জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / শুভজিৎ মুখার্জী

রবীন্দ্রসংগীত-এ লিঙ্গভেদ

শু ভ জিৎ  মু খা র্জী 

ইংরেজি ১৯৪১ সাল থেকে ২০২০, এই সুদীর্ঘ ৭৯ বছর পরে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮০ তম প্রয়াণ দিবসের প্রাক্কালে, তাঁকে নিয়ে লেখনী-নির্ভর হতে গিয়ে, শুরুতেই জানাই আমার সশ্রদ্ধ বিনম্র অক্ষমতা--- ব্যাপারটা যেন প্রদীপ শিখার অরুণালোক বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা; আদতে ধৃষ্টতা মাত্র। তবুও, আলোক শক্তির উৎস হিসেবে প্রদীপ ও সূর্যের ন্যূনতম সাধারণ মিলটুকুকে ভরসা করে, এক্ষেত্রে শুধুমাত্র মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু অনুভব করেছি, তারই অংশবিশেষ জ্বলদর্চির পটভূমিতে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার প্রয়াসই আমার কবিপ্রণাম ।

            "সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর---  আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর" (পূজা পর্যায় - ৬৫/৬১৭) । ছোট থেকে বড় (বয়সেই কেবল) হয়ে ওঠার ফাঁকে সব থেকে বেশি যে কথাটা শুনেছি বিভিন্ন জনের কাছে, বিভিন্নভাবে, সেটা হল, রবীন্দ্রনাথ এমনই এক সমুদ্র, যিনি নিজে এবং তার ভাবধারা তথা রচনা সত্যিকারেরই যেন সেই "সীমার মাঝে, অসীম"-এর এক অদ্ভুত জ্বলন্ত উদাহরণ। সাগরের ভৌগোলিক সীমানা আছে --- যেমন সংখ্যার নিরিখে রবীন্দ্র রচনাবলী, তা সে যে কোন রচনাই হোক, বস্তুজগতের সাপেক্ষে সীমাবদ্ধ, নির্দিষ্ট । কিন্তু গভীরতা ? অতল সাগরেরও একটা তলদেশ থাকে, যদিও সেই বিস্তীর্ণ-ব্যপ্ত গভীরতায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মণি-মুক্তোরাজি, জীববৈচিত্র্য, রহস্যময়তা তথা সর্বোপরি অসীম আনন্দঘন উপলব্ধি ---তা সে যে একবার অন্তত ডুব না দিয়েছে, সে কি বুঝবে ? বই পড়ে জ্ঞান অর্জন হতে পারে, অনুভব বা উপলব্ধি, মানসিক আনন্দ লাভ কেবল একাত্মবোধেই সম্ভব ---আমার বিশ্বাস ।

   জীবনের প্রতিনিয়ত ওঠা পড়ায়, দৈনন্দিন কালাশ্বের সওয়ারী হয়ে জাগতিক জ্ঞান আহরণের হাতেখড়ির মুহূর্ত থেকেই, জেনে বা না জেনে খুঁজে চলেছি "প্রেম" নামক সেই পরম রহস্যময় মণিরত্নটি --- প্রাণের ঠাকুরের রচনা সমুদ্রে ডুব দিয়ে--- আর এক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আকর্ষণ করেছে তাঁর গান --- একই সঙ্গে পদ ও  সুরের মেলবন্ধন আমার মনের চোখের দরজা খুলে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অনন্য এক অনির্বচনীয় আনন্দ-সাম্রাজ্যের পরিসরে । অখণ্ড গীতবিতান-এ স্বয়ং রবিঠাকুর-কৃত বিষয় বিন্যাস-এ চোখ রেখে দেখি, শুধু প্রেম-পর্যায় আবার দুটি উপবিভাগে বিভক্ত--- গান (২৭ টি) এবং প্রেম বৈচিত্র (৩৬৮ টি) অর্থাৎ মোট ৩৯৫ টি গান। কিন্তু অবাক লাগে, যখন দেখি অন্যান্য পর্যায়গুলোর মধ্যেও, সাবলীল ভাবে মিশে আছে আরও বহু, বহু প্রেম-গীতি, তার নিজস্ব প্রাসঙ্গিক, সার্বজনীনতার মোড়কে ।

  মূল যে অনুভব প্রকাশ নিমিত্তে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস, তা হল, যতই কপিরাইট উঠে যাক, সবকটি প্রেমময় রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া সকলের পক্ষে শোভা পায় না। যেহেতু কন্ঠসংগীত শব্দ-শক্তি নির্ভর এবং যেহেতু পুরুষ ও নারীর কণ্ঠস্বরের ধরন  আলাদা, তাই শতগুণে শ্রুতি-মধুর হলেও, সুরের খেয়া বেয়ে পদগুলির সাথে একাত্ম হতে গিয়ে কখনো কখনো হোঁচট খেতে হয়। দু'একটা উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করা যাক ।

