জ্বলদর্চি

ভীমপূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব ৭

ভীমপূজা

ভাস্করব্রত পতি


একবার পঞ্চপাণ্ডবের মা কুন্তী একাদশী ব্রত পালন করার মনস্থির করেছিলেন। এজন্য তিনি স্নান করবেন। কিন্তু মাঘ মাসের প্রবল ঠাণ্ডায় কিছুতেই তিনি জলে নামতে পারছিলেন না। ফলে স্নান না হওয়ায় একাদশীর ব্রত পালনও হচ্ছিল না। এ খবর জানতে পেরে ভীম তৎক্ষণাৎ তাঁর লাঙ্গলের ফলাটি গরম করে ঐ কনকনে ঠাণ্ডা জলে ডুবিয়ে দেন। এতে জল গরম হয়ে ওঠে। তখন অনায়াসে কুন্তী সেই জলে স্নান করে একাদশী পালন করতে পেরেছিলেন। তখন মহাখুশি হন কুন্তী। তাঁরই আদেশে এবং ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশে মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের ঐ একাদশী তিথিটির নামকরণ করা হয় ভীমের নামে। আবার কারও কারও মতে, মাঘ মাসের শেষ বৃষ্টিতে ভিজে ভীম মর্ত্যে প্রথম চাষ শুরু করেন। সেই চাষ শুরুর দিনটি ছিল মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি। সেই চাষ শুরুর ঘটনাকে প্রতীয়মান করে তুলতেই নামকরণ হয় ‘ভীম একাদশী’। দক্ষিণবঙ্গের এক অন্যতম লৌকিক উৎসব এই ভীম একাদশীতে ভীম পূজা।

মহাভারতের কাহিনী অনুসারে ভীম মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের যে একাদশী তিথিতে একাদশী পালন করে বিষ্ণুপূজা করেছিলেন সেটাই ‘ভীম একাদশী’। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশানুসরে এই একাদশী তিথিতেই বিষ্ণুপূজা শেষে ভীম বধ করেছিলেন জরাসন্ধ এবং দুর্যোধনকে। ভীম একাদশীতে কিন্তু ভীম পূজার কোনও নিদান বা বিধান মেলেনা। প্রদীপকুমার চক্রবর্তী লিখেছেন – “এই একাদশী ভীমের উপাসিত একাদশী, কৃষ্ণের নির্দেশে দশমীর দিন সংযম করে একাদশীর দিন উপবাস করে, দ্বাদশীর দিন পালন করেছিলেন তিনি। এই দ্বাদশী সেজন্য ‘মাঘ দ্বাদশী’ বা ‘কল্যানিনী ব্রত’ বলে খ্যাত”। 

তবে শাস্ত্রানুসারে জৈষ্ঠ্যমাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে নির্জ্জলৈকাদশী ব্রত পালন করা হয়। এটিই নাকি প্রকৃত 'ভীম একাদশী'। যদিও এই একাদশী তিথিতে গ্রামবাংলার কোথাও ভীমের পূজা হয়না। লোকগাথা অনুযায়ীই ভীম একাদশীর সৃষ্টি। লোকবিশ্বাসের পথ ধরেই লৌকিক কৃষি দেবতা হিসেবে ভীম পূজিত হয়ে আসছে। শাস্ত্রানুযায়ী নয়। বরং শাস্ত্রানুসারে মাঘ মাসের শুক্লা একাদশী থেকে শুরু করে পূর্ণিমা পর্যন্ত এই পাঁচ দিন ধরে একটি বিশেষ ব্রত পালন হয় কোথাও কোথাও। যা পরিচিত ‘ভীষ্মপঞ্চক ব্রত’ নামে। প্রতিদিন সকালে স্নান করতে হয়। একাহার, হবিষ্যান্ন করতে হয় ব্রতীকে। শেষ দিন অর্থাৎ পূর্ণিমার দিন, যথাযথভাবে শ্রীবিষ্ণুর পূজা সেরে ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে ভীষ্মপঞ্চক ব্রত ভঙ্গ করতে হয়। কিন্তু ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তবর্তী এলাকায় কার্তিক মাসে এই ব্রতের উদযাপন হয় বলে জানান বিশিষ্ট শিক্ষক এবং লোকসংস্কৃতি গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্র।

