জ্বলদর্চি

দেবব্রত ভট্টাচার্য্য


হিমালয়ের পথে চলতে চলতে || পর্ব- ৩
       
দে ব ব্র ত  ভ ট্টা চা র্য্য  


কেদারনাথ দর্শন 

গৌরীকুণ্ড হ'ল কেদারনাথ যাত্রার gate way । সব তীর্থ অভিযাত্রী গৌরীকুণ্ডে এসে রাত্রিযাপন করেন। এ স্থান পুণ্যকামী মানুষের চরণ স্পর্শে  পবিত্র। আমরাও রাত্রি বাস করে পুণ্যলাভের অধিকারী হবো। 
  মেঘলা পরিবেশ এবং চারপাশের পাহাড়ের আড়াল আমাদের মনে করিয়ে দিল -
 -কিরে? চা খাবি না? যা যা ফিরে যা এবার। 
 ততক্ষণে আমরা আমাদের দীপক লজের সিঁড়ির মুখে এসে পড়েছি। পাশেই চায়ের দোকান। কয়েকটা বেঞ্চ পাতা। চায়ের আর্জি জানিয়ে বসে পড়লাম। 
 -আপ কাঁহা সে আয়ে হেঁ  ?
 দোকানদার দেহাতি টানে প্রশ্ন করলেন ।
  -কোলকাত্তা সে। 
 পশ্চিমবঙ্গের সব জায়গার মানুষ বাইরে গেলেই নিজেকে কোলকাতার মানুষ বলে পরিচয় দেয়। কারণ সারা পৃথিবীবাসী এক ডাকে কোলকাতাকে চেনে। 
 -আপনারা বাঙালী ?
খাঁটি বাংলায় দোকানদার প্রশ্ন করলেন। 
 -মানে আপনিও ?
 -চল্লিশ বছর আগে এই গৌরীকুণ্ডে এসেছিলাম বাবার হাত ধরে। তখন আমি বার বছরের। 
 -তারপর ?
  দু গ্লাস ভর্তি চা এগিয়ে দিলেন দোকানি বাবু। 
 -বিস্কুট দেবো ?
পাঁচ টাকার একটা ছোটো বিস্কুটের প্যাকেট নিলাম। ভদ্রলোককে দেখলাম, অন্য খোদ্দেরকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যেন ইচ্ছে করেই আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন। বন্ধু প্রশ্ন করলেন, 
 -এখানে রাতের খাবার পাওয়া যাবে ?
 -চারটে রুটি, ডাল আর সবজি ষাট টাকা পড়বে। 
 খুব মন্দ নয়। তা ছাড়া বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সুতরাং এ ব্যবস্থাই মেনে নিতে হবে। কাল ভোরেই তো প্রভুর দর্শনে যাত্রা শুরু হবে। বাবার ডাক শুনতে পাচ্ছি। 
  চা খেতে খেতে দোকানদার মশাইকে দেখছিলাম। একমনে চা তৈরী করে চলেছেন। সাথে রুটি তৈরীর ব্যবস্থা চলছে। দেখলাম, এক কোনায় একটি লোহার ঠোঙায় অনেকগুলি বাঁশের লাঠি দাঁড় করানো। কেদারনাথের পাহাড়ী পথে এ লাঠির চেয়ে বড় কোন বন্ধু নেই। লাঠি হ'ল তৃতীয় পদ। একটি লাঠি মাত্র দশ টাকা। অনেক বাছাবাছি করে দুটি লাঠি জোগাড় হ'ল। দোকানীবাবুকে বললাম 
 -একবার রুম থেকে ফিরে আসি। তাড়াতাড়ি ডিনার করবো। 
 দুটি লাঠি হাতে রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। রুমের সামনেই একটা বড় ব্যালকনি। কিছুটা ঢাকা, বাকিটা খোলা। অন্ধকারের সাম্রাজ্য থেকে তীব্র জল স্রোতের শব্দ উঠে আসছে। উঁচু পাহাড়গুলোর অশরীরী উপস্থিতি অনুভব করছিলাম। মন্দাকিনীর হিমশীতল জলধারা দেখছি না কিন্তু তার চঞ্চল উচ্ছ্বলতা গায়ে হিমেল স্পর্শ দিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ হুঁস এলো -
 -কি হ'ল দেবুদা ? বৃষ্টিতে ভিজছেন কেন ?ঠাণ্ডা লাগাবেন না একদম। 
 অভিভাবকের বকুনি শুনতে হয়। ঘরে ফিরে এলাম। বেশ শীত শীত করছে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। বাংলায় এখন গ্রীষ্মের দাবদাহ। আর এখানে গরম জল ছাড়া স্নানের কথা ভাবাই যায় না। 
