জ্বলদর্চি

অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল- ১৪

অলংকরণ  -প্রান্তিকা মাইতি


অ্যাঁতেলেকত্যুয়েল বনাম আঁতেল- ১৪
 
স ন্দী প  কা ঞ্জি লা ল


বুদ্ধি আর বিদ্যা থাকলেও সবাই বুদ্ধিজীবী নয়


     
আমরা দেখেছি বিদ্যালয়ে দুটি ছেলে টিফিনের সময়  যখন মার্বেল নিয়ে ঝগড়াঝাটি করে, তখন তা শিক্ষক মহাশয়ের হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাধান হয় না। যে ছেলেটি মার্বেল কেড়েছে,সে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়, মার্বেলটি তার। সে কখনো বলেনা, "এই মার্বেল আমার নয়। আমার নেই তাই নিয়েছি।" না, সে একথা বলেনা। সে বরং প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয় সেটা তার। সে তখন বলে, "মার্বেলটা আসলে আমার, ও অযথা ঝগড়া করছে।"তারপর সে কিছু প্রমাণ হাজির করে, পয়সা কোথায় পেয়েছিল, কোন দোকানে কিনেছে, কেনার সময় কে ছিল। সবশেষে মার্বেলটা যে অবশ্যই তার, তা প্রমাণ করতে মোবাইলের শরীরের বর্ণনা দেয়। এর দ্বারা আমরা বুঝতে পারলাম, সব কিছুকেই যুক্তিসহ উপস্থাপন করার উপায় রয়েছে। আর এইসব বুদ্ধিজীবীরা করে থাকে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় উপরের ছেলেটির মতো বুদ্ধিজীবীরা পুরো প্রক্রিয়ার সাথে একাত্ম হয়ে যান। বিগত শতকের যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন রোঁমা রঁলা, অরি বার্বুস, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, জোলিও কুরি,বার্ট্রান্ড রাসেল এবং বাঙালী রবীন্দ্রনাথ। এরা কলম হাতে ফ্যাসিস্ট যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে লড়াই  করেছেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি অস্ত্রহাতে রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছেন। সে যুদ্ধে 'রাল্ফ ফক্স', 'ক্রিস্টোফার কর্ডওয়েল' এর মতো প্রতিভাবান লেখক-বুদ্ধিজীবী শহীদ হয়েছে। তবু 'লোরকা'র জীবনের বিনিময়ে বাঁচানো যায়নি স্পেন কে ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রাংকোর হাত থেকে। তবে গণতন্ত্রী স্পেনের পক্ষে বিশ্ব বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন এককাট্টা সমর্থক। এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের ছিল সক্রিয় ভূমিকা, এমনকি সাহায্য তহবিল ও গঠন করেছিলেন। তাঁর একটা বিবৃতি, "আজ স্পেনে বিশ্বসভ্যতা অমানুষিকভাবে পদদলিত। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিস্ট সংঘ বিদ্রোহীদের দলে দলে সৈন্য ও অর্থ প্রেরণ করিতেছে। মাদ্রিদে আগুন।..... রমণী ও শিশুদিগকে নির্বিচারে হত্যা করা হইতেছে।.... স্পেনের এই সংকট মুহূর্তে স্পেনের জনসাধারণের সাহায্যে অগ্রসর হউন। জনগণ প্রতিষ্ঠিত সরকারকে সাহায্য করুন এবং সহস্র কণ্ঠে বিদ্রোহীদের কার্যের প্রতিবাদ করুন।" (৩ মার্চ ১৯৩৭) বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা এমনই হওয়া উচিত। অর্থাৎ মানবিক এবং গণতান্ত্রিক। তাই রবীন্দ্রনাথের কথা বারবার ঘুরে ফিরে আসে। জীবনের শেষ পর্ব পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা সম্পর্কে নির্দিষ্ট সচেতনতায় ও প্রত্যয়ে তিনি উপস্থিত হন। 
বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব এবং তাদের বর্তমান ভূমিকা তা কয়েকটি পর্যায়ে আলোচনা করবো। অনেকেই লেখালেখি করেন, অনেকেই শিক্ষিত বুদ্ধিমান। তবে সবাই বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেন না কেন?পর পর কয়েকটি  আলোচনায় আমি তাঁর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করবো।
 এ পৃথিবীতে যা কিছু ভালোমন্দ, সত্য, মিথ্যা, সুন্দর, অসুন্দর, সব কিছুর বিচারক মানুষ। আজকের যে এই সভ্যতার উন্নতি তা ও মানুষের দান। আজ থেকে যদি আমরা বেশ কয়েক শ' বছর পিছিয়ে যাই দেখতে পাবো, আজকের সঙ্গে সেদিনের আকাশ পাতাল পার্থক্য, যাকে আমরা বলি আধুনিক সভ্যতা। তা যে সূত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার নাম 'হিউম্যানিজম্' বা মানব তন্ত্র। এই পরিবর্তন কোনো ব্রহ্মা, ঈশ্বর, দেবদেবী বা কোনো অতিমানবিক শক্তি ঘটায়নি। তার জন্য কোনও অন্য ভাবনা ভাবার অবকাশ নেই। এই ঈশ্বর, দেবদেবী স্বর্গ নরক বা ঐ জাতীয় সব কল্পনা মানুষের সৃষ্টি। গ্রিক দার্শনিক 'প্রোটাগোরস' এর সেই বিখ্যাত উক্তি, "মানুষ সবকিছুর মাপকাঠি - মানবতন্ত্রের এটি অন্যতম মূল প্রত্যয়।" তা বলে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই, সেই সব বুদ্ধিজীবীরা সকলেই নাস্তিক ছিলেন। তবে বাস্তব বলছে যতই মানুষ তাঁর বুদ্ধির প্রভাব বাড়িয়ে উন্নত হতে থাকলো, ততই মন্দির মসজিদ গীর্জার প্রভাব মানুষের জীবনে কমতে লাগলো। ঐতিহাসিক 'বুকহার্ট'  নিজে ধার্মিক ছিলেন, তবু তিনি লেখেন,"এই বুদ্ধিজীবী চিন্তানায়করা পাপ, প্রায়শ্চিত্ত, পরিত্রাণ, স্বর্গনরক ইত্যাদি আধ্যাত্মিক তত্ত্ব নিয়ে মাথা ঘামাননি, মর্ত্যলোকে মানুষের জীবন ও তাদের উন্নতি নিয়েই তারা কৌতূহলী ছিলেন। মানবতন্ত্রীর বিচারে মানুষ শুধু সবকিছুর মাপকাঠি নয়, মানুষের মনুষ্যত্বই একটি। মানুষ কতটা মানুষ তার মাপকাঠি। কারণ আজও আমরা দেখতে পাই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ কতগুলি মূঢ় বিশ্বাসের দ্বারা আচ্ছন্ন এবং আত্মকেন্দ্রিতায় ভরপুর। তাই নবজাগরণের মনীষীরা ঘোষণা করলেন মানুষের বিচিত্র সম্ভাবনাসমষ্টির নাম মনুষ্যত্ব। আর এই মনুষ্যত্ব বিকাশের জন্য মানুষকে অতিরিক্ত কিছু অর্জন করতে হয়না। কারণ মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা। তাই 'পিকো দেলা মিরান্দোলা' তার "মানুষের মহত্ত্ব বিষয়ক নিবন্ধে" লেখেন, "ঈশ্বর আদমকে বললেন, দেখো তোমাকে আমি মুক্ত জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছি। আমার অন্য কোন ও সৃষ্টির মধ্যে বিকাশ নেই। কিন্তু তুমি নিজের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগ করে নিজেকে যেভাবে খুশি বিকশিত করতে পারো। শুধু তোমার মধ্যেই বৈশ্বিক জীবনের বীজ উপ্ত আছে।" 
অর্থাৎ মানুষ কারও হাতের যন্ত্র নয়, সে নিজেই যন্ত্রী। মানুষ যদি ইচ্ছে করে তবে সব কিছুই সে করতে পারে। কোন গ্রহ নক্ষত্র বা দৈবশক্তি মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে দমিত করতে পারেনা। এইভাবে মানুষ নিজেকে নিজে বারবার সৃষ্টি করে, তার অপর কোনও সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই।
মানুষ যে নিজের ভাগ্য নিজে নির্ণয় করতে পারে তার প্রধান কারণ দুটি। একটি তার বুদ্ধি দ্বিতীয়টি তার নিজেকে  প্রকাশ করার ইচ্ছা। জন্তু জানোয়ারের মধ্যেও এই দুটি সামর্থ্য আছে। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্কের আশ্চর্য বিবর্তনের জন্য, এই দুটি সম্ভব হয়। বুদ্ধির দ্বারা মানুষ বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত  কার্যকারণ সূত্রের অনুধাবন করে এবং বিশ্বপ্রকৃতিকে নানা উদ্দেশ্য সাধনের কাজে লাগায়। এবং বুদ্ধি বিকাশের ফলে মানুষ ভাষা, যন্ত্র, রীতিনীতি, প্রয়োগপদ্ধতি ইত্যাদির উদ্ভাবন করে নিজের  অন্তর্নিহিত অফুরন্ত সম্ভবনাকে নানাভাবে সার্থক করতে পারে। এই বিচিত্র সম্ভবনাকে সার্থক করার অপর নামই মুক্তি। তবে এই মুক্তি মরে বাঁচা নয়। মুক্তি বলতে মানুষের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভবনা রয়েছে তাঁর মুক্তি। তার জন্য দরকার বুদ্ধিকে মার্জিত করা। বুদ্ধি ছাড়া ব্যক্তির বিকাশ অসম্ভব এবং ব্যক্তির বিকাশ না ঘটলে বুদ্ধি ক্রমেই জড়ত্ব লাভ করে। বুদ্ধি সত্যকে অনুসন্ধান করতে সাহায্য করে। মনের জিজ্ঞাসাকে জীবন্ত করে তোলে৷ এইজন্য অনুভূতিকে সূক্ষ্মতর করা দরকার। সেজন্য প্রয়োজন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে সক্রিয় করা৷ আর সবকিছু নিবিড় সম্ভোগের দ্বারা দেহ ও মন কে সুন্দর ও সতেজ রাখা দরকার। বুদ্ধিবিমুখ মন নিজের আত্মবিলোপে সার্থকতা খোঁজে। আর তারা দাস্যভাবের সাধকহয়ে ওঠে। অতি যত্নে নিজেকে এবং নিজের  স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব প্রশ্নকে এড়িয়ে নিপাট ভদ্রলোকের মুখোশ পরে ঘোরেন। এরা প্রকৃত অর্থে মানুষ নয়। কারণ মানবতন্ত্রের নায়ক কখনো দাস হতে পারে না। সে সবসময় নিজের বুদ্ধির দ্বারা এই নিয়ম আর নিয়ন্ত্রণের জগতকে নিজস্ব বিকাশের উপাদান করতে আগ্রহী। এইজন্য বুদ্ধিজীবীরা হন ইতিহাসের নায়ক।
তবে নায়ক মানে সবকিছু বুঝে যাওয়া নয়। মানুষের জ্ঞান যেহেতু অভিজ্ঞতা নির্ভর, সে কারণে এ পৃথিবী সম্পর্কে সব ধারণাই অসম্পূর্ণ। বাইবেল, গীতায় বা কোরানে যা লেখা থাক কিংবা কোন নির্দেশ স্বৈরাচারী শাসকের কাছ থেকে আসলেও বুদ্ধিজীবী তাকে আপ্তবাক্য বলে মানতে নারাজ। বুদ্ধিজীবী তার সত্য অনুসন্ধান না করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় না। সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য কোন সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতেও পেছপা হয় না। বুদ্ধিজীবীর মূল কথা সত্য সম্বন্ধে অনুসন্ধান এবং প্রতিটি ব্যক্তি মূল্যবান জেনে তার উন্নতিতে নিজেকে নিবেদন করা। 
প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে নানারকমের বাসনা প্রবৃত্তি থাকে। এর একটি দাবি মেটাতে গেলে অন্যটি অবহেলা করতে হয়। অনেক সময় তাদের অদমিত করারও প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু মনের মধ্যে স্থায়ী আছে যে মনোভাব তাকে চিরকাল অদমিত করা যায় না। তাই কিছু মানুষ বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী সাজার চেষ্টা করলেও বাস্তবে তা রুপ পায় না। কারণ পাড়ার পচাকে রাজার পোশাক পরিয়ে স্টেজে কিছু সময় রাজা সাজালেও, বা রাজার মেজাজ ধরলেও, কোনও একসময় তাকে পোশাক খুলতে হয়। তখনই তার বেরিয়ে পরে আসল রুপ। এর কারণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা ও আকাঙ্খা বড় হয়ে যাওয়ার কারণে,সে শখের রাজা সেজেছিল গ্রাম্য যাত্রায়। (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments