জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা


মেদিনীপুরের বিজ্ঞানীদের কথা

ভা স্ক র ব্র ত  প তি

রত্নগর্ভা মেদিনীপুর। এই জেলা একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ঠিক তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও অনবদ্য ছাপ রেখে গিয়েছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে এখনও। অসংখ্য বিজ্ঞানী আজ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। যাঁদের জন্মভূমি এই মেদিনীপুরের মাটি। 


নারায়ণ চন্দ্র রানা

পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন-২নং ব্লকের সাউরি গ্রামে জন্ম। ১৯৫৪ সালের ১২ই অক্টোবর। বাবার নাম রাজেন্দ্র রানা এবং মা নাকফুঁড়ি রানা। অখ্যাত এক গ্রাম থেকে নারায়ণচন্দ্র রানা হয়েছিলেন একজন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে তাঁর উঠে আসা। সাউরি ভােলানাথ বিদ্যামন্দিরে তাঁর পড়াশুনা। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন ১৯৬৯ সালে। সে সময় যা ছিল অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। কিন্তু তিনি তা পেয়েছিলেন। 
নারায়ণই তাঁর পরিবারের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে উচ্চশিক্ষার দোর ডিঙিয়ে ছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাশ করেন। স্নাতকোত্তরে দ্বিতীয় স্থান পান। এরপর ১৯৭৭ সালে ‘টাটা ইনস্টিটিউট অব ফাণ্ডামেন্টাল রিসার্চ’তে পিএইচ.ডি, শুরু করেন পদার্থ বিজ্ঞানে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার ছিলেন তাঁর গবেষণার গাইড। কিভাবে নক্ষত্র সৃষ্টি হয়েছিল, তার অভ্যন্তরে কি রয়েছে, এবং কিভাবে নক্ষত্ররা মহাবিশ্বে বিরাজমান – এসবই তাঁর গবেষণার বিষয়। Cosmic Microwave Radiation। ১৯৮৩ সালে তাঁর এই গবেষণাপত্রটি বর্ষসেরার স্বীকৃতি পায়। এরপর তিনি ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পােষ্ট ডক্টোরাল করেন। 

অবশ্য তাঁকে আকাশ সম্পর্কে জানতে উৎসাহিত করেন মণীন্দ্র নারায়ণ লাহিড়ী। ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি'র পক্ষ থেকে শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাঁকে। TIFR মুম্বাই থেকে শ্রেষ্ঠ গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ দেওয়া হয় 'গীতা উদগাঁওকার পদক'। পুনে-তে ১৯৯৫ সালে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সম্মান মেলে। ১৯৯৫ এর ২৪ শে অক্টোবর এক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহনের দিন তিনি সারা ভারত থেকে বাছাই করা ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে রাজস্থানের দিল্লি জয়পুর হাইওয়েতে সূর্যের ব্যাস পরিমাপ করতে নেমেছিলেন। সেখানে প্রায় আট কিলোমিটার জুড়ে ৬৬০০০ বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সূর্যের ব্যাস নির্নয় করে ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। 

ক্ষণজন্মা এই বিজ্ঞানীকে আমরা বেশিদিন পাইনি। ১৯৯৬ এর ২২ আগষ্ট মাত্র ৪১ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। খুব ছােটোবেলা থেকেই হৃৎপিণ্ডের অসুবিধা ছিল। ফলে প্রায়শই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বাড়িতে আর্থিক অবস্থা ভালাে ছিলনা। তাই সুষ্ঠু চিকিৎসা করানাে যায়নি। শারীরিক এই অসুবিধার কারণে তিনি বিবাহ করেননি। প্রবলভাবে শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকে স্মরণ করতেন। সেখানে পেতেন বেঁচে থাকার শক্তি এবং প্রেরণা। নিজের পিএইচ.ডি.র থিসিস পেপারটি তিনি উৎসর্গ করেন রামকৃষ্ণদেবের চরণে। 

'Classical Mechanics' এর ওপর তাঁর এম.এসসি.-র পাঠ্যবই আজও ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিদেশের অক্সফোর্ড, হাভার্ড-এও পড়ানাে হয়। ১৯৯৭ সালে প্রকাশ করেছেন - 'Observer's Planner'। ১৯৯৫ এ প্রকাশিত হয় "Challenge to Aestronomy' বইটি। এ বছরই তিনি লেখেন 'Myth and Legends Related to Eclipse' নামে আর একটি বই। এছাড়া তাঁর লেখা 'Night Fall on a Sunny Morning' এবং 'Our Solar System'-ও বেশ আলােড়ন ফেলেছিল। 

