প্রসূন কাঞ্জিলাল
ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য এক নাম হলো- রাজনারায়ণ বসু।বিখ্যাত এই শিক্ষাবিদ ব্রাহ্মধর্ম প্রচার ও প্রসার এবং বিধবাবিবাহ আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।রাজনারায়ণ বসুর জন্ম ১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দে ৭ ই সেপ্টেম্বর,দ: ২৪ পরগনা জেলার বোড়াল গ্রামে।তাঁর পিতা ছিলেন নন্দকিশোর বসু।
তার পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন কলকাতার গড় গোবিন্দপুরে। রাজনারায়ণ বসুর ভাতুষ্পুত্র ছিলেন বীর বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে হত্যা করার জন্য প্রেসিডেন্সি জেলে যাঁর ফাঁসি হয়েছিল।রাজনারায়ণ বসুর দৌহিত্র ছিলেন ঋষি অরবিন্দ।
পরবর্তীকালে তিনি তাঁর মাতামহ রাজনারায়ণ বসুকে স্মরণ করে এক সনেট রচনা করেছিলেন।
ওনার লেখাপড়া প্রথমে কলকাতার হেয়ার স্কুলে এবং পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজে হয়েছিল (১৮৪০-৪৫)।তিনি ছাত্রাবস্থায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।তিনি হিন্দু কলেজে উচ্চতর বৃত্তি লাভ করেন।১৮৪৫ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তাঁর পিতার দেহাবসান ঘটে।এরপর ১৮৪৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন।এই সময় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে উপনিষদের ইংরেজি অনুবাদক হিসাবে ব্রাহ্মসমাজের কাজে নিয়োজিত করেন।
তারপর ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দের মে মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।
এরপর তিনি ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।তিনি ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দের থেকে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন।
এই সময়কালে তার কর্মজীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ – মেদিনীপুর জেলা স্কুলের সামগ্রিক উন্নতি সাধন, বালিকা বিদ্যালয় সংস্থাপন, মেদিনীপুর ব্রাহ্মসমাজের পুনঃ সংশোধন ও উন্নতি সাধন, জাতীয় গৌরব সম্পাদনা সভা সংস্থাপন, ধর্মতত্ত্ব দীপিকা এবং ব্রাহ্ম সাধন প্রমুখ গ্রন্থ রচনা ও সুরাপান নিবারণী সভা সংস্থাপন প্রভৃতি।
মেদিনীপুরে রাজনারায়ণ বসুর সংস্কার প্রচেষ্টার সূত্রপাত মূলত: শিক্ষা কেন্দ্রিক সংস্কারই ছিল।তার প্রচেষ্টায় উনবিংশ শতকের মেদিনীপুর জেলার শিক্ষা চিত্রে কিছু সংযোজন ঘটেছিল।তিনি শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সমাজের সমগ্র স্তরে।নিজের শিক্ষাগ্রহণকালে , বোড়াল থেকে তাকে কলকাতায় ছুটে যেতে হয়েছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য।তাই তিনি মেদিনীপুরে কার্যকর গ্রহণ করার পরে সেখানকার শিক্ষা ধারারও আমূল পরিবর্তন ঘটাতে চেয়েছিলেন।তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন মফস্বল শহর মেদিনীপুরেও উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন ঘটাতে।তিনি মেদিনীপুরেও আধুনিক শিক্ষার আবহাওয়া তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
মেদিনীপুরের শিক্ষাক্ষেত্রের ইতিহাসে তার শিক্ষা-সংস্কারক রূপটিই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে।কেবল মৌখিক প্রতিশ্রুতিই না,বরং লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন।তার উদ্দেশ্য ছিল মুষ্টিমেয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শিক্ষাকে সর্বস্তরের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
রাজনারায়ণ বসু যখন মেদিনীপুরে পদার্পণ করেছিলেন, তৎকালীন মেদিনীপুরের শিক্ষাচিত্র সম্পর্কে সেকালের বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারা যায় -
১৮০২ সালে এইচ. স্ট্র্যাচি-র প্রতিবেদনে মেদিনীপুরের সাধারণ জনগণের মধ্যে আধুনিক শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহকে প্রায় অনুপস্থিত বলা হয়েছিল।
১৮৫২ সালে মেদিনীপুরের কালেক্টর এইচ. ভি. বেলী-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল যে, মূলতঃ নতুন সরকারি চাকরিতে নিয়োগের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিবেচিত হওয়ায়, তখনকার মেদিনীপুর জেলার অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ক্রমবর্ধমান আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
সেই পরিস্থিতিতে ১৮৫১ সালে রাজনারায়ণ মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র থেকে জানা যায় মেদিনীপুর স্কুলের লক্ষণীয় উন্নতি ঘটেছিল।তার শিক্ষাদানের পদ্ধতি ও ছিল অভিনব।কোন শব্দার্থ ব্যাখ্যা করবার জন্য তো প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রশ্নাবলীর উত্থাপন,কিংবা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষামূলক গল্পের অবতারণা – এ সমস্ত কিছুকেই তিনি শিক্ষাদানের এক অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে গণ্য করতেন।শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তির চালনা ও বক্তৃতাশক্তির বৃদ্ধির জন্য তিনি ছাত্রদের নিয়ে বিতর্ক সভা গড়ে তুলেছিলেন।তার সময়ে পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও, প্রতিটি ছাত্রকে অন্য কোন নির্দিষ্ট পুস্তক পাঠের নির্দেশও দেয়া হতো। যেটির উপর ভিত্তি করে তার পরীক্ষায় মূল্যায়ন করা হতো। বিদ্যা চর্চার পাশাপাশি নিয়মিত শারীরচর্চার উপযুক্ত পরিকাঠামো গঠনেও,রাজনারায়ণ যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন;তা সেই যুগের পক্ষে নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।