জ্বলদর্চি

বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন -৮

 বিজ্ঞানে ঈশ্বরের চিহ্ন 
পর্ব ― ৮ 


পূ র্ণ চ ন্দ্র  ভূ ঞ্যা   


প্রোটন ক্ষয় : ঈশ্বর ছলনাময় ?

প্রায় এক দশক আগের ঘটনা। টেলিভিশনের পর্দায় একটি বিজ্ঞাপন প্রায়শই দেখা যেত। বিজ্ঞাপনটি ক্যাডবেরি জেমস চকোলেটের। চকোলেটের ছোট ছোট লাল ও হলুদ দানা দিয়ে তৈরি কিম্ভুদাকার এক প্রাণীর অবয়ব। 

 এক পা, এক মাথা। গোটা শরীরে বেশ ক'টা প্যাঁচানো বাঁক। তার পা উপরে দড়ি দিয়ে বাঁধা আর বডি-সহ মাথা নীচের দিকে ঝোলানো। এ হেন প্রাণীর নাকের ওপর নাকছবির মতো নীল রঙের একটি জেমস দানা বসানো। লোভ সংবরণ করতে না পেরে কক্ষে উপস্থিত এক আগন্তুক নীল বর্ণের ওই চকোলেট দানা তুলে নেয়। ব্যাস, তারপর এক আজব ঘটনার সাক্ষী হয় রুমে উপস্থিত লোকজন। তাসের ঘরের মতো এক এক করে খসে পড়ে সমস্ত দানা। হতবাক আগন্তুকও।
                            

প্রিয় পাঠক, ভাবছেন এর সঙ্গে প্রোটনের কী সামঞ্জস্য? ধরুন একটি কক্ষে দণ্ডায়মান আপনি আর আপনার শরীরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানাগুলো (পড়ুন কণা) এক এক করে খসে পড়ল মাটিতে। নিমেষে আপনার অস্তিত্ব ধুলোয় মিশে গেল। কী, অবাক হলেন খুব ? ভয়ও পেলেন কি ? আচ্ছা ধরা যাক, শুধু আপনি একা নন, পৃথিবীর সমস্ত মানুষ, গাছপালা, জীবজন্তু, এমনকি জড় বস্তু সমেত গোটা ধরিত্রী ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে। এবার একটু আশ্বস্ত হলেন বোধকরি এই ভেবে যে শুধু আমি নয়, সবই যখন ধ্বংস হচ্ছে তখন একক ভাবনায় মন সঁপে দেওয়ার বিলাসিতা কেন ? আচ্ছা ধরুন পৃথিবী নয়, এই ব্রহ্মাণ্ডের যেখানে যত ভর আছে, পদার্থ আছে, বিপরীত পদার্থ আছে ― সব ভেঙে যাচ্ছে মৌলিক কণায় ও ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের কোণায় কোণায়। বিগ-ব্যাঙ সময়কার মতো আগের অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে ব্রম্ভাণ্ড। তবে ঘনত্ব ও উষ্ণতা অনেক কম। এবার কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয় ? চলুন, তেমন-ই এক ক্ষণে নিয়ে যাই আপনাকে।

আস্তিকরা বলে  ― মানুষের শরীর নশ্বর, আত্মা অবিনশ্বর ; কতটুকু সত্য এ প্রবাদ ? আত্মা কী ? প্রাণ নামক কোন মায়াজালে আটক ধার্মিক চিন্তাভাবনা ? মানব শরীর কোটি কোটি বছর জীবিত ― এমন সম্ভাবনা কতখানি ? এখন ব্রহ্মাণ্ডের বয়স কত ? আর কতদিন টিকে থাকবে সে ? এমন হাজারো প্রশ্নের ভীড়ে দৈনিক ভাবনাগুলো ওলটপালট খায় বিজ্ঞানীদের।