আমরা বেশিদিন পাইনি এই বিজ্ঞানীকে। অথচ মৃত্যুর কিছুদিন আগেই ১৯৯৬ এর ১৭জুন থেকে ২৩ জুলাই তিনি ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, পােল্যাণ্ড সহ ইউরােপের ৭টি দেশে ঘুরে ঘুরে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন মহাকাশ বিষয়ে। অতলান্ত মহাকাশের অসীম রহস্য ভেদ করতে তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। সারা জীবনে ৭০টির বেশি গবেষণাপত্র লিখেছেন। দুবার জাতীয় সম্মান পান। 'Evolution of Galaxy and Earth' বিষয়ে গবেষণার জন্য ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে দেওয়া হয়েছিল Wealth Bursnay Award এবং SERC ফেলোশিপ। Indian National Science Academy তাঁকে দিয়েছে Best Young Scientist Award। The National Council for Science Academy and Technology Communication এর পক্ষ থেকে মরণােত্তর সম্মান পান।

বিজ্ঞানী নারায়ণ চন্দ্র রানাকে নিয়ে দীপক কুমার দাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে 'জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নারায়নচন্দ্র রানা' (২০১৭)। 'মনীন্দ্র নারায়ন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ট্রাস্ট' এই বইটির প্রকাশক। এই  সংকলনে রয়েছে বিজ্ঞানীর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা এবং তাঁকে নিয়ে নানা ব্যক্তির স্মরণ ও মূল্যায়ন। ২০১৬ সালে 'ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি'র নিজস্ব 'ইণ্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স' ম্যাগাজিনের ৫১ তম বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় লেখা হয়েছে নারায়ণচন্দ্র রানাকে নিয়ে। এখানে উৎপল মুখোপাধ্যায় ও শৈবাল রায়ের লেখা গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ 'এন সি রানা : লাইফ অ্যাণ্ড হিজ কন্ট্রিবিউশনস ইন অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল সায়েন্স' ছিল বিজ্ঞানীর প্রতি এক অনন্য মূল্যায়ন। এই ২০১৬ সালেই স্বপ্নময় চক্রবর্তী লিখেছেন উপন্যাস 'পাউডার কৌটোর টেলিস্কোপ'। মুলতঃ নারায়ণচন্দ্র নারায়ণ রানার জীবনের কাহিনী নিয়ে এই উপন্যাসের প্রকাশক 'মিত্র ও ঘোষ'। এতে আছে এক প্রান্তিক গ্রামের সাধারণ পরিবারের ছেলের মহাকাশবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার আশ্চর্য কাহিনি। 

আজ তাঁর স্মৃতিতে সাউরি গ্রামে স্থাপিত হয়েছে নারায়ণ স্মৃতি মন্দির। সেখানে তাঁরই দেওয়া দুটি দূরবীণ যন্ত্র (একটি ৬ ইঞ্চি ব্যাস, অন্যটি ১০ ইঞ্চি ব্যাস) রয়েছে। সাউরি ভোলানাথ বিদ্যামন্দিরের প্রয়াত স্যারের জন্য বিদেশ থেকে এনেছিলেন এই ১০ ইঞ্চি ব্যাসের টেলিস্কোপটি। ১৯৯১ তে তিনি গড়ে তুলেছিলেন 'এম এন লাহিড়ী অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'। মেদিনীপুর কলেজে রয়েছে 'এন সি রানা স্কাই অবজর্ভেশন সেন্টার'। যা এখনও মেদিনীপুরের এই প্রয়াত বিজ্ঞানীর স্মৃতি বহন করে চলেছে।



ড. মণিলাল ভৌমিক

খালি পায়ে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হত তাঁকে। আলিনান থেকে কোলা ইউনিয়ন হাইস্কুল। পর্যন্ত তাকে যেতে হত চরম দারিদ্রের সাথে লড়াই করে। তিনি মণিলাল ভৌমিক। আজ যাঁর নাম বিশ্বজোড়া। পূর্ব মেদিনীপুরের শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের অখ্যাত গ্রামের মণিলাল আজ সারা ভারতবাসীর নয়নের মণি। ১৯৩১ এর ৩০ শে মার্চ জন্ম শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের শিউরি গ্রামে। বাবার নাম গুণধর ভৌমিক এবং মা ললিতা ভৌমিক।
একসময় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর সাথে মহিষাদল ক্যাম্পে কাটিয়েছেন। তাঁর বাড়ির অদূরেই মাতঙ্গিনী হাজরার জন্মস্থান। প্রত্যন্ত গ্রামের বুক চিরে জেগে উঠেছিলেন তিনি। স্কুল জীবনের গণ্ডি কাটিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে বি.এসসি. এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় এম.এসসি. করেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নজরে এসে যান তিনি। বদলে যায় মণিলাল ভৌমিকের জগৎ। 