তিনি তৎকালীন মেদনীপুরের সেচ বিভাগের কর্তা ক্যাপ্টেন রিডল সাহেবের পরামর্শ অনুযায়ী সরকারী উদ্যোগ ছাড়াই কেবলমাত্র অভিভাবক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের অনুদানের সাহায্যে শিক্ষার্থীদের জন্য ক্রীড়াঙ্গন নির্মাণ এবং তাদের শ্রেণিকক্ষে বসার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত বেঞ্চের ব্যবস্থা করেছিলেন।১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে শিক্ষা বিষয়ক সরকারি রিপোর্টগুলোতে রাজনারায়ণ বসু ও তাঁর স্কুলের সম্পর্কে সদর্থক মানসিকতার প্রকাশ পেয়েছিল।১৮৫৭-,৫৮ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষা বিষয়ক সরকারী রিপোর্টে একজন প্রধান শিক্ষক হিসেবে রাজনারায়ণ বসু বয়সে প্রশংসা করে বলা হয়েছিল যে বিদ্যালয়ের স্বার্থ সম্পর্কিত সকল বিষয় তিনি সর্বদা সচেতন ছিলেন।বস্তুত মেদিনীপুরবাসীর চোখে রাজনারায়ণ বসু তখন উচ্চমানের পাশ্চাত্য শিক্ষার,একজন বাস্তব রূপকার হয়ে উঠেছিলেন।রাজনারায়ণ বসুর যোগদানকালে মেদিনীপুর জেলা স্কুলের ছাত্রসংখ্যা যা ছিল, তার অবসর গ্রহণকালে সেই সংখ্যা প্রায় চার গুণে পরিণত হয়েছিল।তার সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থী সমন্বয়ে বিদ্যালয়ে এক দরিদ্র ভান্ডার খোলা হয়েছিল,যেটি একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলেই পরিগণিত হয়।
তিনি যে তাঁর ছাত্রদের প্রতি কি ধরণের স্নেহশীল ছিলেন, সেটার প্রমাণ তাঁর নিজের লেখাতেই পাওয়া যায়। তিনি মেদিনীপুর থেকে চলে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরে দেওঘরে অবস্থানকালে, মেদিনীপুর জেলা স্কুলের প্রাক্তন এক ছাত্র (যাঁকে তিনি ‘শ্রীযুক্ত ক’ হিসেবে নিজের লেখায় উল্লেখ করেছিলেন) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। যিনি ওই সময়ে দেওঘরের স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষকের পদে নিযুক্ত ছিলেন। সেই সাক্ষাতের প্রতিক্রিয়া রাজনারায়ণ তাঁর প্রাত্যহিক বিবরণীতে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “পুরাতন ছাত্রদিগকে দেখিলে কি আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইতে হয়, অধিক বয়স্ক হইলেও বোধহয় যেন তিনি সেই অল্পবয়স্ক আছেন।” তাঁর প্রিয় ছাত্র ঈশানচন্দ্র বসুর সাহিত্যকর্মের পিছনে, রাজনারায়ণ বসুর কাছে তাঁর পাঠগ্রহণের অভিজ্ঞতাই প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল। এমনকি রাজনারায়ণের ‘সেকালের সঙ্গে একালের তুলনা’ বিষয়ক বক্তৃতার লিখিতরূপ তিনিই তৈরি করেছিলেন, যেটার মাধ্যমে পরবর্তীকালে সেটা ‘সেকাল ও একাল’ গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছিল।
রাজনারায়ণ ব্যক্তিগত ভাবে স্ত্রীশিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন। মেদিনীপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তাঁর সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। সেকালের মেদিনীপুর শহরের মান্যগণ্য ব্যক্তিদের কাছে ঘুরে ঘুরে তিনি নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিলেন। সেটারই ফলশ্রুতিতে ১৮৬১ খ্রীস্টাব্দের ১৯শে জুলাই তারিখে, মেদিনীপুর শহরের মীরবাজারের হনুমানজীর চক্রের কাছে একটি ছোট বাড়ীতে রাজনারায়ণের একক উদ্যোগে ‘অলিগঞ্জ হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’-এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেটিই মেদিনীপুর শহরের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়, এবং সমগ্র মেদিনীপুর জেলার প্রথমদিকের বালিকা বিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল। প্রারম্ভিক পর্বে সেটি একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। তৎকালীন সময়ের মেদিনীপুর শহরের অভিজাত পরিবারের কন্যারা ছাত্রীরূপে ওই বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণে এগিয়ে এসেছিলেন। রাজনারায়ণ সেই বিদ্যালয়ের সম্পাদক ছিলেন। মেদিনীপুর পৌরসভার রেকর্ড থেকে জানা যায় যে, সেই সময়ে বিদ্যালয়টি বঙ্গীয় সমাজ কর্তৃক পরিচালিত হত। তখন ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পণ্ডিতমশায় ও গুরুমা নামে পরিচিত ছিলেন। যেহেতু রাজনারায়ণ ওই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তাই দীর্ঘদিন পরেও মেদিনীপুরের জনমানসে ওই বিদ্যালয়টির গুরুত্ব স্বতন্ত্র ছিল। মেদিনীপুরে শিক্ষাকে সার্বজনীন করে তোলবার লক্ষ্যে রাজনারায়ণের অন্যতম প্রচেষ্টা ছিল শ্রমজীবী বিদ্যালয় স্থাপন। সম্ভবতঃ ১৮৫২-৫৩ খ্রীস্টাব্দে সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ওই বিদ্যালয়টি তৎকালীন প্রেক্ষাপটে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে জুন তারিখের সোমপ্রকাশ পত্রিকায় মেদিনীপুরে শ্রমজীবী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, “শ্রমজীবীদের বিদ্যাশিক্ষার নিমিত্ত একটি রাত্রিকালীন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাজনারায়ণ বসু এটির সম্পাদকীয় কাজের ভার গ্রহণ করেছেন।”
শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনারায়ণের অগ্রণী ভূমিকায়
