জ্বলদর্চি

২২ শে শ্রাবণ / মঙ্গলপ্রসাদ মাইতি



মৃত্যুহীন রবীন্দ্রনাথ

ম ঙ্গ ল প্র সা দ  মা ই তি

বাংলা ২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিরোধান দিবস। এই দিনটিকে যদি নিছক প্রয়াণদিবস হিসাবেই ভেবে থাকি তবে মনে হয় ভুল করা হবে। আসলে কবির তো মৃত্যু নেই, রবীন্দ্রনাথের মতো কবির তো নয়ই। রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশাতেও যেমন আলোক জ্বেলে গেছেন, মৃত্যুর মধ্য দিয়েও সেই একই আলোর দীপশিখাকে আমাদের জন্য অর্থাত্‍ সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রদীপ্ত করে গেছেন। মানবজমিন কর্ষণ করে এক জীবনে তিনি এত সোনার ফসল ফলিয়েছেন ভাবতে গেলেই আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। যে সোনার ফসলের একটুখানি ছোঁয়ায় আমরা নিত্য-নতুন বেঁচে উঠছি, পথ খুঁজে পাচ্ছি সামনে এগিয়ে যাবার। যে মৃত্যুর জন্য আমরা সব সময় ভীত, সন্ত্রস্ত সেই মৃত্যুকেও তিনি অতি সহজ-সাধারণ ভাবে নিয়েছেন। “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?” এই অমোঘ সত্যটিকে কবি রবীন্দ্রনাথ, মানুষ রবীন্দ্রনাথ যেন একান্ত নিজের করে নিয়েছিলেন। তাইতো তিনি সাধারণ খাওয়া-পরার মতো ‘মরণ’কেও বলতে পেরেছিলেন- 

–“মরণ রে,
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট
রক্ত কমলকর, রক্ত অধরপুট,
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান।
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান॥”
   
   আসলে রবীন্দ্রনাথ এমন এক বর্ণময় চরিত্র, এমন এক অসাধারণ স্তরের মানুষ যাঁর সম্বন্ধে কিছু বলতে গেলে কোনখান শুরু করবো সেটাই আমরা ভেবে পাই না। স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যুতে এই মানুষটির কথা শেষ হয়ে যায় না, ফুরিয়ে যায় না। তাইতো তিনি সর্বত্র এবং সব সময়ের জন্যই ঘুরে ফিরে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে যান। রোগে-তাপে, শোকে-আনন্দে, সাফল্যে-ব্যর্থতায়, দুঃখে-সুখে তিনি আমাদের বাঁচার মন্ত্র, জীবনের প্রেরণা। সর্বক্ষণের জন্যই তিনি আছেন। আজ-কাল-পরশুর ক্ষণকালে তাঁকে বাঁধা যাবে না। তিনি বিশ্বজনীন, এবং অনন্ত কালের জন্য। এক কথায় রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন তা কোনোদিনই শেষ হবার নয়। বরং নিত্য-নতুন ভাবনা-চিন্তার জন্ম দিয়ে আমাদের তিনি ঋদ্ধ করে যাবেন। 
   ২০২০ সাল আমাদের কাছে এক অন্ধকারের কাল। মারণব্যাধি কোভিড নাইন্টিনের প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্বের জনজীবন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। আমাদের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ প্রায় নষ্ট। একটা দমবন্ধ পরিবেশ আমাদের সামনে উপস্থিত। আমরা ভারতবাসীরাও তার থেকে মুক্ত নই। এমনই একটা অভূতপূর্ব পরিবেশের মধ্য দিয়ে আমরা এবারে কবিগুরুর জন্মদিন ২৫ বৈশাখ পালন করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম খুব শীঘ্রই হয়তো আমরা এই অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরে আসতে পারব, আমরা ফিরতে পারব আগের মতোই স্বাভাবিক পরিবেশে। কিন্তু তা হয়নি। সেই বদ্ধজীবনের কাল কাটাতে কাটাতেই আবার আমরা কবিগুরুর মৃত্যুদিন ২২ শ্রাবণে উপস্থিত হয়েছি। আমরা মনে করি কবিগুরুর এই দিনটিকে সামনে রেখেই এই মহাসঙ্কটকাল পার হবই। কবিগুরুর জন্মদিনের মতোই তাঁর মৃত্যুদিনও আমাদের কাছে একবুক প্রত্যয়, একবুক বিশ্বাস, একবুক প্রাণ ভরে নেওয়া শ্বাস। ২২ শ্রাবণকে আমরা নিছক কান্নার মধ্য দিয়ে স্মরণ করবো না, তাঁকে স্মরণ করবো বেঁচে থাকার আলো হিসাবে। আমি মনে করি এই রবীন্দ্রনাথ যখন আমাদের আছেন তখন ভয় পাবার কোনো কারণ নেই। তিনি আমাদের শক্তি, তিনি আমাদের পরিত্রাতা। অনেক দুর্মুহূর্ত, অনেক সঙ্কট আমরা পেরিয়ে এসেছি রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে। আজকের ভয়াল- ভয়ঙ্কর সময়কেও অনায়াসে জয় করবো রবীন্দ্রনাথকে সামনে রেখেই। তিনি আমাদের আলোর দূত, তিনিই পথ দেখাবেন। তিনি মৃত্যুহীন, তিনি চিরজীবী।




Post a Comment

0 Comments