জ্বলদর্চি

কবিতার তৃতীয় ভুবনে - ২




কবিতার তৃতীয় ভুবনে, কণ্ঠে – উচ্চারণে 

পর্ব- ২

আ র ণ্য ক ব সু 


কেন কবিতার কাছে ফিরে ফিরে আসি


কবিতা যখন আমাকে কাঁদায় হাসায়,

ট্রেনের জানালা টপকে আকাশে ভাসায়;

আমার আমিকে আবিষ্কারের শেষে,

কবিতা আমার স্বপ্ন নিরুদ্দেশের।


প্রিয় কবিতা বন্ধুরা, এই ধারাবাহিক লেখার দ্বিতীয় পর্বে এসে ভাবগম্ভীর একটি সঙ্গীতের কথা মনে পড়ে গেল – জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই …….. কবিতার কথা বলতে গিয়ে গানের কথা মনে আসল কেন? আসলে কবিতা আর গান পরস্পরের এমনই পরিপূরক যে ভালো গান শুনতে শুনতে কবিতার কথা মনে পড়ে, আবার কবিতার শব্দ ছুঁয়ে উঠে আসে সঙ্গীতের মূর্চ্ছণা। আমার একটি সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় প্রয়াত কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায় লিখেছেন – “এ এক বিরল সৌভাগ্য যে এমন কোনো বাঙালী পাওয়া যাবেনা যিনি কবিতায় কথা বলতে চান না।....... কবিতায় কথা না বললে আমাদের কথা শেষ হয় না”।এখানেই সেই প্রাণজুড়োনো ভাবসঙ্গীতের অনুসঙ্গ এসে গেল। যেন গভীরতার অতলে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ এই গানটি ধরেছেন - জুড়াইতে চাই কোথায় জুড়াই ……..

আমি এই পর্বেও বাচিক শিল্পের আলোচনার আগে কবিতার কাছে পৌঁছনোর দু-একটা ব্যক্তিগত স্মৃতি আলোচনা করবো। পাঁচ বছর বয়সে মায়ের হারমোনিয়ামের সরগম থেকে উঠে গিয়ে বাবার অচর্চিত কণ্ঠে শোনা কবিগুরুর সোনার তরী আমাকে বিস্ময়ের শেষ বিন্দুতে এনে ফেলেছিল - “শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি, যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী”। আমি বাবা-মা কে পাগল করে দিয়েছিলাম প্রশ্নে প্রশ্নে – তারপরে কী হল? বহুদিন পরে প্রথম যৌবনের শুরুতে, জীবনানন্দের কবিতা - আট বছর আগের একদিন, আমাকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল - আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত করে..... আমি ভাবতে ভাবতে আবার পাগল হয়ে গেলাম।ঠিক কতটা ক্লান্ত হলে চাঁদ ডুবে যাওয়ার পরে একটা মানুষ একগাছা দড়ি হাতে অশ্বথ্থের কাছে একা একা চলে যায়! আমি একই সঙ্গে পথের কবি বিভূতিভূষণ আর রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দকে আঁকড়ে বাকি জীবনটা কাটাবো ঠিক করে ফেললাম।এই বুড়ো বয়সে এসেও যে ধারণা থেকে আমি সরে যাইনি। স্বরলিপির খাঁচাবন্দী গানের পাতা থেকে উড়ে গিয়ে স্বরলিপিহীন কবিতার শঙ্খচিল সেই কবে আমার মাধুকরীর ঝুলিতে একটা সোনালি পালক রেখে দিয়ে উড়ে গেল, যা দিয়ে আমি আজও কবিতাই লিখে চলেছি।এই আমার কবি জন্মের অন্তরতম কথা।