   ধরা যাক, "কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি," (বিচিত্র পর্যায় - ৭৫/১৪০) গানটির কথা । শ্রদ্ধেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় -এর কণ্ঠে শুনে, চোখ বুজে একাত্ম হয়ে অনুভব করি, "আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা, // মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ ।" ---- কল্পনার চোখে দেখতে পাই, তার 'যুগল ভুরু' সমেত 'কালো হরিণ চোখ'। কিন্তু এই গানটিই যখন কোন মহিলা শিল্পীর কন্ঠে শুনি, তা সে তিনি যত বড় শিল্পীই হোন না কেন, সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন পূর্বক ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে স্বীকার করি, বুকে বড় ধাক্কা লাগে --- মেলাতে অর্থাৎ একাত্ম হতে পারি না। কল্পলোকের বুদবুদের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে, ভীষণ জাগতিক অথচ সুন্দর পদ ও সুরারোপিত একটি সাধারণ (?) গান মাত্র। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ ছড়িয়ে আছে সমগ্র গীতবিতান জুড়ে। যেমন, "বলি, ও আমার গোলাপ-বালা," (প্রেম ও প্রকৃতি - ৫/১০১) গানটি। কেবল পুরুষ কন্ঠেই গানটির যথার্থতা ---- পরিসমাপ্তিতে যেখানে গোলাপ-বালা ( স্ত্রীলিঙ্গ ) সখীর কাছে গোপনে একটি করে চুম্বন দেওয়া ও চাওয়ার আবেদন রয়েছে ।

   আবার এর বিপরীত ক্ষেত্রটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, "কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া" (প্রেম ও প্রকৃতি--- ২০/১০১) গানটি। নির্দিষ্টভাবে এক নারীর অন্তরে সযত্নে, গোপনে লালিত, তার প্রিয়তম সখার প্রতি প্রেমানুভূতি --- কোন পুরুষ কন্ঠে গাওয়া মানে তো গানটিকে সার্বিক ভাবে হত্যা করা।  কিংবা ধরা যাক, "আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী ।" (প্রেম পর্যায় --- ৯১/৩৯৫) গানটি । কখনো পুরুষ কন্ঠে শুনলে, অন্তর্বর্তী পদ -- "সেথা আঁচল পাতব আমার---", কতখানি যে হৃদয় বিদারক হয়, তা সুজন পাঠকের কাছে সহজেই অনুমেয় ।

            কবিগুরুর ২২০০ -এর অধিক সঙ্গীতাবলীর মধ্যে থেকে, শুধুমাত্র জাগতিক নারী-পুরুষের প্রেম প্রকাশিত হয়েছে --- এমন গানের তালিকা, তা সে যে কোন পর্যায়ের বা গীতিনাট্য / নৃত্যনাট্যের অন্তর্গত হোক না কেন, তৈরি করলে তাকে প্রধানত পদগুলির শব্দার্থ অনুযায়ী তিন ভাগে ভাগ করা উচিত বলে আমার মনে হয়েছে । (১) পুরুষ কন্ঠোপযোগী, (২) নারী কন্ঠোপযোগী এবং (৩) উভয় কন্ঠোপযোগী অর্থাৎ যে গান পুরুষ বা নারী যে কেউ গাইলেই সমান অর্থবহ ---যেমন, "তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা," (প্রেম পর্যায় - ১২১/৩৯৫, আবার ব্রহ্মসংগীতও বটে) গানটি।  

    পরিশেষে, আপন অন্তরের যে সুপ্ত বাসনা অকপটে স্বীকার করতে চাই---  সমগ্র গীতবিতান-এর গানগুলির মধ্যে যেগুলোতে ছিঁটেফোঁটাও প্রেম-রস বর্তমান, সেগুলোকে অদূর ভবিষ্যতে লিঙ্গ ভেদে গায়ক-গায়কী নির্ধারণের চেষ্টা করব। আজ এ স্বল্পপরিসরে অন্তত এইটুকুই আমার তরফে সবিনয় শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।

 তথ্যসূত্র :তুলি - কলম প্রকাশিত ( ফাল্গুন ১৪০৮ // ফেব্রুয়ারি ২০০২ ), শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর গীতবিতান(অখন্ড সংস্করণ) ।


Post a Comment

0 Comments