জ্বলদর্চি

হাজার বছরের বাংলা গান -১১


হাজার বছরের বাংলা গান।। পর্ব-১১

তু ল সী দা স   মা ই তি

দাশরথি রায়, নিধুবাবু ও অন্যান্যদের গান;
বাংলাগানে নতুন আঙ্গিকের সূচনা।


"আকাশে মেঘের মধ্যে বাষ্পাকারে যে জলের সঞ্চয় হয়, বিশুদ্ধ জলধারাবর্ষণেই তার প্রকাশ। গাছের ভিতর যে রস গোপনে সঞ্চিত থাকে তার প্রকাশ পাতার সঙ্গে ফুলের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে। সঙ্গীতেরও এই রকম দুই ভাবের  প্রকাশ। এক হচ্ছে বিশুদ্ধ সংগীত আকারে, আর হচ্ছে কাব্যের মিশ্রিত হয়ে।...বাংলাদেশে হৃদয়াভাবের স্বাভাবিক প্রকাশ সাহিত্যে। 'গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি'-...বাণীর প্রতিই বাঙালির অন্তরের টান; এইজন্যই ভারতের মধ্যে এই প্রদেশেই বাণীর সাধনা সব চেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু এক বাণীর মধ্যে তো মানুষের প্রকাশের পূর্ণতা হয় না- এইজন্যে বাংলাদেশে সংগীতের স্বতন্ত্র পঙক্তি নয়, বাণীর পাশেই তার আসন।"

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই উদ্ধৃতি থেকেই স্পষ্ট বাংলা গানে কথার গুরুত্ব কতখানি। ভারতচন্দ্র,রামপ্রসাদের সময়কাল থেকেi বাঙালির নিজস্ব গান সুরের সাথেই কথা বৈচিত্র্যে মহিমাময়। প্রকৃতপ্রস্তাবে অষ্টাদশ শতক থেকে বাঙালির গান তথা বাংলা গান অনেকটাই বদলে যায়। কবিগান, পাঁচালি, আখড়াই, হাফআখড়াই, তর্জা, আর্যা, খেউড়, নেটো প্রভৃতি গানে একটা নব সংগীত সংস্কৃতির  পরিচয় নির্মিত হয়। পরে পরে টপ্পা গানকেও এই পর্যায়ে আনা হয়। আর এও সত্য এই সকল সংগীত রূপ ও বৈশিষ্ট্য কাছাকাছি। এই গানগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনাতেই তা স্পষ্ট হবে।

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো সমকালে বাংলার নানা প্রান্তে শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চারও কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। হিন্দুস্থানী কালোয়াতি গানের অনুশীলনও চলছিল। বাংলার বিভিন্ন রাজবাড়ি ও জমিদারবড়ির ভেতর ধ্রুপদ -খেয়াল- ঠুংরি গানের চর্চা শুরু হয়। বাংলা গানের সমান্তরাল এই ক্ষেত্র গড়ে উঠলেও বাংলা গানের চর্চায় তার একটা প্রভাব ছিল। পরবর্তী  ক্ষেত্রে এই বিষয়ে বিস্তীর্ণ আলোচনার পরিসর রইলো। এখন সমকালীন বাঙালির জনপ্রিয় কিছু গানের আঙ্গিক নিয়ে কথা। শুধু প্রয়োজনীয় শাস্ত্রীয় প্রভাব টুকুই আসতে পারে এই আলোচনায়।

