জ্বলদর্চি

সেমিকোলনের আত্মজীবনী - ৩


সেমিকোলনের আত্মজীবনী // পর্ব -৩ 

সা য় ন


কবির পিঠ ভরা চাবুকের দাগই হল গণতন্ত্র !

ভারভারা রাও কে একটা আগ্নেয়গিরি মতো মনে হচ্ছে। তার সামনে দাঁড়াতে পারছি না, গা'যে ছ্যাঁকা লাগছে। চারপাশে বাংলার কবিগণ মিলে বিশ্বের সর্ব বৃহৎ কবিতা রচনায় রত, কিন্তু একজন কবির পিঠে যখন চাবুক মারা হয়, বর্তমানে তিনি নাকি কোভিড পজিটিভ, তার পরও একটা নির্লজ্জ ভারত(অ)মানবসন্তানদের মনে হয় না একজোট হয়ে না কবির জেলের তালা মুচডে় ভেঙে ফেলি। তাকে কোভিড এর দিকে ঠেলে দেওয়ার পিছনে আরও একটি কারণ, জনমানস থেকে একজন ব্রাত্যজনে রূপান্তরিত করা। 
অবশ্য বঙ্গসন্তানরা এসব দেখবেন কেন! তাদের চোখের সামনে দিয়েই তো একজন বাংলার কবির কলার ধরে, রাস্তার উপর দিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, আমরা সবাই চোখে কালো কাপড় বেঁধে হাততালি দিয়েছি । 
ভারভারাও এর পিছনে একজন বাঙলার কবির ক্ষতের ইতিহাস পাঠ করি আসুন। আসুন দেখি সুবোধ সরকারের পিঠের কালশিটে কতটা শুকিয়েছে আজ।
সোভিয়েত যখন ভেঙে পড়ল, বামপন্থীরা অনাথ হল- ঠিক সুবোধ সরকার যখন অর্পিতা ঘোষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন, একদল লেখক- কবি- সাহিত্যিক- সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ খুলে গেল। ২০১৪ সালে তখন সুবোধ সরকারের ভেতর থেকে আরেকটা সুবোধ সরকারকে কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে দেখলেন। অর্থাৎ ২০১৪-র পর থেকে শুরু হল ‘সুবোধ VS সুবোধ’- এর লড়াই। এই লড়াইয়ের রেফারি সময় আর বইমেলায় প্রতিভাসের নতুন বই- ‘সুবোধ VS সুবোধ’। একটা ডিনামাইট। 
এই বইয়ের ছন্দ থেকে ছিটকে আসে কুৎসা, এক একটা শব্দ AK-47 এর বুলেট। মানুষের মুখগুলো কতখানি অন্ধকারের নীচে চাপা থাকলে কেউ একজন কবিকে গালিগালাজ করতে পারে। প্রতি কবিতার ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে আছে একটা রাতজাগা শিল্পীর হতাশা, একজন বাবার, ছেলেকে নিয়ে ভবিষ্যৎ- স্বপ্ন একটু শান্তিতে বেঁচে থাকা আর সত্যি কথা বলার সাহস। তাঁর কবিতা ধার করেই বলি- “যদি কোন বিষ্ঠা থাকে বসার চেয়ারে/ কেউ এসে বসেছেন, তবু আপনারা/ আড়চোখে দেখে/ মুখ ঢেকে, খবরের কাগজ পড়েন।/ কতদিন খবরের কাগজ দিয়ে মুখ ঢাকবেন?
এই সত্যি কথাগুলো আসলে ‘বাম চিকিচিকি’ হাব আর ভাব নিয়ে যারা বসে থাকে, তাদের ভিতর বাজতে থাকে ‘দম মারো দম’- সেই মুহূর্তে কবি আরেকটা বোমা ফেললেন (লেখা দিয়ে)
‘পোঁদে নেই চাম / তবু চাই চারিদিকে নাম।’
বইয়ের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে লা রোশ ফুকোর, যাঁকে সপ্তদশ শতাব্দীতে ভয় পেত, ধকধক করে কাঁপত ফরাসী রাজতন্ত্র তার একটা বিখ্যাত ‘ম্যাক্সিম’ (নীতি) মনে পড়ে গেল- “স্বার্থান্বেষীরা সব ভাষায় কথা বলতে পারে, সব লোকের ভূমিকায় অভিনয় করতে পারে, এমনকি উদাসীন লোকের ভূমিকায়।” কবিতাগুলো অধিকাংশই টানা গদ্যে লিখিত- কারণ ঝাঁঝ প্রতিটি শব্দের ফাঁকে ফাঁকেই লুকিয়ে থাকে- “ওরা ৩২ বছর জুজু দেখাল.....কিন্তু আজ সকালে উঠে দেখলাম/ নধরকান্তি বিপ্লব নিজেই গলায় দড়ি দিয়ে/ ঝুলে পড়েছে চা বাগানের নিমগাছে।”
নধরকান্তি বিপ্লব’, ‘কলোনিয়াল হারামি’, ‘ম্যানহোলের চাকরি’, ‘জিনস পরা বনলতা সেন’ চিত্রকল্পগুলো তীব্র ব্যঙ্গের অ্যাসিড ছোঁড়ে। সেইসঙ্গে বিভিন্ন ডায়ালেকটিক্স কবিতাগুলোয় এনেছে শ্লেষ আর বিদ্রুপের আগুন, “হরিজনরা কখনও রাষ্ট্রনায়ককে না বলতে পারে না, রাষ্ট্রনায়করা হরিজনকে না বলতে পারে না।’ ‘সেক্স আগে নাকি আগে বিয়ে / ভাবতে ভাবতে দেখি হরিণ পালায় গলি দিয়ে’, ‘একটি চুমু গহন / একটি গভীর/ একটি চুমু আনখশির/ একটি চুমু চরম।’ আসলে এই পক্ষ, ওই পক্ষ, প্রতিপক্ষ, ঘণ্টাখানেক সঙ্গে থাকা মানুষের একটাই দ্বন্দ্ব মনের মধ্যে ‘সুবোধ সরকার এটা করবে ভাবতে পারিনি’ কিংবা ‘উনি এতদিন পর স্ত্রীকে সামনে রেখে নিজেকে রক্ষা করতে চাইলেন’- এইসব দ্বন্দ্ব মুখে ‘গু’ মাখিয়ে এই কষ্ট যেন উত্তর দেয়- “বেশ করেছি শালা। ক্ষমতার জন্য কারোর ধুতির কোঁচা ধরে থাকিনি। কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে চিলির কবি নিকানো পাররা-র কথা মাথায় আসে। বিনোদন আর বিস্ফোরণ দিয়ে তাঁর কবিতা জন্মাত। শব্দে, তথ্যে, রাজনৈতিক চিন্তায়, সরাসরি বলার সাহস- সব কিছুতেই চুরমার করে দিতে চায় ‘আপনার সামনে আরও একজন ধুতি পরা লোক/ নন্দীগ্রামের আগে এক গোধূলি নন্দনে।/ আপনি চা এগিয়ে দিলেন/ তার মানে আপনি চা- ওয়ালা হয়ে গেলেন? কিংবা ‘ব্যবহৃত হতে হতে, খুব কষ্ট পেয়ে/ পশ্চিমবঙ্গ থেকে কার্ল মার্কস যেদিন চলে গেলেন/ আকাশ কালো করে মেঘ ডাকছিল।’

------

Post a Comment

0 Comments