'Resonant Electronic Energy Transfers' বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনিই প্রথম ছাত্র হিসেবে আই.আই.টি খড়গপুর থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ তে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের উপর তাঁর এই গবেষণা। ১৯৫৯ সালে পেয়ে যান Sloan Foundation Fellowship'। 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা তিনি দেখেছেন নিজের চোখে। কিন্তু সেই অভাবের জগতের কালো মেঘ সরতে শুরু করে মনিলালের  'মণিকাঞ্চন'-এর ছোঁয়ায়। 

পােষ্ট ডক্টরাল করতে পাড়ি দিলেন University of California Los Angeles (UCLA)তে। ১৯৬১ সালে সেখানে লেজার বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৭৩ এর মে মাসে Optical Society of America তাঁকে ঘােষণা করে। "Successful Demonstrator of the World's First Efficient Excimer Laser' অভিধায়। ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মণিলালের নাম। অখ্যাত, অজ্ঞাত গ্রামের কালোপানা ছেলেটা হয়ে উঠলো নয়নের মনি। পেয়ে গেলেন Electrical and Electronics Engineers এবং American Physical Society র Fellowship।

আজ মনিলাল ভৌমিককে চেনেনা, এমন বিদগ্ধ মানুষ নেই। আজ তিনি মেদিনীপুরের গর্ব। কাজের মহিমা ও ধারাতেই তিনি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন। তাঁর লেখা দুটি বই আজ সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে বহু চর্চিত বিষয়। মণিলাল ভৌমিকের সর্বশেষ Paper টি হোলো - 'Unified Field The Universal Blueprint'। 

গত ২০১১ তে ভারত সরকার দিয়েছে 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার। ১৯৯৫ তে খড়গপুর আই.আই.টি, দিয়েছে সাম্মানিক 'ডি.এস.সি.' সম্মান। ২০০৬ তে এশিয়াটিক সােসাইটি তাঁকে Fellow নির্বাচিত করেছে। সারা জীবনে ৫০ টিরও বেশি গবেষণাপত্র করেছেন। প্রতিটি বিজ্ঞানী মহলে উচ্চ প্রশংসিত। মনিলাল ভৌমিকের দুটি বিখ্যাত বই সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা হল --


'CODE NAME : GOD'

২০০৫ সালে Crossroads Publishing এই বইটির (ISBN-0-8245-2519-1) প্রকাশ করে। Fritjof Capra তাঁর 'The Tao of Physics' গ্রন্থে মনিলাল ভৌমিকের এই বই সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, 'The Attempt to find common ground between Eastern Spiritually and Western Science is eloquently told and makes for fascinating veading'। আবার আলেকজাণ্ডার সােলঝিনেতসিন বইটি পড়ে লিখেছিলেন - "This example of a personal spiritual growth and Re evaluation of material values.... Arouses very warm feelings. God is one and there are no major differences between religions'।

"THE COSMIC DETECTIVE'

মণিলাল ভৌমিকের লিখিত এই বইটির প্রকাশক 'পেঙ্গুইন'। ২০০৯ তে (ISBN-9780-143330691) প্রকাশিত হয় International Year of Aestronomy (IYA-২০০৯) এর অফিসিয়াল বই হিসেবে। বিশ্বের সাতটি বহুল ব্যবহৃত ভাষাতে অনুদিত হয় তা। এই 'IYA-২০০৯' এর স্লোগান ছিল – 'The Universe - Yours to Discover'। বইটি তারই প্রতিচ্ছবি। Modern Cosmology বিষয়ে নানা তথ্য পরিপূর্ণ ছিল তা। 

CERN এর Dr. Walter Thirring এই বই সম্পর্কে মতামতে জানিয়েছেন, 'The cosmic detective reveals another of Mani Bhowmik's talents, he is an outstanding science writer to complement his demonstrated scientific insight. He has the unique ability to distill from the voluminous material the essential concepts for the general public'। একইভাবে অ্যাপোলো ১৪ এর মহাকাশচারী এডগার মিটচেল মন্তব্য করেছেন, 'Mani Bhowmik builds on recent development in science to bring us new pictures, larger views and insights about the magnificens of our universe'। মণিলাল ভৌমিকের এই বই যে রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছিল তা বোঝা যায় International Astronomical Union এর সভাপতি ড. ক্যাথরিন ক্যাসারস্কির মন্তব্য থেকে। তিনি লিখেছেন, 'The cosmic detective is an inspirational read. Dr. Bhowmik tackles topics with impressive scope, yet delves into them with spirit rarely seen. Marrying scientifically accurate text with accessible language is no easy task, but the cosmic detective is a proof that it can be done'।

বিখ্যাত প্রবন্ধকার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মণিলালকে নিয়ে লিখেছেন 'মণিকাঞ্চন'। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে মিলবে মণি ভৌমিকের লেখা 'ব্ৰহ্ম সত্য জগৎ সত্য : উপনিষদ বিজ্ঞান রবীন্দ্রনাথ' (দাম ১৫০ টাকা) বইটি। মণিলালের জন্ম সোনার চামচ মুখে দিয়ে হয়নি। কিন্তু কর্মগুণে আজ তাঁর জীবনে অঢেল সম্পদ। বিজ্ঞান সাধনায় দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকলেও ভুলে যাননি দেশকে। তিনি আজ আমাদের মেদিনীপুরের গর্ব। এরাজ্যের গর্ব। এ দেশের গর্ব। দেশের যুবসমাজের কাছে আদর্শ তিনি। নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় থাকলে যে কোনও সাফল্য অর্জন করা যায় - তা দেখিয়েছেন মণিলাল।


সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র

১৯২৪ এর ১ সেপ্টেম্বর জন্ম এই বিজ্ঞানীর। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের সাউটিয়া গ্রামে। দাঁতন হাই স্কুলের পর মেদিনীপুর কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়েন। সেখানে বি.এসসি.ও পড়েন। এ সময় তাঁর বাবা কিশােরীরঞ্জন করমহাপাত্র মারা যান। সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল। তবুও কালক্রমে পরিচয় হয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে। প্রবল ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়ার। কিন্তু সেই লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় অবশেষে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যাতে এম.এসসি.তে ভর্তি হন। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, ঐ ভর্তির আবেদনপত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসু নিজেই লিখে দিয়েছিলেন ‘অ্যাডমিট' কথাটি!
ছােট থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকতে ভালােবাসতেন। প্রচুর বইপত্র পড়তেন। কবিতা লিখতেন। কিন্তু মূল পছন্দ ছিল বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি। একদিকে পারিবারিক কারণে জমিদারী-দেখাশুনা, অন্যদিকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমে জীবনের চলার পথে নতুন বাঁক তৈরি হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকায় (অক্টোবর সংখ্যা) সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি লেখা পরপর ছাপানাে হয় তাঁর। সে সময় এই পত্রিকার যাবতীয় বিষয় নজর রাখতেন বিজ্ঞানী গােপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনিই সূর্যের লেখায় মােহিত হয়ে চিঠি লিখে গ্রাম থেকে ডেকে এনে যােগাযােগ করিয়ে দেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে।

এদিকে এম.এসসি. এর রেজাল্ট বের হওয়ার দিনই আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার অধীনে 'সাইক্লোট্রন' প্রকল্পে কাজ শুরু করে দেন। এমনকি পিএইচ.ডি.র জন্য 'মাসস্পেকট্রোমিটার' যন্ত্র বানিয়ে (১৯৫৫) তা নিউক্লিও পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যবহার করেন। পেয়ে যান ডক্টরেট ডিগ্রি। মূলতঃ তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ভর বর্ণালীবিদ্যা এবং আইসােটোপ পৃথকীকরণ। তিনি একাধিক আয়নিক পরমাণু সমষ্টির সংমিশ্রনের বিশ্লেষণের জন্য তড়িৎচুম্বকীয় পদ্ধতিতে এমন এক বিশেষ ধরনের ভর বর্ণালি যন্ত্র গঠন করেছিলেন, যা প্রচলিত যন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর হয়েছিল। তাঁর আবিষ্কৃত এই যন্ত্র আলােড়ন ফেলে দেয় বিজ্ঞানীমহলে। 

নিউক্লিও বিজ্ঞানীদের কাছে সমাদৃত হয় তাঁর তৈরি নানা রকমের আয়ন উৎস। তিনি যখন শুরু করেন আইসোটোপ পৃথক করার কাজ, তখন ভারতে কেউই এই বিষয়ে গবেষণা শুরুই করেনি। কানাডার বিজ্ঞানী এইচ ই ডাকওয়ার্থ, যিনি ছিলেন মাসস্পেকট্রোস্কোপিস্ট তিনি ১৯৬০ সালে ভারতে এসেছিলেন। সূর্যেন্দুবিকাশের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে কানাডাতে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬২ তে রেনে বার্নাস 'আইসোটোপ সেপারেটর আন্তর্জাতিক সম্মেলন'এ ফ্রান্সের ওরস গবেষনাগারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সেসময় ইউরোপীয় বেশ কিছু গবেষণাগারে তিনি যান। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাটমিক অ্যাণ্ড মলিকিউলার ফিজিক্সের ডিরেক্টর কিস্তেমেকার, এহাল্ড, নেলসনদের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৭০ নাগাদ তাঁরই পরিচালনায় সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ আইসােটোপ পৃথকীকরণ যন্ত্র স্থাপিত হয়। ১৯৮৬ তে এখান থেকে অবসর নেন।