প্রাচীনকাল থেকেই পাঁচালির নানারূপ বাংলার সংস্কৃতিতে প্রচলিত ছিল। শিব,কৃষ্ণ,মনসা, চন্ডী, চৈতন্যকথা-সব নিয়েই পাঁচালি গীত হয়েছে। মূলত কৃষ্ণযাত্রা, বালকসঙ্গীত, রামযাত্রা, রাখালসঙ্গীত,পীরের গান-এসবের সঙ্গে মিশেই সূক্ষ্ম পার্থক্য নিয়ে পাঁচালি গাওয়া হতো। পাঁচজনে চামর দুলিয়ে আবৃত্তির মতো করে এ গান গাইত বলেই পাঁচালি নামকরণ। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে পাঁচালি বদলে গেল। পাঁচজন নির্দিস্ট থাকলো না। কবিগানই কিছুটা রূপ বদলে নতুন পাঁচালির দল গড়ে উঠলো। ঈশ্বর গুপ্ত, দাশরথি রায়, ব্রজনাথ রায়, সন্ন্যাসী চক্রবর্তী, অক্ষয়া পাটনী, গঙ্গানারায়ণ নস্কর, ঠাকুরদাস দত্ত, দ্বারিকানাথ অধিকারী প্রমুখ পাঁচালি গান রচনা করলেও শক্তিশালী পাঁচালীর কবি ও গায়ক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন দাশরথি রায়। পরবর্তী বাংলা গানকে প্রভাবিত করেন তিনি।

তাঁর গান 'নবরসের' ভাণ্ডার। তাঁর গান বাংলার ঘরে ঘরে প্রচলিত হয়ে পড়ে। বালক থেকে বৃদ্ধ, প্রাসাদবাসী থেকে কুটিরবাসী, গ্রামের মানুষ থেকে শহরের মানুষ সবার কাছেই তাঁর গান ছিল উপভোগ্য। তিনি যে দল তৈরি করেন বাদক দুয়ারী নিয়ে তার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। প্রথমে তিনটাকা থেকে পরে শত মুদ্রাতেও তাঁর দল দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে। তাঁর পাঁচালি নানা পালায় বিভক্ত ছিল। সবই পুরাণ ও ঐতিহ্যের কাহিনি।  ঝাঁপতাল, যৎ, ঢিমে তেতালা, একতালা, আড়া, পোস্তা, খয়রা ,কাওয়ালি প্রভৃতি তালের সাথে সিন্ধু মল্লার, ললিত, ঝিঁঝিট, সুরট, সিন্ধুভৈরবী, খটভৈরবী, আলিয়া, অহং, খাম্বাজ, জয়জয়ন্তী প্রভৃতি রাগ রাগিনীতে  গান বেঁধেছিলেন। প্রায় চৌষট্টি ধরণের পাঁচালি রচনা করেছিলেন। বৈচিত্র্য তাতে অনেক বেশি। গোষ্ঠলীলা, কালীয়দমন, মাথুর,কলঙ্কভঞ্জন, গোপীগণের বস্ত্রহরণ, বামনভিক্ষা, তরণীসেনবধ,মহিষাসুর বধ প্রভৃতি পালাগুলি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিদ্যাসাগর মশাইকে তিনি প্রশংসা করেছেন। ঈশ্বর গুপ্তের নিন্দা করেছেন।
"এলেন গুণের সাগর বিদ্যাসাগর ,
বিধবা পার করতে তরির,তরির গুণ ধরেছে  গুননিধি।
…………….
"ঈশ্বর গুপ্ত অল্পেয়ে, নারীর রোগ চেনে না বৈদ্য হয়ে
হাতুড়ে বৈদ্যতে যেন বিষ দিয়ে, দেয় প্রাণে বধি।"
 
দাশরথি রায়ের কিছু গান তো অমর হয়ে আছে। তিনি শব্দ ব্যবহারের কৌশলে মোহিত করেছেন । সিন্ধুমল্লারে রচিত তাঁর সেই গানের পঙক্তি:
"সেকি কাল দেখে এলি কাল সায়
কালের কাল যায়, যে কালপূজায়
সেই কাল দরশনে, জীবের কাল দরশন যায়।"
তাঁর গানে অনেক চটুল আদিরস থাকলেও ভক্তিতেও তিনি ভরপুর ছিলেন
"দোষ কারো নয় গো মা ।
আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।"

