জ্বলদর্চি

শকুন্তলা দেবী

শকুন্তলা দেবী: সম্পর্কের জটিল অঙ্কে সাজানো গল্প

পী যূ ষ  প্র তি হা র


শকুন্তলা দেবী (০৪/১১/১৯২৯-২১/০৪/২০১৩) ছিলেন একজন ভারতীয় গণিকতজ্ঞ এবং লেখক। তিনি তার গণিতে পারদর্শিতার জন্য গীনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের অধিকারী এবং কম্পিউটারের থেকেও দ্রুতগতিতে গুন,ভাগ, বর্গমূল করতে পারার জন্য 'হিউম্যান কম্পিউটার' হিসেবে বিখ্যাত।
এমন একটি বাস্তবের চরিত্র, যিনি তাঁর গণিতে পারদর্শিতার কারণে মূলত বিখ্যাত, তাঁকে নিয়ে বায়োপিক দেখব ভাবলেই মনে হয় গণিতের কচকচির মধ্যে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু দেখতে বসে মনে হল গণিত বেশ উপভোগ্য হতে পারে যদি তার পরিবেশন ঠিকঠাক হয়। বলা বাহুল্য যে, এ ছবিতে সম্পর্কের জটিল টানাপোড়েন, ভালোবাসা-ঘৃণা, মান-অভিমান এবং গণিত পুরোমাত্রায় রয়েছে এবং এই সমস্ত মশলা দিয়ে পাকা রাঁধুনি অর্থাৎ পরিচালক অনু মেনন একটি সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করেছেন। আসলে বাস্তবকে মাথায় নিয়ে অনু মেনন এবং নয়নিকা মাথানি যে গল্পটি লিখেছেন তার উপযুক্ত সংলাপ লিখেছেন ঈশিতা মৈত্র। গল্প এবং সংলাপ যদি টানটান হয় তাহলে অর্ধেক কাজ হয়েই থাকে। বাকিটা পরিচালক এবং অভিনেতারা ঠিকঠাক করলেই হল। অনেকদিন পর হিন্দীতে এরকম মেদবর্জিত টানটান বায়োপিক দেখলাম।
এ ছবির শুরুতেই দেখানো হয় মায়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইছেন মেয়ে, তারপর ফ্ল্যাশব্যকে শকুন্তলার ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠা। অঙ্কের অসাধারণ জ্ঞান তাকে তার বাবার কাছে উপার্জনের মেশিন বানিয়ে দেয়। তার কোন ইচ্ছাই মর্যাদা পায় না। তার একমাত্র হাসি-কান্নার সঙ্গী তার দিদি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেও তার মা কিছু বলে না। মা-বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে বাড়ি ছাড়ে সে। বেঙ্গালুরুতে অঙ্কের স্টেজ শো করে রোজগার ও প্রেমে পড়া। পরে সেই প্রেমিক তাকে ধোঁকা দিলে সে তাকে গুলি করে দেশ ছেড়ে লন্ডন চলে যায়। বিদেশ বিভুঁইয়ে অত্যন্ত কষ্টে আস্তে আস্তে তার গণিতের প্রতিভার সাহায্যে এগিয়ে চলার পথ পায়‌। এখানেও প্রেম এবং প্রত্যাখ্যান। অবশেষে বাঙালি পরিতোষ ব্যানার্জীর সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে। তাদের সন্তান হয় অনুপমা ব্যানার্জী। অনু চায় তার বাবা-মায়ের ভালবাসা, সে চায় স্কুলে পড়তে। অঙ্কের কচকচি তার ভালো লাগে না, ভালো লাগে না মায়ের অঙ্কের প্রেম, ভালো লাগে না হোটেল থেকে হোটেল সারা বিশ্বে ঘুরে বেড়াতে। অন্যদিকে পরিতোষ চান তার মেয়ে শৈশব উপভোগ করুক, স্কুলে পড়ুক , ইচ্ছে মত বড় হয়ে উঠুক। শকুন্তলা কিন্তু চান না তার মেয়েকে কাছছাড়া করতে, তিনি আবার তার মেয়েকে নিয়ে লন্ডনে বাসা বাঁধেন। সেখানেই তিনি মেয়ের ইচ্ছে গুলোকে একটু একটু প্রশ্রয় দেন। তার জন্য একটা পুরো বাড়ি কিনে দেন ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের জন্য। অনু আস্তে আস্তে তার ইন্টিরিয়র ডেকোরেশনের ব্যাবসা গড়ে তোলে। তারও জীবনে প্রেম আসে এবং সে বিয়ে করে বেঙ্গালুরু নিবাসী অজয় অভয় কুমার কে। যদিও সে মা হতে চায় না কিছুতেই, হয়তো তার মায়ের প্রতি ঘৃণায়। শকুন্তলা চান তার মেয়ে-জামাই তার সঙ্গে লন্ডনে চলুক, কিন্তু অনু যেতে চায় না কিছুতেই। দীর্ঘ দিন অনু তার মায়ের ফোন ধরে না, কোন যোগাযোগ রাখে না। সে তার মা কে ভুলে যেতে চায়। ঠিক এমন সময় শকুন্তলা দেবী তাঁর মেয়ের লন্ডনে যে ব্যবসা ছিল তা থেকে বঞ্চিত করেন। অনু বাধ্য হয় মায়ের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে। সেই আইনী লড়াইয়ের টেবিলে দীর্ঘদিন পর দেখা হয় মা ও মেয়ের। অনেকদিনের ক্ষোভ-রাগ-অভিমান অশ্রু হয়ে গলে পড়ে, যখন আইনি কূটকচালি উপেক্ষা করে শকুন্তলা দেবী বলে ওঠেন তোমাকে একবার দেখবার জন্য অধীর হয়ে পড়েছিলাম, আমার যাকিছু সবই তো তোমার। দুজনেরই চোখের জল বাঁধ মানে না। আইন হারিয়ে যায় মা-মেয়ের ভালোবাসার কাছে।
ছবির গান শচীন-জিগর জুটির সুরে গেয়েছেন সুনিধি চৌহান,বেনী দয়াল,শ্রেয়া ঘোষাল এবং মোনালি ঠাকুর। গানগুলো আশি নব্বই দশকের নষ্টালজিয়া আনে। বেশ ভালো লেগেছে।
সিনেমাটোগ্রাফার জাপানের কেইকো নাকাহারার কাজ ভীষন ভালো লাগে।
এ ছবির অভিনয় এক সম্পদ। বিদ্যা বালান,যীশু সেনগুপ্ত, সানিয়া মালহোত্র ছাড়াও বিদেশি যে সমস্ত অভিনেতা রয়েছেন সবাই বেশ ভালো। বিদ্যা বালান প্রোটাগনিস্ট হিসেবে সমস্ত আলো কেড়ে নিয়েছেন। যীশু সেনগুপ্ত, পরিতোষ ব্যানার্জীর চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। যীশু অনেক দিন পর একজন বাঙালি অভিনেতা হিসেবে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন।
সিনেমার সার্বিক বিচারে বলা যায় এ সিনেমা সিনেমাপ্রেমীদের জন্য ভালো খবর।

Post a Comment

2 Comments

  1. পৃথিবীর বিস্ময় শকুন্তলা দেবী। রচনাটি ভালো লাগলো। / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  2. পৃথিবীর বিস্ময় শকুন্তলা দেবী। রচনাটি ভালো লাগলো। / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete