পথ যখন সঙ্গী || পর্ব- ৩
ন রে ন হা ল দা র
গাড়ি এসে থামল মেঘাটাবুরুতে। লাঞ্চের সময়। কিছু খেতে হবে। এখানে একটা মাত্র হোটেল। তাতেই ঢুকে পড়লাম। আলুর সাথে কিছু সব্জী ভাজা, ডাল আর মাংসের ঝোল। মেঘাটাবুরুকে মোটামুটি গ্রামই বলা যায়। কয়েকটা মাত্র পাকা বাড়ি। তবে এখান থেকে বাস সার্ভিস আছে চাইবাসা হয়ে রাঁচী পর্যন্ত। আমাদের পাঁচ বন্ধুরই উদ্দেশ্য থলকোবাদের ফরেস্ট হাউসে থাকা, যেমন থেকেছিল ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র চারবন্ধু।
মেঘাটাবুরু থেকে কিরিবুরু। দূরত্ব পাঁচ থেকে ছ’কিলোমিটার। এই কিরিবুরুতেই ফরেস্টারের মেন অফিস। এখান থেকেই থলকোবাদের রেস্ট হাউস বুক করতে হয়। দুরত্ব বারো কিলোমিটার। আমরা তো আর উপন্যাসের চরিত্র নই যে অগ্রিম বুকিং ছাড়াই ওই চার বন্ধুর মতো ফরেস্ট রেস্ট হাউস দখল করে বসতে পারবো! বুকিং অফিসারের খোঁজ করলাম, তিনি অফিসে নেই, রাউণ্ডে বেরিয়েছেন, ফিরতে দু’ঘন্টা লাগবে। অগত্যা অপেক্ষা। কিন্তু শুধু বসে থেকে তো আর অপেক্ষা করা যায় না, তাই পাশের মাঠেই দুটি আট-দশ বছরের বাচ্চার সাথে ফুটবল খেলায় মেতে উঠল রমেশ, অমিয় আর তুহিন। আমি আর কনাদ পাশে দাঁড়িয়ে তাদের খেলা দেখলাম, কখনও বা চারিদিকের বনরাজি।
দু’ঘন্টা পর অফিসার এসে জানাল রেস্ট হাউস ভাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। সেখানে কোনো উচ্চপদাধিকারিকের পরিবার এসে রয়েছে। ‘বজ্রাঘাত সম বাজে বুকে’ এ কথা। রাগে ক্ষোভে পৃথিবীটাকে উল্টে দিতে ইচ্ছে করছিল, আর মনে হচ্ছিল যদি ওই চার বন্ধুর মতো আমরাও জোর করে বুকিং ছাড়াই রেস্ট হাউস দখল করে নিতাম তাহলে সে স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হতাম না। সমস্ত অধিকার কি কেবল মাত্র আধিকারিকদের জন্যই! আমাদের জন্য কিছুই নয়!
অতএব আমাদের ফিরতে হবে মনোহরপুরে। তবে ফেরার আগে কিরিবুরুটা দেখে যাওয়া দরকার। ওখানকার সূর্যাস্তের সৌন্দর্য আরেকটা আশ্চর্যের। সূর্যাস্তের প্রায় ঘন্টা দুয়েক আগেই আমরা ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে গেলাম। সরকারি উদ্যোগে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে এখানটা। সামনেই যেহেতু খাদ তাই রেলিং দিয়ে ঘিরেও দিয়েছে।
কিরিবুরুকে একটি ছোটো শহর বলা যায়। এই ভিউ পয়েন্টকে কেন্দ্র করে অনেক পাবলিক রেস্ট হাউসও তৈরি হয়েছে। এবং ঝাড়খণ্ড সরকারের কয়েকটি অফিসও রয়েছে এখানে। রাস্তাঘাট সুন্দর করে তৈরি করা।
আমরা এসে দাঁড়ালাম ভিউ পয়েন্টে। সামনে তাকিয়ে দেখি বহুদূর বিস্তৃত অরণ্যভূমি। ছোটো ছোটো টিলার উপর ঘন বন। নীল আকাশের নিচে ঢেউ খেলানো ভূমিরূপের উপর অরণ্যভূমির সজ্জিত অবস্থান আমাকে নিয়ে গিয়েছে কোন রহস্যময় কল্পনালোকে। অরণ্যভূমির উপর স্তরে স্তরে নীল রঙের খেলায় মেতেছে গাছপালা। সামনে যতদূর চোখ যায় তার সবটাই মায়ার জালে আবদ্ধ করে রাখা এক প্রকৃতি।
এই ভিউ পয়েন্ট থেকেই একটা রাস্তা নেমে গেছে বনের দিকে। এই রাস্তা এবং এই সূর্যাস্তের কথায় মনে পড়ে যায় সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘সারান্ডায় শয়তান’ উপন্যাসের কথা। এখন সূর্যাস্তের সময়। এতক্ষণ এখানে আমরা আর কয়েকজন ছাড়া সম্পূর্ণ ফাঁকাই ছিল। কিন্তু সূর্যাস্তের সময়ে কোথা থেকে এত লোক এসে সমস্ত জায়গাটি ভরিয়ে দিল বুঝতেই পারলাম না। তবে এটা বুঝতে পারলাম এ জায়গার বিশেষত্ব গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই বিদিত।
সত্যই কি অপূর্ব এ সূর্যাস্ত। চোখে না দেখে বিশ্বাসই করা যায় না। কল্পনার মন ছুটে যায়- উগাণ্ডার সূর্যাস্তও কি এরকমই সুন্দর!
0 Comments