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সাথে আজীবন জড়িয়ে ছিলেন তিনি। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯৮১ ৮২ তে দুবার সভাপতি ছিলেন এই পরিষদের। প্রচুর বই লিখেছেন। সম্মানও পেয়েছেন বহু। মিলেছিল 'প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। প্রথমবারের 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পুরস্কার তাঁকে দিয়েছিল বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ (১৯৯৫)। অসংখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ তাঁর কলম থেকে প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'নরসিংহ দাস পুরস্কার' পেয়েছেন ১৯৮৫ তে। পেয়েছিলেন মোয়াট স্বর্ণপদক।

সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র বিজ্ঞানী হিসেবে দুই মেদিনীপুরের গর্ব। গত ২০০৭ এর ২৩ মার্চ আমরা হারিয়েছি এই মহান বিজ্ঞানীকে। অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ সম্পদ হিসেবে রেখে গিয়েছেন তিনি। যাঁরা বিজ্ঞানকে ভালােবাসে, তাঁদের কাছে এই লেখা অমূল্য সম্পদ। ১৯৯৯ সালে 'রবীন্দ্র পুরস্কার' পেয়েছিলেন তাঁর 'সৃষ্টির পথ' গ্রন্থের জন্য। যুক্ত ছিলেন 'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার' ম্যাগাজিনের সাথে। তিনি নানা সময়ে লিখেছেন - 'কণাত্বরণ', 'মহাবিশ্বের কথা', 'পদার্থ বিকিরণ রহস্য', 'মেঘনাদ সাহা জীবন ও সাধনা', 'ভরের বর্ণালি', 'প্রগতি পরিবেশ পরিণাম' ইত্যাদি গ্রন্থগুলি। 

এতো কাজের মধ্যেও তিনি নিজের গ্রাম সাউটিয়াকে ভোলেননি। ১৯৪৩ সালে এখানে বাবার স্মৃতিতে স্থাপন করেন 'কিশোরীরঞ্জন স্মৃতি পাঠাগার'। এই গ্রামেই তাঁর উদ্যোগে ১৯৮২ তে শুরু হয় সাউটিয়া গ্রামীন বিজ্ঞান মেলা। বিজ্ঞানের নানা বিষয় প্রদর্শিত হোতো এখানে। ২০০৯ থেকে এই মেলা বন্ধ। এই গ্রামেই সাউটিয়া হাইস্কুল, সাউটিয়া হাসপাতাল গড়ে তোলার পেছনে তাঁর অবদান যথেষ্ট। ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই লিখেছেন – “বিজ্ঞানী সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্রের জীবন ও কর্মকে স্মরণে আনলে সবার স্বাভিমান জাগ্রত হবে। বিশেষ করে মেদিনীপুরবাসীর'।


রামচন্দ্র মণ্ডল

পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির কশাড়িয়া গ্রামে ১৯২৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন কৃষিবিজ্ঞানী রামচন্দ্র মণ্ডল। প্রথমে হলুদবাড়ি হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীর পাঠ শেষ করে ব্রিটিশের ভয়ে পানখাই গ্রামে মামাবাড়িতে আশ্রয়। সেখান থেকেই উত্তরন নিদারুণ সমস্যাকে সাথী করেই। ১৯৪৯ এ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ পার্বতীপুর স্কুল থেকে। এরপর কাঁথির প্রভাত কুমার কলেজ থেকে আই এস সি। একসময় বাবার সঙ্গে কৃষিকাজ করতেন। আগ্রহটা তখন থেকেই। ফলে ঝাড়গ্রাম কৃষি কলেজে ভর্তি হলেন কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে তুমুল ভালোবাসা থেকে।

১৯৫৭ তে কর্মজীবন শুরু খড়গপুরের বলরামপুরে 'নঈতালিমী' সংঘের লেকচারার হিসেবে। এরপরেই পাঁচমাস বাদে বর্ধমানের পাটুলিতে পূর্বস্থলী এগ্রিকালচার এক্সটেনশন অফিসার হিসেবে যোগ দেন। সেই শুরু। ১৯৬০ থেকে তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটোরে এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি ফার্মে 'ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচার রিসার্চ' এর প্রোজেক্ট অন ইনটেন্সিফিকেশন অফ রিসার্চ অফিসার ইন এগ্রোনমি হিসেবে যোগ দেন। এখানে ছয় বছর কাজ করে কেরলের তিরুবনন্তপুরমে সেন্ট্রাল টিউবার কর্পস রিসার্চ ইনস্টিটিউট এ সিনিয়র রিসার্চ অফিসার ইন এগ্রোনমি হিসেবে যোগদান করেন। কৃষিবিজ্ঞানী হিসেবে ক্রমশঃ তখন এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। এ সময় অল ইন্ডিয়া কো অর্ডিনেটেড প্রোজেক্ট টিউবার কর্পস এ প্রোজেক্ট কো অর্ডিনেটর এবং ডিরেক্টর ইনচার্জ ছিলেন এক বছর। ১৯৭১-৭৩ পর্যন্ত ভারত সরকারের'প্রিন্সিপ্যাল সায়েন্টিস্ট' হিসেবে ফিজি সরকারের কাজে যোগ দেন।

