জ্বলদর্চি

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত -৬


পর্ব-৬  

শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্গীতামৃত  

সু দ র্শ ন  ন ন্দী

পরের গান কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের। ২৭শে অক্টোবর ১৮৮২। এদিন ঠাকুর অনেকগুলি গান গেয়েছেন। সেদিন ঠাকুর নৌকোতে গঙ্গায় ভ্রমণ করছেন কেশবদের সাথে। কথা হচ্ছে আদ্যাশক্তি লীলাময়ী প্রসঙ্গে। তিনিই কালী। কথাপ্রসঙ্গে ঠাকুর বললেন, কালী কি কালো? দূরে তাই কালো, জানতে পারলে কালো নয়। আকাশ দূর থেকে নীলবর্ণ। কাছে দেখ, কোন রঙ নাই। সমুদ্রের জল দূর থেকে নীল, কাছে গিয়ে হাতে তুলে দেখ, কোন রঙ নাই।
এই কথা বলে প্রেমোন্মত্ত হয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ গান ধরলেন:
       মা কি আমার কালো রে ৷
কালোরূপ দিগম্বরী, হৃদ্‌পদ্ম করে আলো রে...।। 
কমলাকান্ত ভট্টাচার্যেরগানটি কথামৃতে চারবার গাইতে দেখি ঠাকুরকে।

পরের গান ঐ গঙ্গাবক্ষেই, ১৮৮২, ২৭শে অক্টোবরে। সংসার নিয়ে কথা হচ্ছে। 
শ্রীরামকৃষ্ণ কেশবদের বলছেন- বন্ধন আর মুক্তি -- দুয়ের কর্তাই তিনি। তাঁর মায়াতে সংসারী জীব কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ, আবার তাঁর দয়া হলেই মুক্ত। তিনি “ভববন্ধনের বন্ধনহারিণী তারিণী”।
এই বলে রামপ্রসাদের একটি গান ধরলেন ঠাকুর:
শ্যামা মা উড়াচ্ছ ঘুড়ি (ভবসংসার বাজার মাঝে) ৷
(ওই যে) আশা-বায়ু ভরে উড়ে, বাঁধা তাহে মায়া দড়ি ৷৷

গান শেষ হলে ঠাকুর বললেন,  তিনি লীলাময়ী! এ-সংসার তাঁর লীলা। তিনি ইচ্ছাময়ী, আনন্দময়ী। লক্ষের মধ্যে একজনকে মুক্তি দেন।
পরের গানটিও এদিন গঙ্গাভ্রমণে ইশ্বর বিষয়ে আলোচনা করতে করতে। ঠাকুর বলছেন-“তিনি মনকে আঁখি ঠেরে ইশারা করে বলে দিয়েছেন, ‘যা, এখন সংসার করগে যা।’ মনের কি দোষ? তিনি যদি আবার দয়া করে মনকে ফিরিয়া দেন, তাহলে বিষয়বুদ্ধির হাত থেকে মুক্তি হয়। তখন আবার তাঁর পাদপদ্মে মন হয়।”
এবার ঠাকুর সংসারীর ভাবে মার কাছে অভিমান করে গাইছেন:

আমি ওই খেদ খেদ করি ৷
তুমি মাতা থাকতে আমার জাগা ঘরে চুরি...
 
গানটি গেয়ে বললেন-“তাঁরই মায়াতে ভুলে মানুষ সংসারী হয়েছে। ‘প্রসাদ বলে মন দিয়েছে, মনেরি আঁখি ঠারি’।” ঠাকুরের কণ্ঠে গানটি কথামৃতে পাঁচবার উল্লেখ পাই। 
 
ঠাকুর গঙ্গাবক্ষে একাধিক গান গেয়েছেন আজ। পরের গানটিও এদিনই গাওয়া। কথায় কথায় ঠাকুর বললেন, “আমি মার কাছে কেবল ভক্তি চেয়েছিলাম। ফুল হাতে করে মার পাদপদ্মে দিয়েছিলাম; বলেছিলাম, ‘মা, এই নাও তোমার পাপ, এই নাও তোমার পুণ্য, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার জ্ঞান, এই নাও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার শুচি, এই নাও তোমার অশুচি, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও; এই নাও তোমার ধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, এই নাও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধাভক্তি দাও’।”
এই বলে তিনি বললেন  একটি রামপ্রসাদের গান শোন:
    “আয় মন, বেড়াতে যাবি ৷
কালী-কল্পতরুমূলে রে (মন) চারি ফল কুড়ায়ে পাবি ...
  রামপ্রসাদ সেনের এই গানটি কথামৃতে ছবার উল্লেখ পাই। 
ঐদিন গঙ্গাবক্ষে ঠাকুরের পরের গান। ঠাকুর বললেন, সংসারে ঈশ্বর লাভ হবে না কেন? জনকের হয়েছিল। এ-সংসার ‘ধোঁকার টাটি’ প্রসাদ বলেছিল। এরপর গাইলেন তিনি-

এই সংসারই মজার কুটি, আমি খাই-দাই আর মজা লুটি।
জনক রাজা মহাতেজা, তার কিসের ছিল ক্রটি...
           
গান শুনে ভক্তদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। “ধোঁকার টাটি গানটি রামপ্রসাদের। তিনি আলোচনায় তিনবার উল্লেখ করেছেন কথামৃতে আর “মজার কুটি” গানটি আজু গোঁসাইয়ের। গানটি পাঁচবার গেয়েছেন তার উল্লেখ পাই কথামৃতে। 
 এদিন গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণে আরেকটি গান গাইতে দেখি কথামৃতে। ঠাকুর বলছেন,  বিবেক-বৈরাগ্য লাভ করে সংসার করতে হয়। সংসার-সমুদ্রে কামক্রোধাদি কুমির আছে। হলুদ গায়ে মেখে জলে নামলে কুমিরের ভয় থাকে না। বিবেক-বৈরাগ্য -- হলুদ। সদসৎ বিচারের নাম বিবেক। ঈশ্বরই সৎ, নিত্যবস্তু। আর সব অসৎ, অনিত্য; দুদিনের জন্য। এইটি বোধ আর ঈশ্বরে অনুরাগ। তাঁর উপর টান -- ভালবাসা। গোপীদের কৃষ্ণের উপর যেরূপ টান ছিল। এবার বললেন একটা গান শোন:
বংশী বাজিল ওই বিপিনে ৷
(আমার তো না গেলে নয়) 
(শ্যাম পথে দাঁড়ায়ে আছে)...
 
ঠাকুরের চোখে জল। অশ্রুপূর্ণ নয়নে এই গান গাইতে গাইতে কেশবাদি ভক্তদের বললেন, “রাধাকৃষ্ণ মানো আর নাই মানো, এই টানটুকু নাও, ভগবানের জন্য কিসে এইরূপ ব্যাকুলতা হয়, চেষ্টা কর। ব্যাকুলতা থাকলেই তাঁকে লাভ করা যায়।”
কথামৃতে গানটির উল্লেখ একবারই পাই। রচয়িতা অজ্ঞাত।
______________________________________
প্রতি সোমবার ও  বৃহস্পতিবার নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে এই ধারাবাহিক। 
www.jaladarchi.com      

Post a Comment

2 Comments

  1. অসাধারণ / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ / পার্থপ্রতিম আচার্য

    ReplyDelete