননি। পরবর্তীকালে তাই তাঁর চিন্তার অভিমুখ পরিবর্তিত হয় এবং মাতৃভাষার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন। কবি ও নাট্যকার দুই হিসেবেই তিনি ছিলেন সমান সফল। নাট্যকার হিসেবে প্রথম আত্মপ্রকাশ। ১৮৫৮ সালে 'শর্মিষ্ঠা' নাটক রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে নাট্যকার হিসেবে নিজের জায়গা করে নেন। ১৮৬০ সালে প্রকাশিত 'পদ্মাবতী' তাঁর দ্বিতীয় নাটক। পাশ্চাত্য আদর্শ প্রভাবিত তাঁর এক অভিনব সৃষ্টি। পদ্মাবতীর পর ঐতিহাসিক কাহিনী অবলম্বনে লিখলেন বিয়োগান্তক নাটক কৃষ্ণকুমারী। ইতিহাস, পুরাণ তাঁর মৌলিক ভাবনার স্পর্শে এক নবরূপ লাভ করল,অবশ্য সামাজিক সমস্যাগুলোও তাঁর সাহিত্যে অনালোকিত ছিলনা। প্রহসন গুলিতে (একেই কি বলে সভ্যতা, ও বুড়- সালিকের- ঘাড়ে- রোঁ) তার প্রমাণ মেলে।  শেষ নাটক 'মায়াকানন' যা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
  তিনি নাট্যকার হলেও কবিত্ব ছিল তাঁর সহজাত প্রতিভা। আবাল্য কাব্যপ্রীতি তার পরিচায়ক। 'তিলোত্তমাসম্ভব' তাঁর প্রথম কাব্য। 'মেঘনাদবধ কাব্য' রচনার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালি জনমানসে অমর আসন লাভ করেন। 'মেঘনাদবধ কাব্য' ভাব, ছন্দ ও ভাষার মৌলিকত্বে এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি । 'বীরাঙ্গনা' ও 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য তাঁর আধুনিক মনস্কতার উজ্জ্বল  স্মারক। বীরাঙ্গনা কাব্যে দূরদর্শী কবি প্রায় শতবর্ষ আগে নারীজাগরণের আগাম বার্তা  জানাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৮৬২সালে তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলেত যাত্রা করেন। প্রবাসে থাকাকালীন রচিত তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী' দেশাত্মবোধের এক অনন্য নজির। ১৮৬৬ সালে তিনি ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। দারিদ্র্য কবিকে বারবার পীড়িত করলেও সৃষ্টি ধারা ছিল অব্যাহত। দুর্দিনে বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যে ধন্য হয়েছিলেন একথা উদাত্ত চিত্তে তিনি স্বীকার করেছেন বার বার।
১৮৭৩ সালের আজকের এই দিনটিতে অর্থাৎ ২৯শে জুন এই মহান প্রতিভার অকাল প্রয়াণ ঘটে। মধুকবি তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের স্বল্প পরিসরে সাহিত্যচর্চায় যে কালজয়ী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন বাংলা সাহিত্যে ও বঙ্গবাসীর মনে তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

-----

Post a Comment

0 Comments