ফিরে এলেন দেশে। ১৯৭৩-১৯৭৮ পর্যন্ত গোয়ায় আই সি এ আর এর জয়েন্ট ডিরেক্টর ছিলেন। এরপর কর্ণাটকের ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর ক্যাসিউর জয়েন্ট ডিরেক্টর ছিলেন ১৯৮০-১৯৯০ পর্যন্ত। তৈলবীজ ও জোয়ার বাজরার উন্নত ফলনের নানা পদ্ধতি তিনি চালু করেন। যা 'রিটোনিং' নামে পরিচিত। কৃষিবিজ্ঞানের নিরন্তর গবেষণা থেকে তিনি লিখেছেন 'এনসাইক্লোপেডিক ডিকশনারি অফ বায়োলজি, এগ্রিকালচার অ্যাণ্ড লাইফ সায়েন্স'। এটি এই রকম ধারার বিশ্বের একমাত্র বই। ১৯৮৯ তে চাকরি থেকে অবসরের পর ১৯৯৬ তে খেজুরির বিধায়ক হয়েছিলেন। আজও তিনি ডুবে রয়েছেন গাছের পরিচর্যা আর বনৌষধীতে।


নন্দগোপাল সাহু

পশ্চিম মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ের কুনারপুর অঞ্চলের চকগণকা গ্রামে ১৯৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী নন্দগোপাল সাহু। এখন নৈনিতালের কুমায়ুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানো সায়েন্স অ্যাণ্ড ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে গবেষণারত ২০১৩ থেকে। এখানকার উপাচার্য রাকেশ ভাটনগর তাঁকে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ করেছেন এখানে। 
ভারত সরকারের কেমিক্যালস অ্যাণ্ড ফার্টিলাইজারস মন্ত্রকের কেমিক্যাল ও পেট্রোকেমিক্যাল বিভাগ থেকে অষ্টম জাতীয় পুরস্কার পানমাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূলতঃ পলিমার ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট ও রিসাইক্লিং পেট্রোকেমিক্যাল অ্যাণ্ড ডাউনস্ট্রিম প্লাস্টিক প্রসেসিং ইণ্ডাস্ট্রি আবিষ্কারের জন্য এই স্বীকৃতি। উপরাষ্ট্রপতি এম বেঙ্কাইয়া নাইডু এই পুরস্কার তুলে দেন।

গ্রামের স্কুল থেকে পড়ার পর কাঁথির প্রভাত কুমার কলেজ থেকে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা। এরপর বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৭ তে স্নাতকোত্তর পাশ। ২০০০ সালে খড়গপুর আই আই টি তে পলিমারের ওপর মেটেরিয়াল সায়েন্স নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ২০০৪ এ পি এইচ বি  লাভের পর ২০০৫ এদক্ষিন কোরিয়ার কনকু বিশ্ববিদ্যালয় ও সিঙ্গাপুর থেকে পলিমার ন্যানো কম্পোজিট নিয়ে পোস্ট ডক্টোরাল করেন। এখন তিনি প্লাস্টিক আর গ্রাফিন  নিয়ে কাজ করছেন। 'স্বয়ম্ভূ ২০২১' নামে তাঁর এই প্রকল্পে একসময় প্লাস্টিক সমস্যার সমাধান হবে বলে তাঁর বিশ্বাস। আজ তিনি গ্রাফিন আর প্লাস্টিক নিয় কাজ করতে থাকা দেশের অন্যতম এক বিজ্ঞানী। মেদিনীপুরের গর্বের মানুষ।


রনজিৎ কুমার সামন্ত

মহিষাদলের অতি সাধারণ গোপালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে উত্তরণ। তারপর মহিষাদল রাজ কলেজ। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি ডিগ্রি লাভ 'কৃষি সম্প্রসারণ' বিষয়ে। তিনিই আমাদের অন্যতম কৃষিবিজ্ঞানী রনজিৎ কুমার সামন্ত। একসময় দেশের ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ এগ্রিকালচার রিসার্চ অ্যাণ্ড ম্যানেজমেন্ট এর ডিরেক্টর পদে ছিলেন।