রাজনারায়ণ দীর্ঘদিন ধরে মেদিনীপুর গর্ভমেন্ট বাংলা বিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির সদস্য ছিলেন, এবং সেই বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়টির উন্নয়নের স্বার্থে যে বিবিধ পদক্ষেপগুলি গৃহীত হয়েছিল, তাতে সমিতির একজন সদস্য হিসেবে তাঁর ভূমিকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেগুলোর মধ্যে কতগুলি বিশেষ বিষয়ের আলোচনা উল্লেখের দাবী রাখে। যেমন, ১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর তারিখে সমিতি স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা গ্রহণ করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল, যেটি ইতিপূর্বে অনুষ্ঠিত হত না।
১৮৬১ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী রাজনারায়ণ ঐ বিদ্যালয়ের সাহিত্যের শিক্ষক মনোনীত হয়েছিলেন। সেই সময়ে মেদিনীপুরে নতুন প্রতিষ্ঠিত মিশনারি পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে, বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের ক্রমশঃ যোগদানে সেখানকার ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়ায়, বিদ্যালয় পরিচালন সমিতির উৎকণ্ঠাও লক্ষ্য করা যায়; কারণ, সেটা ওই বিদ্যালয়ের জনপ্রিয়তা ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল। তখন বিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বার্থে, মিশনারী স্কুল থেকে প্রত্যাগত ছাত্রদের কোন রকমের ‘দন্ড’ ছাড়াই বিদ্যালয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার কথাও সমিতির সভায় অনুমোদন লাভ করেছিল। এমনকি দীর্ঘকাল ধরে অনুপস্থিত ছাত্রদের নামকর্তনের পরিবর্তে ভয়প্রদর্শনই তখন উপরোক্ত কারণে বিধেয় বলে বিবেচিত হয়েছিল। শুধুমাত্র পরিচালন সমিতির সদস্য হিসেবেই নয়, রাজনারায়ণ সময়বিশেষে উক্ত বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবেও নিযুক্ত হয়েছিলেন। সমিতির ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দের ১লা আগস্ট তারিখের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় - “বর্তমান মাসে বিদ্যালয় পর্যবেক্ষণ জন্য শ্রীযুক্তবাবু রাজনারায়ণ বসু মহাশয় তত্ত্বাবধায়ক নির্দিষ্ট হইলেন।”
গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠায়
মেদিনীপুরের প্রথম সাধারণ গ্রন্থাগারটি ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল।সেযুগে প্রাচীন মফস্বল শহরে গ্রন্থাগার স্থাপন,শিক্ষার প্রসারণের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।প্রথম পর্বে রাজনারায়ণ বসু ওই গ্রন্থাগারের সম্পাদক ছিলেন।ওই গ্রন্থাগারটির জন্য নানাবিধ পুস্তক ক্রয় বা সংগ্রহ করার ব্যাপারে তিনি যথেষ্ট সচেষ্ট ছিলেন।এই সময়েই পশু মেদিনীপুর লাইব্রেরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ভিত্তিক লিখিত বিবরণী প্রকাশ করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতকে মেদিনীপুর জেলার ওই সাধারণ গ্রন্থাগারটির প্রতিস্থাপনে রাজনারায়ণ বসুর সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন জেলা কালেক্টর হেনরি ভিনসেন্ট বেলি সাহেবও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
ব্রাহ্মধর্মের পুনঃসংস্কার ও প্রসারে
-- “হিন্দু কলেজে পড়িবার সময় আমার ধর্ম্মতে পরপর কতকগুলি পরিবর্তন হয়; কিন্তু উনবিংশ বৎসরের সময় পরম শ্রদ্ধাস্পদ শ্রীযুক্তবাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সঙ্গে আলাপ হইলে যে আদিব্রহ্ম সমাজের ব্রাহ্ম হই, তাহা এখনও আছি। শেভালিয়র র্যামজের ‘সাইরাসেজ ট্যাভেলজ’ পড়িয়া প্রচলিত হিন্দুধর্ম্মে আমার বিশ্বাস বিচলিত হয়। তৎপরে রামমোহন রায়ের ‘অ্যাপীল টুদি ক্রিশ্চিয়ান পাবলিক ইন ফেভর অফ দি প্রিসেপ্টস্ অফ জীসাস’ এবং চ্যানিঙ্গের গ্রন্থ পাঠ করিয়া ইউনিটেরিয়ান খ্রীস্টিয়ান হই, তৎপরে ঈষৎ মুসলমান হই, পরিশেষে কলেজ ছাড়িবার অব্যবহিত পূর্ব্বে হিউম পড়িয়া সংশয়বাদী হই। যে পুস্তক যখনই পাঠ করা যায় তখনই সেইরূপ হওয়া অবশ্য বালকতা বলিতে হইবে। আর তখন যথার্থই বালক ছিলাম।” (আত্মচরিত, রাজনারায়ণ বসু, ৩য় সং, ১২১২ বঙ্গাব্দ, পৃ: ৪৩-৪৪)
“কিন্তু আমার স্ত্রী ও পিতার মৃত্যু আমাকে প্রকৃতিস্থ করিল। পুনরায় ধর্মে আমার বিশ্বাস হইল; কিন্তু এবার আমার পৈতৃক ও সে-সময়ের তত্ত্ববোধিনী সভার প্রচারিত বৈদান্তিক ধর্মে বিশ্বাস হইল।” (আত্মচরিত, রাজনারায়ণ বসু, ৩য় সং, ১২১২ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৪৮) – ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতি বসুর এই নিষ্ঠা আমরণ থেকে গিয়েছিল।কিন্তু হিন্দু বা ব্রাহ্ম বলে পৃথক দুটি অস্তিত্ব রাজনারায়ণ বসুর কাছে কখনোই প্রাধান্য পায়নি।ফলে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণরূপে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সংস্কার মুক্ত।ধর্ম বিষয়টি মধ্যযুগীয় স্বরূপ নিয়ে কোন ধরনের মানসিক অচলায়তনের সৃষ্টি করতে পারেনি তার মনে।বরং তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বমানবতার প্রেমিক।
“যেদিন প্রতিজ্ঞাপত্র স্বাক্ষর করিয়া ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করি, সেদিন আমি স্বগ্রামের দুই-একজন বয়স্ক ব্যক্তিদিগের সহিত তাহা করি। যে দিন আমরা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করি, সে দিন বিস্কুট ও সেরী আনাইয়া ঐ ধৰ্ম্ম গ্রহণ করা হয়। জাতি বিভেদ আমরা মানিনা, উহা দেখাইবার জন্য ঐরূপ করা হয়। খানা খাওয়া ও মদ্যপান করা রীতির জের রামমোহন রায়ের সময় হইতে আমাদের সময় পর্যন্ত টানিয়াছিল, কিন্তু সকলেই যে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের দিন ঐরূপ করিতেন এমন নহে। আমি এই সময়ে অতি পরিমিতরূপে পান করিতাম।” (আত্মচরিত, রাজনারায়ণ বসু, ৩য় সং, ১২১২ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৪৯)
যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভক্তিমূলক ব্রাহ্মধর্মের দ্বারা রাজনারায়ণ বসু তাঁর পিতার অধ্যাত্ম বিশ্বাসকে — ‘ভক্তিরসের জারকে স্নিগ্ধ’ —করে নিয়েছিলেন, তবুও ব্রাহ্মধর্মকে কিন্তু তিনি কখনই সম্পূর্ণভাবে হিন্দুধর্ম নিরপেক্ষ ভাবতে পারেননি।এবং রাজনারায়ণ বসু কিন্তু নিজের জীবনে কোনও এক ধর্মবিষয়ে উগ্র হতে পারেননি, আর সেই কারণেই তিনি হিন্দু ও ব্রাহ্ম— সকলেরই শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন।ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের অনুষঙ্গ হিসেবে রাজনারায়ণ মেদিনীপুরে একটি ব্রহ্ম বিদ্যালয়ও স্থাপন করেছিলেন। ১৭৮২ শকের ২৫শে মাঘ তারিখে কলকাতা থেকে লেখা একটি পত্রে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ওই ব্রহ্ম বিদ্যালয়ের ব্যাপারে রাজনারায়ণের ওপরে নিজের গভীর আস্থা ব্যক্ত করতে গিয়ে লিখেছিলেন, “ব্রহ্ম বিদ্যালয় তোমার দ্বারা যেমন উন্নত হইবে, এমত আমি কেশববাবুর দ্বারাও আশা করিতে পারি না।” ১৮৫২-৫৩ সালে তিনি মেদিনীপুরে ধর্মালোচনা সভা, বিতর্ক সভা ও সাহিত্য উৎসাহিনী সভা স্থাপন করেছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম ভিত্তিক তাঁর লেখা দুটি শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ - ‘ব্রহ্মসাধন’ (১৮৬৬), এবং ‘ধর্মতত্ত্বদীপিকা’ (১৮৫৩-১৮৬৬) - মেদিনীপুরে অবস্থানকালেই রচিত হয়েছিল।
সাহিত্যিকরূপে রাজনারায়ণ বসু ছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একাধারে লেখক ও সমালোচক। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ছিল অসামান্য।
রাজনারায়ণ বসুর সহপাঠীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। বন্ধুকে লেখা মধুকবির চিঠিগুলির মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে রাজনারায়ণ বসুর পাণ্ডিত্যের প্রতি মধুসূদন দত্তের মুগ্ধতার আভাস পাওয়া যায়।
রাজনারায়ণের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এর প্রথম তিনটি সর্গ মধুকবি ডাকযোগে রাজনারায়ণকে পাঠান। মধুসূদনের চিঠির বেশির ভাগই পান মেদিনীপুরে বসে। লেখেন ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকায় বন্ধুর ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যের আলোচনা।
রাজনারায়ণ বসুর সাহিত্য রচনা নিয়ে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন অত্যন্ত গর্বিত।মধুসূদন দত্তের কাছে রাজনারায়ণ বসুর পাণ্ডিত্য কেবলমাত্র তার বলিষ্ঠ লেখনীতেই ছিল না,ছিল তাঁর অতুলনীয় প্রধান শিক্ষকতায়,উপযোগী শিক্ষাদর্শন ও সার্বিক সংস্কার মনস্কতায়।রাজনারায়ণ বসুর চিন্তন ও বিচক্ষণতাকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত খুব গুরুত্ব দিতেন।তিনিই কবিকে সিংহলবিজয়কাব্য রচনা করতে পরামর্শ দেন। মধুকবি ও তাঁর কাব্যিক বন্ধুত্বের আলোচনা বাংলা সাহিত্য প্রেমীদের কাছে রত্নখনির সমান।
হিন্দু কলেজে পড়াকালীন যে ক'জন সহপাঠীর সাথে মধুকবির আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছেন রাজনারায়ণ বোস। কেন তাঁর স্থান দ্বিতীয় তা একটু খুলে বলা দরকার। রাজনারায়ণকে লেখা মধুসূদনের চিঠির সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম।
অন্তত প্রাপ্ত ও প্রকাশিত চিঠির সংখ্যা তাই বলছে। গৌরদাসকে বাদ দিলে, রাজনারায়ণকে লিখেছেন মাত্র ২০টি চিঠি। এদের মধ্যে প্রথমটি লেখা ১৮৬০ সালের ২৪শে এপ্রিল, আর শেষ চিঠিটি ১৮৬২ সালে।
সংখ্যায় কম হলেও, এই ক'টি চিঠির গুরুত্ব বাংলার কাব্যের ইতিহাসে কোনো দিনই ম্লান হবে না। তিনটি বিশেষ কারণে এই চিঠিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।
প্রথমত, কবির কাব্যদর্শন ও তাঁর কাব্যকৃতি সম্বন্ধে একটি প্রামাণ্য দলীল এই চিঠিগুলো। দ্বিতীয়ত, কাব্যসাহিত্য সম্বন্ধে চিরাচরিত ধারণা বনাম আধুনিকতার দ্বন্দ্ব নিয়ে একটি সুন্দর আলোচনা রয়েছে এই চিঠিগুলোতে। তৃতীয়ত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্বন্ধে রাজনারায়ণের পাণ্ডিত্য ও তাঁর বৈদগ্ধের আভাস পেয়ে কবিবন্ধুর মুগ্ধতা-- এই নিয়ে একটি সুন্দর লেখচিত্র এই চিঠিগুলোতে পাওয়া যায়। মধুকবির সার্বিক মূল্যায়নে এই কয়েকটি চিঠি যে কোনো অন্বেষু পাঠক ও গবেষককে দারুন ভাবে সাহায্য করবে।
মধুকবির এই কটি চিঠির নিরিখে তাঁর এই বন্ধুকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে যে কথা বলার লোভ সামলানো যায় না তা হ'ল, খুব কম মানুষই রাজনারায়ণের মত বন্ধু পায়। কবির কাছে তাঁর এই বন্ধু হলেন An honest-hearted and guileless fellow. তাঁর পাণ্ডিত্য তাঁর প্রধান শিক্ষকতায়, তাঁর বৈদগ্ধ তাঁর বলিষ্ঠ লেখায় , তাঁর সমদর্শিতা তাঁর সার্থক সমালোচনায়।
এইসব ঈর্ষণীয় গুণে গুণান্বিত বলেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একজন ডাকসাইটে লেখক ও সমালোচক হয়েছিলেন তিনি। এই পত্রিকাতেই তিনি তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের রিভিউ করবেন এই খবর জানতে পেরে যারপরনাই খুশি মধুকবি। তাই বন্ধুকে লিখেছেন : You deserve my warmest thanks for encouraging me, for, you are, decidedly, one of the 'Representative men' of the day. তাঁর এই কাব্য কেমন ভাবে সমালোচনা করা উচিত সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিখেছেন - If you should review the work, pray, don't spare me because I am your friend. Pitch in into me as much as you think I deserve. I am about the most docile dog that ever wagged a literary tail !
অনুরোধ করেছেন , উনি যেন তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যের রিভিউ এমন ভাবে করেন যাতে তাতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমালোচনার আদর্শ সংমিশ্রণ ঘটে। তাহলেই সেটি একটি উন্নত মানের মূল্যায়ন হবে । অর্থাৎ সেই রিভিউতে যেন এ্যরিস্টটল্, লঙ্গিনাস, কুইন্টিলিয়াস, সাহিত্য দর্পণ, বার্ক, ক্যামেস, এ্যলিশন, এ্যডিশন, ড্রাইডেন ও অন্যান্য ইংরেজ সমালোচকদের দৃষ্টিকোণ উপলব্ধ হয়। কবির চেয়েছেন : You must... review it in such a way (publicly) as to initiate our countrymen into the mysteries of a just and enlightened criticism. কবির এমন উদ্দেশ্যের একমাত্র কারণ ছিল রাজনারায়ণের মাধ্যমে তাঁর দেশবাসীকে ইউরোপীয় সমালোচনার আলোতে দীক্ষিত করা।
আবার বন্ধু বলে বন্ধুর কাছে একটি ব্যক্তিগত অনুরোধও রেখেছেন। তাঁর পরিচিত শিক্ষা আধিকারিককে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যটির গুণমান সম্বন্ধে অবহিত করে বিদ্যালয়ের উচ্চতর শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের জন্য পাঠ্যবই হিসেবে চালু করা যায় কিনা সে ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। যুক্তি হিসেবে লিখেছেন, তাঁর মত শিক্ষকের শিক্ষন পদ্ধতির গুণে নিঃসন্দেহে এই কাব্যের সুনাম ও সুকৃতি জনমানসে ছড়িয়ে পড়বে।
একই চিঠিতেই জানা যায় কীভাবে স্নিগ্ধ-সুন্দর ঊষালগ্ন থেকে হিমেল গোধূলিলগ্ন পর্যন্ত তাঁর সময় কাটে। মধুকবি প্রথম চার কি পাঁচ ঘণ্টা পড়তেন আইনের বই , তারপর যথাক্রমে সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক এবং অবশেষে সেগুলোর অনুশীলনও করতেন।
তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বন্ধুকে রসিকতার ছলে লেখেন-(I began the poem in a joke.) কিন্তু ঘটনাচক্রে তিনি একটি অসাধ্য সাধন করে ফেলেছেন।তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল দেশীয় কাব্যের সংস্কার, শ্রীবৃদ্ধি ও উত্তরণ ঘটানো (I have actually done something that ought to give our national Poetry a good lift)। একই চিঠিতে লিখেছেন -- I would sooner reform the Poetry of my country. তবে একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, তাঁর এই কাব্যাদর্শ কখনোই সফল হবে না যতদিন না পয়ার-রূপ পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তি দেওয়া যায়। এবং যদি সত্যিই মুক্তি দিতে হয়, তাহলে বাংলা কাব্যে একটি নতুন শ্রুতিমধুর কাব্যরীতি প্রবর্তন করা অবশ্যই প্রয়োজন যার কেতাবি নাম হোক ব্ল্যাঙ্ক ভার্স।(Good Blank Verse should be sonorous...)
বন্ধুকে রসিকতা করে বলেছেন, তাঁর লেখা ব্ল্যাঙ্ক ভার্স ইংরেজদের চেয়ে শতগুণ বেশি ভালো! একটি নমুনা হিসেবে পাঠিয়েছেন মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম কাব্যদেবীর বন্দনা (Invocation to the Goddess Of Learning )। আরেকটি সুখবরও যোগ করেছেন এই চিঠিতে : তাঁর একগুচ্ছ ওড্ কেবলমাত্র প্রকাশের অপেক্ষায়। একই সাথে বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর প্রাথমিক অবজ্ঞা ও অবহেলার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন । তারপর লিখেছেন বাংলা কাব্যে ব্ল্যাঙ্ক ভার্স-এর প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি তাঁর মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে তাঁকে আত্যন্তিক ও আন্তরিক শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন ও করবেন ।
এই প্রসঙ্গে নাটকের প্রসঙ্গও এসে গেছে। লিখেছেন, প্রহসন লিখে তিনি মোটেই খুশী নন। তার কারণ, তখনও পর্যন্ত এদেশে কোনো জাতীয় মঞ গড়ে ওঠে নি। এর পরপরই এসেছে শর্মিষ্ঠা ও পদ্মাবতী নাটকের প্রসঙ্গ। লিখেছেন , এই দুটো নাটক রচিত হয়েছে ইউরোপীয় আদলে এবং আরও অন্তত চারটি নাটক ঠিক একই আদলে লিখতে চান তিনি। ঐতিহাসিক কিংবা ওই জাতীয় নাটক লেখার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন এই চিঠিতে। আধুনিক বাংলা নাটকের মিডিয়াম্ কী হবে তা বলতে গিয়ে লিখেছেন, ক্রমে ক্রমে ব্ল্যাঙ্ক ভার্সকেই নাটকের একমাত্র মাধ্যম করতে হবে। এবং তা করতে গিয়ে সাহিত্যদর্পণের অঙ্গুলি হেলন বা তার নীতি নির্দেশকে একেবারে মানা চলবে না। তাঁর নিজের কথায় :
I am of opinion that our dramas should be in Blank Verse and not in prose , but the innovation must be brought about by degrees. If I should live to write other dramas, you may rest assured, I shall not allow myself to be bound down by the dicta of Mr. Biswanath of the Sahitya Darpan.
