জ্বলদর্চি

পথ যখন সঙ্গী - ৪

   সুবর্ণরেখা

পথ যখন সঙ্গী (বাংরিপোসি)
পর্ব - ৪

ন রে ন  হা ল দা র


এক উইকেণ্ড-এ বাইকে করে বেরিয়ে পরেছিলাম বাংরিপোসির উদ্দেশ্যে। সঙ্গে স্ত্রী ছিল। গুগুল ম্যাপ দেখে আগেই জেনে নিয়েছিলাম বাড়ি থেকে দূরত্ব প্রায় একশ কিলোমিটার। বাংরিপোসি পশ্চিমবঙ্গ লাগোয়া উড়িশ্যার একটি পাহাড়ি এলাকা। মেদিনীপুর থেকে কলাইকুণ্ডা হয়ে গোপীবল্লভপুর। তারপর ঝাড়খণ্ডকে (বহরাগেরা) ছুঁয়ে বাংরিপোসি। প্রায় পুরোটাই হাইরোড (N.H. 49)। পথে সুবর্ণরেখা নদী। 
বুদ্ধদেব গুহর ‘বাংরিপোসির দু’রাত্রি’ এই বাংরিপোসিকে কেন্দ্র করেই লেখা একটি প্রেমের উপন্যাস। কিন্তু আমাকে প্রেমের থেকে বেশি আকর্ষণ করেছিল এই স্থানটি। পাহাড়ের পাদদেশে একটি ছোট্ট শহর। দুটো মাত্র হোম স্টে। সিমলিপাল খইরি রিসোর্ট একটি, অন্যটি ঘরোয়া থাকার জায়গা। আমরা গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন মধ্যাহ্ণ অতিক্রান্ত। লাঞ্চ সেরে এগিয়ে গেলাম পাহাড়ের দিকে। পথ তেমন কঠিন নয়। সে পথ বাংরিপোসি টপ হিল পেরিয়ে চলে গিয়েছে বিসোই পর্যন্ত। পুরোটাই প্রায় বনপথ। পথের দুধারে অসংখ্য বানর অপেক্ষা করে আছে যাত্রিরা কখন তাদের জন্য কিছু খাবার, বিশেষ করে বিস্কুট ছুঁড়ে দেবে।  
আমরা ফিরে এলাম বাংরিপোসিতে। এবার আমাদের গন্তব্য ব্রাহ্মণকুণ্ড, বাংরিপোসি থেকে তার দূরত্ব প্রায় পনের কিলোমিটার। বুড়িবালামের পাশ দিয়ে রাস্তা। যে বুড়িবালামের কথা সেই কবে ছোটোবেলায় ইতিহাস বইতে পড়েছিলাম। বুড়িবালামের যুদ্ধ। বাঘা যতীনের নেতৃত্বে মাত্র পাঁচজন বিপ্লবীর সঙ্গে ব্রিটিশ পুলিশের যুদ্ধ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সে যুদ্ধের গুরত্ব অসীম। ঘটনাটি ছিল এমন - স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহায্যার্থে জার্মানি থেকে অস্ত্র আসার কথা ছিল উড়িশ্যার বালাসোর উপকূলে। বাঘা যতীন ও তাঁর সঙ্গী বিপ্লবীরা নির্দিষ্ট সময়ের কিছুদিন আগে থেকেই উপকূলবর্তী জঙ্গলে  লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু বিপ্লবীদের সন্ধানে ওই এলাকা তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালাচ্ছিল ব্রিটিশ পুলিশ। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে বেশ কিছু দিন কাটানোর পর শেষ পর্যন্ত সম্মুখ সমরের সিদ্ধান্ত নেন বাঘা যতীন। সঙ্গে ছিলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত এবং নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত। ১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর ভোরে বালেশ্বরের নদী বুড়িবালামের উপকণ্ঠে পৌঁছে একটি ডোবার মধ্যে আশ্রয় নেন। 
   বুড়িবালাম

পাঁচজন অসীম সাহসী বিপ্লবীদের উল্টোদিকে ছিল সশস্ত্র পুলিশ ও সামরিক বাহিনী। পাঁচজন বিপ্লবী শুধুমাত্র মাউজার পিস্তল নিয়ে লড়াই করেন সারাদিন, অন্ধকার নেমে আসা পর্যন্ত। আহত বাঘা যতীনকে ভর্তি করা হয় বালেশ্বরের সরকারি হাসপাতালে, সেখানেই পরদিন তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনাস্থলেই শহিদ হয়েছিলেন চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। 
এ নদীর সৌন্দর্য কোনো হিমালয়ান নদীর থেকে কম নয়। বালির পরিবর্তে ছোটো ছোটো পাথর বিছানো পুরো নদীটা। স্থির জলের গতিতে বাঘা যতীনের বীরত্বগাথা এখনো যেন গেয়ে চলেছে। চড়ার দু’পারে কোমর সমান জঙ্গল ঘাস আর উজানের সুদূরে দেখা যায় আবছা অনুচ্চ টিলা, যেন ধূসর নীল রঙের আল্পনা এঁকে দিয়েছে।
বুড়িবালামকে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে চললাম ব্রাহ্মণ কুণ্ডের উদ্দেশ্যে। 
(চলবে)

Post a Comment

0 Comments