মানুষের শরীরের উপকরণ কী ? জীববিজ্ঞানের মতে ― কোষ, তন্তুর সমন্বয়ে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জটিল ও কঠিন পরিকাঠামোই হল মানবদেহ। অথচ পদার্থবিজ্ঞান শোনায় ভিন্ন কথা। স্তুপীকৃত মৌল, যৌগের জটিলতম সূক্ষাতিসূক্ষ কারুকার্য মানবদেহ। সেখানে প্রাণের আবির্ভাব কীভাবে, তা জীববিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়, পদার্থ বিজ্ঞানের নয়। এখন মূলত তিনটি প্রাথমিক কণা ― ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি সকল বস্তু (মৌল ও যৌগ)। পদার্থ তৈরিতে নিউট্রন ও প্রোটনকণার বিশেষ ভূমিকা উল্লেখ্য। এই দুই কণার অবস্থান পরমাণুর নিউক্লিয়াস। সেখানে তীব্র নিউক্লিয় বলের প্রভাবে প্রোটন নিউট্রনে এবং নিউট্রন প্রোটনে পরিনত হতে পারে। প্রতিনিয়ত হচ্ছেও । কিন্তু নিউক্লিয়াসের বাইরে মুক্ত অবস্থায় পরিবেশে তারা কীভাবে থাকে ? একটি স্বাধীন নিউট্রনের ভর ১.৬৭৫০ × ১০^(–২৪) গ্রাম ও একটি স্বাধীন প্রোটনের ওজন ১.৬৭২৫ × ১০^(–২৪) গ্রাম। অর্থাৎ নিউট্রনের ওজন প্রোটনের থেকে সামান্য বেশি। এই অতিরিক্ত ওজন কাল হল নিউট্রনের। এর ফলে নিউক্লিয়াসের বাইরের পরিবেশে নিউট্রন চূড়ান্ত অস্থিতিশীল। আইনস্টাইনের E=mC^2 নিয়ম মেনে যেকোন সময় উপযুক্ত পরিস্থিতি পেলে আপনা-আপনি নিউট্রন প্রোটনে পরিনত হবে। কিন্তু উল্টো ঘটনা ঘটে না। তাহলে প্রোটন কি অক্ষয়, অমর ? তাও বলা যাবে না। এর পেছনে কারণ কী ? কসমোলোজীর গ্র্যান্ড ইউনিফায়েড থিওরি বা GUT নিয়ম। এ হেন নিয়মে অঙ্ক কষে বিজ্ঞানীত্রয় আবদুস সালাম (১৯২৬ ― ১৯৯৬),
                                 
 
শেলডন গ্ল্যাসো (জন্ম ― ৫ ডিসেম্বর, ১৯৩২) ও যোগেশ চন্দ্র পতি (জন্ম ― ১৯৩৭ সাল) দেখলেন, একটি প্রোটনের আয়ুষ্কাল ১০^৩০ বছর থেকে ১০^৪০ বছরের মধ্যে। এই সময়কালের ভেতর প্রোটনকণা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তার ক্ষয়ে জন্ম নেবে পাই-মেসন, ইলেকট্রন, পজিট্রন, নিউট্রিনো সহ এক ঝাঁক মৌলিক কণা অথবা গামা বিকিরণ। ঠিক যেমন বিগ-ব্যাঙ সময়কার ঘটনা। যেহেতু ব্রহ্মাণ্ড এখনও সেই কালে পৌঁছয়নি, তাই শুরু হয়নি প্রোটন বিনাশ। সে না-হয় হল। তাতে আমাদের চিন্তিত হওয়ার কী কারণ আছে ? 

চিন্তার নয়, বরং প্রশ্নটা অস্তিত্ব রক্ষার। কারণ এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে যেখানে যত পদার্থ দেখতে পাচ্ছি, তার ৯৯.৯৯% ওজন প্রোটন ও নিউট্রনের অবদান। অর্থাৎ আজকের দৃশ্যমান পদার্থ জগতের পুরোটা তৈরি এই দু'কণার হাত ধরে। এদের সম্মিলিত ভরের জন্য বস্তু, পাহাড়, পর্বত, গাছপালা, জীবজন্তু, মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদি তৈরি হয়েছে। অবশ্যই মহাকর্ষ বলের সৌজন্যে। কিন্তু প্রোটন যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আজকের পদার্থ জগৎ দৃশ্যত ক্যাডবেরি জেমস চকোলেটের মতো ভেঙ্গে পড়বে। আমাদের অস্তিত্ব শূন্যে মিশে যাবে। সে সম্ভাবনা খুব বেশি দূরে নয়। এখন ব্রহ্মাণ্ডের বয়েস ১৩৮০ কোটি বছর বা ১৩.৮০ × ১০^১০ বছর। দুই জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্রেড অ্যাডামস ও ক্যালিফোর্নিয়ার গ্রেগ লগলিন-এর মতে ― ব্রহ্মাণ্ড এখন তার শৈশবে বর্তমান। এ সময়কাল 'স্টেলিফেরাস এরা' বা নক্ষত্র যুগ নামে পরিচিত, যা ১০^০৬ বছর থেকে ১০^১৪ বছর পর্যন্ত ব্যপ্ত। যখন বিশ্ব তার কিশোর-যৌবন দশা 'ডিজেনারেট এরা' (১০^১৫ বছর থেকে ১০^৩৯ বছর)-য় পৌঁছবে, তখন থাকবে না দিন। সবদিকে রাতের অন্ধকার গ্রাস করবে। এ যুগের শেষে কোন নক্ষত্র আলোক বিকিরণ করবে না।  তার মধ্যে সব জ্বালানি হাইড্রোজেন বা প্রোটন নিঃশেষিত হবে। নক্ষত্র বনে যাবে মরা তারা (white dwarf star)। তারায় তারায় হবে সংঘর্ষ। সেই সংঘর্ষ থেকে কদাচিৎ আলোক স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরিত হবে ঠিকই, তবে সে-সময় বিগ-ব্যাঙের পরে পরেই জন্মানো অধিকাংশ প্রোটন কণা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে। এক এক করে ভেঙে পড়বে যেখানে যত ভর আছে সঅব। তারপর ব্রহ্মাণ্ডের অবস্থা কী হবে ? ব্রহ্মাণ্ড এবার ব্ল্যাক-হোল এরা'য় পৌঁছে যাবে। 
                              

টাইম মেশিনে চড়ে ভবিষ্যতে প্রবেশ করে প্রোটন ক্ষয়ের ক্ষণটি দেখতে ইচ্ছে করে না পণ্ডিতদের ? অবশ্যই করে। এর জন্য তারা চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না। ভারতে কর্ণাটক রাজ্যে ব্যাঙ্গালোর থেকে একশ কিলোমিটার দূরে কোলার সোনার খনির সুড়ঙ্গের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিশাল এক ল্যাবরেটরি। সেখানে হবে প্রোটন ক্ষয়ের পরীক্ষা। কীভাবে চলছে এমন কঠিন গবেষণা ? ১৪০ টন লোহা নিয়ে পাতাল-প্রবেশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এত লোহার মধ্যে আছে কোটি কোটি প্রোটন। এক বছরে তাদের মধ্যে দু'একটি প্রোটনের ক্ষয় অসম্ভব না। তারই আশায় হা-পিত্যেস চেষ্টা চলছে খনি-মধ্যে, দীর্ঘ দশ বছর। দু'একটা এমন প্রোটন কণার ক্ষয়ে কী পরিস্থিতি তৈরি হয় তার সন্ধানে দিন রাত এক করে ওৎ পেতে বসে আছেন পণ্ডিতগন, ল্যাবরেটরিতে। এখন অবশ্য ল্যাবরেটরি বন্ধ। টাকার অভাবে। অথচ আমেরিকায় বিজ্ঞানীরা দশ হাজার টন জল নিয়ে মাটির নীচে ফলাফলের অপেক্ষায় দিন গুনছে ― কবে আসবে সেই কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট। ইতালিতে ১৬০ টন লোহা নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নীরিক্ষা। জাপান আরও নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে। সবই হচ্ছে মাটির নীচে, ভূগর্ভে। কসমিক কণা বা মহাজাগতিক রশ্মির ছোঁয়া বাঁচিয়ে। প্রত্যেক দেশ হার থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আবার। ভারত কেবল বন্ধ রেখেছে এ হেন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা, সরকারি উদাসীনতায়। 

প্রিয় পাঠক, সৃষ্টিকর্তা যাকে আমরা ঈশ্বর নামে মানি বা জানি এই ব্রম্ভাণ্ডে পদার্থ-গ্রহ-তারা-মানুষ সৃষ্টি করলেন যদি, তাহলে ধ্বংসের ব্লু-প্রিন্ট কেন রচনা করলেন তিনি ? কী মন্ত্রণাবলে এমন ছলনা তিনি করতে পারলেন ? তবে কি ঈশ্বর বলে কোনকিছু নেই ? মহাবিশ্ব গনিতের নিয়ম মেনে চলছে নিয়মিত ? গনিতের সে-নিয়মে যখন বিনাশ হবে সবকিছু, ধ্বংস স্তুপের ভেতর এককোণে শুধু প্রতিধ্বনিত হবে ব্রহ্মাণ্ডের সবচাইতে উন্নত জীবের এমন সব অবান্তর প্রশ্নের একগুচ্ছ তরঙ্গঢেউ।

Post a Comment

0 Comments