  রাতের খাবারের খোঁজে আবার নেমে এলাম। বেশ কিছুটা সময় বসতে হ'ল। আর সে কারণেই এক হৃদয় গলানো কাহিনীর সাক্ষী থাকতে পারলাম। রাতের খাবার কিভাবে খেয়েছিলাম মনে নেই। 
 আমি দোকানীবাবুকে বললাম, 
 -আপনার সাথে তো ভালো করে আলাপই হ'ল না। কি নাম আপনার? কোথায় বাড়ী ছিল ?
  অনেকক্ষণ কোনও কথা নেই। তারপর নীচু স্বরে বললেন -
 -আজ আর ও সব জেনে কি হবে ? সব বন্ধন তো ছিন্ন করেই এসেছিলেন বাবা। আর আজ তো আমার কোন পিছুটান অবশিষ্ট নেই। 
  আবার কিছু সময় কোন কথা নেই। আমরাও স্থির। ওনাকে কিছুটা সময় দেওয়া প্রয়োজন বুঝেছিলাম। 
 -বাবা, মা, আমি আর ছোট বোন। আট বছরের সুলেখা। কেদারনাথের চরণ দর্শনে এসেছিলাম। তখন তো বাস গুপ্তকাশী পর্যন্ত আসতো। তারপর হাঁটাই একমাত্র উপায়  ।অনেক চটী ছিল। পথে রাত কাটানো যেতো। রামওয়াড়া চটীতে বোনের ধূম জ্বর এলো। সেই জ্বর নিয়ে বোনের আর কেদারনাথের চরণ দর্শন সম্ভব ছিল না। আমরা ফিরে এলাম ত্রিযুগীণারায়ন হ'য়ে গৌরীকুণ্ডে দু দিন পর বোনটা মরে গেলো। ঐ মন্দাকিনীর কোনও এক চড়ায় সে আজও শুয়ে আছে। 
কিছু সময় কোন কথা নেই। দোকানদার মশাই এর হাত চলছে। রুটি সেঁকা হচ্ছে। আবার কথা শুরু করলেন তিনি -
 -বাবা আর ফিরলেন না। এখানেই গৌরীমাঈর মন্দিরের পাশে একটা দোকান খুলে বসলেন বাবা। চা বিস্কুট, টুকিটাকি জিনিস। খাওয়ার জোগাড় চাই তো! তবে বাবা বা আমাদের কেউ কোনোদিন কেদারনাথের পথে পা বাড়াইনি। এই দোকানে বসে কত মানুষের তীর্থ দর্শনের গল্প শুনেছি। তাদের পুণ্যের ছোঁয়ায় আমাদের পুন্যলাভ হয়েছে কিনা জানি না। 
 ভবেশদা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন - -আপনার বাবা -মা এখন কোথায়?
 কোন উত্তর নেই। আমরা খাওয়ার থালিতে হাত নাড়ছি। অপেক্ষা করছি কিছু শোনার জন্য। দোকানদার মশাই প্রশ্ন করলেন - 
 -আপনাদের আর রুটি লাগবে নাকি?
  অর্থাৎ উনি আর কথা এগোতে চাইছেন না। আমাদের ও মনে হ'ল, আর দেরী করা উচিত হবে না। ভোর চারটেতে উঠতেই হবে। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে পড়লাম। 
  ব্যালকনিতে সুধীর বাবুর সাথে দেখা হয়ে গেল। বেঁটে খাটো চেহারা। তবে যথেষ্ট বলিষ্ঠ গঠন। জানলাম, কোলকাতার বারাসতে বাড়ী। ওঁরা সাতজন এসেছেন। কেদারনাথ দর্শন করে জীবন সার্থক করবেন। সুধীর বাবুর স্ত্রী, তাঁর ভাই মানে শালাবাবু এবং তাঁর স্ত্রী। এর সাথে দুই পরিবারের তিন ছেলে মেয়ে। ভারত সেবাশ্রমে গিয়েছিলেন, জায়গা মেলেনি। শেষমেষ এইখানে। কাল ভোরে সবাই মিলে হাঁটা লাগাবেন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। ওঁনাদের মনের অসম্ভব জোর দেখে আমরাও মনে বেশ বল পেলাম। শুভেচ্ছা বিনিময় হ'ল। কাল ভোরে দেখা হবে -জানিয়ে রুমে ফিরে এলাম। 
  বাইরে রিমঝিম বৃষ্টির সুর বাজছে। মন্দাকিনী একই রকম বয়ে চলেছে অবিশ্রান্ত গতিতে। আর নয়। এবার সোজা লেপের তলায়। সর্ব ক্লান্তিহরা নিদ্রাদেবীর কোলে পরিতৃপ্তির অবগাহন। (চলবে)
-----

Post a Comment

0 Comments