জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / বিমল মণ্ডল


ভয়কে জয় করা

বি ম ল  ম ণ্ড ল 


"একা বসে সংসারের প্রান্ত জানালায়
দিগন্তের নীলিমায় চোখে পড়ে অনন্তের ভাষা। 
আলো আসে ছায়ায় জড়িত 
শিরীষের গাছ হতে শ্যামলের স্নিগ্ধ সখ্য বহি। 
বাজে মনে - নহে দূর, নহে বহু দূর।"
 (আরোগ্য কাব্যগ্রন্থ) 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর দীর্ঘ জীবনে মানবমনের  মধ্যে নানান উপলব্ধির কথা বলেছেন। আজ সারা বিশ্ব তথা ভারতবর্ষে  মানুষের চারপাশে ভয় আর আতঙ্ক যে ভাবে জড়িয়ে ধরেছে তাই সেখান থেকে বেরোবার পথ আকুল হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আর সেই পথ খুঁজতে খুঁজতে মনে পড়ে যায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি, শ্রেষ্ঠ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে। যিনি হৃদয় অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন আর আকুল হয়ে পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন। তিনি মুক্তির আকুলতায় ছিলেন ব্যাকুল। তাই  তিনি বলে ওঠেন -

''দুঃখ ক্লেশে আমি কি ডরাই 
আমি কি তাঁদের  চিনি নাই 
তারা সবে আমারি কি নয়। 
তবে, আশা, কেন এত ভয়।"

সত্যি, এখানে কবি যেভাবে মানুষের মুক্তির পথে খুঁজে নেওয়ার কথা বলেছেন তা বাস্তব। 

আবার এই বিশ্বসংসারের মাঝে একদিকে প্রেম এবং  প্রতিবাদ তিনি তাঁর লেখনীতে প্রকাশ করেছেন। ষোড়শ শতাব্দী থেকে  বাংলার আপামর জনসাধারণ যে প্রেমরস সাগরে ভেসে ছিল তা ঠাকুরের মাধ্যমে সেই প্রেমরসের সমাবেশ ঘটে। তবে এখানে ইউরোপ ছিল তাঁর প্রেরণার উৎস।   তাই রবীন্দ্রনাথকে 'জন্ম রোমান্টিক' বলে দাবি করেছেন বুদ্ধদেব বসু। 

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ঐশ্বর্য পর্বকে রোমান্টিক কাব্যধারার অন্যতম পর্বে  হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। প্রেমের ক্ষেত্রে  তিনি সর্বদা শরীরকে গৌণ মনে করতেন। তাই উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর 'রবীন্দ্র কাব্য পরিক্রমা' গ্রন্থে বলেছেন "যে প্রেম বুভুক্ষিত দৃষ্টিতে দেহের চারপাশে ঘুরিয়া মরে। ব্যক্তি মানুষের বাস্তব দেহ মন যাহার ভিত্তি সেই আবেগময়, আত্মহারা সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়। প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাহাকে ধরা যায় না।"

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষের প্রেম সম্পর্কিত আবেগ আর ধারনার পরিবর্তন যেমন হয় ঠিক তেমনি সময়ের ধারায় টেনে নিয়ে যায় প্রতিবাদকে। যদি আমরা  ভারতবাসী তথা গোটা পৃথিবীর দিকে চেয়ে দেখি সেখানে শুধু কান্না, মৃত্যু, হাহাকার আর সাথে রাজনৈতিক বাজনা। তাই এই মহামারির প্রকোপে  দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে পারি -

" চিত্ত যেথা ভয় শূন্য
  উচ্চ যেথা শির। "      

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি চেতনার পাশাপাশি  প্রতিবাদের  ভাষায় কবি এইভাবে গর্বিত করেছিলেন ভারতবাসীকে। 

কবির শেষ জীবনের অনুভূতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষ সাধারণত কঠিন সত্যের মুখে দাঁড়াতে ভয় পায়। অথচ অনেক স্বপ্ন নিয়ে মানুষ শুরু করে পথ চলা। সেই স্বপ্ন যেন মুকুলিত হয় না, আর আঘাত যখন যেভাবে নেমে আসে মানুষের জীবনে তখন যেন জীবনকে ব্যর্থ বলে মনে হয়। আসলে মৃত্যু মানব জীবনের এক কালো ছায়া। তাই এই বর্তমান সময় মানুষকে মনে করে দেয় যে এই ঝড়কে ভয় পেলে চলবে না। তাই ভয়কে জয় করতে মানুষের একমাত্র উপায় প্রেম ও প্রতিবাদ। কবি শেষ জীবনে এসেও  মানুষকে এই উপলব্ধির কথা শুনিয়েছিলেন।

            
                                                                          

Post a Comment

0 Comments