কৃষিদেবতা হিসেবে পূজা পায় মধ্যমপাণ্ডব ভীম। কেবলমাত্র দক্ষিণ বঙ্গের কয়েকটি জেলাতেই এই লৌকিক উৎসব সীমাবদ্ধ। পূর্ব মেদিনীপুর এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জুড়ে ভীমপূজার আধিক্য দেখা যায়। মানুষের মধ্যে সংস্কার রয়েছে যে মেদিনীপুর বৃত্তে যে ভীমের আরাধনা করা হয় সেই ভীম নাকি মাঘ মাসের শুক্লা একাদশীর তিথিতে বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে পৃথিবীতে প্রথম হলকর্ষণ করেছিলেন।

এই হাল বা লাঙ্গলের ফাল তৈরি হয়েছিল শিবের ত্রিশূল থেকে। পল্লব সেনগুপ্ত লিখেছেন, “প্রধানত ঘাটাল মহকুমাতেই ব্যাপকতম প্রসার ঘটলেও লৌকিক দেবতা ভীম মেদিনীপুরের আরো অন্য অনেক অঞ্চলেই অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। পৌরাণিক ভীম এবং লোকায়ত সংস্কৃতির উৎসব ভীম এর মধ্যে মিশে গেছেন বলেই মনে করা যেতে পারে। বিভিন্ন কিংবদন্তী এবং লোকপুরাণবৃত্ত এই দেবতা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ভাবনাকে সংগঠিত করেছে ধীরে ধীরে।”

ভীমপূজোর তথাকথিত কোনো মন্ত্র তেমন নেই। একাদশী তিথি পড়লে ভীমের পূজা হয় – দিনে, সন্ধ্যা বা রাত্রে। তবে তিথি রাতে পড়লে চার প্রহরে চারবার পূজার্চ্চনা হয়। ভীম পূজার সময় নানা লোকাচার মানা হয়। যেমন ঢেঁকির কাজ বন্ধ থাকে। হলকর্ষণ বন্ধ থাকে। এছাড়া কাপড় কাচা, চুল দাঁড়ি কাটা, ধান সেদ্ধ করা, কামারশালার কাজও বন্ধ রাখার নিয়ম আছে ভীমঠাকুরের পূজার সময়। 