বঙ্কিম চাটুজ্যে যিনি সাহিত্যকে শ্লীল ধারায় স্থাপন করেছিলেন তিনিও দাশরথি  রায় সম্পর্কে দরাজ ভাবে বলেছেন " যিনি বাঙ্গালা ভাষায় সম্যকরূপে ব্যূৎপন্ন হইতে বাসনা করেন  তিনি যত্নপূর্বক আদ্যোপান্ত দাশু রাযের পাঁচালী পাঠ করুন।" দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বালক রবীন্দ্রনাথও দাশুরায় শুনতেন।

বাংলা গানে পাঁচালির সাথেই হেঁয়ালি ছড়ায় উত্তর- প্রত্যুত্তরে যে গান প্রচলিত  হয় তাকে আর্যা বলা হয়। এই আর্যাগান রূপ বদলে হয় তর্জা গান। মানুষকে আনন্দ দেওয়াই ছিল এই গানের উদ্দেশ্য। এই গানের পরম্পরা আজও চলে  আসছে।এটি বাংলা গানের খাঁটি লৌকিক পর্যায় ।

খেউড়  অধ্যাত্ম ও প্রণয়-ঘটিত গানেরই একটি বিশেষ চলন। ভারতচন্দ্র এই গানের প্রবর্তক। বাংলার  বিভিন্ন প্রান্তে গাওয়া হতো। চঞ্চল প্রকৃতির এই গানে আদিরস ছিল বেশি। খেউড়ের পরেই ওস্তাদী বা আখড়াই গানের সূচনা। শ্রীদাম দাস,  রামপ্রসাদ ঠাকুর, নসিরাম সেকরা  এই গানে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আখড়াই গান ভেঙে হাফ আখড়াই গান সৃষ্টি হয়। কথাপ্রথান এই প্রকার অর্ধ ওস্তাদীগানের শ্রেষ্ঠ শিল্পী মোহনচাঁদ বসু।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর এই সকল সঙ্গীত ধারায় আরো যারা প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে গোপাল উড়ে, নিধুবাবু  কালীমির্জা শ্রীধর কথকের কথা বলতেই হয়। 

গোপাল উড়ে উড়িষ্যায় জন্মগ্রহণ করলেও কলকাতাতেই বসবাস করতেন। তিনিই প্রথম কলকাতায় 'বিদ্যসুন্দর' নামে এক যাত্রার দল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পণ্ডিতগণ বলেন এই যাত্রাদলই বঙ্গদেশের প্রথম শখের যাত্রাদল। পরে এখানে যোগ দেন বহুবাজারের মতিলালগোষ্ঠী, বাড়ুজ্যেগোষ্ঠী ধরগোষ্ঠির লোকজন। অনেকে মনে করেন এই দলে রাজকৃষ্ণ রায় সখী সাজতেন। যাইহোক গোপাল উড়ে বাংলাগানের ধারায় শক্তিশালী প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
কি অপরূপ, হয় কিরূপ
চাঁদের স্বরূপ বকুল-মূলে
হেরে অতি রতিভৃঙ্গ ভুরু যুগ স্মৃতিমূলে।
আদরে আবৃত দেহ, হৃদে রাখি করি স্নেহ
আহা মরি কি অমিয়, হাস্য শ্রীমুখমণ্ডলে।।