রাজনারায়ণকে লেখা তাঁর তৃতীয় চিঠিটি যেন একটি হীরের টুকরো। কবির মহাকাব্যিক অগ্রগতির ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিকাশ ধরা আছে এই অমূল্য চিঠিতে। রাজনারায়ণের দৃষ্টিতে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে ত্রুটি কোথায় , কেন ও কীভাবে রাজনারায়ণ দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি নির্দয়, মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় কাণ্ডের প্রারম্ভ, বাবু জ্যোতিন্দ্রমোহন ঠাকুর কীভাবে তাঁকে তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রেরণা যুগিয়েছেন, মাদ্রাজে কী যত্নে তিনি সংস্কৃত ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন, বন্ধু রাজেন্দ্রলালের ব্যাকরণ বিষয়ে অতলান্তিক গভীরতা এবং আরো অনেক অনেক বিষয় লুকিয়ে আছে এই চিঠিতে।
🍂
তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য প্রসঙ্গে আত্মপক্ষ সমর্থনে লিখেছেন, কাব্যটি মোটেই বীররসাত্মক কাব্য নয়, বরঞ্চ বীররসে সিঞ্চিত। আবার মেঘনাদবধ কাব্য প্রসঙ্গে বলেছেন, গ্রীক পুরাণের আলোকে এই মহাকাব্য লেখা হলেও মহাকবি বাল্মীকি থেকে তিনি কিছুই নেন নি। এখানে কল্পনাশক্তির উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই গ্রীক গল্পের কোনো প্রয়োজনই হয় নি। বরঞ্চ একজন গ্রীক লেখক যেভাবে এই কাব্য রচনা করবেন, ঠিক সেই ভাবেই তিনি এটি রচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে কবির কথাগুলো মনে রাখার মতো -- It is my ambition to engraft the exquisite graces of the Greek mythology on our own; in the present poem, I mean to give free scope to my inventing Powers (such as they are) and to borrow as little as I can from Valmiki... I shall not borrow Greek stories but write, rather try to write, as a Greek would have done.
বীররসে সিঞ্চিত মেঘনাদবধ কাব্যের দ্বিতীয় সর্গের প্রারম্ভিক অংশ বন্ধুকে পাঠিয়েছেন । লিখেছেন কীভাবে যুগ যুগ ধরে গ্রীক-রীতি অনুসৃত হয়েছে কাউপার / ক্যুপার অনুদিত হোমারের ইলিয়াডে এবং মিল্টন রচিত প্যারাডাইস লষ্টের প্রথম সর্গে।
এই চিঠিতেই তিনি তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য সম্বন্ধে স্বয়ং বিদ্যাসাগরের প্রতিক্রিয়ার কথাও লিখেছেন। কলকাতার বিদ্বজনদের কাছে যথেষ্ট কদর পেলেও, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে পেয়েছে অবজ্ঞা এই কাব্য বিষয়ে! এতে অবশ্য তিনি বিস্মিত হন নি। তার কারণ, (তাঁর মতে) বিদ্যাসাগর মহাশয় জানেন না এর লেখক কোন্ কোন্ মহাকবির আদর্শকে মাথায় রেখে এই কাব্য রচনা করেছেন কিংবা কোন্ কাব্যিক ঘরানায় তিনি নিজেকে সুস্নাত করেছেন।
এর পরের চিঠি থেকে জানা যায়, কলকাতার পণ্ডিত মহলে মেঘনাদবধ কাব্য যথেষ্টই প্রশংসা কুড়িয়েছে । কবি একান্তই খুশি একথা জেনে। আরও খুশি , এই কাব্যে ব্যবহৃত অলংকারের সুখ্যাতিও করেছেন পণ্ডিতেরা। তবে মেঘনাদবধ কাব্য ছন্দে লেখা হলে আরও ভালো হতো - একথা শুনে তাঁর পছন্দ হয় নি। সখেদে লিখেছেন - Some other Pundits, literary stars of equal magnitude, say-'হাঁ,উত্তম উত্তম অলংকার আছে। মন্দ হয়নি'। But they regret the author did not write in rhyme, that would have made him popular.
ছন্দের ঘোর বিরোধী ছিলেন কবি নিজেই । এবং এটাই হ'ল তাঁর কাব্যদর্শনের মূল কথা। চিঠির শেষ বাক্যে সেই প্রতিবাদ প্রকট হয়ে উঠেছে -- What have I to do with Rhyme?
এর পরের চিঠিতে তিনি তাঁর কাব্যরীতি সম্বন্ধে রাজনারায়ণের অন্যান্য বন্ধুদের সংশয়ের কথা জেনেছেন। তাই রাজনারায়ণকে অনুরোধ করেছেন তিনি যেন তাঁর বন্ধুদেরকে অবশ্যই মিল্টনের প্যারাডাইস লষ্ট পড়তে অনুরোধ করেন। আত্মবিশ্বাসের সাথে লিখেছেন - The fact is, my dear fellow, that the prevalence of Blank Verse in this country, is simply a question of time. Let your friends guide their voices by the pause (asin English Blank Verse) and they will soon swear that this is the noblest measure in the Language. তবে যে বিষয়টি এই প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হ'ল, বন্ধুকে নিশ্চিন্ত করেছেন এই বলে, পড়তে পড়তে এবং শুনতে শুনতে নতুন কাব্যরীতির সাথে পরিচয় হয়ে গেলে অচিরেই তা ভালো লাগবে।
রাজনারায়ণের চিন্তার গভীরতা ও তাঁর বিচক্ষণী পরামর্শকে খুব গুরুত্ব দিতেন তিনি। এই রাজনারায়ণই তাঁকে সিংহলবিজয়কাব্য রচনা করতে পরামর্শ দেন। তাঁর এই মতামত বিষয়ে রাজনারায়ণ অন্য আরেকটি চিঠি লিখেছিলেন তাঁর বন্ধু রাজেন্দ্রলালকে। সে চিঠি ঘটনাচক্রে কবির হাতে এসে যায় এবং কবি সেই চিঠি পড়ে সিংহলবিজয়কাব্য বিষয়ে রাজনারায়ণের মতামত ও পরামর্শ এত ভালো লেগেছিল যে, তিনি সেই চিঠিটি রাজেন্দ্রলালকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেন।
এই চিঠিতে রাজেন্দ্রলাল মিত্র ছাড়া আরও একজন বন্ধুর কথা এসেছে। তাঁর নাম রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রিয় রাজেন্দ্রলাল তাঁর কাছে The jolly youth of Sunro বলে পরিচিত। তার কারণ বোধ হয়, তাঁর জন্ম চব্বিশ পরগনার শুনরা গ্রামে বলে। রঙ্গলালের কাব্যকৃতি সম্বন্ধেও মতামত রয়েছে এই চিঠিতে। তাঁর মতে, রঙ্গলালের টান বাইরন, ম্যুর ও স্কটের প্রতি। অপরপক্ষে , নিজের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন, মহাকাব্যই তাঁর বেশি পছন্দের।
As for me, I never read any poetry except that of Valmiki, Homer, Vyasa, Virgil, Kalidasa, Dante(in translation), Tasso (Do) and Milton. These কবিকুলগুরুs ought to make a fellow a first rate poet if Nature has been gracious to him.
এর পরের চিঠিতে রাজনারায়ণের সাহিত্য রচনা নিয়ে কবিবন্ধু যারপরনাই গর্বিত। রাজনারায়ণ একজন বড় মাপের লেখক --রাজেন্দ্রলালের এই মতামতের সাথে সহমত তিনি। তারপর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে মেঘনাদবধ কাব্য। এই বীররসাশ্রিত কাব্যশৈলী কতটা সার্থক ও সফল হয়েছে সে বিষয়ে আলোকপাত করতে অনুরোধ করেছেন বন্ধুকে। নিজেকে একজন প্রতিভাবান বিপ্লবী বলে দাবি করেও সানুনয়ে অনুরোধ করেছেন -
... my position, as a tremendous literary rebel, demands the consolation and the encouraging sympathy of friendship.
দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বন্ধুকে লিখেছেন -
I ought to rise higher with each poem.
মেঘনাদবধ কাব্য কতদূর এগিয়েছে এবং কীভাবে এগোচ্ছে সেকথা লিখতে গিয়ে বলেছেন মাঝেমধ্যে আলস্য চেপে ধরলেও যখন তিনি নিজেকে প্রাণিত বলে মনে করেন তখন ঝড়ের গতিতে লেখা এগিয়ে চলে। সুতরাং তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁর প্রিয় রাবননন্দনকে নিয়ে তাঁর বন্ধুর সুনির্দিষ্ট মতামত শোনার জন্য। আবেগের বশে লিখেছেন, ঘর শত্রু বিভীষণ না থাকলে মেঘনাদ রামের ক'পি সেনাকে অনায়াসে চুবিয়ে মারতে পারতেন। সখেদে লিখেছেন, মহাকবি বাল্মীকি যদি রামচন্দ্রকে বাঁদর সেনার পরিবর্তে নরসেনায় ভূষিত করতেন , তাহলে মেঘনাদের মৃত্যু নিয়ে তিনি আরও একটি ইলিয়াডও রচনা করতে পারতেন।
চিঠিতে রসিকতাও কম করেন নি। লিখেছেন এই কাব্য রচনার সময় তিনি কখনোই পানদোষে দুষ্ট হন না। রসসিক্ত সেই বাক্যটি কবির নিজের ভাষায় না পড়লে নয় -
I never drink when engaged in writing poetry; for, if I do, I can never put two ideas together!
তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা দিয়ে চিঠিটি শেষ হয়েছে। ব্ল্যাঙ্ক ভার্স তাঁর প্রিয় শৈলী হলেও, তিনি ঠিক করেছেন ব্ল্যাঙ্ক ভার্স-এর পরিবর্তে ছন্দের কবিতা লিখবেন । এবং সেই শৈলীর নাম হবে ওটাভা রাইমা (Ottava Rima)। এর জন্মস্থান ইতালি। লিখেছেন :
I have made up my mind to write (Deo Volente!) three short poems in Blank Verse, and then do something in rhyme; don't fancy I am going to inflict and on you. No! I mean to construct a stanza like the Italian Ottava Rima and write a romantic tale in it...
ভাষার অগ্রগতি ও উন্নতিসাধনে রাজনারায়ণ বসুর চিন্তন, মনন অবশ্যই আজও আলোচনার শীর্ষ-বিষয়।
“জাতীয় ভাষার উন্নতিসাধনের প্রতি জাতীয় উন্নতি নির্ভর করে”- রাজনারায়ণ বসু (বাঙ্গলাভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা)।
মাতৃভাষার প্রাধান্য দান ও মাতৃভাষাযোগে প্রগতির দ্রুত প্রসারই তৎকালীন বঙ্গদেশীয় নবজাগরণের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল।তিনি ইংরেজি ও বাংলা ভাষার সাহিত্যের তুলনামূলক বিচারের দ্বারা তৎকালীন পাঠকগণকে করে তুলেছিলেন সাহিত্যের মান সম্পর্কে সচেতন।
তাঁর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থগুলি হল - রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা (১ম ভাগ-১৮৫৫, ২য় ভাগ-১৮৭০),ব্রাহ্ম সাধন (১৮৬৫),ধর্মতত্ত্বদীপিকা (১ম ভাগ-১৮৬৬, ২য় ভাগ-১৮৬৭),আত্মীয় সভার সদস্যদের বৃত্তান্ত (১৮৬৭),হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা (১৮৭৩),সেকাল আর একাল (১৮৭৪),ব্রাহ্মধর্মের উচ্চ,আদর্শ ও আমাদিগের আধ্যাত্মিক অভাব (১৮৭৫),হিন্দু অথবা প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিবৃত্ত (১৮৭৬), বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা (১৮৭৮),বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খন্ড-১৮৮২),তাম্বুলোপ হার (১৮৮৬),সারধর্ম (১৮৮৬),বৃদ্ধ হিন্দুর আশা (১৮৮৭),রাজনারায়ণ বসুর আত্মচরিত (১৯০৯) প্রভৃতি।এছাড়াও তিনি ‘কঠ,কেন,মুন্ডক ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদ’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
বিধবাবিবাহের প্রচার ও প্রসারে রাজনারায়ণ বসুর অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, এছাড়াও ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তির সুপরিচালনার প্রতি প্রখর দৃষ্টি রেখেই তিনি বিভিন্ন সভা-সমিতি স্থাপন ও সমাজ সংস্কারের নানা পন্থা গ্রহণ করেছিলেন।টমসন বায়রন ও স্পেনসারের প্রত্যক্ষ প্রভাব তার স্বদেশ প্রীতির ভাবধারাকে আরো গভীর করে তুলেছিল।সুরাপান নিবারণী ও জাতীয় গৌরব সম্পাদনা সভার মাধ্যমে তার নিজ আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করবার প্রচেষ্টাই পরিলক্ষিত হয়।
জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার সূচনাও হয়েছিল মেদিনীপুরে। সভার মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয় ভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। এই সভার অনুপ্রেরণাতেই নবগোপাল মিত্র কলকাতায় হিন্দুমেলার পরিকল্পনা করেন। স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ সভার সভ্যরা ‘গুডনাইট’-এর বদলে ‘সুরজনী’ বলা অভ্যেস করেন। পয়লা জানুয়ারির বদলে বৈশাখের প্রথম দিন নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের রীতি চালুর চেষ্টা করেন। সভ্যদের পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজি বলা ছিল কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। একটি ইংরেজি শব্দ বললে এক পয়সা করে জরিমানা হত। এ নিয়ে অবশ্য রাজনারায়ণকে অনেক রসিকতা সহ্য করতে হয়।