প্রচণ্ড আর্থিক সঙ্কটে থেকেও তিনি আজ প্রতিষ্ঠিত  আই আই এম কলকাতা, কোঝিকোড, আহমেদাবাদে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এছাড়া ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকার কর্নেল ও সাইরাকাসে গিয়ে আধুনিক কৃষির ওপর দখল লাভ করেন। এক সময় হিমাচল প্রদেশ সরকারের (১৯৯৫-৯৬) কৃষি উপদেষ্টার কাজ করেছেন। এখন হায়দরাবাদে থেকে আখ, সোনালী ধান, রাবার গবেষণা বোর্ডের মধ্যে থেকে কাজ করছেন। ইতিমধ্যেই ১৮৪ টি গবেষণাপত্রের এবং কৃষি গবেষণার ওপর ২২ টি বই লিখেছেন মহিষাদলের এই কৃষি বিজ্ঞানী।


বাসুদেব প্রধান

পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের পশ্চিমবঙ্গ ওড়িশা সীমান্তবর্তী গ্রাম বামনদা। প্রত্যন্ত গ্রামের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। লন্ঠনের আলোয় পড়াশোনা করে আজ তিনি এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিজ্ঞানী। তিনি বাসুদেব প্রধান। মেদিনীপুরের গর্ব। 

গত ২০১২ থেকে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব ঝাড়খণ্ডের এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক। এর মধ্যেই ২০১৮-২০১৯ এ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি তে ন্যানোসায়েন্স টেকনোলজি সেন্টারে ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট ছিলেন। কল্যানি বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় স্নাতকোত্তর পাশ করে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কালটিভেশন অফ সায়েন্স থেকে পিএইচডি লাভ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সোলার সেলের ওপর কাজ করেন। জার্মানিতে পেয়েছেন অত্যন্ত সম্মানজনক আলেকজান্ডার ভন হুমবোল্ট ফেলোশিপ। বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টোরাল ফেলো ছিলেন তিনি।

ইংল্যাণ্ডের শেফিল্ড হ্যালম বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যানো ইলেকট্রনিক্স রিসার্চ ল্যবরেটরিতে, সারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে, জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, আমেরিকার অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল অফ মেটেরিয়ালসে, উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন ও জীবরসায়নবিদ্যা বিভাগে রিসার্চ ফেলো এবং পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। এখন কম খরচে উন্নতমানের সৌরকোষ তৈরির কাজে নিয়োজিত বেলদা গঙ্গাধর একাডেমী থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা মেদিনীপুরের এই কৃতি বিজ্ঞানী।


ড. অমল কুমার মণ্ডল

তিনি এখন পরিচিত উদ্ভিদবিজ্ঞানী। প্লান্ট ট্যাক্সোনমি, জীববৈচিত্র্য, বিজ্ঞান ও সমাজের জন্য উল্লেখযোগ্য কাজ করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের নিরিখে ২০২০ তে 'সোসাইটি ফর বায়োটিক এন্ড এনভারমেন্টাল রিসার্চ' (এস বি ই আর) থেকে সম্মাননীয়  ফেলোশীপের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি এন্ড ফরেস্টের বিভাগীয় অধ্যাপক ড. অমল কুমার মন্ডল। সম্প্রতি তিনি এই সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন।
২০১২ তে ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাঞ্জিওস্পার্মস ট্যাক্সোনমির ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৩ তে লিলিয়ান সোসাইটি অব লণ্ডনের (স্থাপিত-১৮৭৬) ফেলো নির্বাচিত হন। ঐ বছরই পান 'ভারত জ্যোতি' সম্মান। এছাড়াও অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন মেদিনীপুরের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই উদ্ভিদবিজ্ঞানী।

সম্প্রতি এস বি ই আর এর এডভাইসর অর্ধেন্দু চক্রবর্তীর কাছ থেকে তিনি এই ফেলোশীপ সংক্রান্ত একটি চিঠি পান। আন্তর্জাতিক স্তরের সম্মান এটি। ২০০৬ সাল থেকে জীব বৈচিত্র্যের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র দীঘা, মন্দারমনি, সুন্দরবন সহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় পরিবেশের ভারসাম্যের সঙ্গে জীব বৈচিত্র্যের সাযুজ্য রক্ষা করার ক্ষেত্রে তিনি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। 

২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত পঞ্চবার্ষিক বিশ্ব উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে আলোচক হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন ড.অমল কুমার মন্ডল। তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেবছর পাঁচ সদস্যের  গবেষকদের একটি দল সেবছর মেলবোর্ন গিয়েছিল। বায়োডাইভারসিটি এন্ড এনভারমেন্ট এই বিষয়ে পশ্চিমবাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের পাঁচটি জেলা মূলতঃ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম এবং পূর্ব মেদিনীপুর ওই এলাকাগুলিতে জীববৈচিত্র্যের উপর কাজ করে অমলবাবুর কাছে ইতিমধ্যে ১০ থেকে ১২ জন গবেষক সম্মানিত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় কর্মরত রয়েছেন। তাঁর পি এইচ ডি'র বিষয় 'The Ecofloristics survey of Burdwan District West Bengal with special reference to allergenic significant plants'। ১৯৯৯ তে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছিলেন।


সৌভিক মাইতি

১৯৭১ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের ময়নার তিলখোজা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বিজ্ঞানী সৌভিক মাইতি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই মানুষটি আজ কোরোনা ভাইরাসের পরীক্ষার কিটস তৈরি করেছেন। বিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন সম্মানজনক 'শান্তিস্বরূপ ভাটনগর' পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে। ২০১৪ তে মিলেছিল এই পুরস্কার। এর আগে ২০০৭ এ পেয়েছেন 'ইয়ং সায়েন্টিস্ট পুরস্কার'। ২০০৯ এ পেয়েছেন 'স্বর্ণজয়ন্তী ফেলোশিপ'। এছাড়া 'ডিডিটি ন্যাশনাল বায়োসায়েন্স অ্যাওয়ার্ড' পেয়েছেন ২০১৫ তে। মূলতঃ নিউক্লিক অ্যাসিডের গঠন এবং তার কার্যকারিতার ওপর তাঁর গবেষণার ফসল এই পুরস্কারগুলি। এখন গবেষণা করছেন 'সিকল সেল অ্যানিমিয়া' নামের এক বংশগত রোগ নিয়ে।
কথায় বলে 'ওল কচু কিটনা, তিন নিয়ে ময়না'। প্রত্যন্ত জলডোবা ময়নার বুক থেকে উঠে এসে আজ তিনি দেশের অন্যতম বিজ্ঞানী। প্রথমে তিলখোজা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠ শুরু। সরকারি স্কুল ছিলো তা। এরপর বৈকুণ্ঠ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে সবংয়ের ভেমুয়া অটলবিহারী হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৮৭ তে। উচ্চমাধ্যমিক করেন পিংলার গোবর্ধনপুর প্রমথনাথ হাইস্কুল থেকে ১৯৮৯ সালে। 

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মূল রসায়নে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে হায়দরাবাদের সি এস আই আর ইণ্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ১৯৯৯ তে পলিমার কেমিস্ট্রি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপরই ঐ বছরই তিনি পাড়ি দেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব নেব্রাস্কার 'মেডিক্যাল সেন্টার কলেজ অব ফার্মাসী' থেকে 'বায়ো ফার্মো ডায়নামিক' বিষয়ে পোষ্ট ডক্টোরাল করতে। ২০০১ এ ফ্রান্সের ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্স ক্যুরি ইনস্টিটিউট থেকে 'ডি এন এ ন্যানো টেকনোলজি' নিয়ে আবারও পোষ্ট ডক্টোরাল করেন। ২০০২ তে বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা 'ইনস্টিটিউট অ্যাণ্ড জেনোমিক্স ইন্টিগ্রেটেড বায়োলজি'তে।

Post a Comment

15 Comments

  1. অসাধারণ একটি প্রতিবেদন। একেবারে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাঁরা দেশ ও জাতির সেবায়
    নিয়োজিত প্রাণ তাদের নিয়ে এমন
    লেখার উৎসাহী মানুষটি র জন্য অনেক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা।
    এমন লেখা আরও আসুক।

    ReplyDelete
  2. অত্যন্ত মনোগ্রাহী, অসাধারণ লেখা। কৃতি মানুষদের এই কাহিনি সকলের জানা উচিত। লেখক কে কৃতজ্ঞতা।

    ReplyDelete
  3. পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  4. পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  5. অত্যন্ত মূল্যবান প্রবন্ধ । ভালো লাগলো ।

    ReplyDelete
  6. ভাস্কর ভাইকে অনেক দিন থেকেই চিনি একজন প্রকৃত অনুসন্ধানী লেখক হিসাবে। সমীক্ষা ভিত্তিক কাজে তার তুলনা নেই। অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Download করে কপি সংগ্রহ করলে আপত্তি আছে কি? Sudeb bhattacharyya।

      Delete
    2. করুন 🙏🏻

      Delete
  7. ধন্যবাদ সকলকে

    ReplyDelete
  8. Osadharon protibedon... emon prato-sworoniyo scientist der jibonkahini emon sundor vabe tule dhorar jonnyo.... Bhaskarbrata Pati ke amar ontorer shrodhya janai... Uni nije o Medinipur er gorbo.

    ReplyDelete
  9. Congratulations 👏

    ReplyDelete
  10. ধন্যবাদ সকলকে

    ReplyDelete