গ্রীক নায়ক প্রমিথিউস, হারকিউলিসের সাথে তুলনা করা হয় লোকায়ত ভীমকে। এই প্রমিথিউস দেবলোক থেকে মানুষের জন্য আগুন চুরি করে আনার জন্য শাস্তি ভোগ করেছিলেন। আর এই ভীম মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটানোর জন্য শুকনো এবং ঊষর প্রান্তরকে করে তুলেছেন শস্যশ্যামলা বসুন্ধরা। তবুও যথার্থ মর্যাদা দেওয়া হয়নি তাঁকে। ভীমঠাকুরের জলঘট বিসর্জন দেওয়া হলেও ভীমঠাকুরকে বিসর্জন দেওয়া হয় না। গবেষক দীপঙ্কর দাস লিখেছেন – “মূর্তি পূজাস্থলীতে খাঁড়া দাঁড়িয়ে থাকে, রোদে জলে একটু একটু করে মাটি খসে পড়ে। খড় পচে যায়। শেষে ধসে পড়ে। এর থেকেই ক্ষেত্রপাল চরিত্র পরিস্ফুট। ভীমের কাজ তো মাঠ পাহারা দেওয়া, শষ্য রক্ষা করা। কাকতাড়ুয়ার পরিশীলিত সংস্করণ। লৌকিক প্রথায় বোধ হয় ঘট পাতা হত না। নৈবেদ্য ধরে দিয়ে চাষীরা পুজো শেষে ঘরে ফিরে যেত এই বিশ্বাস নিয়ে যে ভীম ক্ষেত পাহারা দেবেন। পূজাস্থলী নির্বাচন করা হত কয়েকটি ক্ষেতের সম্মিলন হয়েছে এমন একটা মাটির ঢিপির উপরে।”
ভীমের পূজায় নৈবেদ্য সাজানো হয় সাধারণ দেবদেবীর মতোই। এতে থাকে – আলোচাল, পাকাকলা, মিষ্টান্ন, নানাধরণের ফলমূল, লুচি, পায়েস ইত্যাদি। এইসব নৈবেদ্য ছাড়াও সেদ্ধ রাঙা আলু এবং সেদ্ধ মুগডাল দেওয়া হয় পূজায়। কোথাও কোথাও তিলা বাতাসা এবং গুড়ের পাটালী দেওয়ার রীতি রয়েছে। তবে কোনও কোনও স্থানে সেদ্ধ রাঙা আলু এবং সেদ্ধ মুগডাল নুনবিহীন ভাবে দেওয়ার চল রয়েছে। তবে এগুলি কাঁচা হিসেবেও দেওয়া হয়ে থাকে। ভীমের গলায় বেলপাতা, ফুলের মালার পাশাপাশি নানা আকারের বাতাসার মালা পরানোর রেওয়াজ বেশিরভাগ স্থানে। থালার মতো বাতাসার মালা দেওয়া হয় তমলুকের কূলবেড়্যা এবং ব্যাবর্তাহাটের তাড়াগেড়িয়াতে। টাকার মালাও পরানো হয় এখানে। বেশিরভাগই মানসিক শোধ করার জন্য। অনেকে পেতলের গদা দান করেন। তাছাড়া ভীমঠাকুরের কাছে পুতুল দেওয়ার চলও দেখা যায়। সর্বত্রই ভীমকে কৃষির দেবতা হিসাবেই পূজা করা হয়। শিবের অন্যতম কৃষি সহযোগী এই ভীম। তাঁর কাজ হাল করা। তাই ভীমকে বলা হয় 'হেল্যা ভীম'। স্বভাবতই ভীম পূজার আয়োজনে কৃষিজ দ্রব্য ব্যবহারের প্রচলন বেশি লক্ষ্য করা যায়।

ভীমপুজার মন্ত্রেরও তেমন কোনও বই নেই। মূলতঃ উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণদের দ্বারা ভীমঠাকুরের পূজাচার বৈদিক পূজার রীতি অনুসারে হয়ে থাকে। সব ক্ষেত্রেই ঘটস্থাপনের মাধ্যমে পূজার সূচনা হয়। তবে তার আগের দিন যাবতীয় মানসিক পুতুল, মালা, অর্থ ইত্যাদি ভীম মন্দিরে ব্রতীদের দিয়ে যেতে হয়। ব্রতীদের এদিন নিরামিষ খাওয়া বাধ্যতামূলক। তাড়াগেড়িয়াতে শোভাযাত্রা করে ঘটোত্তলনের পর ‘দণ্ডীভাঙ্গন' শুরু হয়।

ভীমের ঘট বসানো হয় সাদা থানের ওপর। ঘটের মাথায় ডাব বা নারকেলের পরিবর্তে মাটির সরা বসানো হয়। এতে থাকে আলোচাল। সেই আলোচালের উপরে বসানো হয় ডাব এবং নতুন গামছা। ভীমপূজার সময় কোনও কোনও গ্রামে গ্রামবাসীদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে শাঁখালু, রাঙা আলু, গোটা মুগ, গোটা ছোলা, গোটা কলাই ভিজিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। কেউ কেউ আবার এই দিন ‘সাতশাক’ বা ভাতের সঙ্গে সাত ধরণের শাক রান্না করে খায়। ঠিক যেমন ভূত চতুৰ্দ্দশীর সময় মানুষজনের চৌদ্দ ধরণের শাক খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে, তেমনই। ভীমপূজায় তার ঠিক অর্ধেক ধরণের শাক খাওয়ার আগে উপোস করে থাকার নীতিও মেনে চলেন অনেক। ভীমপূজায় একাসনেই আবাহন ও বিসর্জন করে দেন পুরুত ব্রাম্ভণ।

ভীমদেবতাকে প্রসাদ হিসেবে দেওয়া বিশেষ ধরণের ‘মকর' সম্পর্কে দীপঙ্কর দাস বিবরণ দিয়েছেন – “আলুনি মুগ ও রাঙালু সেদ্ধ দিয়ে মকর অবশ্যই চাই। এই মকর জিনিসটা রাঢ় বাংলার একটা অত্যাবশ্যক পূজোপকরণ। মুগ ভিজে, দুধ, গুড় বা মধু, আখের টুকরো, শাঁখালু, রাঙালু, শশাকুচি, মটর ইত্যাদি দিয়ে ঘাঁটা একটা পদার্থ।” তবে এই ‘মকর’ এর সাথে পৌষ সংক্রান্তির দিন তৈরি ‘মকর’ এর পার্থক্য হল, এতে চাল বাটা দেওয়া হয়না।

ভীমপূজার রকমফের একদিক থেকে শিবের অনুচর ভীমকে লোকায়ত কৃষিদেবতা রূপে প্রতিভাত করতে পেরেছে। ঘটের নীচে সাদা থান আসলে পরিচ্ছন্ন বীজ বপনের প্রতীক। ঘটের উপরে রাখা মাটির সরাতে রাখা সাদা আলোচাল পরিপূর্ণ খাদ্য সম্ভারের প্রতীক। ভাতের সঙ্গে ‘সাত শাক' খাওয়ার রীতি চিহ্নিত করে বিবিধ উৎপাদিত শস্যকে। আবার রাঙালু, শাঁখালু, কলাই, আখ ভক্ষণ বিভিন্ন উপাদানকে স্মরণ করে। এগুলি সবই কৃষির সাথে সম্পৃক্ত। 

বেশিরভাগ স্থানে ভীমের পূজার পূজকরা হলেন ব্রাহ্মণ। কোথাও কোথাও দুলে বাগদি বা অন্য কোনও অব্রাহ্মণ শ্রেণীর মানুষ পূজা করেন বলে জানা গেছে। হুগলীর খানাকুলের রাজহাটে দুলে সম্প্রদায়ের পূজক সন্ন্যাসী পণ্ডিত এবং শ্যাম পণ্ডিতদের পূজো করতে দেখা গেছে। আসলে লোকায়ত কৃষিদেবতা হিসেবে ভীমের পূজার্চনা হয়। তাই পূজকদের তালিকায় অবধারিত ভাবে চলে আসে গ্রামের লোকায়ত মানুষজন।

ভীম পূজা হয় সার্বজনীনভাবে। কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা কোনও নির্দিষ্ট পরিবার এককভাবে পূজা করেনা। একসাথে মিলিত জনগণের সমবেত প্রচেষ্টায় ভীম হয়ে ওঠেন সার্বজনীন দেবতা। একসময় তিলি, লোহার, গোয়ালা, মাঝি, বাগদি, ডোম, সদগোপ ইত্যাদিদের দ্বারা পূজা হত। ইদানিং সব ধরণের হিন্দু লোকজনের মধ্যেই পূজার চল শুরু হয়েছে। কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় ছাড়া সাঁওতাল থেকে ব্রাহ্মণ, মাহিয্য, কায়স্থ সকলেই পুজোয় যোগদান করে। মেদিনীপুর জেলা জুড়ে ভীমঠাকুর হয়ে উঠেছেন কৃষিজীবী মানুষের আত্মিক দেবতা।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments