জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস পর্ব - ৬


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৬

 শ্যা ম ল  জা না


পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা এবং তাঁদের মতবাদ ও ছবি(২য় অংশ)

ভিনসেন্ট ভ্যান গখ ও বিস্ময়কর আবেগ-অনুভূতি – 

একই সঙ্গে সবচেয়ে প্রবাদপ্রতিম ও সবচেয়ে নির্যাতিত চিত্রশিল্পীটির নাম ভিনসেন্ট ভ্যান গখ্৷ তীব্র ও ভয়ংকর আবেগ, অনুভব ও আধ্যাত্মিকতার প্রয়োগ তাঁর প্রতিটি ছবিতে অনুভব করা যায়৷ কারণ, প্রতিটি ছবি আঁকার সময়ে তিনি নিজেকে ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভাঙচুর করেছেন, রক্তাক্ত করেছেন! অথচ, এই সর্বস্ব দিয়ে ছবি আঁকার পরেও জীবদ্দশায় তাঁর একটিমাত্র ছবি বিক্রী হয়েছিল৷ ঠিকমতো খাবার জুটত না! আর, এখন তাঁর ছবির চাহিদা সবচেয়ে বেশি৷ তাঁর ছবিই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী! সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রী হয়(ছবি-১)৷

ভ্যান গখ্-এর জন্ম ১৮৫৩ সালে৷ ছবি আঁকা শুরু করেন ১৮৮৩ সালে তিরিশ বছর বয়েসে৷ছবি এঁকেছেন মাত্র সাত বছর৷ ১৮৯০ সালে তিনি আত্মহত্যা করেন৷ এই মাত্র কটা বছরেই তিনি ছবি এঁকেছেন প্রায় নশো৷ তার মধ্যে একটিও ক্যানভাস এরকম নেই, যেটি অনুভবের দিক থেকে অগভীর!আসলে, তিনি যখন কোনো ছবির বিষয় দেখতেন, চোখ দিয়ে দেখতেন না৷ তাঁর চোখ শুধুমাত্র দৃশ্যের প্রবেশপথ(Gateway)হিসেবে ব্যবহৃত হত৷ আসলে তিনি দেখতেন হৃদয় দিয়ে৷ আর সেই দেখাকে তিনি জারিত করতেন, তাঁর সেই অসম্ভব তীব্র আবেগমথিত অনুভূতি দিয়ে! ফলে, মনে মনে যে ছবিটি প্রস্তুত হত ক্যানভাসে আঁকার জন্য, সেটির সঙ্গে বাস্তবের হুবহু মিল থাকত না৷ তাছাড়া, তাঁর ছবি আঁকার পদ্ধতি বা করণকৌশলটিও ছিল একেবারে ভিন্ন৷ তিনি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো ক্যানভাসে কোনো রঙের সঙ্গে কোনো রং না মিশিয়ে তুলির সাহায্যে মোটা মোটা স্বতন্ত্র রং-এর পোঁচ(Brush stroke) দিলেও সে পদ্ধতি ছিল একেবারে আলাদা৷ একান্ত নিজের, কারোর মতো নয়! সেই পোঁচের বিন্যাস ছিল অত্যন্ত সুচারু, এবং সেগুলি সরলরেখায়, বক্ররেখায়, ও বিন্দুতে এই তিন পদ্ধতিতেই, অসাধারণভাবে বিন্যস্ত হত(ছবি-১ ও ২ দেখুন))৷ আবার, ঠিকমতো বিচার করলে দেখা যাবে, পোস্ট-ইম্প্রেশনিজম-এর ব্যানারে যতগুলি মতবাদ তৈরি হয়েছিল, সবকটিই তাঁর ছবির মধ্যে পাওয়া যায়৷ অথচ তাঁর এই ছবি আঁকার পদ্ধতিটি ছিল একেবারে স্বতন্ত্র ও স্বকীয়৷ এতটাই যে, একশো বছর পেরিয়েও এখনো তা আমাদের বিস্মিত করে, আমাদের হৃদয়ের গভীর পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলে৷ এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস ফেলবেও আগামী সুদূর পর্যন্ত৷

একটি ক্যানভাসে ছবির যে বিষয় থাকে, তাকে ছাপিয়ে ভ্যান গখ্-এর ক্যানভাসে ফুটে উঠত নাটকীয়তা, সুদূর কল্পনা, কবিতার ছন্দ ও তীব্র অনুভূতি!তিনি অনায়াসে শৈলী ও বিষয়বস্তুকে মিলিয়েমিশিয়ে একাকার করে দিতে পেরেছিলেন৷ আর, এই শক্ত কাজটি তিনি অনায়াসে করতে পেরেছিলেন যেহেতু মানুষের ভেতরে ও প্রকৃতির ভেতরে যে অর্ন্তনিহিত আধ্যাত্মশক্তি থাকে, সে দুটি শক্তিকে তিনি মিশিয়ে একত্রিত করতে পেরেছিলেন তাঁর ছবির প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রাণের কারণে৷

ভ্যান গখ্-এর সারা জীবনে সেরকম কোনো আনন্দের ঘটনা ঘটে নি! বলতে গেলে তিনি সারা জীবনই মর্মাহতই(Upset) থেকেছেন৷ আর, এটিই ছিল তাঁর ছবি আঁকার উৎস! তিনি সর্বক্ষণ ভয়ংকর মানসিক টানা-  পোড়েনের মধ্যে থাকতেন বলেই অতিরিক্ত উত্তেজিত থাকতেন৷এই মানসিক অবস্থা থেকে যে একেবারে স্বতন্ত্র ও তীব্র আবেগের জন্ম হত, তাই দিয়েই তিনি জারিত করতেন তাঁর চারপাশে ঘটা ঘটনাগুলিকে, যা ক্যানভাসে প্রতিফলিত হত৷

তাঁর ওই অস্থির মেজাজটিই পরবর্তীকালে একজন নির্যাতিত শিল্পীর রোমান্টিক ইমেজের সমার্থক হয়ে ওঠে! এই অস্থির মেজাজ, মানসিক টানা-পোড়েন, অবসাদগ্রস্ত আবেগ-অনুভূতি, মাঝে মাঝে অতি তীব্র আকার ধারণ করত৷ তখন তাঁকে অ্যাসাইলামে যেতে হত৷এবং অ্যাসাইলামে থাকাকালীন তিনি বেশ কিছু ছবি এঁকেছিলেন৷ ওই ছবিগুলিই তাঁর ওই অস্বাভাবিক মানসিকতার শীর্ষ অবস্থানকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করে৷এই রকমই একটি ছবির নাম— স্টারি নাইট(ছবি-২)৷ 

ভ্যান গখ্, তাঁর এই ‘স্টারি নাইট’ ছবিটি তিনি একেবারে ভিন্ন মাত্রায় উপস্থাপন করেছেন। অ্যাসাইলামে থাকাকালীন যখন তাঁর অস্বাভাবিক মানসিকতা শীর্ষে অবস্থান করছে, তখনই এই ছবিটি তিনি এঁকেছিলেন৷ পাঠক লক্ষ করবেন, সুস্থ মানসিকতায় এই ধরনের ছবি আঁকা প্রায় অসম্ভব বলাই ঠিক৷গভীর নীল পর্দার ওপর যেনো তারকারা ঝিকমিক করছে। মনে হয় যেন এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে তিনি এই ক্যানভাসে উপস্থিত করেছেন, যেখানে এই তারাসকল ঘূর্ণায়মান ও গতিশীল। তার নিচের মাটির পৃথিবী ও পরিবেশ যেন ভয়াবহ দূর্যোগকবলিত। ছবির বাঁ দিকে এক বিশাল গাছ, অনেকটা লেলিহান আগুনের শিখার মতো৷ যেন দ্রুত বেড়ে উঠেছে বিস্ফোরণে উন্মুখ হয়ে থাকা আকাশের নীচে। শিল্পী এখানে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঐকতানকে উপেক্ষা করেছেন বরং একান্ত নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি এ বিষয়টিকে প্রকাশ করেছেন। ভ্যান গখ্-এর সব ছবিতেই আমরা দেখি এই ধরনের এক প্রচণ্ড আবেগঘন মুহূর্ত যার সাথে কোনো কালের কোনো শিল্পীর মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, তাঁর ছবি সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাসটি ছিল একেবারে স্বতন্ত্র, যা অন্য কারোর সঙ্গে মেলে না! তিনি বিশ্বাস করতেন— শিল্পের দায়িত্ব হচ্ছে মানুষকে সান্ত্বনা দেওয়া।                                            (ক্রমশ)



Post a Comment

1 Comments

  1. একটু দেরিতে হলেও তৃষ্ণা চাপা ছিল। আজ ভোরবেলা খুলেই ভ্যান গখকে পেলাম। সংক্ষিপ্তাকারে তাঁর জীবন ও
    জীবন সম্পৃক্ত ছবি ও ছবি সম্পর্কে তাঁর অভিনিবেশ ও
    ভাবনাকে যে ভাবে তুলে ধরেছে,তা মনোমুগ্ধকর।চলুক এই
    লেখা পড়ে ঋদ্ধ হতে পারছি। ধন্যবাদ লেখককে।

    ReplyDelete