বাংলা গানে একজন উল্লেখযোগ্য প্রতিভাযোজনা নিধুবাবু। রামনিধি গুপ্ত। বাংলাভাষায় টপ্পা গানের প্রচলন তাঁর হাতেই সার্থক হয়ে ওঠে। কালোয়াতি গানের প্রভাব মিশিয়ে উচ্চমানের প্রণয়সঙ্গীত হলো টপ্পা। ধ্রুপদ খেয়াল-এসবের সংক্ষিপ্ত রূপ। দুই তুক। অস্থায়ী আর অন্তরা। খেয়ালের রাগে টপ্পা গাওয়া হতো না। প্রাচীন রাগিনীর মধ্যে ভৈরবী, সিন্ধু ,কালাংড়া, খাম্বাজ, এই সব রাগে টপ্পা গাওয়া হয়। আধুনিক কাফী, পিলু প্রভৃতি রাগে টপ্পা গাওয়া হয়ে থাকে।
ছাপড়ায় হিন্দুস্থানী কালোয়াতি শিল্পীদের কাছে টপ্পা খেয়াল গজল শিক্ষা লাভ করে রামনিধি গুপ্ত বাংলায় মৌলিক টপ্পাগান রচনা করেন। অল্পকালের মধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। হিন্দিগানের অনুকরণে শোরী মিঞার প্রভাবে  গান রচনা করলেও নিধুবাবু স্বতন্ত্রতায় উজ্জ্বল। জলদতেতালা, ঢিমে তেতালা, আড়া প্রভৃতি তালে  অসাধারণ সব গান নির্মাণ করেন তিনি। সরফরদা, খাম্বাজ, কালাংড়া, আলাইয়া,ভাটিয়ালি, শ্যাম, বিভাস প্রভৃতি রাগে তার গান গাইতেন। মানব মানবীর প্রেম তিনি প্রকাশ করেছেন। দেশপ্রেমের গানও তিনি গেয়েছেন। 'বিনা স্বদেশীয় ভাষা পুরে কি আশা'।
তাঁর গান উচ্চ শ্রেণির। গানের ছন্দকে সহজ সরল করে তিনি প্রকাশ করেছেন।
"বিনাদরে ,অনাদরে,কে করে বাস।
করিলে আদর হয়, হৃদয় প্রকাশ।
রাখিতে একের মন,করে যদি এক মন 
দুই মন দুই মন, এক কি হয় কোনো ভাষ।"
তাঁর "ভালোবাসিব বলে ভালোবাসিনে" গানটি উদ্ধৃত করে কবিগুরু বলেছেন -এতে তানের প্রগলভতা নেই কিন্তু বেদনা আছে তো। এও যে নিতান্তই চাই সাধারণের জন্যে। শুধু সাধারণের জন্য কেন বলি,এক সমযে উচ্চ ঘরের রসনাও তৃপ্তির সঙ্গে এর স্বাদ গ্রহণ করেছে।"

নিধুবাবু ছোটো ছোটো  গীত রচনা করেছেন। কিন্তু একটা সমগ্রের ব্যাপ্তি দিতে পেরেছেন। তাঁরই পথে  গিয়ে শ্রীধর কথক, কালীমির্জা প্রমুখ টপ্পা গান নির্মাণ করে বাঙালিকে মাতিয়েছেন। এই পথ বেয়েই বাংলা গান তার নিজস্ব রূপ প্রকাশ করতে করতে পথ হাঁটছে।
প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা গান সৃষ্টির সোপান হিসেবে এই সকল গান এক বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। কথাশিল্প ও সুরশিল্প এক নিবিড়ে মিশে একাকার হয়েই নতুন গান। তাই গানের ইতিহাসে এগুলির এতখানি গুরুত্ব।
রবীন্দ্রনাথ এই সকল গানকে 'জনসঙ্গীত' বলেছেন। বলেছেন-
"নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রাঙ্গণে প্রাঙ্গণে ছোট-বড়ো নদী-নালা স্রোতের জাল বিছিয়ে দিয়েছে, তেমনি বয়েছিলো গানের স্রোত নানা ধারায়। বাঙালির হৃদয়ে সে দৌত্য করেছে নানা রূপ ধরে। যাত্রা, পাঁচালি, কবির গান, কীর্তন মুখরিত করে রেখেছিল দেশকে।"...(চলবে)
----

Post a Comment

0 Comments