জ্বলদর্চি

আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৯


আধুনিক চিত্রশিল্পের ইতিহাস -৯

শ্যা ম ল  জা না


পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীরা এবং তাঁদের মতবাদ ও ছবি(৪র্থ অংশ)

পল সেরুসিয়ের ও দ্য নবিস—

পল সেরুসিয়ের ১৮৮৮ সালে একবার পন্ত অ্যাঁভে স্কুলে গিয়েছিলেন ৷ ওখানে পল গগ্যাঁর ঘনিষ্ট তত্ত্বাবধানে(Guidance) তিনি বন্দরের একটি অদ্ভুত ছবি এঁকেছিলেন ৷ যেখানে, দৃশ্যত সরাসরি বন্দরের কোনো ছবি তিনি আঁকেননি৷ একটি বন্দরকে দেখলে মনের ভেতরে যে অদ্ভুত অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতি অনুযায়ী শুধু কিছু রঙের প্যাচ দিয়ে তিনি ছবিটি এঁকেছিলেন একটি সিগারেটের বাক্সের ওপর ৷ নাম— “দ্য তালিস্মান”(ছবি-১)৷ 


এই ছবিটি থেকেই “দ্য নবিস”-এর যাত্রা শুরু হয় ৷ এটিই “দ্য নবিস”-এর প্রথম ছবি৷ 

 “দ্য নবিস”-রা স্পষ্টতই ঘোষণা করলেন তাঁদের দর্শন ৷ যে, প্রকৃতিকে হুবহু ক্যানভাসে ধরলে তা শিল্প হবে না ! রূপক-অলংকার ও প্রতীকের সঠিক মিশ্রণই একটি যথার্থ পেন্টিং-এর জন্ম দিতে পারে !

অতি সংক্ষেপে “দ্য নবিস” সম্পর্কে বললে বলতে হয়— এরা পল গগ্যাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত, “লিটারারি থিওরি”র দ্বারা প্রভাবিত হলেও মুলত “সিম্বলিস্ট” ৷ অথচ সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক চেতনায় নিমজ্জিত৷ যার প্রতিষ্ঠাতা পল সেরুসিয়ের ৷ তবে, ১৮৮৮ সাল থেকে ১৮৯০, মাত্র এই দু-বছর টিকেছিল এই “দ্য নবিস”৷ তা সত্ত্বেও বলতেই হবে, এঁদের অনুশীলন ছিল অত্যন্ত কঠোর ৷ একেবারে ভিন্ন মাত্রার ৷ আর, এঁদের প্রভাব ছিল সুদূর পর্যন্ত ৷

সেরুসিয়ের, তাঁর বন্ধুদের নিয়ে একটি গোপন আধ্যাত্মবাদী সমিতি গড়ে তুলেছিলেন ৷ এই সমিতি মনে করত— যে, স্পর্শ না করেই, উচ্চ-আধ্যাত্মশক্তিকে আমরা অনুভব করতে পারি, এবং তার সাহায্যে আমরা উঁচু মানের ধর্মযাজকের সমতুল কাজ করতে পারি ! আর, যা দেখা যায় না, অদৃশ্য, তাকে অনুভূতির সাহায্যে দৃশ্যে পরিণত করে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমাদের আছে ৷ আমরা, নবিস-এর শিল্পীরা সেই ছবিই আঁকি, যার বিষয়বল্তু আমাদের আত্মার গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসে ৷

যখন নবিসদের ছবিগুলি বিষয়বস্তুর দিক থেকে একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে যেত, তখনই তাঁরা সবাই, সাধারণ নির্দিষ্ট নিয়মাফিক(Formal) মতবাদ আরোপ করতেন৷ যেমন— অনেকগুলি রেখা ও রঙ মিলে ক্যানভাসে যে সুরের ঐকতান গড়ে ওঠে, তাকেই পেন্টিং বলে ৷ এই ধরনের এক-একটি ধারণাই অনেকগুলো আলাদা আলাদা সমস্যার সমাধান করে দিত ৷

ছবি আঁকার সময়, ক্যানভাসে, কীভাবে, রেখা ও রঙকে সমন্বয় করবে বিষয়, এবং শিল্পীর নিজস্ব শৈলী, এসবেরই তাঁরা কার্যত সাধনা করতেন ৷ কী রকম এই সাধনা ? নবিসদের চিন্তার অভিমুখ(Approach) ছিল এই রকম— তাঁরা যখন ছবি আঁকার জন্য এক জায়গায় মিলিত হতেন, তাঁরা সবাই মিলে সমবেতভাবে মন্ত্রপাঠ করতেন ৷ এর ফলে শুধু রং নয়, রঙের সঙ্গে যুক্ত হত কোরাস মন্ত্রধ্বনি, মন্ত্রবাণী ! আর, আক্ষরিক অর্থে শব্দ বলতে যা বোঝায়, তার ঊর্ধ্বে উঠে, আরও ভালো করে বললে, সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে, তাঁরা আশ্চর্যজনকভাবে ক্যানভাসে দৈবশক্তির প্রকাশ ঘটাতেন ৷

এঁদের প্রসঙ্গে নবিখ্যাত ঐতিহাসিক চার্লস চাসে(Charles Chassé) চমৎকার একটি কথা বলেছিলেন— “একটি ছবির তখনই মানে হয়, যখন তার শৈলী আমাদের আবিষ্ট করে ৷ আমি যেটা বলতে চাইছি— একজন শিল্পী ছবির প্রয়োজনে যখন লক্ষ্যবস্তুটির আকৃতি অনুভূতির সা্হায্যে পাল্টে দেয়, এবং চিত্তাকর্ষতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়, আর রঙের ভেতরে নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশে সক্ষম হয়, তখনই সে হয়ে ওঠে সবচেয়ে সফল শিল্পী”৷

নবিসরা নিজেদের এইভাবে বিবেচনা করত, যে, বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের জন্য তাঁরা নিবেদিতপ্রাণ ৷ এজন্য তাঁরা ব্যক্তিগতভাবে বা আধ্যাত্মিকভাবে ছবির বিশুদ্ধ বা পবিত্র উৎসের খোঁজে অন্বেষণ চালাত ৷ বিষয় যতই সাদামাটা হোক বা দৈনন্দিন জীবন থেকে নেওয়া হোক, প্রকৃতিতে যে সাধারণ সৌন্দর্য থাকে, তাকে অতিক্রম করে নবিসরা অন্বেষণ করত অতিপ্রাকৃত সৌন্দর্যের ৷ আর, এ জন্য তাঁরা রহস্যাক্রান্তও হয়ে পড়ত।

আার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— নবিসরা তাঁদের নান্দনিকতার ক্ষেত্রটি অনেকটা বিস্তৃত করেছিল ৷ যার মধ্যে অ্যাপ্লায়েড আর্টের প্রায় সবকটি দিকই যুক্ত হয়েছিল ৷ যেমন— অর্কিটেকচারাল পেন্টিং, ডেকরেটিভ স্ক্রীন, ম্যুরালস, পোস্টারস, বুক-ইলাস্ট্রেশনস এবং থিয়েটার ডিজাইন ৷ এই ডেকরেটিভ আর্ট সেই সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি ভূমিকা পালন করেছিল ৷ প্রথমত উনিশ শতকের নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের মধ্যে ফিরে এসেছিল, এবং একই সঙ্গে আসন্ন শতকের জন্য অ্যাবস্ট্রাশন ও বিজ্ঞাপন জগতের সূচনা করেছিল ৷             (ক্রমশ)


 

Post a Comment

4 Comments

  1. নবিসদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। ছবির বিবর্তনের সাথে
    সাথে ভাবি প্রজন্মের জন্য রেখে
    যাওয়া অ্যাবস্ট্রাকট আর্ট জেনে
    অভিভূত!। কত বছর আগে গগ্যাঁর
    নেতৃত্বে একদল নবিস শিল্পী যে
    আত্মিক অনুভূতিকে শিল্পের মাধ্যম
    করেছিল,আজ তাইই আমাদের
    চর্চার বিষয়। ভাবলে বিস্ময় জাগে।
    আর এই বিস্মিত সৃষ্টি করে চলেছে
    শিল্পী শ্যামল জানা।অভিনন্দন তাকে।

    ReplyDelete
  2. আর এই বিস্ময় সৃষ্টি করে চলছে--হবে। (সংশোধন)

    ReplyDelete
  3. আপনার এই সিরিজের লেখাগুলির গুণাবলী এখানেও অব্যাহত ।আপনি শুধু ইতিহাস বলছেন না, আন্দোলনের ভবিষ্যত রূপান্তরের কথা ও তার প্রভাব বিস্তারের দিকটিও জানিয়ে আমার মত মূর্খদের শিক্ষিত করছেন।অজস্র কৃতজ্ঞতা।

    ReplyDelete
  4. সদ্য মন্তব্যটি অদীপ ঘোষের

    ReplyDelete