“তাঁহার (রাজনারায়ণ বসু) নিকট হইতে বাঙ্গালী রাজা বিজয় সিংহের সিংহল বিজয়ের কাহিনীটি প্রাপ্ত হই। এই বাঙ্গালী বীরের কাহিনী বলিতে বলিতে গর্বে তাঁহার মুখমণ্ডল উজ্জল হইয়া উঠিত। নবগোপাল মিত্র মহাশয় রাজনারায়ণ বাবুর নিকট হইতেই তাঁহার স্বদেশী মেলা প্রবর্তনের প্রেরণা লাভ করেন।” (Men I have seen, Shibnath Shastri, p- 84) – শিবনাথ শাস্ত্রী।
প্রাচীন পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক বীর চরিত্রের পুনরায় গৌরবোজ্জ্বল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তৎকালীন দেশীয় বর্গের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও আত্মবিশ্বাসের ভাবোন্মেষ ঘটানোই ছিল তাঁর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টায় তিনি ছিলেন সদাসচেষ্ট।
রাজনারায়ণ বসু ছিলেন সুবক্তা।তাঁর বক্তৃতার মাধ্যমে শ্রোতৃবর্গের অনেককেই তিনি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১৮৭৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠতা’ নামক এক বক্তৃতায় তিনি হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বসহ পাশ্চাত্যবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেন।তার বৃদ্ধহিন্দুর আশা বক্তৃতাটি ছিল অসাম্প্রদায়িক।তিনি নিজেকে ‘Hindu Theist' বলে মনে করতেন।
১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে বদলি হয়ে পঁচিশ বছরের রাজনারায়ণ বসু যোগ দিয়েছিলেন মেদিনীপুর গভর্নমেন্ট জিলা স্কুলে। তিনি এসেছিলেন হিন্দু কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র, প্রগতিশীল ব্রাহ্মনেতা পরিচয়ে কিন্তু এই শহর তাঁকে বদলে দিয়েছিল ঋষি রাজনারায়ণে। নিজেই লিখেছেন, জনসাধারণের কাছে তিনি ‘মেদিনীপুরের রাজনারায়ণ বসু’ নামে পরিচিত। আত্মকথার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে শহর মেদিনীপুরের কথা।
১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে স্বাস্থ্যের কারণে সহসাই প্রিয় মেদিনীপুর শহর ছেড়ে যান রাজনারায়ণ। শহরবাসী কোনও বিদায়-সংবর্ধনারও আয়োজন করতে পারেননি। পরে শহরবাসীর পক্ষে ১৬৫ জনের স্বাক্ষর করা বিদায়জ্ঞাপক অভিনন্দন বার্তা রাজনারায়ণকে পাঠানো হয়। সঙ্গে ছিল ৭০০ টাকা। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মেদিনীপুরবাসী তাঁদের প্রিয় প্রধান শিক্ষকের জন্য একটি বসতবাড়ি নির্মাণ করে দেন। পরে তাঁর স্মৃতিতে মেদিনীপুরে গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়।
১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৮ই সেপ্টেম্বর এই মহান শিক্ষাব্রতী ইহলোক ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন।
তাঁর মৃত্যুর পর,তাঁর অনুগামীরা ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘হিন্দু মহাসভা' নামক এক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন।
এই মহান বাঙালী চিন্তাবিদের কর্মকান্ডের সার্থকতা কেবলমাত্র শিক্ষা-সংস্কারকরূপেই সীমাবদ্ধ ছিল না,তিনি ছিলেন একাধারে সুলেখক,অনুবাদক,বিশিষ্ট সমালোচক, ব্রাহ্মধর্মের সংশোধনকারী এবং বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদী এক ব্যক্তিত্ব।তাঁর প্রজ্ঞার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছিল তৎকালীন বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষ।
তথ্যসূত্র
১- Reports of H. Strachey, Judge and Magistrate of Midnapore, to George Dowdeswell, Esq. secretary to Government, in the Judicial and Revenue Department on 30th January, 1802.
২- Memoranda of Midnapore, H. V. Bayley.
৩- General Report on Public Instruction in the Lower Provinces of the Bengal Presidency for1850-51.
৪- অত্যচরিত, রাজনারায়ণ বসু, ৪র্থ সংস্করণ।
৫- রাজনারায়ণ বসু ও তৎকালীন মেদিনীপুর, যোগেশচন্দ্র বসু।
৬- রাজনারায়ণ বসু: জীবন ও সাহিত্য, অশ্রু কোলে।
৭- সেকাল আর একাল, রাজনারায়ণ বসু, বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত।
৮- General Report on public Instruction in the Lower Provinces of the Bengal Presidency for 1851-52, Midnapore School Chapter.
৯- General Report on Public Instruction in the Lower Provinces of the Bengal Presidency for 1857-58, Vol. 1, Appendix - A.
১০- General Report on Public Instruction in the Lower Provinces of the Bengal Presidency for 1858-59.
১১- History and Development of Midnapore College, S. K. Som, Centenary Commemoration Volume, Midnapore, 1973.
১২- দেবগৃহে দৈনন্দিন লিপি, রাজনারায়ণ বসু।
১৩- আনন্দবাজার পত্রিকা(১১/০৩/২০১৯)
১৪- বিশেষ সহায়তা --- মৌমিতা ভৌমিক।
0 Comments