সালটা বোধহয় ষাটের দশকের শেষের কোনো একটা বছর, আনন্দবাজারের সিনেমার পাতায় চিরস্মরণীয় পরিচালক তপন সিংহের একটি অসামান্য ছবি, আপনজন’এর বিজ্ঞাপন দেখে কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো মনে হয়েছিল নিজেকে।একটা ইঁট বার করা দেওয়ালের গায়ে কয়েকটি কবিতার লাইন – সেই রাজনৈতিক অস্থিরতার মুহূর্তগুলোকে ছন্দোময় কাব্যে দেগে দিয়েছিল যেন। কী ছিল সেই কবিতার কথাগুলো? - স্কুল কলেজে খিল।রাস্তায় মিছিল। ক্র্যাকারে কাঁপে রাজপথ, কিনু-গোয়ালার গলি। হিরের টুকরো ছেলেরা সব অশ্বমেধের বলি।বারুদ গন্ধ বুকে নিয়ে আকাশে ওঠে জোছনা।ময়লা হাতে যেন ওকে ছুঁস না। ওরে মন, পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।

আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি, সত্তর দশকের নকশাল আন্দোলনকে নিয়ে লেখা, কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্যর মহাকাব্যিক কবিতা – গান্ধীনগরে এক রাত্রি - পড়বার পর, আমার সারা শরীর জুড়ে জলপ্রপাতের মতো যে জ্বর-জ্বর ভাব নেমেছিল, তা কোনো প্যারাসিটামলের ছোঁয়ায় নিরাময় হয়নি।ইয়েস, আজও হয়নি। পাঠক, মনে করুন সেই শেষ দুটো লাইন – উনুন জ্বলেনি আর, শুধু বেড়ার ধারেই সেই ডানপিটের তেজি রক্তধারা, গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা.......

আমি আজও ঘোর শ্রাবণ-বর্ষণের কোনো সন্ধ্যায়, বাস্তবের জমি থেকে উড়ে গিয়ে সেই সত্তর দশকের গোড়ার যাদবপুরের গান্ধীকলোনীর কোনো চায়ের দোকানের নড়়বড়ে বেঞ্চে বসে থাকি; যদি একবার পুলিশের গুলিতে মৃত সেই ডানপিটে গোকুলকে দেখতে পাই, যে দুনিয়াটাকে পাল্টে দেবার স্বপ্ন দেখেছিল!

এই পর্বের শেষে আর একটা ছোট্ট কবিতাময় অভিজ্ঞতার কথা বলে যাই।সর্বজনশ্রদ্ধেয়া অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র প্রয়াত হয়েছেন তার কিছুদিন আগে।নাট্যাচার্য শম্ভু মিত্রর শরীরও ভালো নয়, সেই সময় কলকাতার আকাদেমি মঞ্চে শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে শুনেছিলাম গীতাঞ্জলির কবিতা – চাইগো আমি তোমারে চাই, তোমারেই আমি চাই...... 

মনে পড়ছে, ভীষণভাবে মনে পড়ছে - সেই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে বিরতির সময় আমি ও আমার স্ত্রী রূপা চুপ করে বসে ছিলাম আমাদের আসনে।হলে আলো জ্বলছে, সবাই আমাদের দেখছে যে আমরা দুজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছি।অসহায়, কী পরিত্রাণহীন অসহায় সেই কবিতার মুহূর্ত, যখন কবিতার কাছে নতজানু হয় জীবনের সমস্ত উপলব্ধি। 

প্রিয় কবিতা বন্ধুরা, বলুনতো কবিতা ছেড়ে কখনো চলে যাওয়া যায়? কেউ যেতে পারে!

পরের সপ্তাহে বাচিকশিল্পের আঙিনায় পা রাখবো।



Post a Comment

1 Comments

  1. অসাধারণ লেখা।না কবিতা ছাড়া বাঁচতে পারি না।যে দুটি কবিতার কথা বললেন 'সোনারতরী ' আর 'আট বছর আগের একদিন ' তা আজও আমাকে আলোড়িত করে।এ দুটি কবিতা আমি আবৃত্তি করতে করতে প্রথম জীবনে শিহরিত হয়েছি।আর 'গান্ধী নগরে রাত্রি' আমার প্রিয় কাব্যগ্রন্থ।কবিতা নিয়ে আপনার এই লেখাও আমাকে আলোড়িত করল।ভালো থাকবেন।

    ReplyDelete